ক্লিওপেট্রা পর্ব-০৬

0
1232

#ক্লিওপেট্রা
পর্ব- ০৬

‘ভালোবাসি’ বলেই ক্লিওপেট্রা রহস্যময়ভাবে হাসলো। আমার চোখের দিকে ঘোরলাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। আমার অপ্রতিভ লাগতে লাগল। তাই পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তারপর? প্রতিশোধ কীভাবে নিলে?’

ক্লিওপেট্রা ঠান্ডা গলায় বলতে লাগল,

‘আমার ওপর ওই ত্রিবিদ্যা প্রয়োগের পর আমার আত্নবিশ্বাস যেন আরো বহুগুণে বেড়ে যায়। আমি আমার হেপ্নোটাইজ করার ক্ষমতার মাধ্যমে প্রথমেই আমাদের আত্নসাৎ হওয়া সম্পত্তি নিজের নামে লিখিয়ে নেই। এরপর ওই লোক, এলেক্সা এবং আমাদের অফিসের সেই সহকর্মীকে বশ করে একে একে আমাদের পুরোনো বাড়িতে ডেকে আনি।
বাড়ির বেসমেন্টে আমি ওদের চেয়ারে বসিয়ে মোটা দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখেছিলাম ঠিক পনেরো দিন।
কারণ আমি ঠিক করেছিলাম ধীরে ধীরে ওদের নিঃশেষ করব। একবারেই মেরে ফেললে তো ওরা মরে গিয়ে বেঁচে যাবে। তার চাইতে বরং তিলে তিলে ওদের শেষ করা যাক!

আমি ওদের একেকদিন একেক ধরনের শাস্তি দিতাম। তবে শাস্তি দেবার আগে ওদের হ্যালুসিনেট করতে ভুলতাম না। ওদের বিভ্রম তৈরি হতো। ফলে আমার স্থানে ওরা মা’কে দেখতে পেত। ভাবত মা মরে গিয়েও ফিরে এসেছে। তখন ভয়ে ওদের মুখটা চুপসে যেত। আমি যখন ওদের মারতাম ওরা ভাবত মা মারছে।
আমি ওদের হাত-পায়ের নখ তুলে ফেলতাম। আঙুল ভেঙে দিতাম একটা একটা করে। কখনো হাত ভাঙ্গতাম, কখনো পা। পায়ের গোড়ালি কেটে ফেলে দিতাম। তারপর হাতের বাঁধন খুলে দিতাম। পায়ের পাতা না থাকায় ওরা হাঁটতে পারতো না। যন্ত্রণায় ওরা চিৎকার করত। ওরা যখন মা’য়ের নাম ধরে ডেকে বলত, “ক্যাথরিন, আমাদের ক্ষমা করে দাও! হ্যাভ মারসি অন আস! প্লিজ ক্যাথরিন! আমরা নিজেরাই পুলিশের কাছে আত্নসমর্পণ করবো। গড প্রমিজ! ক্যাথরিন আমাদের ক্ষমা করে দাও! আমাদের ক্ষমা করে দাও! ফর গড সেক!”

তখন আমার এত হাসি পেত! একইসঙ্গে একটা অদ্ভুত তৃপ্তি হত। এত শান্তি লাগতো তখন আমার! উফ আহান! তুমি যদি সে অনুভূতিটা টের পেতে!’

বলেই ক্লিওপেট্রা উচ্চস্বরে হাসতে লাগল। এই প্রথম ওকে ভয় লাগল আমার। এই নিষ্পাপ চেহারার মেয়েটা এত নৃশংসভাবে কাউকে খুন করতে পারে!

ক্লিওপেট্রা আবার বলতে শুরু করল,

‘শেষমেশ ওদের শরীরে আগুন ধরিয়ে দেই। ওরা পুড়ে ছাই হয়ে যায়। ওদের মেরে ফেলার পর আমার হঠাৎ একটা স্বাভাবিক জীবন-যাপন করার ইচ্ছে হয়। কিন্তু ওই যে! ত্রিবিদ্যা! তান্ত্রিক মহিলাটি যদি আমার ওপর শুধু ডাকিনীবিদ্যা প্রয়োগ করতো তাহলে হয়তো আমায় এতগুলো বছর ভুগতে হত না।

প্রথম ক’মাস কোনো সমস্যাই দেখা দেয়নি। উলটো নানানরকম ক্ষমতা আমার আয়ত্তে আসে। কিন্তু ত্রিবিদ্যা প্রয়োগের ষাট দিন পেরোতেই সব ওলট-পালট হয়ে যায়। রাত বারোটার পর আমি কোনো সাধারণ মানুষ থাকতাম না। হয়ে উঠতাম পিশাচের চাইতেও ভয়ংকর। আমার শুধু মানুষের মাংস খেতে ইচ্ছে করতো! ‘

আমি বিস্ফোরিত চোখে ক্লিওপেট্রার দিকে তাকালাম। ও হয়তো কিছু বুঝতে পারল। তাই বলল, ‘ভয় পাচ্ছো আমায়?’

আমি তৎক্ষনাৎ মাথা নাড়ালাম। ও বলল, ‘ভয় পেয়ো না। তোমার সঙ্গে ঘুমোলে আমার কখনো অমন ইচ্ছে জাগে না।’

আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘পরে? তুমি ধরে ধরে মানুষ খেতে?’

ও আওয়াজ করে হেসে দিল। বলল, ‘কখনোই না। অন্যের মাংস খেতে যাব কেন! আমার নিজের শরীর আছে না?’

আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। সম্বিৎ ফিরে পেতেই আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারলাম না। দৌড়ে বাথরুমে চলে গেলাম। দরজার কাছে পৌছাতেই বমি করে মেঝে ভাসিয়ে ফেললাম। ক্লিওপেট্রা আমার পিছু পিছু এসেছে। ও আমার পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বলল, ‘ঠিক আছো আহান?

আমি হাঁপাতে হাঁপাতে উপর-নিচ মাথা ঝাঁকালাম।

কিছু সময় লাগল আমার স্বাভাবিক হতে। স্বাভাবিক হতেই ওকে বললাম, ‘তুমি নিজের শরীরের মাংস খেতে? ‘

ও বলল, ‘উপায় কী! নিজেই তো ডাকিনী হবার পথ বেছে নিয়েছিলাম। পরে নাহয় তান্ত্রিক আমায় ত্রিবিদ্যায় ফাসিয়ে দিয়েছিল। এর সম্পূর্ণ দায় আমার। খামোখা কেন নিষ্পাপ মানুষদের খেতে যাব! এর থেকে নিজেকেই নিজের খাবার বানানোটা বেটার নয় কি!’

‘তাহলে তুমি কীভাবে বেঁচে আছো? ‘

ও বলল, ‘ বেশি খেতে হত না। এক কামড়ই যথেষ্ট ছিল। সে ক্ষতও আবার রাত পেরোতে না পেরোতেই সেরে যেত।’

আমি আর সেসব শুনতে পারছিলাম না। তাই এড়াতে বললাম, ‘আচ্ছা, পরে কী করলে?’

ক্লিওপেট্রা লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে পরল। শুয়ে বলল, ‘আর বসে থাকতে পারছি না। আজ কি অন্যদিনের চাইতে বেশি ঠান্ডা পরেছে আহান?’

আমি বললাম, ‘তুমি ঠান্ডা অনুভব করতে পারো?’

‘আগে পারতাম না। হঠাৎ আজ পারছি। তুমি কি আমাকে ভালোবাসতে শুরু করে দিয়েছো?’

আমি বুঝলাম না ওর কথার মানে। তাই জিজ্ঞেস করলাম, ‘মানে?’

ও চুপ করে চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইল। আমি বললাম, ‘তারপর কী করেছিলে বলবে না?

ক্লিওপেট্রা শুয়ে শুয়েই বলতে লাগল, ‘এভাবেই দিন যাচ্ছিল আমার। অদৃশ্য হয়ে। নিজের শরীরের মাংস খেয়ে।
তোমার কোনো ধারণা নেই আহান আমি কতবার নিজেকে শেষ করে দিতে চেয়েছি! শতবার আত্নহত্যা করতে গিয়েছিলাম আমি। কিন্তু প্রত্যেকবারই ব্যর্থ হয়েছি। ফাঁসি দিতে গেলে দড়ির সঙ্গে ঝুলে থাকতাম কিন্তু কোনো ব্যাথা পেতাম না। ওভাবেই সারারাত ঝুলে থাকতাম মরতাম না। শরীরে আগুনও লাগিয়ে দিয়েছিলাম আমি। অথচ সামান্যও পুড়তো না। পানিতেও ঝাপ দিয়েছি। পানির নিচে থেকেও আমার কিচ্ছু হত না। গাড়ির সামনে ঝাপ দিতে গেলে অদৃশ্য হয়ে যেতাম।
মোটকথা, একটা অভিশপ্ত জীবন কাটছিল আমার। মরতেও পারবো না, বাঁচাটাও মৃত্যুর চাইতে যন্ত্রণাদায়ক।

এ অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে তান্ত্রিক মহিলাটির কাছে ছুটে যাই। কিন্তু উনিও কোনো সমাধান দিতে পারে না। শেষে তান্ত্রিক মহিলাটি তার গুরুর কাছে এর সমাধান চায়। তিনি আমাকে দেখা করতে বলে। সাক্ষাৎ হলে উনি জানান, এর একটামাত্রই সমাধান আছে। আমাকে একজন মানুষকে বিয়ে করতে হবে। তাও আবার কোনো যেনতেন মানুষ নয়। একজন সত্যিকারের ভালো মানুষ। যে জীবনে কোনো পাপ করেনি। ফুলের মতো নিষ্পাপ। তবে আরেকটাও শর্ত আছে। সেই মানুষটাকে ভালোবেসে স্বেচ্ছায় আমাকে বিয়ে করতে হবে।
আমি ভেবেছিলাম অমন সাধু পুরুষ এ যুগে আমি কই পাবো! হয়তো আমার সারাজীবনটাই অভিশপ্তভাবে কাটাতে হবে!

কিন্তু আমাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে তার কয়েকমাস পরেই তুমি আমেরিকা এলে।
সেদিন আমি একা একটা লোকাল রেস্টুরেন্টে বসে লাঞ্চ করছিলাম। তুমি যখন রেস্টুরেন্টে ঢুকছিলে তোমার সঙ্গে আমার চোখাচোখি হয়।’

বলে ক্লিওপেট্রা একটু থামে। তারপর অভিমানী সুরে বলে, ‘অথচ তোমার একটুও মনে নেই সে কথা।’

আমি মনে করার চেষ্টা করি। কিন্তু মনে পড়ে না। আমাকে ভাবতে দেখে ক্লিওপেট্রা বলে,

‘থাক সাধুপুরুষ। আপনার আর কষ্ট করে ভাবতে হবে না।

তোমার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই এক সেকেন্ড সময় লাগে আমার তোমার মন পড়ে নিতে। এরপর তোমার কথা আমি গুরু তান্ত্রিককে জানাই। উনি বলেন তবুও তোমাকে একটা পরীক্ষা করে নিতে।
তুমি বাংলাদেশে যেদিন চলে এলে সেদিন তোমার সঙ্গে একই ফ্লাইটে আমিও ঢাকা ফিরি। এরপর কিছু মাস যায়। তোমাকে আমি নিরীক্ষণ করি। একদম শেষ পর্যায়ে এসে পরীক্ষণ করার স্বীদ্ধান্ত নেই। তাই আমি রোজ তোমার সঙ্গে এসে ঘুমিয়ে থাকতাম। প্রথমদিনই তুমি টের পেয়ে যাও আমি তোমার পাশে। একদম নগ্ন গায়ে প্রথমদিন থেকে আজ পর্যন্ত তোমার সঙ্গে এসে ঘুমোই। ছুঁয়ে দেখা তো দূর কোনোদিন কামনার দৃষ্টিতেও দেখোনি। এইযে এখনও ভাবছ, “এই মেয়েটার চোখে এতো মায়া কেন!”

কথা থামিয়ে ক্লিওপেট্রা হো হো করে হাসতে লাগল। আমার খানিক লজ্জা লাগল। এই মেয়ে কেন যে মনের কথা পড়তে পারে!

চলবে…

লেখা: #ত্রয়ী_আনআমতা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে