ঘরকন্না পর্ব-০১

0
784

#ঘরকন্না
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্বসংখ্যা_০১

আমার স্বামী আবির আজ বিকেলে বিদেশ থেকে আসবে। দুই বছর সে প্রবাসে ছিল। শাশুড়িকে সকালে চা দিতে যাওয়ার সময় ঘরের বাহিরে থেকে শুনতে পেলাম তিনি তার মেয়েকে বলছেন,” জামাইকে বল হাসপাতালে একটা বেড খালি করতে। আমি হাসপাতালে ভর্তি হব। অন্তত সপ্তাহখানেক সেখানে থাকব। আবির আসার পর সেখানে পাঠিয়ে দিবি। আগুন আর ঘি যেন কাছাকাছি না থাকে। তোর বাপ, ওই মেয়েকে পছন্দ করে আবিরের সাথে বিয়ে দিয়েছিল আবিরের পছন্দ ছিল না। তোর বাপ যেহেতু বেঁচে নাই এখন ওই মেয়েকে বিদায় করতেও সময় লাগবে না।”

পাশে থেকে আমার ননদ বলে উঠলো,” তোমাকে কেন হাসপাতালে থাকতে হবে? তুমি অনামিকার মামাকে বলে ওকে যেন এসে নিয়ে যায়। ও চলে গেলেই তো সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। ভাইয়া আসলে নতুন মেয়ে দেখা শুরু করো, এই মেয়েকে আমার পছন্দ না৷ সবসময় বেশি বোঝে। তোমার ছেলেকে তোমার কাছে থেকে দূরের মানুষ বানিয়ে দেবে দেইখো!”

শাশুড়িও তাল মিলিয়ে বলে ওঠেন,” সেদিন শুনলাম আবিরকে বলছে এটা লাগবে ওটা লাগবে। এখানে এসে থেকেছে ক’দিন? এখানে এসে কোনকিছুতে হাত লাগাতে দেয় না আমাকে। এই মেয়ে আমার সংসার আমার কাছে থেকে কেড়ে নিচ্ছে। এতসব আমি কিছুতেই বরদাস্ত করব না। আমার ছেলের কাছে থেকে ওকে আলাদা করেই ছাড়ব। ”

আম্মার কথা শুনে যেন আমার পায়ের তলার মাটি সরে গেল। আবিরের থেকে আমাকে আলাদা করতে চায়! কী ক্ষতি করেছি আমি তার, কেন এমন করতে চাইছে? রাজ্যের চিন্তা যেন মাথায় এসে ভর করল।

নিজেকে সামলে নিয়ে দরজায় নক করতেই দুজন চুপ হয়ে গেল। ভেতর থেকে আম্মা জোরে বলে উঠলেন,” কে?”
” আম্মা, আমি৷ চা নিয়ে এসেছিলাম।”
” ভেতরে আসো।”

চা নিয়ে ভেতরে যেতেই আমার ননদ রুম থেকে বেরিয়ে এলো। আম্মাকে চা দিয়ে নিজের রুমে চলে আসব তখনই তিনি আমাকে পিছন থেকে ডাক দিলেন। আমি কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়ালাম।

আম্মা চায়ে চুমুক দিয়ে কাপটা হাতে রেখেই বললেন,” অনেকদিন তো হলো এখানে এসেছো। তোমাকে তো উঠিয়ে নিয়ে আসা হয় নি৷ আমি তোমার মামাকে ফোন করে বলে দিচ্ছি তোমাকে যেন এসে নিয়ে যায়। আবির আসলে ওকে তোমাদের বাড়ি পাঠিয়ে দেব। ওর সাথে এখানে এসে আবার কয়েকদিন থেকে যেও। অনুষ্ঠান করে তোমাকে নিয়ে আসব একেবারে কিন্তু তার জন্য সময় লাগবে একটু।”

আমি বাধ্যমেয়ের মতো মাথা ঝাঁকালাম। আম্মার দুই সময়ে দুইরকম কথা আমার ভেতরে ঝড় তুলেছে। আবিরের সাথে আমার সংসার কি সত্যিই ভেঙে যাবে! আমি তো আম্মাকে আমার মায়ের মতো ভালোবেসেছিলাম। উনাকে দেখতে ইচ্ছে করলেই চলে আসতাম। উনিও আমার সাথে ভালোভাবেই মিশতো, ভালোবাসতো আমাকে কিন্তু হঠাৎ এত পরিবর্তন আমাকে যেন দশতলা ছাদ থেকে নিচে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিচ্ছে। আমি অল্পতে ভেঙে গুড়িয়ে যাওয়ার মেয়ে নই তবুও নিজের সংসারের কথা চিন্তা করে ভীষণ ভয় লাগছে আজ। আম্মার সাথে কথা শেষ করে নিজের রুমে চলে আসলাম৷ খুব কান্না পাচ্ছে আমার। আম্মার সাথে কি খোলামেলা কথা বলতে চাওয়া উচিৎ হবে? মা মারা যাওয়ার পর মামার বাড়িতে মানুষ হয়েছে। মামিও কোনদিন স্বার্থ ছাড়া ভালো ব্যবহার করেনি। মামা অত্যন্ত ভালো মানুষ। উনি ভালো জন্যই হয়তো উনার ওপর ভরসা করে বিয়েটা করেছিলাম। আমাকে পছন্দ করেছিলেন আমার শ্বশুরবাবা। নিজের ছেলে বিদেশ থাকা সত্ত্বেও ফোনেই সবাইকে সাক্ষী রেখে ভিডিয়ো কলে আমাদের বিয়ে দিয়েছিলেন।

রুমে এসে খুব খারাপ লাগছে। কোনকিছু বুঝতে না পেরে মামাকে কল দিলাম। দুইবার রিং হতেই মামা কল রিসিভ করলেন।

আমি জোরে একটা শ্বাস টেনে বললাম,” মামা!”

মামা হয়তো ব্যস্ত ছিলেন। চারপাশে মানুষজনের উপস্থিতি বোঝা যাচ্ছে। মামাকে ডাকতেই তিনি তড়িঘড়ি করে আমার ডাকে জবাব দিয়েই বলে উঠলেন,” কেমন আছিস রে মা? জামাইবাবার কী খবর? কখন আসবে?”
” মামা, আমার শাশুড়ি তোমাকে কল দিবে হয়তো। আজ আসতে বললে তুমি একদম আসবে না।”
” কেন, কিছু হয়েছে?”
” মামা আমার শাশুড়ি হয়তো আমাকে পছন্দ করছেন না।”
” তোর শাশুড়ি! আমার বিশ্বাস হচ্ছে না অনু। তোর শাশুড়ি তো খুব ভালো মানুষ। তুই কি কিছু করেছিস? ভুল করলে মাফ চেয়ে নে মা। উনাকে মায়ের মতো ভালোবাসবি, সম্মান করবি।”
” মামা আমি কিছুই করি নি। এর আগে উনি আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করেন নি। একটু আগেই আমার শাশুড়ি আর ননদ আমাকে নিয়ে কথা বলছিলেন। আমাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিতে চাইছেন। মামা, আমার শাশুড়ি তোমাকে ফোন দিলে তুমি এসো না। ”
” তুই একদম ভয় পাস না, মা। ”

মামার সাথে কথা বলে ফোনটা রেখে দিলাম। আমার ননদ নিশিতা এসে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বলল,” আম্মা তোমাকে ডাকছে।”
” এখন?”
” হ্যাঁ। ”

নিশিতা আবিরের ছোটবোন হওয়া সত্ত্বেও আমাকে কখনো ভাবি বলে না। আমিও এটা নিয়ে কিছু বলি না। এ জীবনে যতটুকু সম্মান পেয়েছিলাম এটাই অনেক। তবে সেটা আমার ভাগ্যে টিকবে কি না সেটা নিয়ে সন্দিহান।

আম্মার রুমের দরজায় গিয়ে নক করতেই তিনি ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দিলেন। ভেতরে ঢুকে দেখতে পেলাম তিনি আগের মতোই বিছানাতে বসে আছেন। আমাকে দেখেই ডেকে বসতে বললেন। নিজেকে কেমন পুতুল পুতুল লাগছে। যে যা বলছে তাই শুনছি তবুও কি আমার সাথে কেউ ভালো হতে দেবে না!

আম্মার সামনেই বিছানায় গিয়ে বসলাম। তিনি হাতের বা’পাশ থেকে দুইটা শপিংব্যাগ দিয়ে বললেন,” এগুলো তোমার জন্য আনা হয়েছিল। বাড়ি যাওয়ার সময় নিয়ে যেতে ভুলো না। এখানে একটা শাড়ি আর তিনটা থ্রিপিস আছে।”
” আম্মা আজই যেতে হবে আমার? মানে উনি তো আজই আসছেন আর আমি উনাকে সরাসরি দেখিওনি কখনো। আজ ওই বাড়ি গেলে উনি রাগ করবেন না?”
” সেসব আমি দেখে নেব। তোমার মামা এলে তুমি চলে যেও।”

আমি আবারও বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়লাম। আমি সর্বদা শান্তশিষ্ট মেয়ে। ঝামেলা আমার কোন কালেই পছন্দ ছিল না। জোর-জবরদস্তিতেও আমি নেই। আমি বিশ্বাস করি যে যেটা আমার জন্য সৃষ্টিকর্তা রেখেছেন সেটা আমারই থাকবে। ভালো কিছু পাওয়ার জন্য চেষ্টা করা যায় কিন্তু জোর করে ভালোবাসা অন্তত পাওয়া যায় না।

” যাও, রুমে গিয়ে তোমার ব্যাগ গুছিয়ে নাও।” আম্মার কথায় রুম থেকে বাহিরে চলে আসলাম। বের হতেই দেখি পাঁচ-ছয়জন লোক বড় বড় ডালা করে সবজি, মাছ, মাংস নিয়ে এসেছেন। আম্মা বাহিরে এসে সবাইকে রান্নাঘর দেখিয়ে দিলেন। আমাকে ছাড়া সবাই এ বাড়িতে কত আনন্দ করবে ভাবতেই বুক ভারি হয়ে আসছে৷ নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করলাম- আমাকে কি ভালোবাসা যায় না? কেন সবাই এত দূর দূর করে আমাকে?

নিজের জন্য বরাদ্দকৃত রুমে এসে জামাকাপড় সব গুছিয়ে ব্যাগে নিলাম ঠিকই কিন্তু মামাকে আগে থেকে বলে রাখায় নিশ্চিত ছিলাম মামা আসবে না। সবাইকে দেখাতেই ব্যাগটা গুছিয়ে নিলাম। ব্যাগ গুছিয়ে খাটের পাশে রেখে দিলাম। বাড়িতে কোথায় কী হচ্ছে সেটা দেখতে থাকলাম।

রান্নাঘরে সবাই কাজ করছিল, আমিও সেখানেই দাঁড়িয়ে কাজ করা দেখছিলাম। আমাকে কেউ কিছু করতে দিচ্ছে না। কাজের জন্য কয়েকজনকে নিয়ে আসা হয়েছে৷ পরিস্থিতি দেখে যা বুঝলাম আজকে আমাকে ছাড়া বড়সড় অনুষ্ঠান বা খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

” অনু মা…”
মামার গলা শুনে পিছনে ফিরে তাকাতেই দেখি মামা মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে। নদীর বাঁধ ভেঙে যাওয়ার মতো কষ্টগুলো যেন সবকিছু ভেঙেচুরে বাহিরে আসতে চাচ্ছে৷ মামাকে এতবার নিষেধ করার পরও মামাকে আমাকে নিতে এলো! মামা চায় না আমি সংসার করি!!

#চলবে……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে