#গুমোট_অনুভুতি
#লিখাঃ Liza Bhuiyan
#পর্ব_১৯
“রুশি! কাউকে কখনো ভালোবেসেছো তুমি?”
সায়ানের প্রশ্নে রুশি প্রথমে কিছুটা অবাক হলেও পরে নিজেকে সামলে দিলো,তারপর বাইরের দিকে তাকিয়ে শান্ত কন্ঠে বললো
“নাহ”
রুশির জবাবে সায়ান ওর দিকে তাকিয়ে রইলো, রুশির মুখভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে ও সত্যি কথা বলছে তবে উনিশবছর জীবনে কখনো কাউকে ভালোবাসে নি?সায়ান কিছু জিজ্ঞেস করতে গিয়ে করতে পারলো না তার পুর্বেই রুশি হতাশ গলায় বললো
“তবে কারো মায়ায় পড়েছিলাম ছিলাম ভয়ংকরভাবে যা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারছিনা।”
সায়ান রুশির দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকালো, রুশি অন্য কারো মায়ায় পড়েছিলো এটা যেনো ভাবতেই পারছে না ও, কেমন চিনচিন ব্যাথা করছে। তবুও সাহস জুগিয়ে প্রশ্ন করলো
“তোমার কাছে ভালোবাসা মানে কি?”
রুশি তাচ্ছিল্যের সাথে বিড়বিড় করে বললো
“ভালোবাসা!”
তারপর সায়ানের দিকে তাকিয়ে শান্ত স্বরে বললো
“ভালোবাসা মানে হচ্ছে সহস্র অনুভুতির সংমিশ্রনে সৃষ্ট এক ‘মায়া’ যে মায়া কখনো কাটিয়ে উঠা যায়না”
“তোমার কাছে ভালোবাসা মানে হচ্ছে মায়া! তাহলে তুমিও কাউকে ভালোবাসতে?কে সেই মানুষটি?”
রুশি সায়ানের চোখে একরাশ কৌতুহল দেখতে পেলো আর মনে হলো খানিকটা রেগে আছে। কিন্তু রাগার মতো কথা বলেছে বলে মনে পড়ছে না। রুশি খানিকটা মুচকি হেসে বললো
“প্রথমেই বলেছি যে আমি কাউকে ভালোবাসি নি বরং কোন একজনের মায়ায় পড়েছিলাম। তার মানে এই না আমি তাকে ভালোবাসি! সকল ভালোবাসাই মায়া তবে সব মায়া ভালোবাসা নয় অন্তত আমার জন্য নয়। সেই মানুষটির মায়ায় আমি পড়েছি ঠিকি তবে সে বন্ধু ছাড়া অন্য কেউ ছিলো না। তাই যেই ভালোবাসার কথা আপনি শুনতে চাচ্ছেন তা কারো প্রতি জন্মায়নি এখনো”
রুশি জানে না কেনো সায়ানের কাছে এক্সপ্লেইন করলো যে ওর ভালোবাসার নেই,ও আজ পর্যন্ত অন্য কারো প্রেমে পড়েনি। ও চাইলেও সায়ানকে ভুল বুঝাতে পারতো কিন্তু কেনো ক্লিয়ার করলো তাতে যেনো নিজেই হতাশ। তারপর সায়ানের দিকে তাকিয়ে বললো
“আপনি কাউকে ভালোবসেছেন?”
কথাটা বলে নিজেই থতমত খেয়ে গেলো, অবশ্যই সে ভালোবাসে অন্যকাউকে আর সেই অন্যকেউটা চন্দ্রিকা। চন্দ্রিকার জন্য সে নিজের মায়ের এগেইন্সট চলে গিয়েছে, এতোবছর এই বাড়িতে পা রাখেনি। তাই ও বাইরের মানুষ হয়েই ভালোবাসার গভীরত্ব মাপতে পারছে, হয়তো প্রচণ্ড ভালোবাসে চন্দ্রিকাকে। রুশি সায়ানকে জবাব দেয়ার সুযোগ না দিয়েই বললো
“অবশ্যই ভালোবাসেন আমিও বা কি প্রশ্ন করছি! আচ্ছা আপনি চন্দ্রিকাকে কেনো ভালোবাসেন? মানে আপনাদের প্রেম কাহিনী শুনতে চাচ্ছি যদি মাইন্ড না করেন”
রুশির কথা বলার ভংগি দেখে সায়ান হাল্কা মুচকি হাসলো, কেমন প্রশ্ন করেই নিজেই যেনো থতমত খেয়ে ফেলেছিলো। ও রুশির দিকে তাকিয়ে বললো
“আমাদের তেমন কোন কাহিনী নেই তবে এটা বলতে পারি আমার বয়স তখন খুব একটা বেশি ছিলো না, একদিন বাড়ি ফেরার পথে আমি হঠাৎ কিডন্যাপ হয়ে যাই। পুরো একদিন তারা আমায় বন্দি করে রাখে কিন্তু সুযোগ বুঝে আমি সেখান থেকে পালিয়ে যাই। রাস্তায় হঠাৎ তুমুল বৃষ্টি শুরু হয়, আমার শরীর ধীরেধীরে অশাড় হয়ে আসে তাই কোথাও একটা বসে পড়ি। ওই সময় একেকটা মিনিট যেনো ঘন্টার মতো ছিলো, মনে মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখছিলাম।সবাই নিজেদের নিয়ে এতোটাই মগ্ন যে আমায় খেয়াল করেনি, পাশ দিয়ে হেটে হেটে চলে গিয়েছে। কতোটা অসহায় ছিলাম বলে বুঝাতে পারবো না, ঠিক তখনি কোন একটা আলো আমার অন্ধকার সময়ে আমার কাছে আসছিলো। আমার পাশে এসে আমাকে ডাকছিলো কিন্তু ততক্ষণে হুশ হারিয়ে ফেলেছিলাম। যখন হুশ আসে তখন পাশে ছোট্ট একটা মেয়েকে আমার হাত ধরে বসে থাকতে দেখি,পরে জানতে পারি এই মেয়েটি আমাকে নোটিস করেছে বলেই আমি বেচে আছি। দীর্ঘ তিনদিন পর আমার হুশ এসেছে, গায়ে তীব্র জ্বর তখনো ছিলো।জ্বরের ঘোরে শুধু একটা নামই মাথায় ছিলো যে সে মেয়েটির নাম পরি, আমার ছোট্ট পরি!তারপর সেখান থেকে যখন চোখ খুলে তখন নিজেকে নিজের ঘরের বেডে আবিষ্কার করি, এরপর আর অনেক বছর তার খোঁজ নিতে পারিনি।তারপর সেই মেয়েটিকে ছয়বছর পুর্বে খুজে পাই, আমার ছোট্ট পরি থেকে এখন সে অনেক বড় হয়ে গিয়েছিলো আর তার নাম পরি থেকে চন্দ্রিকা হয়ে গিয়েছিলো!”
সায়ান এতোটুকু বলে দম নিলো,সে যেনো ওইসব ঘটনা নিজের চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিলো। রুশির ফুঁফিয়ে কান্নায় ওর ধ্যান ভাঙল, চোখের পানি মুছে রুশিকে বলে উঠলো
“কাঁদছো কেন?”
“আপনাদের প্রেমকাহিনী এতো কষ্টের কেনো?মনে হচ্ছিলো সিনেমা দেখছি। আচ্ছা তারপর কি হয়েছিলো?”
“তারপর আর কি হবে চন্দ্রিকে আমার কাছে নিয়ে আসি এই বাড়িতে কিন্তু মা কেনো যেনো ওকে দেখতে পারতো না। আর একসময় মা ওকে আমার জীবন থেকে সরাতে চায় তাই সেদিন আমি ওকে ওয়াদা করি যাই হয়ে যাক না কেনো আমি ওর পাশে থাকবো আর ও আমাকে শুধু ওকে ভালোবাসার ওয়াদা করিয়ে নিয়েছিলো কারণ ওর ভয় হতো যে ও আমাকে হারিয়ে ফেলবে।আমি ওর কাছে কৃতজ্ঞ, ওর জন্যই বেঁচে আছি আমি! ও না থাকলে হয়তো আজ আমি তোমার সামলে দাঁড়িয়ে থাকতাম না।আমি তাকে ভালোবাসতে বাধ্য!”
সায়ানের দিকে রুশি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো হয়তো কিছু একটা খোঁজার চেষ্টা করলো কিন্তু পেলো না। তাই অন্যদিকে ফিরে বললো
“আপনি সত্যিই চন্দ্রিকাকে ভালোবাসেন নাকি সেটা শুধুমাত্র কৃতজ্ঞতা?কারণ ভালোবাসা তো কখনো বাধ্য কিছু হতে পারেনা বরং তা মুক্ত এবং স্বাধীন! কাউকে বাধ্য হয়ে ভালোবাসা আদোও ভালোবাসা? নাকি শুধুমাত্র বাধ্যতা?”
“সেটা জানিনা তবে সেই ওয়াদা আমি স্বেচ্ছায় করেছি, আমি জানি তোমার কাছে নিতান্তই খারাপ একজন মানুষ হয়তো তুমি ভাবছো আমি দুই নৌকায় পা দিয়ে চলছি কিন্তু তোমার আর বাবুর সাথে যেমন থাকতে চাই, তোমাদের খেয়াল রাখতে চাই তেমনি আমি আমার ওয়াদা ভুলে যেতে পারবো না।আমি…”
সায়ান থামলো তারপর জোরে জোরে শ্বাস নিলো, চোখে পানি টলমল করছে। কিছুটা ধরা গলায় আবার বললো
“আমি আমার বাবাকে ঘৃণা করি! প্রচণ্ড ঘৃণা করি তাইতো তার মৃত্যুর সময় তার জন্য এটুকু মায়া হয়নি আমার, তার লাশ দেখে আমার চোখে এটুকু জল গড়ায়নি বরং মনে হয়েছিলো ভালোই হয়েছে সে চলে গিয়েছে”
রুশি সায়ানের চোখের দিকে তাকালো, এই চোখে কিছুক্ষণ পুর্বেও অসহায়ত্ব ছিলো কিন্তু এখন তীব্র ঘৃণা ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। কারো বাবার জন্য এতো ঘৃণা এই প্রথম দেখলো, বুঝতে পারলো হয়তো কোন সিরিয়াস ব্যাপার আছে। ও সায়ানের দিকে শুন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে হয়তো ভাবছে সায়ান এরপর কি বলবে?সায়ান হুট করেই ওর বাহু চেপে ধরলো তারপর আহত কন্ঠে বললো
“জানো কেনো তাকে ঘৃণা করি?কারো সে তার কথা রাখেনি। সে আমার মাকে আজীবন ভালোবাসার ওয়াদা করেছিলো অথচ পর নারীতে আসক্ত হয়ে গেলো!সে আমার মাকে ধোকা দিয়েছে আর সেটা আমি সেদিন স্বচক্ষে দেখেছি, অফিসের কেবিনে ছিহ!তাই সেখান থেকে গাড়ি না নিয়ে বেরিয়ে পড়ি আর পরে কিডন্যাপ হয়ে যাই। বাসায় ফিরার পর তার সাথে আর কখনো কথা বলিনি,কিন্তু মাকে তার ধোঁকার কথাও বলতে পারিনি। প্রচণ্ড ভালোবাসতো আমার মা তাকে আর এখনো বাসে, তার এই ভালোবাসা হারিয়ে গেলে সে বাঁচতে পারবে না আর আমি মরতে দিবো না। তাই আমার কাছে ওয়াদার অনেক মুল্য কারণ আমি আমার বাবার মতো হতে চাইনা যাকে আমি প্রচণ্ড ঘৃণা করি!
সায়ান কয়েকবার শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো তারপর আবার বললো
“রুশি আমি জানি অনেক অন্যায় করছি তোমার সাথে, তোমার প্রাপ্য অধিকার তোমাকে দিতে পারছিনা। আমি নিজেও এটা মানি যে আমি তোমার সাথে থাকতে চাই, আমাদের বেবিকে একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ দিতে চাই আবার আমি চন্দ্রকাকে করা ওয়াদাও ভুলতে পারবো না তাহলে আমার ওই লোকটির মাঝে কোন পার্থক্য থাকবে না, আমি তাকে যতোটা এখন ঘৃণা করি তার থেকেও বেশি নিজেকে ঘৃণা করবো।”
রুশি কিছু বললো না, কিছু বলার ভাষা নেই। এই পরিস্থিতিতে একটা মানুষের কিই বা বলার থাকতে পারে?বিষয়টি খুবই জটিল। সায়ানের মেন্টাল প্রেশারের পরিমাণ বুঝতে পারছে তবে হুট করেই ওয়াদা করার পুর্বে ভাবা উচিৎ সে সেই ওয়াদা রাখতে পারবে কিনা যেখানে ওয়াদা শব্দটি এতো গুরুত্বপূর্ণ তার কাছে!রুশি কিছু একটা ভেবে হঠাৎ করে প্রশ্ন করলো
“আচ্ছা আপনি কাকে ভালোবাসেন আপনার ছোট্ট পরিকে নাকি চন্দ্রিকাকে?”
সায়ান হচকিয়ে গেলো কিছুটা তারপর সামলে গিয়ে বললো
“দুজন তো একই মানুষ তাহলে যাকেই বাসিনা কেনো একই তো হলো তাইনা!”
“নাহ এক না। ধরুন চন্দ্রিকা আর পরি একই ব্যাক্তি না হলো তাহলে যদি আপনাকে যেকোন একজনকে চুজ করতে হতো তাহলে কাকে চুজ করতেন?”
সায়ান রুশির প্রশ্ন ঠিক বুঝে উঠতে পারলো না তবুও কিছুটা ভেবে বললো
“চন্দ্রিকা আমার সেই ছোট্ট পরি বলেই সে আমার সাথে আছে আর আমি পরির কাছে ওয়াদাবদ্ধ! আই ও মাই লাইফ টু হার”
“তার মানে বাই এনি চান্স ধরুন যদি চন্দ্রিকা আপনার ছোট্ট পরি না হয় আর আপনাকে যদি একজনকে চুজ করতে হয় তাহলে পরিকেই করতেন তাইনা?”
সায়ান হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ালো, চন্দ্রিকা ওর ছোট্ট পরি তাইতো চন্দ্রিকা ওর সাথে আছে।
“তারমানে আপনি ছোট্ট পরিকে ভালোবাসেন আর চন্দ্রিকা পরি বলে তাকে ভালোবাসেন যদি চন্দ্রিকা পরি না হতো তাহলে কি ওকে ভালোবাসতেন না?ধরুন হঠাৎ একদিন পরি অন্যকেউ হলো তাহলে চন্দ্রিকাকে কি করবেন?”
সায়ান চোখ ছোট ছোট করে ওর দিকে তাকিয়ে বললো
“বলেছিই তো চন্দ্রিকা আমার ছোট্ট পরি বলেই আমার সাথে আছে!”
“আর যদি না হতো তবে কি আপনার সাথে থাকতো না?”
সায়ানের চোখের দিকে তাকিয়ে রুশি থেমে গেলো, রুশি একটু বেশিই জিজ্ঞেস করে ফেললো?আসলে ওর খুব কৌতুহল জাগছিলো সায়ানের কাছে পুরো কাহিনী শুনে, নিজেকে কেমন জানি এসিপি প্রাতিউমান মনে হচ্ছে। মনের ভিতর কেউ জেনো বলেছিলো “কুছ তো গাড়বার হ্যায় দায়া থুরি রুশি!” তাইতো রহস্য উদঘাটনে লেগে পড়লো যে সায়ান আসলে কাকে ভালোবাসে ‘ছোট্ট পরি’ নাকি চন্দ্রিকা? সায়ান যখন বললো যে চন্দ্রিকা ছোট্ট পরি বলে তার কাছে তখন মনে হলো চন্দ্রিকা ছোট্ট পরি না হলেই পারতো, জেলাসি কিনা জানেনা তবে আজকাল চন্দ্রিকাকে ওর ভালো লাগে না। যেখানে নিজেকে তৃতীয় ব্যাক্তি মনে হতো চন্দ্রিকাকে তা মনে হচ্ছে এখন,মনে হচ্ছে চন্দ্রিকা ওদের জীবনে না থাকলেই পারতো হয়তো সায়ান,ও আর ওদের অনাগত বেবির একটা ছোট্ট সংসার হতো!
কিন্তু পরক্ষনেই নিজেকে নিজে সামাল দেয় এই ভেবে যে যা ওর নয় তা ওর নয় আর যা ওর তা ওরই থাকবে। এতটুকু ও বলতে পারে যে সায়ান চন্দ্রিকাকে ভালোবাসে না বরং সে কৃতজ্ঞ তার ছোট্ট পরির প্রতি!রুশি সায়ানের দিকে তাকিয়ে জোর পুর্বক হাসলো তারপর বললো
“আম জাস্ট আস্কিং,ডোন্ট মাইন্ড! আপনি এখানে থাকেন আমি কাউকে বলছি আপনার কফি দিয়ে যেতে”
সায়ান দীর্ঘনিশ্বাস ফেললো, রুশিকে কথাগুলো বলতে পেরে নিজেকে খুব হাল্কা লাগছে। ও আর কথা বাড়াতে চায়না, সবকিছু ভাগ্যের ছেড়ে দিয়েছে যা হবার তাই হবে। আচ্ছা খুব বেশি কি ক্ষতি হতো যদি রুশিই ছোট্ট পরি হতো!তাহলে হয়তো ওকে চুজ করতে হতো না। নিজের ভাবনায় নিজেই যেনো অবাক হলো,কি ভাবছে এসব ও?
#চলবে
#গুমোট_অনুভুতি
#লিখাঃ Liza Bhuiyan
#পর্ব_২০
রুশি সায়ানের দিকে তাকিয়ে দেখে ও কিছু ভাবছে তাই ও ফটাফট বলে দিলো
“আরে এটা তেমন কিছুনা, মনে করেন আমি কিছু জিজ্ঞেসই করিনি আপনাকে। হিহিহি! আর আপনার বাবা যা করেছে তা আমি আপনাকে ভুলতে বলছিনা, এসব ভুলার কথাও না তবে একজন মৃত মানুষের জন্য ঘৃণা পুষে রেখে কি লাভ বলেন?তার থেকে ভালো আপনি সেই ঘটনা ভুলে যান অথবা তাকেই ভুলে যান! এতে না আপনি কষ্ট পাচ্ছেন আর আপনার মন খারাপের কারণে আশেপাশের মানুষের মন খারাপ হচ্ছে। আপনি শুধুমাত্র একজনের জন্য বাকি সবাইকে শাস্তি দিয়েছেন আর দিয়ে যাচ্ছেন, এ বাড়িতে আসার পর শুনেছি আপনি খুব চঞ্চল আর হাসিখুশি ছিলেন কিন্তু হঠাৎ ই আপনি গম্ভীর হয়ে গেছেন আর এই প্রভাবটা কিন্তু আপনার আশেপাশের সবার উপরে পড়েছে। এখানে থাকা সবাই আগে আপনাকে ভালোবাসতো, এখনো বাসে তবে তার সাথে ভয় পায় আপনাকে কারণ আপনি এখন কঠোর!আর কেউ আপনাকে ভয় পাক এটা নিশ্চই আপনার কাম্য নয়?”
রুশি সায়ানের দিকে তাকালো খুব মনোযোগ সহকারে, সায়ান ওর কথার কোন জবাব দেয়নি তাই ও ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে আবার বলা শুরু করলো
“যারা আছে আশেপাশে তাদের বেঁচে থাকতেই কদর করতে শিখেন, এক সময় হারিয়ে গেলে হাজার চেষ্টায়ও ফিরিয়ে আনতে পারবেন না। আমি জানি আপনার পরিবারের বিষয়ে নাক গলানোর অধিকার আমার নেই তবুও একজন মানুষ হিসেবে বলছি আপনার মা আপনাকে ভালোবাসে, পৃথিবীর সকল মা যেভাবে ভালোবাসে ঠিক সেই রকম। কোন মা তার সন্তানের খারাপ চায়না,সে যদি কোন ভুল করেও থাকে তবে সে ঘৃণার যোগ্য নয় নিশ্চই?”
সায়ান এবার রুশির দিকে তাকালো আর থমথমে গলায় বললো
“আমি তাকে ঘৃণা করিনা আর কখনো করা সম্ভব ও নয়”
“তাহলে নিশ্চই ভালোবাসেন তবে তার উপর রেগে আছে। আচ্ছা এই রাগ কয়দিন পুষে রাখবেন?মানুষের হায়াত মউত সব আল্লাহর হাতে, হঠাৎ একদিন যদি হারিয়ে যায় নিজেকে ক্ষমা করতে পারবেন?পারবেন এই বোঝা নিয়ে সারাজীবন থাকতে যে আপনি তাকে শেষবারের মতো বলতে পারেননি…
‘মা তোমাকে আমি ঘৃণা করিনা বরং ভালোবাসি বড্ড ভালোবাসি!’
ভালোবাসার মানুষ বেঁচে থাকতেই তার কদর করা শিখুন, বেশি কিছুনা তার সাথে আগের মতো কথা বললেই সব ঠিক হয়ে যাবে। সে আপনার অপেক্ষায় আছে অনেকদিন ধরে যে তার ছেলে তাকে মা বলে ডাকবে,আগের মতো কোলে মাথা রেখে কথা বলবে।তার সেই অপেক্ষার পরিমাণ আর দীর্ঘ করবেন না।বর্তমান নিয়ে বাঁচতে শিখুন অতীত নিয়ে পড়ে থাকলে না নিজে সুখে থাকবেন না অন্যকেউ! এনিওয়ে বাকিটা আপনার ইচ্ছা, আমার বলার ইচ্ছে ছিলো বলেছি।”
রুশি দীর্ঘনিশ্বাস ফেললো, সায়ান এখনো নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ও জানেনা ওর কথা কতটুকু কাজে দিয়েছে, তবে ও চায় ওর সব ঠিক হয়ে যাক তাদের মাঝে। কারণ বাবা মা ছাড়া একজন সন্তান কতোটা অসহায় তা ওর থেকে ভালো আর কে জানে?ও চায়না সায়ানের সেটা থেকেও ও একই দহনে পুড়ুক! রুশি বারান্দা থেকে বেরিয়ে এলো তারপর স্বাভাবিক গলায় বললো
“আপনি কফি খাবেন?আমি কাউকে বলে পাঠিয়ে দিচ্ছি!”
রুশি আর এক মুহুর্ত দাঁড়ালো না সেখানে, এখন ওর নিজের স্পেস দরকার। কিছুক্ষণ একা থাকতে চায়, আজ মনটা বড্ড খারাপ ওর কোন এক অজানা কারণে!খুব ইচ্ছে করছে কারো কাঁধে মাথা রেখে দুঃখবিলাস করতে কিন্তু সেই মানুষটি কই?বাগানের খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বললো
“আমাকে কি আজোও মনে রেখেছো তুমি নাকি সময়ের শ্রোতে ভুলে গেছো? আমি কিন্তু তোমায় ভুলিনি এক মুহুর্তের জন্যও না,স্মৃতি যতই ঝাপসা থাকুক না কেনো!”
_____________________
ইনান প্রায় আধঘণ্টা ধরে ধানমন্ডি লেকের পাড়ে বেঞ্চে বসে আছে, কতোক্ষণ পর পর ঘড়ি দেখছে আর লেকের পানির উথালপাতাল দেখছে।লেকের জলগুলো সুর্যের আলোয় ঝলঝল করছে আর হাল্কা ঢেউয়ের তালে তালে এপাশ থেকে ওপাশে যাচ্ছে ঠিক ওর জীবনের মতো।কোথা থেকে কোথায় যাচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না।
এই কয়দিন ও একবারের জন্যও রুশির সম্মুখীন হয়নি। আর যাইহোক ভালোবাসার মানুষের চোখে ঘৃণা ও কখনোই সহ্য করতে পারবে না, রুশি নিজেও চায় ইনান ওর সামনে না যাক আর ও চায় রুশি ভালো থাকুক। সব মিলিয়ে সুখে থাকুক,ও নিজে থেকে যদি সায়ানের সাথে থাকতে চায় তবে থাকুক।ও তাদের বিরক্ত করবে না আর না তাদের মাঝে তৃতীয় ব্যাক্তি হয়ে থাকবে!কিন্তু কোন একদিন যদি সায়ান ওকে আগলে রাখতে না পারে তবে রুশি না চাইলেও ও রুশিকে নিজের কাছে নিয়ে আসবে!
ইনানের ভাবনার মাঝে কেউ একজন এসে ওর পাশে বসলো, ইনান পাশের মানুষটির দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকালো কিন্তু সামনের মানুষটির চোখ অনুভুতি শুন্য! তার দৃষ্টি দেখে বুঝার উপায় তার মনে বা মস্তিষ্কে কি চলছে। ইনানের দৃষ্টি তার উপর থাকলেও সে মানুষটি লেকের জলের দিকে তাকিয়ে আছে। ইনান মৃদু কন্ঠে বললো
“ডেকেছিলে?”
সামু সেই পানির দিকে তাকিয়ে বললো
“হুম বসিয়ে রাখার জন্য স্যরি!বেশি সময় নেবো শুধু একটা কথা জানাতে এসেছি এই বিয়েটা তোমায় করতে হবে না ইনান ভাই”
ইনান সামুর দিকে অবাক চোখে তাকালো, এই বিয়েটা করার জন্য সামু কতইনা পাগলামি করেছে অথচ আজ বলছে যে সে বিয়ে করবে না? সামুর এই এক মাসের ব্যাবহারে খুব অবাক হয়েছে ইনান,আগে প্রতিনিয়ত সামু তার খোঁজ নিতো। সময়ে অসময়ে ফোন দিতো কিন্তু এই এক মাস তা করেনি। ফোন দিলেও শুধু শরীর কেমন আছে এতটুকু বলে রেখে দিতো, কন্ঠস্বর কেমন যেনো থাকতো।ইনান কয়েকটা কথা বেশি বলতে চাইলে বাহানা দিয়ে রেখে দিতো। আজ সামুকে দেখে ও যেনো চিনতেই পারছেনা, আগের থেকে অনেক শুকিয়ে গেছে। সুন্দর সেই চোখজোড়ার নিচে কালি পড়েছে, মুখটা মলিন হয়ে আছে। ইনানের মুহুর্তেই মনটা খারাপ হয়ে গেলো, সামুর প্রতি ছোট থেকেই ওর বড্ড মায়া কাজ করে তবে সেটা অন্যকিছু হিসেবে নয়। সামুর কষ্টে তাই ওরও বুক পুড়ে! বড্ড অন্যায় হয়ে যাচ্ছে মেয়েটির উপর! ও জানেনা কি বলবে, কি বলা উচিৎ এই মুহুর্তে?ইনানের চুপ করে থাকা দেখে সামু নিজেই বললো
“কোন বাধ্য হয়ে করা সম্পর্কে তোমাকে বেঁধে রাখতে চাইনা আমি, তুমি আজ থেকে আমার থেকে মুক্ত। আর কোনদিন সামু তোমায় ফোন করবে না ইনান ভাই আর না বিরক্ত করবে।তোমার এই জোরজবরদস্তি মুলক বন্ধনে আর থাকতে হবে না। আমি মাকে বলে দিয়েছি আমি এই বিয়ে করবো না, তোমাকে জানানো বাকি ছিলো আজ জানিয়ে দিলাম”
“হঠাৎ এমন সিদ্ধান্ত নিলে?”
“হঠাৎ নয় আজ অনেকদিন ধরে ভেবেছি তারপর এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।আমি বড্ড স্বার্থপর ইনান ভাই, তোমার ভালোবাসা পাওয়ার লোভে এটা ভুলেই গিয়েছিলাম যে ভালোবাসা জোর করে হয়না। সব কিছু জোর করে পাওয়া গেলেও মনের উপর জোর খাটানো যায়না। এই একমাস সব জেনে বুঝেও চুপ ছিলাম মনে হচ্ছিলো একবার বিয়ে গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে কিন্তু বিয়ে হয়ে গেলেই মানুষটা আমার হয়ে যাবে না কারণ সে অন্যকারো! এই যে দেখো সায়ান ভাই আর রুশি আপুর বিয়ে হয়েছে প্রায় একমাস অথচ সায়ান ভাই এখনো চন্দ্রিকা আপুকেই চায়। তোমার ক্ষেত্রেও তো একই তাই না ইনান ভাই!”
ইনান সামুর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো, ওই চোখে তাকিয়ে থাকার সাধ্য ওর নেই। সামুর সেই দৃষ্টি ওকে বড্ড কষ্ট দিচ্ছে, ঠিক সামু এই মুহুর্তে কতোটা অসহায় তা ওর থেকে ভালো কে বুঝবে? সামুর একই অবস্থানে এই মুহুর্তে ও তো আছে। ও নিজেই তো কাউকে ভালোবাসে বিবশ হয়ে আছে, সে কাছে থেকেও তাকে কখনো পাবে না। এই এক তরফা ভালোবাসায় কতো কষ্ট তা ওর থেকে ভালো কে বুঝবে?এতোগুলো বছরের প্রেম এক মুহুর্ত ভুলা তো সম্ভব নয়, সামুর কষ্ট আর ওর কষ্ট একই তবে কার গভীরতা কতোটুকু ওর জানা নেই। সামু চাইলেই কাঁদতে পারবে কিন্তু ও তো তা করতে পারবে কারণ ও ছেলে মানুষ আর ছেলেদের তো কাঁদতে নেই!
ইনান লেকের দিকে তাকিয়ে বললো
“তুমি সবটা জানতে?”
জবাব দিলো না সামু, স্মৃতির পাতায় ডুব দিলো সেই দিনের ঘটনায়…
সেদিন ইনান বিদায় নিয়ে বের হলে ও ইনানের জন্য তৈরি করা খাবারের বক্স নিয়ে তার পেছনে ছুটলো। ডাক দিতে গিয়েও দিলো না যখন দেখলো ইনান গেটের দিকে না যেয়ে বাগানের দিকে গেলো তাই ও কিছু না বলে তার পিছু নিলো!বাগানের একপাশের মোটা আম গাছটার আড়ালে দাঁড়িয়ে পড়লো আর সবকিছু স্পষ্ট শুনতে পেলো। ইনান রুশিকে ভালোবাসে তাও অনেক বছর ধরে, প্রথমে রুশির উপর বড্ড রাগ উঠেছিলো।
ও নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলো না, একজন ওর হবু স্বামী আর আরেকজন ওর ভাবি! কি করে পারলো ওর সাথে এমন করতে? পরে বুঝতে পারলো রুশির কোন দোষ নেই আর হয়তো ইনানেরও নেই। যেহেতু রুশি ইনানকে তার জীবনে চায়না তাই ও সবটা চেপে গেলো, ভেবেছিলো একবার বিয়ে হয়ে সবটা ঠিক হয়ে যাবে ওই যে তার ভালোবাসা পাওয়ার বড্ড লোভ! কিন্তু আজ ভাবিকে ডাকতে গিয়ে তাদের কথা শুনে বুঝতে পারলো বিয়ে হয়ে গেলেই সব ঠিক হয়ে যায়না। ও মরীচিকার পেছনে দৌড়াচ্ছে যেটা আসলে তার হবার নয় তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইনানকে মুক্ত করে দিবে। একটা সম্পর্কে একজনকে বাধ্য করে কি লাভ এতে কষ্ট আরোও বাড়বে! যেটা তার ছিলো না সেটা তার কখনো হবে না তাই উপর মিথ্যে মায়া বাড়িয়ে কি লাভ?
সামু নিচের দিকে তাকিয়ে বললো
“জানো এতোদিন মনে হতো আমি ভালোবেসে ভুল করেছি কিন্তু এখন মনে না ভালোবাসায় কোন ভুল নেই বরং আমি ভুল মানুষকে ভালোবেসে ভুল করেছি। তুমি তো আমার কখনো ছিলেই না তাহলে তোমাকে আমি কি করে পেতে পারি বলো?”
সামু উঠে দাঁড়ালো আর একমুহুর্তও থাকবে না এখানে কিন্তু কিছুদুর যেতেই থেমে গেলো। তাকে আরেকটু দেখার লোভ সামলাতে পারলো না, ছুটে চলে এলো তার কাছে তারপর ধরা গলায় বললো
“আমাকে আজকের দিনটা দিবে ইনান ভাই?প্রমিস করছি কাল থেকে আর বিরক্ত করবো না তোমায়। আজকেই আমার সকল ইচ্ছে পুরণ করে নিবো যা তোমার সাথে পুরণ করতে চেয়েছিলাম। কাল থেকে তো…”
সামু চুপ হয়ে গেলো, আরেকটু কথা বললে কান্না চেপে রাখতে পারবে না ও। গলায় সব কথা জড়িয়ে গেলো যেনো। ইনান সেই টলমলে চোখের দিকে তাকিয়ে আছে, সামুর মাঝে নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে পাচ্ছে, ভালোবাসা ঠিক এতোটাই অসহায় হয়! সকল কিছুর উর্ধে গিয়েই যেনো একটা মানুষকে চায়, খুব করে চায়!ইনানের জবাব না পেয়ে সামু হাটা ধরলো কিন্তু কেউ হাত চেপে ধরতেই থমকে গেলো, ঠোঁটের কোনে এক চিলতে হাসি খেলে গেলো।
ইনান সামুর হাত ধরে হেটে যাচ্ছে আর সামু ইনানের দিকে তাকিয়ে আছে। আর কোনদিন হয়তো এভাবে দেখা হবে না তাকে আর না তার কাছে ভালোবাসার আবদার করা হবে! সামু মনে মনে আওড়াতে থাকলো
“আমি আর তোমার সামনে আসবো না,আমাকে তোমায় ভুলতে হবে ইনান ভাই।তোমার জন্য হলেও তোমায় ভুলতে হবে। তবে মনে রেখো তুমি আমার কৈশর জীবন প্রেম তাই তোমায় চাইলেও ভুলতে পারবো না কিন্তু ভুলার অভিনয় তো করতে পারবো। প্রেমে পড়ে মানুষ কত কি করে,আমি নাহয় অভিনয়ে পারদর্শী হলাম!”
#চলবে
#গুমোট_অনুভুতি
#লিখাঃ Liza Bhuiyan
#পর্ব_২১
রুশি আজ প্রায় এক মাস পর খান বাড়ির বাইরে পা রাখলো, এতোদিন শরীরটা খুব একটা ভালো ছিলো না তাই আর বের হয়নি। বাড়িতে এতোদিন নিজেকে কেমন যেনো ভারী ভারী লাগতো, কোন কাজ ছাড়া সারাদিন শুয়ে বসে থাকা বড় কষ্টকর তাছাড়া ছোট থেকে ওর কাজ করার অভ্যস, তবে রান্নাটা খুব একটা করা হয়নি। পালক মায়ের চাপে মাঝেমাঝে করলেও বেশ ভয়েই থাকতো, কারণ ও আগুনকে ভয় পায় মারাত্মক ভয় পায়!
রুশি রিক্সা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে রওনা হলো,খোলা বাতাসে প্রাণখুলে যেনো নিঃশ্বাস নিতে পারছে।রুশি সাবধানে বসে আশেপাশের প্রকৃতি দেখতে লাগলো,শীতে ঢাকা শহরের চিত্রই যেনো আলাদা। সবাই শীতের চাঁদর কিংবা জেকেটে নিজেদের মুড়িয়ে রেখেছে,ছোট ছোট বাচ্চারা বাবা-মায়ের হাত ধরে স্কুলে যাচ্ছে।আর কয়েকবছর পর ওর বাচ্চাও এভাবে ওর হাত ধরে স্কুলে যাবে। রুশি একটা বাচ্চার দিকে তাকিয়ে আছে, স্কুল ড্রেস পরা বাচ্চাটি বাবার কাঁধে করে রাস্তা আর হচ্ছে আর পাশে মা ব্যাগ নিয়ে তাদের সাথে সমানতালে হেঁটে যাচ্ছে! রুশির রিক্সা ক্রস করে চলে গেলেও ফাঁকা দিয়ে ও তাকিয়ে রইলো সে দিকে,এই বাচ্চাটি একটা সম্পুর্ণ পরিবার পেয়েছে যেখানে বাবা অফিস থেকে এসে হয়তো বাচ্চাটির সাথে খেলবে আর মায়ের সাথে রোজ সন্ধ্যায় বাচ্চাটি পড়তে বসবে!
কিন্তু ওর বেবি!সেতো এইরকম সম্পুর্ণ পরিবার পাবে না, কারণ তিনবছর পর তো রুশিকে এই সব ছেড়ে চলে যেতে হবে। রুশি এতোদিন এটা ভেবেছে ও চলে যাবে অনেক দুরে এসব ছেড়ে কিন্তু এখন ও ছেড়ে যেতে চায়না। বারবার মনে এইসব কিছু তো ওর তাহলে ও কেনো সরে যাবে?ওর মা, ওর বোন, ওর পরিবার আর ওর…
নাহ সবকিছু ওর হলেও স্বামী ওর নয়, সে অন্যকারো হবু স্বামী তাকে নিয়ে ভাবাই হয়তো পাপ। কোন সম্পর্ক তো কাগজের টুকরো দিয়ে মাপা যায়না, সবচেয়ে বড় সম্পর্ক গড়ে উঠে আত্মার মিলনের মাধ্যমে আর রুশি তো সায়ানের মনের কোন এক কোনা জুড়েও নেই!
রুশি এসব কথা ভাবতেই সামনের দিকে তাকালো, ওর কাছাকাছি বয়সের একটা মেয়ে ব্যাগ কাঁধে হেঁটে যাচ্ছে। রুশি দ্রুত রিক্সা থামিয়ে সেটা থেকে নেমে পড়লো তারপর ওই মেয়েটির হাত ধরে ফেললো আর টেনে কর্নারে নিয়ে গেলো। ওকে দেখে মেয়েটি বড্ড বিরক্ত তা দেখেই বুঝা যাচ্ছে, রুশি আর কথা বাড়ালো না। চোখ মুখ শক্ত করে রাগি কন্ঠে বললো
“কেনো করলি আমার সাথে এমন? তুই তো বেস্টফ্রেন্ড ছিলি তাইনা?কি করে পারলি এমন করতে? আমাকে তুই একটা অপরিচিত ছেলের ঘরে অনায়াসে রেখে আসলি!”
রুশির হাত ঝাড়া দিয়ে ফেলে দিলো মেয়েটি তারপর ঝাঝলো কন্ঠে বললো
“তুই আমার ফ্রেন্ড কখনো ছিলিই না বরং তোকে দেখে আমার হিংসা হতো।কলেজে একেতো তুই টপ ছিলি তারউপর সব ছেলেরা তোর পেছনে পড়ে থাকতো!আমি তোর থেকে বেশি স্মার্ট আর সুন্দর হয়েও আমি তোর কারণে ছেলেদের কাছে পাত্তা পাইনি, ছেলেরা তোকে লিখা লাভ লেটার আমাকে দিয়ে যেতো! তাই তোকে শিক্ষা দিতে চেয়েছিলাম কিন্তু সুযোগ পাইনি,আর তাছাড়া তুই ভালো ছাত্রী তোর হেল্প তো পড়াশোনায় লাগতোই। তবে কলেজ শেষে আমি তোকে প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম কিন্তু একদিন ক্লাবে ছেলেদের কাছে বাজি হেরে যাই আর তারা আমাকে বাজে অফার দেয়। ঠিক তখনি মনে পড়লো তোর কথা আর আমি তোর সাথে যোগাযোগ করি আর সুযোগ বুঝে তোকে সেই ক্লাবে নিয়ে যাই!কিন্তু তোর ভাগ্য ভালো যে ওই ছেলেগুলো তোকে অন্য একজনের কাছে ভালো দরে বেচে দিয়েছিলো নাহয় ভাব পাঁচ ছয়টা ছেলে একসাথে…”
কথাটা শেষ করার আগেই রুশি তিথিকে থাপ্পড় মারলো খুব জোরে, তারপর আরেকটা মারতে গিয়েও সামলে গেলো। এইরকম জঘন্য মানসিকতার মেয়ের গায়ে আর হাত তুলে নিজের হাত নোংরা করতে চায়না। শুধুমাত্র জেলাসির বশে এই মেয়েটি একটা নারী হয়ে অন্য নারীর পুরো জীবন নষ্ট করে দিলো? ওর একটুও বুক কাঁপলো না, রুশির প্রতি কি ওর এক ফোটাও দয়া হলো না। মানুষের তো অনেকদিন থাকলে কুকুরের প্রতিও মায়া জন্মায় আর ওর জলজ্যান্ত মানুষের প্রতি দয়া হলো না? এতোটা পাষান্ড হয় কি করে মানুষ?
ও নিজের রাগকে শান্ত করে দাঁতে দাঁত চেপে বললো
“তুই এতোটা জঘন্য আমি ভাবতেও পারিনি, সামান্য জেলাসির কারণে তুই আমার সবচেয়ে জিনিস আমার সম্মান তুই কেড়ে নিলি?আমার তো তোর সাথে কথা বলতেও বিবেকে বাঁধছে!মনে রাখিস উপরওয়ালা সব দেখছে,তিনি সবকিছুর বিচার করবেন। আমি তারউপর সব কিছু ছেড়ে দিলাম।”
বলেই রুশি উল্টো দিকে হাঁটা শুরু করলো তারপর দেখলো রিক্সাওয়ালা মামা এখনো দাঁড়িয়ে আছে, ও সেটাতে উঠে রওনা দিলো।ভার্সিটির দিকে নয় বরং সেই পার্কে! যেখানে ও মন খারাপ হলেই বসে থাকতো। ও সেখানে গিয়ে ধপ করে বসে পড়লো, চোখের সামনে যেনো তিথির সাথে কাটানো সকল স্মৃতি ঘুরছে।ওদের একসাথে চলা, কথা বলা, কাড়াকাড়ি করে ফুচকা খাওয়া! সব মিথ্যে ছিলো সব, সবকিছু অভিনয় ছিলো কি নিখুঁত অভিনয়! অথচ ও সব সত্যি ভেবেছে কিন্তু সবকিছু একপাক্ষিক ছিলো বরং সবাই ওকে ব্যাবহার করেছে।
ওর চোখদুটো লাল হয়ে আছে, কিন্তু ও কাঁদছে না বরং রাগে শরীর ফেটে যাচ্ছে। এতো বোকা কি করে হলো ও, ওদের করা অভিনয় ও বুঝতে পারলো না?রুশি মাথা চেপে বসে আছে, খুব অসহায় লাগছে নিজেকে! পাশে ফোন বেজে যাচ্ছে কিন্তু ও তুলছে না। এভাবে কতোক্ষণ বসে ছিলো ওর জানা নেই, হঠাৎ কারো ছোঁয়ায় চমকে উঠলো। পাশে তাকিয়ে সায়ানকে দেখে যেনো আরো অবাক হয়।সায়ান কি করে জানলো ও এখানে?আর তাকে এতো টেন্স দেখাচ্ছে কেনো। সায়ান রুশির গালে আলতো হাত রেখে বললো
“তুমি ঠিক আছো?এই সময়ে এখানে কি করছো?”
কথাটা শুনতেই রুশির গাল বেয়ে দুফোটা জল গড়িয়ে পড়লো, ও জানেনা কেনো কাঁদলো কিন্তু এখন কাঁদতে ইচ্ছে করছে বড্ড! রুশির চোখের পানিগুলো সায়ান সযত্নে মুছে দিলো তারপর গালে হাত রেখে বললো
“কাঁদছো কেনো? কি হয়েছে?কেউ কিছু বলেছে?”
রুশি মাথা নাড়ালেও ওর কান্নার বেগ বেড়ে গেলো, কাঁদতে কাঁদতে হিচকি উঠে গেছে। সায়ান রুশির এই অবস্থা দেখে ওকে নিজের বাহুডোরে নিয়ে গেলো আর রুশি সায়ানের বক্ষে মাথা রেখে হিচকি তুলা কন্ঠে বললো
“ও আমাকে শুধুমাত্র ব্যাবহার করেছে, আমার বেস্টফ্রেন্ড হয়েও আমাকে বিক্রি করে দিয়েছে অন্যছেলেদের কাছে। ওইদিন যদি আপনি ওইখানে না থেকে অন্য ছেলেরা থাকতো…”
রুশির জড়ানো কন্ঠে বলা শব্দগুলো শুনে সায়ানের বুক ছ্যাঁত করে উঠলো, ওইদিন শুধু ও না বরং রুশিও কারো বিশ্বাস ঘাতকতার স্বীকার হয়েছে। সায়ান হাত মুঠ করে ফেলেছে, সত্যি এমন ঘটনা ও কল্পনাও করতে পারছে না। অথচ রুশি একট অপরিচিত ছেলের হাতে পড়েছিলো সেদিন,এখন যতোই ওকে চিনুক না কেনো একসময় ওতো রুশির মনে হায়না থেকে কম ছিলো না! ও সত্যিই জঘন্য কাজ করেছে, প্রচণ্ড খারাপ কাজ। সায়ান মাথানিচু করে রুশির মাথায় আলতো হাত ভুলাতে থাকলো। এই ঘটনার পেছনে যারাই জড়িত তাদের কাউকে ছাড়বে না ও, কাউকে না।
রুশির কান্নার বেগ কমে আসলে সায়ান মৃদু স্বরে বললো
“কিচ্ছু হয়নি, সব ঠিক আছে দেখো! আমি তোমার কিছু হতে দিবো না, তুমি আর কান্না করো না প্লিজ”
সায়ানের কথায় রুশি বাস্তাবতায় ফিরে আসলো, আলতো করে সায়ানকে সরিয়ে দিয়ে ঠিক হয়ে বসলো। চোখের পানি মুছে সায়ান দিকে না তাকিয়ে বললো
“এভাবে আর আমাকে জড়িয়ে ধরবেন না আর না কেয়ার করবেন আমার।মাত্র তিনবছরের সম্পর্কে আমি কোন প্রকার মায়া জড়াতে চাইনা। এসব আপনার কাছে হয়তো স্বাভাবিক কিছু কিন্তু আমি মনের অজান্তেই এমন স্বপ্ন দেখে ফেলবো যা দেখার অধিকার আর যোগ্যতা আমার নেই। আশাকরি বুঝতে পেরেছেন!”
রুশি হুট করেই দাঁড়িয়েই হাটা শুরু করলো, সায়ান সেদিকে অধির আগ্রহে তাকিয়ে আছে হয়তো একবার হলেও ফিরে তাকাবে কিন্তু তাকায়নি, নিজের মতো করে চলে গেলো গাড়ির দিকে। সায়ান দীর্ঘনিশ্বাস ফেললো,রুশি ফোন না ধরাতে ও কতোটা চিন্তিত ছিলো তা হয়তো ভাষায় প্রকাশ করতে পারবে না, তারপর ট্রেকার অন করে বুঝতে পারলো রুশি এখানে আছে। একা একা রুশি বেরিয়েছে তাও এই অবস্থায় তারউপর গাড়িও নেই। সত্যি বলতে সায়ান বড্ড ক্ষেপে গিয়েছিলো কিন্তু রুশির অবস্থা দেখে আর কিছু বলেনি। ও নিজেও উঠে দাঁড়ালো, ও কাউকে ছাড়বে না ও যার জন্য রুশি এতো কষ্ট পাচ্ছে! কাউকে না।
দুটো মানুষ পাশাপাশি বসে আছে কিন্তু তাদের মাঝে কোন কথা নেই। সায়ান কতোক্ষণ পর তাকালেও রুশি একবারের জন্যও তাকায়নি, যেনো পণ নিয়েছে দুনিয়ায় কেয়ামত হয়ে গেলেও পাশের মানুষটির দিকে তাকাবে না, ভুলেও না। কতো পাশাপাশি বসে আছে দুজন অথচ মনের দুরত্ব কতো বিশাল!
#চলবে