#কলঙ্ক
#১৭তমো_পর্ব
#অনন্য_শফিক
‘
‘
‘
ট্রেন তখনও প্লাটফর্ম ছেড়ে যায়নি একেবারে। তবে আগের চেয়ে খানিক গতি বেড়েছে।আমি এবার ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে নিয়ে ট্রেন থেকে নামতে প্রস্তুত হলাম।যাইহোক হবে।মেহরাবের রাগ না ভাঙিয়ে কিছুতেই ঢাকা যাওয়া যাবে না!
দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়ে লাফিয়ে ট্রেন থেকে নামতে যাবো ঠিক তখন পেছন থেকে কেউ আমার কোমর পেঁচিয়ে ধরে ফেলে।আমি ভয়ে আঁতকে উঠে পেছনে ফিরে তাকাতেই দেখি মেহরাব। ততোক্ষণে ঝকঝক করে ট্রেন প্লাটফর্ম ছেড়ে অনেক দূরে চলে গেছে। এখন অনেক গতিতে ছুটছে ট্রেন।
মেহরাবকে দেখে আমি নিছক বোকা বনে গেলাম।এটা কী করে সম্ভব? তখন তো আমি খুব ভালো করেই খুঁজেছি।সে তো বগিতে ছিল না!
‘
মেহরাবের বুকের কাছে মুখ আমার।ও তখনও আমায় ধরে আছে।আমি কী এক লজ্জায় আবিষ্ট হয়ে মরে যেতে চাচ্ছি। কিন্তু ওর কাছ থেকে কেন জানি ছুটতেও ইচ্ছে করছে না আর। তবে আমার এই ইচ্ছে কিংবা অনিচ্ছেয় তার কিছু যায় আসে না। মেহরাব আমার কোমড় থেকে হাত সরিয়ে নিলো। তারপর বললো,’ওখানে গিয়ে বসো।’
আমি আবার জানলার কাছে গিয়ে সিটে বসলাম। আমার পাশে এসে মেহরাবও বসলো।
খানিক সময় দুজনেই চুপচাপ বসে রইলাম।
তারপর মেহরাবই কথা শুরু করলো।সে পেছনে ঘটে যাওয়া বিষয়টা বাদ দিয়ে নতুন কিছু বললো।বললো,’জানলার কাছে এই আলো আঁধার মাখা সন্ধ্যায় তোমায় খুব ভালো লাগছে তূর্ণা!’
আমি ওর দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলাম।
মেহরাব এবার বললো,’আমি কী তোমার হাতটা একটু ধরতে পারি?’
আমি লজ্জা পাচ্ছি। খুব ইচ্ছে করছে ওর হাতটাই খপ করে ধরে ফেলতে। কিন্তু লজ্জার জন্য পারছি না। তবে ও যখন নিজ থেকেই বলেছে আমার হাত ধরার জন্য তবে আমার না বলার তো কোন প্রশ্নই আসে না!
আমি মাথা নত করে অন্য দিকে তাকিয়ে চাপা গলায় বললাম,’শিউ্যর।’
আমি ভেবেছিলাম মেহরাব মজা করেছে। হয়তো সে আমার হাত ধরবে না। কিন্তু সে আমায় বড্ড অবাক করে দিয়ে আমার হাত চেপে ধরলো।
ধরেই রাখলো সারাক্ষণ।
তখন আঁধার নেমে এসেছে।ট্রেনের ভেতর লাইট জ্বলছে।ঠিক এই সময়টাতে আমি কোনদিন ঘুমাইনি। কিন্তু আজ আমার এতো ঘুম পাচ্ছে কেন?
পরপর দু তিনবার হাই উঠেছে। শরীর এলিয়ে পড়তে চাইছে।আমি জানি না ঠিক কখন যে ঝট করে এলিয়ে পড়লাম মেহরাবের গায়ের উপর। তারপর ঘুমে তলিয়ে গেলাম বিছানা ভেবে ওর বুকের ওপর!
টের পেলাম অনেক পর যখন ট্রেন এসে থামলো কমলাপুর রেলস্টেশনে।সব যাত্রী এক এক করে নেমে গেলো। তখন মেহরাব আমার পিঠে আলতো স্পর্শ করে ডাকতে লাগলো।
‘তূর্ণা,এই তূর্ণা?’
আমি পিঠে ওর স্পর্শের জন্য গায়ে শিরশির করা এক অনুভূতি নিয়ে ওর দিকে এলোমেলো চোখে তাকাতেই সে হাসলো।
আমি লজ্জায় গাঢ় লাল হয়ে ওর থেকে সামান্য সরে আসতে চাইতেই সে আমায় আরো কাছে টেনে নিলো। তারপর আমার কানের কাছে তার ঠোঁট এনে বললো,’একদিন খুব ভালো বাসবো তোমায়!’
আমার তখন খুব ইচ্ছে করছিলো যেন ও এক্ষুনি বলে ফেলে,তূর্ণা আমি তোমায় অনেক ভালোবাসি। তারপর সে আমায় তার বুকের কাছে টেনে নিক।আদর করে চুমু খাক। কিন্তু এসবের কিছুই তো করলো না ও।গাধার মতো করে বললো, তূর্ণা আমি তোমায় একদিন ভালো বাসবো!
ভালো বাসবে না ছাই করবে!এর আগে মরে ভূত হয়ে গেলে কী হবে?
আমাকে মন খারাপ করে বসে থাকতে দেখে মেহরাব বললো,’ আমি ফিরতি ট্রেনেই চলে যাবো মেডাম। আপনি এখন উঠুন। আপনাকে দ্রুত পৌঁছে দিয়ে আসি।’
আমার যা রাগ পেলো তখন।আমি ওর দিকে রাগমাখা লাল লাল চোখে তাকিয়ে বললাম,’হয়েছে।আমি একাই যেতে পারবো। কাউকে আমায় দিয়ে আসতে হবে না গিয়ে!’
মেহরাব হাসলো। কিন্তু কিছুই বললো না।
আমি ওর সামনে দিয়েই ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে বের হয়ে গেলাম। কিন্তু ও মুখ থেকে একটা রা পর্যন্ত করলো না!
‘
প্রচন্ড মন খারাপ আর কাঁদো কাঁদো চোখ নিয়ে হোস্টেলে গিয়ে উঠলাম। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো আমার সিটটা এখন আর খালি নেই।অন্য জনকে দিয়ে দেয়া হয়েছে।হোস্টেলে এখন আর আমার সিট নাই।অথচ আমি কদিন আগে যাওয়ার সময় ভাড়া মিটিয়ে গিয়েছি। তবুও ওরা কেন এমন করলো?
প্রভোস্ট মেমের সাথে দেখা করতে যখন গেলাম তখন তিনি আমার দিকে এমন ভাবে তাকালেন যেন আমি ভিন গ্রহ থেকে একটা এলিয়েন এসেছি! তিনি এমন কাউকে আর কখনো দেখেননি!
আমি মেমকে সালাম দিলাম।
‘আসসালামু আলাইকুম।’
মেম সালামের উত্তর দিলেন না।উল্টো তিনি আমায় কড়কড়ে গলায় জিজ্ঞেস করলেন,’তোমার নামে উপরে উপরে অনেক কিছু শুনেছি।যা শুনেছি তা কী সত্যি?’
এমনিতে আমার অত সাহস নেই। কিন্তু মেহরাবের প্রতি একটা রাগ থেকে আমার মাথা এমনিতেই ধরে আছে। সেই রাগ থেকেই হয়তোবা এমনটা করেছি আমি।মেমকে সরাসরি বলে ফেলেছি,’মেম সত্যি।’
মেম খুব আশ্চর্য হয়ে বললেন,’তোমার লজ্জা করছে না এভাবে সত্যি বলতে?’
আমিও পাল্টা জবাব দিলাম।
‘মেম, আমাদের বিয়ে হয়েছিল। আমার হাসব্যান্ড আমায় ঠকিয়েছে।আমি তো তাকে ঠকাইনি। লজ্জা তো যে ঠকিয়েছে তার হওয়া উচিৎ। আমার কেন লজ্জা হবে?’
মেম খানিক সময় বিষ্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। হয়তো তিনি এখন ভাবছেন, এই মেয়ের অত সাহস হয় কী করে?অথবা এও ভাবতে পারেন যে তার জীবনে এতো নির্লজ্জ মেয়ে তিনি দেখেননি। তবে সত্যিটা হলো এই জগতে খুব কম ছেলে মেয়েই আছে যারা গোপনে কোন প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলেনি!ছেলেটা মেয়েটার ঠোঁটে চুমু খায়নি! জড়িয়ে ধরেনি। তাদের বিষয়টা গোপন বলেই তারা গলা বড় করে অন্যের দোষটা বলতে পারে। অথচ পাপ তো তাদেরটাও কম নয়!হতেও তো পারে যে মেম আজ আমায় এমন বড় বড় চোখ করে দেখছেন,মনে মনে নির্লজ্জ আর বেহায়া ভাবছেন তার নিজেরও এমন একটা অতীত আছে যে অতীত সম্পর্কে কেউ জানে না!হতে পারে না?
মেম বললেন,’কেন এসেছো আমার কাছে বলো?’
আমি বললাম,’আমার সিটটা অন্যজনকে দেয়া হলো কেন?’
মেম সামান্য ভিরমি খেয়ে গেলেন। খাওয়ার কথাও। তিনি এভাবে অন্য কাউকে এই সিট দিয়ে দিতে পারেননা। এই অধিকার তার নাই।কারণ সিটের ভাড়া এখনও আমি বহন করছি। তাছাড়া সিট এখনও আমার অধীনে!
মেম আমার দিকে অবাক চোখে তাকালেন।যেন তিনি ভাবতেও পারছেন না একজন ছাত্র তার সাথে এমন উদ্ধত আচরণ করতে পারে!
মেম হড়বড় করে হঠাৎ বললেন,’তুমি এরকম আচরণ করছো কেন আমার সাথে? তুমি জানো এর জন্য তোমায় আমি পানিশম্যান্ট দিতে পারি?’
আমি আলতোভাবে হেসে বললাম,’জ্বি না।আমি জানি আপনি আমার উপর কিছুতেই পানিশমেন্ট দিতে পারেন না।কারণ আমি আপনার সাথে কোন রকম বেয়াদবি করিনি!’
মেম যেন আমার এই সাহসিকতা কোন ভাবেই মেনে নিতে পারছিলেন না।মেম না শুধু। এখানে অন্য কেউ হলেও এমন করতো। মানুষ স্বভাবগতভাবেই এমন।যারা উচ্চ পদস্থ তারা সব সময় তাদের চেয়ে ছোটদের প্রতি প্রভু সুলভ আচরণ করতে পছন্দ করে!
মেম রাগমাখা গলায় বললেন,’তুমি এখন এখান থেকে যাও বলছি। এক্ষুনি যাও। আমার তোমায় সহ্য হচ্ছে না!’
আমি মৃদু হেসে বললাম,’একশোবার যাবো আমি। কিন্তু এর আগে আপনি আমার সিট ফিরিয়ে দিন।’
‘যদি না দেই?’
‘না দিলে আমি এখান থেকে যাবো না!’
মেম বললেন,’এক চড় দিয়ে দাঁত ভেঙে ফেলবো বেয়াদব মেয়ে!’
আমি এর জবাব দিলাম না। শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলাম।
মেম এবার রাগের গলায় বললেন,’এখনও এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন?’
আমি বললাম,’আমার সিটটা ফিরিয়ে দিন মেম।’
মেম এবার উঠে দাঁড়ালেন। তিনি প্রচণ্ড রকম ক্ষীপ্ত।এই মুহূর্তে তিনি কী করবেন বোঝা যাচ্ছে না। অবশ্য আমার গায়ে হাত তোলার অধিকার তার নেই। কিন্তু যেভাবে তিনি রেগেছেন তিনি হাত তুলতেও পারেন!
‘
#চলবে