কাঁচের সংসার পর্ব-০১

0
2334

#কাঁচের_সংসার
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_১

‘তুমি কোনোদিন আমাকে ছাড়া থাকতেই পারবে না, দ্বিতীয় বিয়ে তো দূরের কথা।’ হাসতে হাসতে আরোহী সেদিন স্বামীকে মজার ছলে কথাগুলো বলেছিল কিন্তু কে জানতো যে আরোহীর হাসির সাথে উড়িয়ে দেওয়া কথাটাই সত্য প্রমাণিত হবে।

বিনিময়ে আরিয়ান সেদিন কিছু বলেনি শুধু মুচকি হেসে আরোহীকে বুকে জড়িয়ে নিয়েছিল।
———

আরোহী দরজা দিয়ে উঁকি দিয়ে একবার তাকালো সদ্য বিবাহিত নতুন দম্পতির দিকে।
আরিয়ানকে বেশ মানিয়েছে মেয়েটির সাথে। মেয়েটা দেখতে ভারী মিষ্টি। হয়ত এজন্যই আরিয়ানের মা সেই মেয়েটিকে ছেলের সাথে বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে-পড়ে লেগেছিল। আর ছোট থেকে দেখে আসছে বলে কথা। বোনের মেয়েকে হয়ত আগে থেকেই নিজের ছেলের জন্য পছন্দ করে রেখেছিল কিন্তু মাঝখানে আরিয়ান আরোহীকে বিয়ে করে নিয়ে আসার জন্য হয়ত সফল হতে পারেনি।

আরোহী এক ফলক আরিয়ানের দিকে তাকালো। তাকে দেখে কোনোরকম লাগছে না। আরিয়ান এই বিয়েতে খুশি না-কি বেজার তা ঠিক বুঝা যাচ্ছে না। তবে আরোহী এতটুক নিশ্চিত যে আরিয়ান এই বিয়েতে রাজি ছিল তবে স্নেহাকে সে বোনের নজরেই দেখে এসেছিলো সেটা আরোহী জানে কিন্তু বিয়েতে রাজি থাকার ফলে লুৎফা বেগম সেই সুযোগটা লুফে নিয়েছে। শতই হোক, অবশেষে নিজের কাজ সফল হলো বলে আর আরোহীর মতো একটা অনাথ মেয়েকে নিজের ছেলের কাছ থেকে দূরে সরাতে পারবে ভেবে উনার মুখ থেকে যেন হাসি সরছেই না।

নতুন দম্পতিকে ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে অনেকেই। আরিয়ানের মা লুৎফা বেগম হাতে মিষ্টি নিয়ে দুজনের দিকে হাসিমুখে মিষ্টি বাড়িয়ে দিল। উনাকে আজ ভীষণ হাসিখুশি লাগছে। হয়ত এতদিনে মনের আশা পূরণ হলো সেই আশায়।

আরোহীর বড্ড ইচ্ছে হচ্ছে, এই দম্পতিকে সে যেন একদম সামনে থেকে দেখে কিন্তু তার শাশুড়ি লুৎফা বেগমের কড়া নির্দেশ। তার অলক্ষী ছায়াটা যেন উনার ছেলে-বউ এর উপর না পড়ে।
আরোহী অশ্রুমাখা দৃষ্টিতে আরেকবার নতুন দম্পতির দিকে তাকিয়ে দরজা আটকে দিতে যেতেই দেখল, এতো মানুষের ভীড় থেকে ঠিকই একজন আরোহীর লুকিয়ে দেখাটা খেয়াল করেছে। সে মানুষটা হলো আরোহীর ভালোবাসা, আরিয়ান। আরিয়ানের চোখে কোনো অপরাধবোধ নেই কিন্তু আরোহীর সামনে ঠিকই অপরাধবোধের মতো দৃষ্টি দেখাচ্ছে। ওই চোখ দিয়েই যেন বুঝাতে চাচ্ছে কিছু একটা কিন্তু আরোহী আজ বুঝার চেষ্টা করলো না কিছু। কেন করবে! আরিয়ান তো আর তার নেই। আজ থেকে অন্য কারো সে।

———-

আরোহী দরজা বন্ধ করে দিয়ে মেঝেতে বসে পড়ল। তার সবচেয়ে আপনজনটাও আজ তাকে ছেড়ে দিল। এই দুনিয়ায় আর কেউ রইল না তার।
আচ্ছা, আরিয়ান তো জানতো যে আরোহীর আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই তবুও কেন এমন করলো! তাই বোধহয় দ্বিতীয় বিয়ে করার কথা উঠলেও ডিভোর্সের কথা তুলেনি।
এটা ভাবনা মাথায় আসতেই আরোহী তাচ্ছিল্য হাসি দিল। মায়া দেখাচ্ছে হয়ত!

মা-বাবা হীন মেয়েটা যখন আশ্রম থেকে বেরিয়ে এই বিষাক্ত শহরে ভালো সেজে মুখোশের আড়ালে ঢেকে থাকা মানুষদের মাঝখানে নিজের একটা ভরসার স্থান খুজছিল ঠিক সেই মুহূর্তে আরিয়ান তার দিকে ভরসার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলো। সে দেখেছিল তখন এই শহরে কত কত মানুষ বাজে প্রস্তাব দিয়ে চাকরি দিবে বলেছিল। তখন আরিয়ানের দু’চোখে আরোহী ভরসা খুঁজে পেয়েছিল। সে তখন কোনো দ্বিরুক্তি প্রকাশ না করেই আরিয়ানের হাত আঁকড়ে ধরেছিল। সে তখনই আরিয়ানকে শর্ত জুড়িয়ে দিয়েছিল যে তাকে পেতে হলে বিয়ে করে নিয়ে যেতে হবে। আসলে আরোহী মনে মনে এই বিষাক্ত শহর থেকে বাঁচার আকুতি থেকেই এটা বলেছিল। আর সে দেখতে চেয়েছিল যে আরিয়ান কী সত্যিকারেই তাকে চাই কিনা! না কি আরিয়ানও ভালোর আড়ালে মুখোশ পড়েছিল কিন্তু আরোহীর ধারণাকে ভুল প্রমাণিত করে আরিয়ান সাথে সাথে আরোহীকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে গিয়েছিল। এরপর একেবারে বিয়ে করেই আরোহীকে আরিয়ান তার বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল।

প্রথম প্রথম আরিয়ানের মা মেনে না নিলেও সময়ের সাথে সাথে মেনে নিয়েছিল কিন্তু আরোহীর হয়ত বুঝার ভুল ছিল। আরিয়ানের মা হয়ত আরোহীকে কোনো কালেই মেনে নেয়নি, এমনি ভালোর আড়ালে মুখোশ পড়ে রয়েছিল তা বিয়ের একমাস পেরোতেই আরোহী বুঝে গিয়েছিল।

আরিয়ানেরও হয়ত এখন আর আরোহীকে ভালো লাগে না! লাগবেই বা কী করে, আরোহী যে একবছর আগের আরোহী নেই। চেহারার সুন্দর ভাবটা আর নেই। লুৎফা বেগম আরিয়ান না থাকা কালীন এটা সেটা করতে দিত, আরোহীকে সারাদিন বিশ্রাম নিতে দিতো না সেসব আরিয়ান জানে না। আরিয়ান আসার সময় হলেই লুৎফা বেগম জোর করে আরোহীকে বিশ্রাম নিতে পাঠিয়ে দিতো। সারাদিন পর একটু বিশ্রাম নেয়ার সুযোগ পেতেই আরোহীর দুই চোখে ঘুম নেমে আসতো। আর সেসময়ই আরিয়ান এসে নিজের মাকে রান্নাঘরে দেখে চেঁচিয়ে উঠতো। সে সোজা রুমে এসে আরোহীকে ঘুমাতে দেখে ধাক্কা দিয়ে ঘুম থেকে টেনে তুলতো। আরোহী ধাক্কার তাল সামলাতে না পেরে ধরফড়িয়ে ঘুম থেকে উঠে বসতো। সে ঘুম ঘুম চোখে কিছু বুঝে উঠতে না পেরে আরিয়ানের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেই আরিয়ান রাগী দৃষ্টিতে বলে উঠতো,

‘ওখানে রান্নাঘরে আমার বৃদ্ধ মা’কে কাজ করতে দিয়ে তুমি আরামের ঘুম ঘুমাচ্ছ? সারাদিন এভাবেই শুয়ে-বসে কাটাও আর আমি বাইরে কাজ করে ম’রি আর এখানে আমার বৃদ্ধ মা’কে কাজে মা’রো! এই বয়সী শাশুড়িকে কাজ করাতে দিয়ে নিজে ঘুমাচ্ছ লজ্জা করে না তোমার!’

আরোহী কিছু বুঝে উঠতে পারতো না। সে তো সব কাজ শেষ করে শাশুড়ি মায়ের জোরাজোরিতে রুমে এসেছিলো কিন্তু এসব…! আরোহী মনে মনে হিসাব মিলাতে ব্যস্ত হয়ে কিছু বলার উদ্দেশ্যে মুখ খুলতে নিতেই হঠাৎ আরিয়ানের পেছনে হাত মুছতে মুছতে তার শাশুড়ি লুৎফা বেগমকে রুমে ঢুকতে দেখতেই আরোহীর টনক নড়ে উঠতো। সে কিছু বলে উঠতেই আরিয়ান হাত উঁচু করে থামিয়ে দিত। লুৎফা বেগম আরেকটু ভালো সাজার অভিনয় করে আরিয়ানের উদ্দেশ্যে বলে উঠতো,

‘থাক বাবা। কিছু বলিস না। আমি যতদিন বেঁচে আছি, সব কাজ নিজের হাতেই করে নিব। এসব নিয়ে তোদের মধ্যে ঝামেলা হোক তা আমি চাই না।’

আরিয়ান তখন আরোহীর দিকে রাগী দৃষ্টি নিঃক্ষেপ করে রুম থেকে বেরিয়ে যেত।
আরোহী আরিয়ানের যাওয়ার দিকে নিস্পলক তাকিয়ে চোখ ভেজাতো। সে তখন থেকেই বুঝে নিয়েছিল যে এই সংসারে তার টিকে থাকা বড্ড কঠিন। এভাবে চলতে থাকলে আরিয়ান আর তার মধ্যে দুরুত্ব বাড়তেই থাকবে কিন্তু তার কোনো উপায় ছিল না। আরিয়ানের ততদিনে আরোহীর কাছ থেকে মন উঠে গিয়েছিল। আরিয়ানেরও বা আর কী দোষ! সে তার জায়গায় ঠিক ছিল। সারাদিন অফিস শেষে বাসায় এসে যখন দেখতো নিজের স্ত্রী রুমে পড়ে ঘুমাচ্ছে আর মা রান্নাঘরে কাজ করছে তখন যেকোনো ছেলেই এসব দেখে মাথা ঠিক রাখতে পারবে না কিন্তু এসব দেখার মাঝে যে বড়ো ভুল লুকায়িত রয়েছে সেটা কোনোভাবেই আরোহী আরিয়ানকে বুঝিয়ে উঠাতে পারতো না। আরিয়ানের কাছে তার মায়ের কথায় সবার আগে। এভাবেই আস্তে আস্তে তাদের মধ্যে একেবারের জন্য দুরুত্ব তৈরী হয়ে গেল। আর একবছর হয়ে যাওয়ার পরেও যখন আরোহী মা হয়ে উঠতে পারছিল না তখন আরিয়ানের মা লুৎফা বেগম যেন সুযোগ একদম হাতের নাগালেই পেল। নিজের বোনের মেয়েকে ছেলের সাথে বিয়ে করিয়ে দেওয়ার সুযোগ। আরিয়ান প্রথমে আরোহীর দিকে তাকিয়ে একটু নাকোচ করলেও পরে রাজি হয়ে গিয়েছিল কারণ তখন তাদের মধ্যে এমনিও দুরুত্ব বেড়ে গিয়েছিল। তবুও আরিয়ান দোটানায় ভুগে আরোহীর কাছে এসেছিলো। আরোহীর তখন আর কীই বা বলার থাকবে। সেও রাজি হতে বলে আরিয়ানকে এই বিরক্তিকর সম্পর্ক থেকে মুক্তি দিতে চেয়েছিল।
এসব ভাবতেই আরোহীর চোখ ফেটে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো।

আরোহী চোখ মুছে মেঝে থেকে উঠে বসলো। রুমের বাইরে থেকে এখন আর আগের মতো শোরগোল শোনা যাচ্ছে না। হয়ত নতুন বউকে নিয়ে আরিয়ান রুমে চলে গিয়েছে।
আজ আরোহীর জায়গা গেস্ট রুমে। এই রুমের পাশের রুমটাই এতদিন আরোহী-আরিয়ানের ছিল তবে আজ থেকে আরিয়ানের সাথে আর অন্য কারোর নাম আর অন্য কারো সাংসারিক হাত বিচরণ করবে সেই রুমে। আরোহীর এতদিনের সাজানো গুছানো সংসার যেন এক নিমিষেই শেষ হয়ে গেল।

#চলবে!

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে