এক সমুদ্র প্রেম পর্ব-১০+১১

0
994

#এক_সমুদ্র_প্রেম!
লেখনীতে: নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
(১০)

পুষ্পর একটি চি*ন্তাযুক্ত সকাল আজ। মিনা বেগম প্রত্যেক দিন নামাজ পড়তে উঠে দুই মেয়ের দরজা ধা*ক্কান,নামাজের জন্যে ডাকেন। পিউ ম*রার মত ঘুমায়। টের পায়না প্রায়সই। ডাক কানে গেলে উঠে যায় অবশ্য। কিন্তু এদিক থেকে কয়েক ধাপ এগিয়ে পুষ্প। ধা*ক্কাতে ধা*ক্কাতে হাত খুলে গেলেও সে ওঠেনা। মোড়ামুড়ি করে। নানা রকম ভ*য়ড*র দিয়ে তুলতে হয়। অথচ আজ ভোর পাঁচটায় উঠে বসে আছে সে। ফজরের নামাজ আদায় শেষ। মনপ্রান দিয়ে আল্লাহ আল্লাহ করছে প্রান বাঁচানোর জন্যে। এরপর ঘরময় পায়চারি করল কিছুক্ষন। শেষ রাতে শীতের প্রকোপ বাড়ে। কনকনে ঠান্ডায় পুষ্পর দাঁত কপাটি বা*রি খাচ্ছে বারবার। দুশ্চিন্তায় হাবুডু*বু খেয়ে সে আর বেশিক্ষন বসে থাকতে পারল না। বিপদে একটু সাহারা পেতে চলল পিউয়ের ঘরের দিক। ওর ঘুম হা*রাম যখন,ওটাকেও আর ঘুমোতে দেবেনা।

পুষ্প তৈরি ছিল,পিউয়ের দরজায় জোড়াল করাঘাতের জন্যে। এই শীতে নিশ্চয়ই ও নামাজে ওঠেনি। তার মতোই ফাঁকিবাজ কী না! অথচ দরজায় হাত দিয়ে দেখল আগে থেকেই খুলে রাখা।
পুষ্প অবাক হলো। কৌতুহলি হয়ে ভেতরে উঁকি দিতেই বিস্ময় আরেকদফা বাড়ে। পিউ বিছানায় আধশোয়া হয়ে ফোন টিপছে। পুষ্প দেয়াল ঘড়ির দিক তাকাল। সাড়ে ছটা বাজে কেবল। বিস্মায়াবিষ্ট হয়ে বলল,
” তুই এত সকালে উঠেছিস?”

আচমকা কথা বলায় পিউ চমকে উঠল। আত*ঙ্কিত হয়ে তাকাল। পুষ্পকে দেখে বুকে থুথু ছিটিয়ে, ভ্রুঁ গুটিয়ে বলল,
” এভাবে হঠাৎ করে কথা বলে কেউ? ”

পুষ্প ভেতরে ঢুকে চাপানো দোর ফের চা*পিয়ে দিল। এগিয়ে আসতে আসতে বলল,
” নামাজ পড়েছিস?”
পিউ ছোট করে বলল, ‘ হু।’

পুষ্প ভ্রুঁ উঁচায় ” বাবাহ! এত ভদ্র কবে হলি?”
” আমি তোর থেকে বেশি উঠি। নিজে পড়িস না,তাই জানিস না। তা তুই আজ কী করে উঠলি?”

পুষ্প ঠোঁট উলটে বলল,” আমার টেনশনে ঘুম ভে*ঙে গেছে। স্বপ্নেও দেখছি ধূসর ভাই আমায় মা*রছেন। আম্মু খুন্তি নিয়ে পেছনে ছুটছেন। আর আব্বু বঁ*কে ঝকে বিয়ে ঠিক করেছেন। ”

পিউ বিজ্ঞের মত ঘাড় দুলিয়ে বলল ” ১০০% নিশয়তা আছে স্বপ্ন সত্যি হওয়ার।”

পুষ্প চিৎপটাং হয়ে শুয়ে পরল বিছানায়৷ দুদিকে দুহাত মেলে দিয়ে হাহা*কার করে বলল,

” আমি ম*রে যাব রে পিউ। ভাইয়া যদি ভার্সিটিতে বসেই থা*প্পড় টা*প্পড় মে*রে বসেন,আমার প্রেস্টিজ ওখানেই ই*ন্তেকাল করবে।”

পিউ কিছু বলল না। ভাবতে বসল সমস্যার সমাধান। পুষ্প হঠাৎই উঠে বসল। আবদার করল,
” আমার সঙ্গে যাবি পিউ? তুই গেলে একটু ভরসা পেতাম।”

পিউয়ের কথাটুকুন পছন্দ হয়। ধূসরের সঙ্গে একটু বাড়তি সময় কাটাবে, সাথে পুষ্পর ও সুবিধে হবে। অর্থাৎ এক ঢিলে দুই পাখি মা*রার অনবদ্য উপায় পেয়ে পিউয়ের মুখ ঝলকে ওঠে। নিমিষেই জবাব দিল,
” যাব।”
পরমুহূর্তে চি*ন্তিত হয়ে বলল ” কিন্তু ধূসর ভাই কি নেবেন সাথে?”

পুষ্প ক্ষনকাল চুপ থেকে বলল,
” তুই ভালো করে বললে নিতে পারে।
পিউয়ের ভাবনা গেলনা। সে ভালো করে বললে কী,পা ধরে ঝুলে পরলেও কাজ হয়? ওই লোক এত ভালো না কি!

পুষ্প বলল,
” কিন্তু তোর কলেজ?”
পিউ আবার ভাবতে বসল। ভেবে ভেবে বুদ্ধি বের করে বলল
” তুইতো দুপুরের দিকে যাবি। আমি হাফ টাইমে চলে আসব ছুটি চেয়ে। ”

পুষ্প দ্বিধান্বিত হয়ে বলল ” যদি ছুটি না দেয়!”

পিউ ততটাই নিশ্চিন্ত উত্তর দিল ” আরে দেবে দেবে।”

পুষ্প মাথা দুলিয়ে বলল, “আচ্ছা, এখন যাই তাহলে। একটু ঘুমিয়ে নেই।”

” যা।”

পুষ্প উঠে দরজা অবধি গিয়ে দাঁড়িয়ে পরল। কী মনে করে ঘুরে তাকিয়ে বলল
” একটা কথা বলতো! ”
পিউ ফোন থেকে চোখ তুলে বলল,
” কী কথা?”

পুষ্প বুকের সাথে দুহাত বেঁ*ধে দাঁড়াল। চোখ সরু করে বলল,
” এমনিতে তো ডাকলেও উঠিস না,আজ কী ভেবে চৈতন্য হলো?”
পিউ মিটিমিটি হেসে বলল,
” আমায় নিয়ে তদন্ত না করে নিজেকে নিয়ে আল্লাহ আল্লাহ কর যা। কপালে দুঃ*খ আছে যে! ”

পুষ্প মুখ বেঁকি*য়ে বলল,
” হাতি কাঁদায় পরলে ব্যাঙেও লা*থি মারে তাইনা?”
” ব্যাঙের বুদ্ধি নিতেই তো আসলি।”
পুষ্প আর উত্তর খুঁজে পেল না। ‘ হুহ’ বলে বেরিয়ে গেল। পিউ হু হা করে হেসে ফেলল এতে। এরপর লম্বা করে শ্বাস টানল।
গ্যালারি ঘেটে ‘ ডেইরিমিল্ক ‘ লেখা ফোল্ডার বের করল। ধূসরের অগনিত ছবি যেখানে। তার মধ্যে কিছু ছবি পিউয়ের ভীষণ প্রিয়। ঘুমোতে যাওয়ার আগে এই ছবি দেখা রুটিন তার। এখনও একটা ছবি বের করে চোখের সামনে ধরল পিউ। স্ক্রিনে হাত বুলিয়ে বলল,

” আপনার জন্যে আর কত কী করতে হবে ধূসর ভাই? এইযে কাল সারা রাত ঘুমোয়নি, বসে বসে অপেক্ষা করেছি সকাল হওয়ার, কেন জানেন? কারন প্রত্যেক সকালে আপনার ঘুমঘুম মুখটা দেখা আমার অভ্যেস। আপনাকে চোখের সামনে রেখে খাবার চিবোনো আমার স্বভাব। পাশাপাশি বসে আপনার শরীর থেকে আসা পারফিউমের গন্ধে ধ্যান হারানো আমার অমত্ত অভিলাষ। এই নিয়ম পাল্টাই কী করে বলুন!

সিকদার বাড়ির পুরুষরা সাড়ে সাতটার মধ্যে নাস্তার পাঠ চুকিয়ে বেরিয়ে যান। গৃহিনীরা সকাল সকাল তাই লেগে পড়েন কাজে। আমজাদ,আফতাব,আনিস ব্যাতীত এ সময় নাস্তার টেবিলে কেউ থাকেনা। হিসেব মত এই দিন থেকে যোগ হবে ধূসর। অফিসে আজ তার প্রথম দিন । অফিস বাড়ি থেকে বেশ কিছুটা দূরে হওয়ায় প্রয়োজনের আগেই সময় মেপে বেরিয়ে পরতে হয়। ভোরবেলা ঢাকার রাস্তা মোটামুটি খোলামেলা গেলেও,নটার পর জ্যামের তো*পে নড়াচড়াও মুশকি*ল।
আমজাদ সিকদার, আফতাব সিকদার দুই ভাই খুশিতে আটখানা হয়ে খাচ্ছেন। আনিস কোনও রকম নাকেমুখে খাবার পুরে বেরিয়ে গেল। দেশের অবস্থা খুবই করু*ন। খু*ন,খারা*পিতে ভরে গেছে। চা*প পরছে তাদের টিমের ওপর। ঘুম হারা*ম করে দিচ্ছে। হৃষ্টপুষ্ট ছিল,আর এই চাকরি নেয়ার পর থেকে একেবারে কুপোকা*ত। নাওয়া,খাওয়া বাদ দিয়ে ছুটতে হয়। আজও তেমনি হলো। তিনি বেরিয়ে গেলেন। সুমনা বেগম ব্যাগে টিফিন বাক্স ভরে দিতে দিতে পেছনে ছুটলেন তার। আনিস গাড়িতে বসলেন, আর সুমনা বেগম জানলা থেকে এক প্রকার ছু*ড়ে মা*রার মত করে বাটি হাতে দিলেন। আনিস অসহায় ভঙিতে চেয়ে বললেন
” প্রত্যেক দিন এত ক*ষ্ট করো কেন? কতবার বললাম,বাইরে খাব,শোনোনা।”

” বাইরের খাবার তোমার সহ্য হয়না,সে আমি ভালোই জানি। আমার একটু ক*ষ্টতে যদি তুমি সুস্থ থাকো তাতে ক্ষ*তি কী?।”
আনিসের প্রান জুড়িয়ে যায়। বুক ভরে শ্বাস ফেলে বলে ” আসি।”

সুমনা বেগম বিদায় পর্ব শেষ করে ঘরে গেলেন। তখনি উপর থেকে ধূসর নামল। সুট্যেড ব্যুটেড, স্বাস্থ্যবান ছেলেটিকে দেখে সুমনা বেগমের চোখ শীতল হয়ে আসে।
তিনি বিস্তর হেসে বলেও ফেললেন” মাশআল্লাহ! আমার একটা মেয়ে থাকলে তোকে জামাই বানাতাম রে ধূসর।”

ধূসর ক্ষীন হাসল,মুহুর্তে সে হাসি মিলিয়েও গেল।
সে নিচে নেমেছে কেবল,ওমনি ওপর থেকে হুটোপুটি করে ছুটে এলো পিউ। ধুপ ধুপ করে সিড়ি ভে*ঙে নামল। প্রত্যেকে হকচ*কাল তার কান্ডে৷ এমনকি ধূসর নিজেও স্বল্প সময়ের জন্যে ভড়কাল। পিউ চেয়ার ধরে হা*পাতে হা*পাতে সবার উদ্দেশ্যে বলল,
” শুভ সকাল।”

প্রত্যেকে অবাক চোখে কিছুক্ষন দেখল ওকে। আমজাদ সিকদার বললেন,
” কী ব্যাপার আম্মা,তুমি এত ভোরে উঠলে যে!”
পিউ ঘন শ্বাস টেনেই জবাব দিল,
,”পড়তে উঠেছিলাম আব্বু। এখন খিদে পেল তো,তাই এলাম।”

ডাহা মিথ্যে কথাটা শুনেই মিনা বেগম খুশি হয়ে গেলেন। গদগদ হয়ে বললেন,
” ওমা তাই? এইতো আমার লক্ষী মেয়ে। নে নে খেতে বোস।”
পিউ মুচকি হেসে আড়চোখে একবার পাশে দাঁড়ানো ধূসরকে দেখল । মুহুর্তে হার্ট মিস করল যেন। আরেকদিক ফিরে, বুকে হাত দিয়ে বলল ফিসফিস করে বলল,
” উফ, মার ডালা!’

আফতাব সিকদার ছেলের দিকে তাকালেন,
” কী ব্যাপার, খাবেনা? বোসো।”

পিউ তক্কে তক্কে ছিল। ধূসর যে চেয়ারে বসবে টুপ করে তার পাশেরটায় বসে পরবে বলে। কিন্তু ধূসর বলল,
” আমি খাবনা।”
আমজাদ সিকদার বললেন ” কেন? খাবেনা কেন?”

” এত সকালে খেতে পারব না। অভ্যেস নেই। আমি বের হচ্ছি আপনারা আস্তেধীরে আসুন।”
রুবায়দা বেগম বললেন,
” ও বাবা,একটু কিছু মুখে দে,প্রথম দিন একেবারে খালি মুখে যাবি?”

ধূসর সংক্ষেপে বলল ” সমস্যা নেই।”
এ ছেলে আর কথা শুনবেনা। এতদিনে সকলের নখদর্পনে তা। হাল ছাড়লেন তারা,সাধলেন না আর।

পিউয়ের চেহারার পরতে পরতে হতা*শা ছেয়ে গেল। নটার আগে তার ঘুম ভাঙেনা। অথচ ধূসর বের হবে আগেই। যদি উঠতে না পারে? সেই ভেবে যার জন্যে রাত জেগে,না ঘুমিয়ে অপেক্ষা করল সকালে একসঙ্গে খাবে বলে৷ সে-ই খাবেনা? পিউয়ের তমসায় ঘেরা মুখমন্ডল ধূসর দেখলনা। সে পা বাড়িয়েছে সদর দরজার দিকে। আমজাদ সিকদার পেছনে থেকে বললেন
” গাড়ির চাবিটা নিয়ে যাও।”
ধূসর ফিরে তাকিয়ে বলল,
” আমি বাইকে যাব।
আপনারা গাড়িতে আসুন।”

আমজাদ ঠোঁট ফু*লিয়ে বিরক্তির শ্বাস নিলেন। আফতাব সিকদার আশাহ*ত হয়ে বসে রইলেন। এই ছেলে আর শোধরাবে না।

পিউকে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মিনা বেগম বললেন,
” তুই দাঁড়িয়ে আছিস কেন? বোস।”
পিউ মুখ কালো করে বলল,
” খাব না।”
জবা বেগম শুধালেন, ” এমা কেন? এই না বললি খিদে পেয়েছে?”
” পেয়েছিল। হারিয়ে গেছে। ”

তারপর হনহনিয়ে ঘরের দিকে চলে গেল পিউ। মিনা বেগম মেয়ের প্রতি রাগে হা হু*তাশ করে বললেন,
” আপনার মেয়ের এসব কাজকর্ম আমার ভালো লাগছেনা। ওর জ্বা*লায় একদিন সন্ন্যাসী হয়ে সংসার ছাড়ব দেখবেন।”

আমজাদ সিকদার চুপ থাকলেও আফতাব সিকদার মুখ খুললেন। প্রখর বি*রোধিতা করে বললেন,
“কেন ভাবী? এখন এই কথা কেন বলছেন? একটু আগে আপনাদের আদরের নবাব সাহেব যে চলে গেলেন,কারো কথায় গ্রাহ্য অবধি করলেন না, তার বেলা তো বলেননি। পিউ কিছু করল না তাতেই এই অবস্থা কেন? ”

মিনা বেগম মিইয়ে গেলেন। যুতসই উত্তর না পেয়ে মিনমিন করে বললেন,
” ধূসর তো ছোট ভাই।”
আফতাব সিকদার ভ্রুঁ কপালে তুলে বললেন,
” সে কী! ছয় ফুটের ষাড় টাকে আপনার ছোট মনে হলো? আর দু ইঞ্চির পিউকে ধেড়ি বুড়ি ভেবে বসলেন?”

” ধূসর সারাদিন বাইরে থাকে,কত ঝু*ট ঝা*মেলা সামলায়,এখন তো আবার অফিস ও দেখবে। ওর মাথা ঠিক থাকবে না এটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু এই মহারানী কী করেন? হেলেদুলে ঘুরে বেড়ান। এবার শুধু রেজাল্ট খারা*প করুক,দেখবে কী যে করব ওকে আমি।”

আফতাব সিকদার দুপাশে মাথা নাড়লেন। তার পূত্রের অপ*রাধ এ বাড়ির কেউ দেখেনা। আমজাদ সিকদার বললেন,
” আফতাব,চলো বের হই। ধূসরের আগে পৌঁছাতে হবে। ”
” কেন ভাইজান?”
আমজাদ উঠতে উঠতে জবাব দিলেন ” চলো বলছি।”
_____
ধূসরের প্রতি ক্রো*ধে বিড়বিড় করতে করতে তৈরি হচ্ছে পিউ। ইউনিফর্মের ক্রস বেল্ট লাগাল বিদ্বিষ্ট হয়ে। মনঃক*ষ্টে সে নিজেও খাবেনা বলে পণ করেছে। তাতে ক্ষুধায় ম*রে যাক,তবুও না। পিউ তৈরি হয়ে ঘর ছাড়ল। পথে দেখা হলো পুষ্পর সাথে। সে দেখতেই অনুরোধ করল,
” তাড়াতাড়ি ফিরিস সোনা,প্লিজ!”

পিউ নি*রাস শ্বাস ফেলল। এখন কাজে লাগবে বলে সোনা, রুপা কত কী ডাকছে। আর এমনি সময় ওর একটা লিপস্টিক ধরলেও চু*লোচুলি বাঁ*ধে। পিউ নেমে এলো। সাদিফ খেতে খেতে ওকে যেতে দেখে বলল,
” কী রে পিউ,খাবিনা? ”

পিউ ছোট করে বলল ” না।”

পেছন থেকে মিনা বেগম হাজারটা ডাক ছু*ড়লেন। মেয়েটা দাঁড়ায়নি। ক্ষে*পে থাকায় টিফিন অবধি নেয়নি।
পিউ একদম মেইন গেটের বাইরে এসে দাঁড়াল। সাদিফ ও তখনি বের হয়েছে। এত তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ কী করে হলো কে জানে! সাদিফ পার্কিং লটের দিকে গেল। বাইকে চে*পে বসতেই পিউ এসে দাঁড়াল সামনে। নিভু কন্ঠে আবদার করল
” আমায় একটু লিফট দেবেন?”

সাদিফ হেসে বলল ” বোস।”
পিউ উঠে বসে। সাদিফ বাইক ছাড়ে। পিউ চেয়ে রয় ধূসরের বারান্দার পানে। জানলা দরজা সব বন্ধ,ধূসরও নেই কক্ষে। সেতো বেরিয়েছে। তবু পিউ চেয়ে থাকে। মিছিমিছি খুঁজে বেড়ায় সে কলেজে যাওয়া কালীন ওই খানটায় দাঁড়িয়ে থাকা তার ধূসর ভাইকে।

______

ধূসর আগে বের হলেও তার পৌঁছাতে সময় লাগল। পথে বাইকের তেল শেষ হওয়ায় পেট্রোল পাম্পে দাঁড়িয়েছিল। সেই ফাঁকেই আমজাদ সিকদার ভাই সহ পৌঁছে গেলেন অফিসে। ধূসর পৌঁছাল তার দশ থেকে পনের মিনিট পর। কতগুলো বছর এখানে পা অবদি রাখেনি । এসেছিল খুব ছোট বেলায়। অথচ গেট বরাবর আসতেই দারোয়ান তৎপর খুলে দিলেন । ধূসর ঢুকল। জিজ্ঞেস করল,
” মেইন অফিস কোনদিকে?”
লোকটি হাত লম্বা করে দেখালেন ” এদিকে স্যার।”

ধূসর সে পথে এগোয়। গ্রাউন্ড ফ্লোর থেকে লিফটে ওঠে। হিসেব মত ষষ্ঠ তলায় এলো। লিফটের দরজা খুলতেই মারবেল মেঝেয় যেই পা ছোঁয়াল,নরম কিছু বিধল জুতোর তলায়। ধূসর ভ্রুঁ কুঁচকে চোখ নামাল। ফ্লোর জুড়ে ফুলের পাপড়ি দেখে বিস্মিত হলো। পরপর সামনে ফেরা মাত্রই আরো পুষ্পদল উড়ে এসে গায়ে পরল। কেউ ছিটিয়ে দিচ্ছে এমন। ধূসর সামান্য হতভম্ব হয়। পরপর ওপাশ থেকে আসে উচ্ছ্বসিত হাত তালির শব্দ। ধূসর খেয়াল করতেই দেখল সামনে অফিসের সমস্ত লোকজন দাঁড়িয়ে । মাঝে দাঁড়িয়ে তার বড় চাচা, তার বাবা। সে তাকাতেই আমজাদ সিকদার বললেন,
” ওয়েলকাম মাই সন। দাঁড়িয়ে কেন, এসো ভেতরে।”

ধূসরের বুঝতে সময় লাগেনা। অফিসে তার প্রথম দিন উপলক্ষে অভিবাদনের বিরাট ব্যবস্থা করেছেন আমজাদ। এমনকি আফতাব নিজেও জানতেন না এসব। যখন জেনেছেন অবাক হয়েছেন তিনিও। ধূসর বূট পরিহিত পা ফেলে সামনে এগোয়। পথে অফিসের সকলে তাকে ফুলের বুকে প্রদান করে শুভেচ্ছা জানায়। ধূসর মৃসূ হেসে গ্রহন করে৷ গিয়ে দাঁড়ায় বাবা এবং চাচার মাঝখানে। আমজাদ ধূসরের কাঁধ পে*চিয়ে নিলেন। সবার উদ্দেশ্যে ঘোষণা করলেন,
” সিকদার ধূসর মাহতাব! আমাদের পরিবারের বড় ছেলে। আপনাদের আফতাব স্যারের একমাত্র সন্তান। আজ থেকে এই কোম্পানির এম-ডি হিসেবে তাকে নিযুক্ত করছি আমি।

ধূসর বিহ্বল হয়ে তাকাল। একিরকম বিস্ময় আফতাবের চেহারাতেও। ফের ঘন তালির বর্ষন হলো। আমজাদ সিকদার ধূসরকে বললেন,
” এসো।”

তকতকে কেবিনের সামনে এসে থামেন তারা। দরজায় লাল ফিতে টানটান করে বাঁ*ধা। আমজাদ ট্রে থেকে কেঁ*চি তুলে ধূসরের হাতে দিলেন। বললেন, ” কা*টো।”

ধূসর দ্বিরুক্তি না করে ফিতা কা*টে। পা মিলিয়ে ভেতরে ঢোকে। বিশাল কেবিনের বড়সড় ফোমের চেয়ার খানা দেখিয়ে আমজাদ বললেন ” বোসো।”

ধূসর বসলনা। সে দূর্বোধ্য চাউনীতে চেয়ে থাকে। আমজাদ সিকদার খানিক অপ্রতিভ হলেন। বাকীদের দিক চেয়ে বললেন ” আপনারা এখন কাজে ফিরে যান।”

এক আদেশে প্রস্থান নিল সবাই। আমজাদ সিকদার ধূসরের পানে নেত্রপাত করে বললেন,
” কী হলো? বসো!”

” এতকিছু কেন করলেন ? কী দরকার ছিল?”
ধূসরের শীতল কন্ঠে, সোজাসুজি প্রশ্ন। আমজাদ সিকদার মুচকি হেসে বললেন,
” বা রে! তুমি এই প্রথম অফিসে এলে,সসন্মানে তোমাকে প্রবেশ করাব না? আমার ছেলে ফেলনা না কী?”

আফতাব সিকদারের চোখ চিকচিক করে উঠল। আলগোছে বাম হাত দিয়ে মুছে নিলেন তা। আমজাদ সিকদার ফের চেয়ার ইশারা করলেন ” বোসো।”

ধূসর এবারেও বসেনি। উলটে আমজাদ কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। ভদ্রলোক চমকে গেলেন। শেষ যখন ধূসরকে বিদেশ পাঠানো হয়,তখনও ছেলেটা তাকে এড়িয়ে গেছে। কারন ওকে বাড়ি ছাড়া করার মূলহোতা তিনিই ছিলেন । আজ এতগুলো বছর পর ধূসর কাছে আসায়,আমজাদ সিকদারের বক্ষে স্নেহের ঢেউ বয়। ধূসর শান্ত,তবে ভেজা কন্ঠে বলল,
” স্যরি বড় আব্বু। আম রিয়্যেলি ভেরি স্যরি!”

আমজাদ সিকদার আবেগে ভেসে গেলেন। বহুদিন পর ধূসরের মুখে পুরোনো ডাক শুনে তার কোটরে জল জমে। বুক ভা*ঙে। কিন্তু না,তার মতো দৃঢ় মানুষের কাঁ*দা চলেনা। তাই লুকিয়ে নিলেন আনন্দাশ্রু। ধূসরের পিঠে হাত বুলিয়ে বললেন,
” ইটস ওকে মাই সন!

ধূসর সরে আসে। এ পাশে দাঁড়ানো বাবার দিকে তাকায়। আফতাব তৎক্ষনাৎ ভেজা দৃষ্টি নত করে ফেললেন। ধূসর বাক্যব্যায় না করে বাবাকেও জড়িয়ে ধরল। আফতাব সিকদার,শ*ক্ত থাকতে পারলেন না। পারলেন না ভাবাবেগ আটকাতে। ছেলেকে পেঁচি*য়ে কন্ঠ ভে*ঙে কেঁ*দে ফেললেন।
মুহুর্তমধ্যে একটি নয়নাভিরাম পরিবেশের সৃষ্টি হলো। অনেকদিনের ধূলো জমে থাকা অভিমান চু*র্নবিচূ*র্ন হলো, একে অন্যের প্রতি টান,ভালোবাসায়।
___

ক্লাশ শুরু হয়নি। পিউ আগে আগে এসে বসে আছে। সামনে বিশাল মাঠ। স্কুল, কলেজ একসাথে হওয়ায় ছাত্র-ছাত্রী প্রচুর। মাঠের মধ্যেই হৈহল্লা বেঁ*ধেছে। এক কোনায় জাল টাঙিয়ে ব্যাডমিন্টন খেলছে ছেলেরা। পিউয়ের বান্ধুবি তানহা ডেকে গেল কয়েকবার। পিউ গাট হয়ে বসে রইল। প্রতিবার আপত্তি জানাল ওদের সাথে যোগ হতে। আজকেও একি কথা,তার মন ভালো নেই। কারনটাও একই’ ধূসর।’
তানহা সবশুনে বিরক্ত হয়ে বলল ” ম*র যা।”
পিউয়ের একটুও গায়ে লাগেনি কথাটা। লাগবে কেন? সে কবেই ধূসরের প্রেমে ম*রে ভূত হয়ে আছে। শুধু উলটো হয়ে, গাছে লট*কে পরা বাকী। এদিকে ক্ষুধা লেগেছে। জে*দ দেখিয়ে খেয়ে আসেনি,টিফিন ও আনেনি। ক্লাশে গিয়ে, ব্যাক থেকে টাকা এনে, তারপর ক্যান্টিনে যেতে হবে। সে অনেক পরিশ্রমের ব্যাপার বলে পিউ পা ঝুলিয়ে ওভাবেই বসে রইল। হঠাৎ পেছন থেকে একটা ফ্যাসফ্যাসে কন্ঠে ভেসে এলো,
” ভাবি!”

পিউ শুনলেও ঘুরে দেখল না। কাকে না কাকে ডেকেছে! অথচ ডাকটা ফের এলো ” ভাবি শুনছেন?”
পিউ এবারেও ফেরেনা। পেছনের মানুষটি সময় নিয়ে ডাকল ” পিউ ভাবি শুনছেন?”

চট করে ঘাড় ঘোরাল পিউ। মোটামুটি রো*গা শোকা ছেলেটাকে দেখে কপাল গোছাল। সে তাকাতেই ছেলেটি দাঁত বার করে হাসল। পিউয়ের যেটুকু সন্দেহ ছিল তাকে ডাকা নিয়ে, সব উধাও হলো হাসি দেখে। । ফটাফট উঠে দাঁড়াল। ডানে বামে দেখে নিজের দিকে আঙুল তা*ক করে শুধাল ” আমাকে বলছেন?”

ছেলেটি বলল ” জি ভাবি, আসসালামু আলাইকুম।”
জিরাফদেহী এক ছেলে, তার মত দু আঙুলের কলেজ পড়ুয়া মেয়েকে সালাম দিচ্ছে! আবার বলছে ভাবি? পিউ হতবাক হয়ে বলল,
” আমি আপনার কোন ভাইয়ের বউ?”

ছেলেটি মুচকি হেসে কয়েক পা এগিয়ে এসে বলল
” হবেন কোনও এক ভাইয়ের। আমি যে জন্যে এলাম সেটা বলি,এই পার্সেলটা আপনার জন্যে। ”

কাগজে মোড়ানো ফুডপান্ডার একটা পার্সেল ছেলেটি বাড়িয়ে ধরল। পিউ সেদিকে একবার দেখে,
চোখ পিটপিট করে বলল ” আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে,আমি কোনও কিছু অর্ডার করিনি।”

” জানিতো আপনি করেননি। ভাই করেছে,আর আমাকে বললেন পৌঁছে দিতে।”

পিউ আকাশ থেকে পরার মত করে তাকাল।
” কোন ভাই? কীসের ভাই? কার ভাই? কেমন ভাই? কী জন্যে ভাই? দেখুন ভাই, আমি আপনার ভাইকে চিনিনা। আপনার সত্যিই ভুল হচ্ছে। অন্য কারো সঙ্গে গুলিয়ে ফেলছেন আমায়। আপনি এটা নিয়ে যান।”

পিউ ঘুরে হাঁটতে গেলেই ছেলেটা ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলল,
” না না ভাবি আমি ঠিক চিনেছি আপনাকে। কী যে বলেন,ভাইয়ের ফোনে এতবার আপনার ছবি দেখলাম আর চিনব না? এটা আপনার জন্যেই। নিন ভাবি আমার খুব তাড়া আছে।”
পিউ ক*রুন চোখে তাকাল। কী ছাতার মাথা বলে যাচ্ছে এ!

কিছ বলার আগেই ছেলেটি হাতের পার্সেল ধরিয়ে দিল তার হাতে। পিউ কিচ্ছু জানতেও পারল না। এর আগেই ছেলেটি যেমন করে এলো,তেমন করেই চলে গেল। পিউ তব্দা খেয়ে চেয়ে থাকল কিছুক্ষন। দূর থেকে এতক্ষন বিষয় টা লক্ষ্য করেছে তানহা। ছেলেটা যেতেই সে ছুটে এলো। ধড়ফড় করে শুধাল,
” এটা কী রে? কী আছে?”

পিউ বিরক্তি নিয়ে বলল ” জুতো। ”
তানহা বোকা বোকা কন্ঠে বলল
” কিন্তু গায়ে তো ফুডপ্যান্ডা লেখা। ওরা আবার কবে থেকে জুতো সাপ্লাই দিচ্ছে ? ওরাতো খাবার ডেলিভারি দেয় তাইনা?”
” জানিসই যখন জিজ্ঞেস করিস কেন? আছে কোনও খাবার টাবার হয়ত।”

তানিহা মুখ ছোট করল। পরমুহূর্তেই উদ্বেগ নিয়ে বলল,
” চল খুলে দেখি।”
পিউয়েরও মনে হলো খুলে দেখা উচিত। কলেজের কমন রুম ঘেঁষে একটি সিড়ি ছাদ ছুঁয়েছে। দুজন মিলে সেখানে এসে বসল। তানহা টেনেটুনে প্যাকেট খুলল। ভেতরে পাঁচটা স্যান্ডউইচ, দু পিস চিকেন ফ্রাই দেখে আনন্দে লাফিয়ে উঠল। পিউয়ের উত্তরের আশায় না থেকে লু*ফে নিলো এক পিস। পিউ কিছু বলল না। ভাবুক হয়ে বসে রইল। তার নিউরনে কৌতুহল ছুটছে,ছুটছে প্রশ্ন। কে পাঠাল এসব?
______

পিউ টিফিন টাইমে বাড়ি এলো। আস্তেধীরে হাটতে দেখে মিনা বেগম ভয় পেলেন। কাছে গিয়ে উদ্বীগ্ন হয়ে বললেন ” তোর কি শরীর খা*রাপ লাগছে পিউ?”

পিউ ক্লান্ত কন্ঠে জবাব দিল ” না মা।”
” আজ তোর প্রিয় খাবার রেঁধেছি। ইলিশ পাতুরি। যা হাত মুখ ধুঁয়ে যায়।

” পরে খাব । এখন না..”

মিনা বেগন বিভ্রমে ডু*বে গেলেন মেয়ের হাবভাব দেখে। এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন ওর যাওয়ার দিকে। তার চঞ্চল মেয়ের মুখমণ্ডল, এত মলিন কেন?

পিউ হাত মুখ ধুঁয়ে নিচে নামল। একটু টিভি দেখলে ভালো লাগবে। কাল ধূসর বাড়িতে থাকায় একটা সিরিয়াল ও দেখতে পারেনি।

পিউ টেলিভিশন কেবল অন করার জন্য বসেছে ওমনি হাজির ধূসর। ওকে ঢুকতে দেখেই পিউ দ*মে গেল। রিমোর্টের বাটন টে*পা আঙুলটা ফিরে এলো জায়গায়। ধূসর সুম্মুখস্থ হেঁটেই যাচ্ছিল, হঠাৎই থমকে দাঁড়াল পিউকে খেয়াল করে। ভ্রঁ বাঁকিয়ে বলল,
” তুই এসময় বাড়িতে যে!”

পিউ তাকিয়েছিল। আচমকা ধূসর তাকানোয় অপ্রস্তুত হলো। জ্বিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নম্র স্বরে বলল
” শরীরটা ভালো____
কথা পুরো না শুনেই ধূসর এগিয়ে এলো। পিউ বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেল তৎক্ষনাৎ। ধূসরকে আসতে দেখেই তার কথা থেমেছে। ধূসর একদম কাছে এসে দাঁড়াল। শুরু হলো পিউয়ের বুকের দ্রিমদ্রিম শব্দ। ধূসর ঠান্ডা হাত পিউয়ের কপালে ঠেঁকাল,পরপর গলায়, গালে। চিন্তিত কন্ঠে বলল,
” কী হয়েছে?”

এই যে ধুসর ছুঁয়ে দিল, এতেই পিউয়ের সব গোলমেলে হয়। খারা*প মন মুখ লুকায়। সে অভিভূতের মতন চেয়ে চেয়ে ঠোঁট নাড়ে,
” বুক চিনচিন করছে ধূসর ভাই।”

” কী?”
পিউ নড়েচড়ে উঠল। ধূসর চোখা চোখে তাকিয়ে। সে থতমত খেয়ে বলল
” না মানে একটু মাথাব্যা*থা করছিল।”

” রোদের মধ্যে হেঁটেছিস?”
পিউ দুদিকে মাথা নাড়ল।
ধূসর মোলায়েম কন্ঠে বলল ” বেশি ব্যা*থা করছে?”
পিউ এবারেও দুপাশে মাথা নাড়ে। ধূসরের কোমল স্বর তার হৃদয় নাড়ি*য়ে দিয়েছে৷
” তাহলে এক কাপ কফি খেয়ে নে। ঠিক হয়ে যাবে। আমি বড় মাকে বলছি।”
পিউ উদগ্রীব হয়ে বলল
” চা -কফিতে হবেনা ধূসর ভাই। আমার অন্য কিছু দরকার।”

ধূসর তাকাল,
ভ্রুঁ উচাল, ” কী?”

পিউ রয়ে সয়ে বলল ” একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসতে পারলে ভালো লাগতো আরকি!”
পিউ হাসার চেষ্টা করল। ধূসর দৃষ্টি সরু করে বলল,
” বাইরে বলতে?”
” বাইরে মানে,এই যে আপনি আপুকে নিয়ে ওর ভার্সিটি যাচ্ছেন না? আমাকেও যদি সাথে নিতেন। আমিতো কখনও যাইনি। ”

ধূসর একটু চুপ থেকে বলল ” ঠিক আছে।”

পিউ ভেবেছিল ধূসরকে রাজি করাতে কাঠখড় পো*ড়াতে হবে। অথচ হলোনা। পিউ খুশি হয়ে যায়। ধূসরের যাওয়ার দিক চেয়ে দুপাশে দুলে দুলে আহ্লাদে আটখানা হয়ে বলে,
” সো সুইট অফ ইউ।”
_____

ধূসর সি এনজি ডেকেছে দেখে পিউয়ের মাথায় বাঁ*জ পরল। এতে উঠলেই তার গা গুলোয়,বমি পায়। পাশাপাশি ভীষণ রকম মেজাজ গর*ম লাগল। লোকটার তো বাইক আছে। তাতে নিলে সমস্যা কী? তার থেকেও বড় কথা বাড়িতে গাড়ি আছে, তাতেও তো যেতে পারতো তিনজন। অসহ্য না? এত বেশি বোঝে কেন ধূসর ভাই? এই লোককে ভালো না বাসলে,কবেই ইট মে*রে মাথা ফাঁটি*য়ে দিত।

পিউ মূর্তির মতন দাঁড়িয়ে দেখে ধূসর ধম*কে উঠল,
” তুই কি আসবি? না কি রেখে যাব তোকে?”

পিউ বিড়বিড় করতে করতে অনীহা সমেত এগোলো। পুষ্প আগেই উঠে বসেছে। পিউ বসল তার পাশে । হুট করে কোত্থেকে বাড়ির আঙিনায় এসে দাঁড়াল একটা সাদা রঙের গাড়ি। ধূসর বসতেই যাচ্ছিল চালকের পাশে। পরিচিত গাড়িটা দেখতেই থেমে গেল। একরকম অপ্রত্যাশিত ভাবে হাজির হয়েছে ইকবাল। গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতেই ধূসর অবাক কন্ঠে শুধাল
” তুই?”
ইকবাল দুদিকে দুহাত মেলে দিয়ে এগোতে এগোতে বলল
” আরে আমার বন্ধু, আমার জানে জিগার,আমার কলিজা, আয় আয় একটু কোলাকুলি করি।”
ইকবাল সত্যিই এসে জাপ্টে ধরে। পরপর সরে যায়। ধূসর সন্দিহান কন্ঠে বলল
” তুই এ সময় এখানে কেন?”
ইকবাল দুঃ*খী কন্ঠে বলল
” এভাবে বলছিস কেন? কাল থেকে তোকে দেখিনি বলে থাকতে না পেরে চলে এসছি। আর তুই? ছি! ধূসর ছি! এতটা অপ*মান আমায় না করলেও পারতি।”

ইকবাল শুকনো খরখরে চোখদুটো আঙুল দিয়ে মুছলো। ভাণ করল কাঁ*দছে। ধূসর বলল
” নাটক বন্ধ কর,
কেন এসেছিস তাই বল। ”

ইকবাল কাঁধ উঁচু করে বলল
” কেন আবার? এমনি। তোকে দেখতে, আর তোর ফুলটু___”

বলতে বলতে থেমে গেল ইকবাল। নজরে পরল সি -এন- জির ভেতর বসে থাকা পিউ আর পুষ্পকে। মুহুর্তে গদগদ হয়ে বলল,
” আরে পিউপিউ! কী খবর বোন ? দিনকাল কেমন যাচ্ছে?”
পিউ মৃদূ হেসে বলল,
” এইত ভাইয়া, চলছে।
ইকবাল মাথা দোলায় ” গুড,ভেরি গুড। তা তোমরা কোথাও যাচ্ছো বুঝি?”

” হ্যাঁ, যাচ্ছিতো। আপুর ভার্সিটিতে যাচ্ছি।”

ইকবাল ঘাড় একটু নিচু করল। ভেতরে বসা পুষ্পকে শুধাল ” কোন ভার্সিটিতে পড়ছো তুমি পুষ্প?”
পুষ্প চোখ না তুলে,না দেখেই জবাব দেয়,
” স্টামফোর্ডে!”

ইকবাল সোজা হয়ে দাঁড়ায়। ধূসরের পানে তাকাতেই সে গম্ভীর স্বরে বলে,
” শেষ হয়েছে তোর জিজ্ঞাসাবাদ? অনুগ্রহ করলে আসতে পারি এখন? ”

” আরে নিশ্চয়ই, যাবিতো। আসলে হয়েছে কী ধূসর, আমি না ওই ইউনিভার্সিটিতে কখনও যাইনি। আর আজ তো ফ্রিই আছি। ভাবছি তোদের সাথে যাব কী না! ”

ভেতর থেকে পিউ উৎফুল্ল হয়ে বলল ” হ্যাঁ হ্যাঁ ভাইয়া আপনিও চলুন,খুব মজা হবে তাহলে।”

ইকবাল ঠোঁট চওড়া করে বলল ” দেখলি? পিউ ও বুঝে গেল যে আমি থাকার ব্যাপারই আলাদা। তোরা আমার গাড়িতে ওঠ। আজ সবাই একসাথে ঘুরে আসব।”

ধূসর গুরুতর ভঙিতে বলল ” ঘুরতে যাচ্ছিনা,কাজে যাচ্ছি। ”

” আরে হ্যাঁ জানিতো সেটা। সমস্যা নেই, কাজ শেষ করেই ঘুরব না হয়। ”

ধূসর চোখ সরু করতেই ইকবাল বাচ্চাদের মত মুখ করে বলল,
” এরকম করছিস কেন ভাই? আমাকে সাথে নিলে কী হয়?”

ধূসর ফোস করে শ্বাস ফেলল। সি -এন- জি চালককে একশ টাকা দিয়ে বলল,
” যাবনা মামা। আপনি যান।”

পুষ্প- পিউকে বলল ইকবালের গাড়িতে উঠতে। দুজন বেরিয়ে আসে। পিউ লাফঝা*প দিয়ে উঠে যায় পেছনের সিটে। ইকবাল ড্রাইভার আনেনি আজ। সেখানে বসে ধূসর। পুষ্প পিলপিল পায়ে উঠতে গিয়ে চোখা চোখে একবার ইকবালের দিক তাকায়। ইকবাল তাকাতেই মুখ ভেঙচি দিয়ে বসে যায়। ইকবাল মাথা চুল্কে হাসে। এরপর ঘুরে এসে বসে ধূসরের পাশে। ধূসর গাড়ির ইঞ্জিন চালু করে। ধোয়া,ধূলো উড়িয়ে চারজন রওনা হয় নতুন কোনও কান্ড ঘটাতে।

চলবে।

#এক_সমুদ্র_প্রেম!
লেখনীতে : নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
(১১)

পিচঢালা রাস্তায় গাড়ি ছুটছে। ধূসর ড্রাইভার হিসেবে মন্দ নয়। ভালোই চালায়। পিউ বসেছে একদম বরাবর ওর পেছনে। ধূসরের গাল ছাড়া কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছেনা। পিউ খুশখুশ করল কিছুক্ষন। ভিউ মিররের কথা মনে পড়তেই চট করে তাকাল সেদিকে। ওইতো স্পষ্ট প্রতিবিম্ব ভেসে আছে ধূসরের। পিউ মুচকি হেসে চেয়ে থাকে সেদিকে। হঠাৎ খেয়াল পরে ড্রাইভ করতে করতে ধূসর আয়নার দিকে কয়কবার তাকাচ্ছে। পিউয়ের খটকা লাগে। কী দেখছে ধূসর ভাই? পিউ হিসাব মেলাতে বসল। যোগ বিয়োগ করে ফলাফল যা পেল অত্যুজ্জ্বল হয়ে উঠল তাতে। তার এখান থেকে ধূসর কে দেখা যাচ্ছে মানে, ধূসরের ওখান থেকে ওকে দেখা যাচ্ছে নিশ্চয়ই। এর মানে ধূসর ভাই তাকেই দেখছিল? পিউ আনন্দে নেঁচে ওঠে। মনে মনে লাফায়। খুব কষ্টে শান্ত হয়ে বসে রয়।

ইকবাল এসি বন্ধ করে জানলা খুলে দিল। শনশন বাতাস ছুঁয়ে গেল মুখমণ্ডল। ইকবালের ফুরফুরে মেজাজ আর গাঢ় হয়। ঠোঁট ফুলিয়ে শীষ বাজায় সে। তারপর গলা ছেড়ে গান ধরে,
” এই পথ যদি না শেষ হয়,তবে কেমন হবে তুমি বলোতো।
যদি পৃথিবীটা স্বপ্নের দেশ হয়,তবে কেমন হবে তুমি বলোতো!”

পেছন থেকে পিউ মজা করে বলল ” তুমিই বলো।”
ইকবাল শব্দ করে হেসে উঠল। ঘাড় ঘুরিয়ে ওর দিক ফিরে বলল,
” বুঝলে পিউ,তুমি আমার নিজের বোন হলে বেস্ট হতো। আমাদের দারুন মিল। তাছাড়া আমাদের মধ্যে একটা ব্যাপার আছে,যা অন্যদের মধ্যে নেই।”

শেষ টুকু বলতে বলতে ইকবাল পুষ্পর দিকে তাকায়। পুষ্প দ্বিতীয় ভেঙচি কা*টে তখনি। থতমত খেয়ে চোখ ফেরায় সে। পাশ থেকে ধূসর বলল,

” তোর মুখটা কিছুক্ষন বন্ধ রাখ ইকবাল। ”
ইকবাল ভ্রুঁ কুঁচকে বলল ” কেন, কেন?”
” কানের পাশে এভাবে মশা ঘ্যানঘ্যান করলে,ড্রাইভ করা যায়?”
পুষ্প এতপথ দুশ্চিন্তায় ডু*বে ছিল। অথচ ধূসরের কথাটুক শুনেই ফিক করে হেসে ফেলল। ইকবালের ঠোঁট উল্টে-পাল্টে এলো। মুখ ছোট করে পিউকে বলল
” আমার হয়ে কিছু বলবে না পিউপিউ?”
পিউ ওর টান ধরে কিছু বলতে হা করল এর আগেই ধূসর বলে ওঠে
” ও কী বলবে? ওটা কী কম,সে তোর আরেক স্বজাতি। ”
পিউ হা করে তাকাল। পরপর দাঁত কটম*ট করল। ইকবাল ভ্রুঁ কপালে তুলে বলল,
” পিউ তোমাকে মশা বলেছে ধূসর! আমাকে বলেছে ঠিক আছে,কিন্তু তোমার মত এত মিষ্টি মেয়ে শেষে কী না মশা? এটা কি মানা যায়?”

পিউ হাঁ*সফাঁ*শ করল। তবে যুক্তিসঙ্গত উত্তর পেলোনা। ঠিক কী বললে ধূসরকে যথাযোগ্য পঁচানি দেয়া যাবে সেটা ভাবতে ভাবতেই ভার্সিটির দোরগোড়ায় গাড়ি থামে। ওমনি পুষ্পর বুক দুরদুরানি শুরু হয়। বার কয়েক শুকনো ঢো*ক গেলে সে। কী যে আছে ভাগ্যে!

ইকবাল সবার আগে নামল। পরপর বাকীরা। পিউ নেমেই ভার্সিটির উঁচু ভবন দেখে বলল,
” আইলা! কত সুন্দর রে আপু।”

ধূসর গাড়ি একদম পার্কিং লটে রেখে এসে দাঁড়াল ওদের পাশে। পুষ্পকে শুধাল,
” ডিপার্টমেন্ট হেডের রুম কোন দিকে?”

পুষ্প ফের ঢোক গি*লে বলল,
” সামনে গেলেই পরবে।”
” চল । ”

পিউ উৎস্যুক নেত্রে আশপাশ দেখছে। প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি। তার ক্ষুদ্র জীবনে প্রথম বার এলো কোনও ভার্সিটি চত্বরে। একেকটা ভবন এত বিশাল,ঘুরে ঘুরে দেখতে গেলেও মাথা ভোঁ ভোঁ করে ঘুরবে। হঠাৎ তার পাশ কা*টিয়ে দুটো ছেলে চলে গেল। বেখেয়ালে একজনের সঙ্গে খানিক ছুঁইছুঁই হলো পিউ। তবে শরীরে স্পর্শ লাগেনি। এর আগেই সচেতন দুরুত্বে সরে গেছে সে।
ধূসর যাওয়ার জন্যে পা বাড়াতে বাড়াতেও দৃশ্যটা দেখে থেমে দাঁড়াল। ভ্রুঁ কোঁচকাল। চারপাশ দেখল সতর্ক চোখে। আশেপাশে গিজগিজ করছে ছেলেরা। কেউ কেউ এদিকেই দেখছে। তক্ষুনি ইকবাল ডাকল,
” ধূসর একটু শুনে যা।”

ধূসর তাকালে ইকবাল সাইডে আসতে ইশারা করল। মেনে নিল ধূসর। ইকবাল তার কাঁধ পেঁ*চিয়ে চলে এলো এক কোনায়। ফিসফিস করে অনেক কিছু বলল। হাত নেড়ে নেড়ে কত কথা বোঝানোর পর ধূসর সব শেষে মাথা নাড়ে। পিউ সেদিকে কপাল গুঁছিয়ে চেয়ে থেকে পুষ্পকে বলল,
” এরা কী বলছে বলতো!”
পুষ্প চেঁ*তে বলল,
” তাতে আমার কী? যা মন চায় তাই বলুক। তোর মনে সুখ আছে তুই দ্যাখ। আমি বাঁচিনা আমার জ্বা*লায়,উনি এসছেন কে কী বলছে তা নিয়ে।’

পিউ নিজেও ভেবে দেখল কথাখানা সঠিক। তার নিজেরও উচিত বোনের দুঃ*খে দুঃ*খী হওয়া। কিন্তু হঠাৎ একটা চিন্তা টোকা দিল মস্তকে। সে কৌতুহল নিয়ে বলল,
” আচ্ছা আপু,রেজাল্ট খা*রাপ হলে তো স্কুল কলেজে অভিবাবক ডাকে। ইউনিভার্সিটি তে ডাকে কেন? তাহলে স্কুলের সাথে ভার্সিটির তফাৎ রইল কই?”

পুষ্প চিবুক গলদেশে ঠেকাল। চোখ খিঁ*চে বুজে ফের খুলল। মনে মনে বলল,
” তোকে কী করে বোঝাব,রেজাল্ট নয়, আমি শেষ চার মাস ধরে একটা ক্লাস ও করিনি বলে ডেকেছেন।”

মুখে আমতা- আমতা করে বলল,
” সে আমি কী জানি! হয়ত আব্বুর পরিচিত বলেই ডেকেছেন। ”

পিউয়ের যুক্তি পছন্দ হয়৷ বুঝতে পেরেছে এমন ভঙিতে মাথা দোলায়। এর মধ্যে ফিসফিসানি ইতি ঘটে ইকবালদের। দুজন এগিয়ে আসে। ইকবালের ঠোঁটের দীর্ঘ হাসি দেখে পুষ্পর গা- পিত্তি জ্ব*লে ওঠে। সে আছে চি*ন্তায়,আর এই লোকের দাঁত ক্যালানি দেখো!

ধূসর কপালের পাশ চুল্কে বলল,
” পুষ্প,তুই ইকবালের সাথে যা। আমি আর পিউ এখানে থাকছি।”
পুষ্প অবাক চোখে তাকালে ইকবাল বাম চোখ টি*পল। ভড়কে গেল সে। পিউ ছট*ফটে কণ্ঠে বলল,
” কেন, আমরা যাব না ধূসর ভাই?”
” না।”
পিউয়ের মুখ ছোট হয়ে আসে।
ধূসর ইকবালকে বলল,” যা। কী বলে জানাস।”
ইকবাল আলোড়িত কন্ঠে আওড়াল,
” আরে ভাবিস না,ওদের হেড মাস্টার যা যা বলবেন একেবারে গড়গড় করে এসে বলব তোকে।”

ধূসর বলল,
” গর্দভ! হেড মাস্টার না,ডিপার্টমেন্ট হেড উনি।”
ইকবাল কাঁধ নাঁচিয়ে বলল,
” ওই একই,আগেপিছে হেড তো আছে।”
ধূসর হেসে বলল ” বুঝেছি, যা।”
ইকবাল ভদ্র ছেলের মত পুষ্পকে রাস্তা দেখিয়ে বলল, ” চলো আপু।”

পুষ্প বাধ্য মেয়ের মত হাঁটা ধরল সামনে। পেছনে পা ফেলে ইকবাল। ধূসর দাঁড়িয়ে থাকে,পাশে পিউ। তার মনটাই খা*রাপ হয়ে গেছে। নাঁচতে নাঁচতে এলো অথচ কিছুই শুনতে পাবেনা বলে কৃষ্ণবর্নে ছেঁয়ে গেল আনন। ঠিক তখনি ধূসর তার এক হাত মুঠোতে নেয়। পিউ চকিতে তাকায়,আশ্চর্য হয়। ধূসর শান্ত কন্ঠে বলে,
” চল,ওদিকে যাই।”

****
ধূসরদের ছাড়িয়ে, মোটামুটি সচেতন দুরুত্বে এসেই পুষ্প জোড়াল ঘু*ষি বসাল ইকবালের বাহুতে। আচমকা হাম*লায়,ব্যা*থায় মু*চড়ে উঠল সে। হাত ডল*তে ডল*তে বলল,
” কী হলো?”
পুষ্প ক*টম*ট করে বলল,
” আমি তোমার আপু?”
” আরে ওটাত ধূসরের সামনে বলেছি। যাতে ও সন্দেহ না করে। নাহলে আমার সন্টুমন্টুটাকে আমি আপু ডাকব কোন দুঃ*খে! ”
পিউ ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,
” চুপ করো, একটা কথাও বলোনা। তুমি একটা বা*জে, স্বার্থ*পর লোক।”
ইকবাল বিস্ময়াবহ হয়ে বলল,
” আমি আবার কী করলাম?”
পুষ্প হাঁটা রেখে দাঁড়িয়ে গেল। কোমড়ে হাত দিয়ে বলল,
” কী করোনি তাই বলো। এই যে আমি ক্লাস মিস দিয়েছি বলে স্যার ডেকে পাঠিয়েছেন,কার জন্যে হয়েছে এসব? ক্লাশ ফাঁকি দিয়ে কার সঙ্গে ঘুরেছি আমি? কে নিয়েছে ঘুরতে? তুমিইতো! তাহলে সেই তুমি কী করে আমার বিপ*দে পাশে না থেকে মিরজাফর হয়ে গেলে ইকবাল? কখন থেকে বত্রিশটা দাঁত দেখিয়ে বেড়াচ্ছো, একবারও খেয়াল করেছ আমায়? বুঝেছো আমার মনের অবস্থাটা?”

সব কটা কথা পুষ্প ইমোশোনাল হয়ে বলল। অথচ ইকবাল হেসে ফেলল । হাসি দেখে পুষ্প আহ*ত হয়। অভিমানে চোখ ভিজে আসে। ইকবাল তখন গাল টে*নে আদুরে কন্ঠে বলল,
” মাই লাভ, আপনি কী সারাজীবনে বোকাই থেকে যাবেন? ”
এই যে আমি মানুষটা কী মাত্রাধিক ব্যস্ততায় দিন কা*টাই। এখন আবার ধূসর অফিস জয়েন করেছে, শ্বাস ফেলার ও জো নেই। অথচ সেই আমি সব কাজবাজ ফেলে আজ ছুটে এলাম। ইনিয়েবিনিয়ে আপনাদের সাথে এসেছি এ অবধি,কেন? আপনার জন্যেইতো!”

পুষ্প প্রথম দফায় অবিশ্বাস্য চোখে তাকাল। পরমুহূর্তেই মুখ বেঁ*কিয়ে বলল,
” মিথ্যে কথা।”
” মিথ্যে নয় জানেমন,একদম দুই শতভাগ সত্যি। ”
পুষ্প ভ্ররু উঁচিয়ে বলল,
” ও তাই? তা এসে কী করতেন আপনি? ধূসর ভাইতো আসতেই যাচ্ছিলেন সাথে। তারপর কী ভেবে এলেন না। যদি আসতেন? ”

ইকবাল আনন্দ চিত্তে আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলল,
” আমি জানতাম ও আসবে না। এমন টনিক দিয়েছি ওকে। আরে শুরু থেকেই ভাবছিলাম কী বলে ওর আসা আটকাব আর আমি যাব তোমার সাথে। এখানে এসে এমন জব্বর উপায় পেয়েছি না!”
” কী উপায়?”
পুষ্পর আগ্রহ দেখে ইকবাল চমৎকার হেসে বলল,
” পরে বলব মাই লাভ,চলো আগের কাজ আগে সাড়ি।”
পুষ্প মাথা দোলায়। দুজনে হেঁটে এসে থামে নির্দিষ্ট কামড়ার সামনে। পুষ্প বিনয়ী হয়ে প্রশ্ন পাঠায়,
” উড আই গেট ইন স্যার?”
_____

পিউ ক্ষনে ক্ষনে ধূসরের ধরে রাখা হাতের দিকে তাকাচ্ছে। প্রতিবারই লজ্জ্বায় আড়ষ্ট হচ্ছে। হচ্ছে লাল- নীল। মুচকি হেসে নিজেই মাথা নোয়াচ্ছে। তুলছে আবার। ধূসর সুদৃ*ঢ় হস্তে ধরেছে,যেন পিউ আসা*মী। ছাড়লেই পালাবে। তবু পিউয়ের এতেই শান্তি। তার ধূসর ভাই ধরেছেতো, ছুঁয়েছে তাকে। এই হাত পারলে সে আলমারিতে তুলে রাখতো। ভরে রাখত সিন্দুকে। তবে হ্যাঁ, আপাতত এক সপ্তাহ এই হাতখানা কাউকে ছুঁতেই দেবেনা। ধূসরের স্পর্শ মুছে যাবে যে। পিউয়ের কত দিনের স্বপ্ন,ধূসরের হাত ধরে আকাশ দেখবে। হাঁটবে সুদীর্ঘ পথ। সেই স্বপ্ন পূরন,কোনও না কোনও ভাবে হচ্ছে তো আজ । এই যে হাঁটছে। দেখছে মাথার ওপর খোলা সাদা আকাশ।

কিছুটা পথ হেঁটে এসে ধূসর ক্যান্টিনের সামনে থামল। পিউ কৌতুহলি হয়ে বলল,
” আমরা কি এখন খাব ধূসর ভাই?”
ধূসর তাকাল, ” খিদে পেয়েছে তোর?”
পিউ ফটাফট দুদিকে মাথা নেড়ে বোঝাল ‘ না’।

এর মধ্যে ধূসরের ফোন বাজে। অন্য হাতেই ছিল। ধূসর রিসিভ করল৷ কথা বলায় ব্যস্ত হলো। সময় এগোচ্ছে। ওদিকে পুষ্প আর ইকবালের দেখা নেই। এদিকে ধূসরের কথা শেষ হওয়ার নাম নেই।
পিউ মহাবি*রক্ত হয়ে পরল। দাঁড়িয়ে থেকে থেকে অস*হ্য সে। ধূসর গুরুতর বিষয় নিয়ে আলাপে মত্ত। রাজনৈতিক ব্যাপার স্যাপার। পিউয়ের মোটা মগজে ওসব ঢুকলোনা। সে ঘাড় চুল্কে ‘চ’ বর্গীয় শব্দ করল। ধূসর তখন এমন ভাবে বলেছিল ” চল ওদিকে যাই।” পিউ ধরেই নিল স্বর্গে যাচ্ছে । কিন্তু সে এসে দাঁড় করাল এখানে।
পিউ আস্তে করে জিজ্ঞেস করল,
” ভেতরে গিয়ে বসব?”
ধূসর কথার এক ফাঁকে জবাব দিল ” না।”

পিউ ওষ্ঠ ফুলিয়ে শ্বাস ফেলে। এখানেই কী দাঁড়িয়ে থাকবে তবে? ভেতরে গিয়ে বসলে কী হয়?
ধূসর ফোন নামাল কান থেকে। উশখুশ করতে থাকা পিউকে দেখে বলল,
” কোনও সমস্যা?”
পিউ এবারেও মাথা নাড়ল। ধূসর চোখ ছোট করে বলল,
” তোর মুখ নেই পিউ? বোবা তুই?”

” বোবা হলে বুঝি খুশি হতেন?”
ধূসরের বিরক্তি নিয়ে বলল,
” এসব আজগুবি কথাবার্তা কোত্থেকে আমদানি করিস? ”
পিউ নিষ্পাপ চাউনিতে তাকাল। যেন ভাজা মাছ উলটে খেতে জানেনা। কিছুক্ষন পর,ধূসর নরম কন্ঠে শুধাল,
” চা খাবি?”
পিউ চটপট সামনে পেছনে মাথা দোলায়। খাবে সে। ধূসর ভাইয়ের সাথে চা খাওয়ার এই দারুন মুহুর্ত কিছুতেই হাত ছাড়া করা যাবেনা। এতক্ষনে ধূসর হাত ছোটাল।
ক্যান্টিনের কাছে গিয়ে বলল চা দিতে। পেছন থেকে মুগ্ধ চোখে চেয়ে রইল পিউ। ঠোঁটের সবদিক জুড়ে হাসি বিস্তৃত। ধূসরের চওড়া কাঁধ,যে কোনও রঙের শার্ট ফুটে ওঠে পড়নে। দেখলে তার অক্ষিদ্বয় জুড়িয়ে আসে, শীতল হয়। তার হুশ,লাজলজ্জা কে*ড়ে নেয়া মানুষটা কবে একান্ত ওরই হবে! কেউ যদি একটু বলে দিত এসে। সেই আগন্তুকের পায়ে জান লুটি*য়ে দিত পিউ।

দেখতে দেখতে ধূসর চা নিয়ে এলো। ওয়ান টাইম কাপে উষ্ণ চা ধোঁয়া ছাড়ছে। কাছাকাছি আসতেই পিউ হাত বাড়াল ধরতে। ধূসর দিলোনা। হাস্যহীন চেহারায় বলল,
” অনেক গ*রম,হাত পুড়*বে। একটু ঠান্ডা হোক,তারপর নিস।”

পিউয়ের অন্তঃস্থল তৃপ্ত হয়ে আসে। ধূসরের এই সামান্য যত্ন টুকু তার কাছে ঠিক কী,কেউ বুঝবেনা। একদমইনা। সে চোখ নামিয়ে লাজুক হাসে।

ক্ষানিকক্ষন বাদে, ধূসর কাপের চারপাশে আঙুল ছোঁয়াল। পরীক্ষা করল কতটা কী গর*ম। বুঝেশুনে পিউকে বলল,
” নে ধর।”
পিউ মোহিত লোচনে চেয়েছিল ওর দিকে। কথাটায় নড়েচড়ে উঠে বলল ” হু? কিছু বললেন?”
ধূসর ভ্রুঁ বাঁকাল,
” মা*র খাবি?”
পিউ তৎপর ঘনঘন মাথা ঝাকিয়ে বলল
” না না। ”
” তাহলে ধর!”
পিউয়ের গোলগাল চেহারা ফের সংকীর্ন হয়। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে চুমুক বসায়। ওমনি ছ্যাঁ*কা লাগে জ্বিভে। ” আহ” বলে ঠোঁট চে*পে ধরে। ধূসর অসহায় চোখে তাকাল।
” তুই কী কোনও দিন ঠিক হবিনা পিউ? হাত যাতে না পুড়ি*স সেজন্যে এতক্ষন কাপটা দিইনি,অথচ জ্বিভ ঠিকই পুড়*লি।”
পিউ নিজের প্রতি নিষ্পৃহায় শ্বাস ফেলল। সে ঠিক কী করে হবে? প্রেমে পড়লে ঠিকঠাক থাকা কোন প্রেমিকার সাধ্যি? যা ভয়*ঙ্কর প্রেমলীলায় মেতেছে গত তিন বছর যাবৎ,পা*গল হয়নি সেই বেশি।
***

পিউ আরেকদিক চেয়ে চেয়ে চা খাচ্ছে। হঠাৎই মনে পড়ল ধূসর ভাইতো চা নেয়নি। একটা কাপইতো আনলেন।
চটজলদি ফিরে তাকাল জিজ্ঞেস করবে বলে। কিন্তু ধূসর পাশে নেই। পিউ ডানে বামে দেখে সামনে তাকাতেই’ থ ‘বনে গেল বিস্ময়ে। তার প্রিয় ধূসর ভাই লাই*টার দিয়ে সিগারেট ধরাচ্ছেন। পিউ নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারল না। বাম হাত দিয়ে কচলে আবার তাকাল। তখনও স্পষ্ট ভাবে দেখল ধূসর সিগারেট টানছে। রীতিমতো নাক মুখ দিয়ে ধোয়া বেরোচ্ছে তার। ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে গেল পিউ। আর্তনা*দ করে বলে,
” একী! ধূসর ভাই আপনি সিগারেট খান?”
পিউ যতটা উদ্বোলিত,ধূসর ততটাই নিরুত্তাপ। ধীরস্থির জবাব দেয় ,
” হ্যাঁ কেন? তোর কোনও সমস্যা?”

পিউ উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইল। তার মন তিঁমিরে তলি*য়ে। যে সিগারেট তার দু চোখের বি*ষ,জন্মের পর বাপ চাচা কাউকে ছুঁতেও দেখেনি। সেই সিগারেট কী না, ধূসর এইভাবে টানছে? পিউয়ের অন্তকরনের পরতে পরতে ধেঁয়ে গেল মন খারা*পের স্রোত।

ধূসর হঠাৎই ডেকে ওঠে,
” পিউ!”
হিমশীতল আওয়াজ। পিউ তাকাল,ধূসর আরেকদফা ধোঁয়া উড়িয়ে বলল,
” তোর আঠের বছর হবে কবে?”
” যেদিন জন্মদিন, সেদিন,তাইনা পিউ?”
পেছন থেকে উচ্ছ্বসিত উত্তর দিতে দিতে এসে দাঁড়াল ইকবাল। পেছনে বিড়াল ছানার মত পিলপিলে পুষ্প। তার চেহারায় তখনও ভ*য় স্পষ্ট। ধূসর সিগারেট ফেলে জুতো দিয়ে পি*ষে দেয়। এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে,
” কী বলল?”
ইকবাল গা ঝাড়া ভঙিতে বলল,
” আরে তেমন কিছুনা। পুষ্পর একবার জ্বর হয়েছিল না কী? মা*রাত্বক, ভ*য়াবহ জ্বর?
ধূসর ক্ষনশ্বর ভেবে বলল,
” হ্যাঁ। ”
” তখন তো ও ক্লাশ এটেন্ড করতে পারেনি। তাই পার্সেন্টেজ কম এসেছে কিছুটা। সে নিয়েই কথা বলেছেন।”
ধূসর সন্দেহী কন্ঠে বলল ” এতটুকু বলতে অভিবাবক ডাকবে কেন?”

পুষ্প আ*তঙ্কে গুঁ*টিয়ে গেছে। ইকবাল যা বলছে ঘটনার আগামাথা মিল নেই। ডিপার্টমেন্ট হেড উলটে ক*ড়া কন্ঠে হু*শিয়ারী দিয়েছেন ওকে। চল্লিশ পার্সেন্টের ও কম উপস্থিতি হলে পরবর্তী পরীক্ষায় বসতে দেবেন না জানিয়েছেন। লোকটা আমজাদ সিকদারের পরিচিত। কী করে, কীভাবে পুষ্প জানেনা। আর পরিচিত বলেই সরাসরি এ্যাকশন না নিয়ে আগে অভিবাবক ডেকেছেন তিনি। নাহলে এ ধরনের ঝামে*লায় শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় বসতে জান বেরিয়ে যায়। ঝড় যা গেছে ইকবালের ওপর দিয়ে। ধূসরের পরিচয় দিয়েছে সে। আমজাদ সিকদার বলে রেখেছিলেন তো, ” ভাইয়ের ছেলেকে পাঠাবেন।” সে সুযোগটাই লুফে নিয়েছে দুজন। আর এখন বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যেও বলছে। ভাগ্যিশ গত মাসের শেষে দিকে জ্বরটা বাধিয়েছিল। কী বলতো নাহলে এখন?

ধূসরের কথায় ইকবাল তৎক্ষনাৎ উত্তর দিতে পারেনা। কথা খোঁজার ছুঁতোয় দাঁত বের করে হেহে করে হাসল। ধূসর চোখ গুছিয়ে বলল,
” গাঁধার মতো হাসছিস কেন?”
” তুই গাঁধাকে হাসতে দেখেছিস কখনও? ”
” না,গাঁধাকে দেখিনি,তোকে দেখেছি।”
ইকবালের হাসি দপ করে নি*ভে গেল। পুষ্প ঠোঁট চে*পে আরেকদিক চেয়ে হাসল।
ধূসর একটু চুপ থেকে বলল,
” আমি নিজে একবার কথা বলে আসি। এই সামান্য কারনে অভিবাবক ডাকার মত কারন পাচ্ছিনা।”

পুষ্পর হাসি বন্ধ৷ ধূসর যাবে শুনতেই আঁত*কে উঠল শঙ্কায়। ধূসর পা বাড়ানো মাত্রই ইকবাল লাফিয়ে পথ আগলে দাঁড়াল।
” তুই আমায় বিশ্বাস করিস না ধূসর?”
ধূসর মুখের ওপর বলল ” না ”
ইকবাল দুই ভ্রুঁ উঁচিয়ে বলল,
” এই তোর বন্ধুত্ব ধূসর! এই আমি তোর ছোট বেলার বন্ধু? এই তুই আমাকে ভালোবাসিস? আজ বুঝলাম,যাকে বিশ্বাসই করিস না তাকে আর কীসের ভালোবাসা,কীসের বন্ধুত্ব। ঠিক আছে,যা,যাচাই করে আয় আমি সত্যি বলেছি না মিথ্যে। তারপর এসে আমার গর্দান ছে*দ করিস ওকে?”

পুষ্প আবেগে গলেগলে পরল। ইকবালের কথায় তার চোখ ভরে আসে প্রায়। মানুষটা কী ক*ষ্টই না করছে ওর জন্যে। ইকবাল মারা*ত্মক মুখভঙি তে কথাগুলো বলল। আরেদিক তাকাল অভিমান করে। ধূসর ঠোঁট ফুলিয়ে শ্বাস ফেলে বলল,
” গাড়ি নিয়ে আসি,দাঁড়া।”

ধূসর চলে যায়। পুষ্পর চেহারা উজ্জ্বল হয়ে আসে। বিজয়ের হাসি হেসে ইকবালের পানে তাকায়। ইকবাল চোখ দিয়ে আশ্বস্ত করে। পুষ্প বুক ভরে শ্বাস টানে। যাক,বাঁচা গেল। তারপর খেয়াল পরে সামনে দাঁড়ানো পিউকে। পুষ্প কপাল গুঁটিয়ে বলল,
” এই পিউ, ওখানে কী করছিস,এদিকে আয়।”
পিউ নড়েচড়ে ওঠে। যেন ধ্যানে ছিল এমন। মাথা নামিয়ে এগিয়ে আসে। ইকবাল আনন্দ সমেত শুধায়,

” কী ব্যাপার পিউপিউ,কী ভাবছিলে এত?”
পিউ হাসার চেষ্টা করে দুপাশে মাথা নাড়ে। এর মধ্যে ধূসর হাজির হয় গাড়ি নিয়ে৷ উঠে বসে ওরা।

আসার সময় সারা পথে পুষ্প গোম*ড়া মুখে ছিল।সে এবার প্রফুল্ল চিত্তে, অথচ উলটে গেল পিউ। চুপচাপ জানলার দিক চেয়ে বসে আছে। জানলা খোলা,হুহু করে হাওয়া আসছে ভেতরে। পিউ ক্ষনে ক্ষনে দীর্ঘকায় শ্বাস ফেলছে । ধূসর সিগারেট খায়,বিষয়টা জেনে একটুও ভালো লাগছেনা। কেন সব বদভ্যেস তার ওই মানুষের মাঝেই থাকতে হবে? ধূমপান করে কতশত রো*গ হয়,সে কি জানেনা?
” হাত সরা পিউ।”
গুরুগম্ভীর স্বরে পিউ হুশে এলো। জানলা থেকে হাত বাইরে ঝুলিয়ে বসেছিল। ধূসর বলতেই চট করে ভেতরে আনল। তাকাল ভিউ মিররের দিকে। ধূসরের চোখ সামনে, তাহলে বুঝল কী করে তার হাত কোথায় ছিল?

ইকবাল হঠাৎই বলল ” তুমি এত চুপ করে গেলে কেন পিউপিউ?’
পুষ্প শুধাল, ” তোর কি শরীর খা*রাপ লাগছে?”
” না,ঠিক আছি আমি।’

ওদের ফিরতে প্রায় বিকেল গড়িয়েছে। রাস্তার পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে অসংখ্য স্ট্রিট ফুডের ভ্যান। পুষ্পর আগে থেকেই যা ভীষণ পছন্দ। জ্বিভে জ্বল চলে এলো দেখে দেখে। কিন্তু ধূসরকে বললে কোনও দিন খেতে দেবেনা এসব৷ বলবে অস্বাস্থ্যকর, অপরিষ্কার। কিন্তু আইসক্রিমের ভ্যান দেখে পুষ্প আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। গাড়ির মধ্যে থেকেই চেঁ*চিয়ে উঠল,
” ভাইয়া আইসক্রিম খাব।”
ধূসর স্টিয়ারিং ঘোরাতে ঘোরাতে বলল,
” এই ঠান্ডায়? ”

” কিচ্ছু হবে না ভাইয়া। প্লিজ, আমার খেতে মন চাইছে খুব। ও ভাইয়া আমি আপনার সব কথা শুনিনা? সেই ভদ্রতার খাতিরে তো একটা আইসক্রিম পেতেই পারি।”

ইকবাল ও সায় দিয়ে বলল, ” একটা আইসস্ক্রিম তো বন্ধু। থামা না গাড়িটা।”
ধূসর হার মানল। ব্রেক কষ*ল রাস্তার একপাশে নিয়ে। ইকবাল আগে আগে নেমে গেল৷ বলল
‘আমি নিয়ে আসছি। ”

পুষ্পও নেমে গেল গাড়ি থেকে। পরপর ধূসর,আস্তেধীরে নামল পিউ।
সে গিয়ে এক কোনে দাঁড়াল রাস্তার। ধূসর আড়চোখে পিউকে দেখতে দেখতে ফোন বার করে পকেট থেকে। ইকবাল দুহাতে দুটো আইসক্রিম এনে ধূসরকে বলল,
” ভাংতি আছে রে ধূসর? আমার কাছে আস্ত নোট, নিচ্ছেনা।”
” আমি দিচ্ছি।”
ধূসর ভ্যানের দিকে এগিয়ে যায়। ইকবাল ওর যাওয়া দেখে চোখ সরিয়ে পুষ্পর দিক তাকায়। আইসক্রিম বাড়িয়ে বলে,
‘ নাও,তোমার ফেব্রেট ম্যাংগো ফ্লেভার।”
পুষ্প গদগদ হয়ে বলল ” থ্যাংক ইউ।”
ইকবাল হাসল। পিউয়ের দিকে চোখ পড়লে বলল,
” ওর হঠাৎ কী হয়েছে বলোত?”
” জানিনা, বুঝতে পারছিনা।”
” দাঁড়াও ওকে আইসক্রিম টা দিয়ে আসি।”

ইকবাল পিউয়ের কাছে গিয়েই শুধাল,
” তোমার কী মন খা*রাপ পিউ?”
পিউ মৃদূ কণ্ঠে বলল,
” না তো ভাইয়া।”
” তাহলে চুপ করে কেন,তুমিতো এমন নও।”
পিউ অল্প হাসে। ইকবাল জোর করল
” কী হয়েছে আমাকে বলো। ধূসর কিছু বলেছে? ”
” না,না।”
ইকবাল মেকি চোখ রা*ঙিয়ে বলল,
” বলবেনা আমায়?”
পিউ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
” আচ্ছা ভাইয়া,উনি সিগারেট কবে থেকে খান?’
” কে ধূসর?”
” হু।”
ইকবাল আকাশ থেকে পরে বলল,
” কই,ধূসরতো এসব খায়না।”

” আপনি বন্ধুর হয়ে মিথ্যে বলছেন,আমি নিজে খেতে দেখেছি।”
ইকবাল কিছু একটা ভেবে বলল,
” তোমার বুঝি স্মোকিং পছন্দ না?”
” একটুওনা। আচ্ছা,উনি কি ড্রিংকও করেন? ”
পিউয়ের কাতর কণ্ঠ। ইকবাল বুঝে উঠল না কী বলবে। তার জানামতে ধূসর তো এসব হাবিজাবি ছুঁয়েও দেখেনা। সে নিজে কতবার সেধেছে,তাও ধরেনি। তাহলে আজ হঠাৎ!
ইকবালের মাথায় ঢুকলনা কিছু। এই ধূসরটা যে কী করতে চাইছে কে জানে! তবুও পিউয়ের মন ভালো করা জরুরি। তাই বলল,
” তুমি আমায় বিশ্বাস করছোনা পিউ? ধূসর কিন্তু সত্যিই এসব খায়না।”
পিউ বড় করে দম ফেলল। একটু দূরের কালো কুকুরটাকে দেখে দুষ্টুমি করে বলল,
” আচ্ছা,ওকে বলতে বলুন,ও যদি বলে যে ধূসর ভাই এসব খায়না,তবেই মেনে নেব।”
ইকবাল তব্দা খেয়ে বলল,
” এ্যা?”
পিউ মিটিমিটি হাসল। ইকবাল ওর মন ঘোরাতে কুকুরটার দিকে চেয়ে আইসক্রিম দেখিয়ে বলল,
” কী পিউয়ের বন্ধু, খাবে?”
পিউ প্রতি*বাদ করবে এর আগেই কুকুরটা খাবার দেখে ঘেউ করে উঠল। ওটা যে বরফখণ্ড,খেতে পারবেনা সে কী আর প্রানীটা বোঝে! পিউয়ের মেরুদণ্ড সোজা হয়ে এলো তৎক্ষনাৎ। ভয়া*র্ত নেত্রে কুকুরটার দিক তাকাল। রীতিমতো বসা থেকে উঠে আসছে ওটা। এই কুকুরে পিউয়ের ভীষণ ভ*য়। কাম*ড়ে দিলেই চৌদ্দটা ইঞ্জেকশন। যেখানে একশ হাত দূরে কুকুর দেখলেও কাঁ*পে, সেখানে এগিয়ে আসতে দেখে পিউয়ের ঘাম ছুটে যায়। মোটামুটি
কাছে আসা মাত্রই পিউ চিৎকার ছুড়ল,
” আয়ায়ায়ায়া”
পরপর প্রবল বেগে ছুটল লাগাল। ওকে দৌড়াতে দেখে পেছন পেছন কুকুরটাও ছুটল। পরপর ঘটনা গুলোয় আহাম্মক বনে গেল ইকবাল। পিউ যেদিক দুচোখ যায় ছুটছে, সাথে গলা ফা*টিয়ে ডাকছে,
” ধূসর ভাই, আয়ায়া আপু,আয়ায়া ধূসর ভাই…. ”

পিউয়ের গলা শুনে বিদ্যুৎ বেগে ফিরে তাকাল ধূসর। ওকে এভাবে নাকমুখে ছুটতে দেখে তাজ্জব হলো। পরপর খেয়াল পরল পেছনে ধা*ওয়া করা কুকুরের দিকে।
” ও শীট!”
এবার একিরকম ছুট লাগাল সেও। ইকবাল,পুষ্প সব ছুটছে। আশেপাশের গুটিকতক মানুষ দেখছে তাদের ছোটাছুটি । ধূসর ছুটতে ছুটতে সাব*ধান করছে
” পিউ দাঁড়া,পিউ ছুটিস না। পিউ শোন….”

পিউয়ের কানে একটা কথাও ঢুকলনা৷ সে পেছন ফিরে একবার কুকুরটাকে দেখে, আর দৌড়ের গতি বাড়িয়ে দেয়। ঘেউ ঘেউ করতে করতে ছোটা কালো কুকুর দেখে তার প্রান ওষ্ঠা*গত। উল্টোপথ থেকে রিক্সা আসছিল। পিউ বেখেয়ালে ছুটতে গিয়ে ধা*ক্কা লাগে তাতে । হুম*ড়ি খেয়ে পরে রাস্তায়। রিক্সার সামনের চাকা উঠে যায় পায়ের ওপর। ধূসর দেখতেই চেঁচিয়ে ওঠে,
” পিউ! ”
ইকবাল ঢিল ছু*ড়ল কুকুরের গায়ে। লেজ তুলে পালাল সেটা। পিউ পা চে*পে বসে পরেছে। রিক্সাচালক ভ*য় পেলেন। পাব্লিকের গণধোলাইয়ের থেকে বাঁচতে তাড়াহুড়ো করে রিক্সা সমেত ভেগে গেলেন।
পিউ কেঁ*দে ফেলল ব্যা*থায়। র*ক্ত পরছে আঙুল দিয়ে। ধূসর হাওয়ার বেগে ছুটে এসে হাটুমুড়ে বসল। উদ্বিগ্ন হয়ে,হাঁস*ফাঁ*স করে বলল,
” কোথায় লেগেছে? এখানে? ব্যা*থা করছে খুব? ও গড! কতবার বলেছি কুকুর দেখলে দৌড়াবিনা? ”
পিউ নাক টানল। ধূসর আহ*ত পা হাতে তুলে করুন চোখে চেয়ে রইল। পকেট থেকে রুমাল বের করে চে*পে ধরল ক্ষত*তে। ইকবাল এসে সেও বসে পরল পাশে।
” শুধু শুধু কেন ছুটতে গেলে?তুমি না ছুটলে ওতো তোমাকে তাড়া করতোনা। ”
পিউ কেঁ*দে কেঁ*দে বলল,
” আমি কী করব ভাইয়া, কুকুর দেখলে আমার পা ঠিক থাকেনা আপনা আপনি ছোটে।”
ধূসরের মেজাজ খারা*প হলো। ক*ষে এক ধম*ক দিল,
” চুপপ। ”
পিউ চুপসে গেল। এই অবস্থায়ও ধূসর ভাই ধম*কাচ্ছেন তাকে? কী নি*ষ্ঠুর! নি*র্মম!
এতক্ষনে পৌছাতে পারল পুষ্প। পিছিয়ে ছিল সে। বোনের পা থেকে র*ক্ত বের হতে দেখেই তার মাথা ঘুরে আসে। এমনিতেই কা*টাছেঁ*ড়া দেখতে পারেনা। তাও কোনও রকম তাকাল পিউয়ের কান্নারত চেহারায়৷ পিউকে কাঁদ*তে দেখে সেও কেঁ*দে ফেলল। এদিকে নাকের জল চোখের জল এক হয়ে গেছে পিউয়ের।
ধূসর কে*টে যাওয়া আঙুল শক্ত করে চে*পে ধরেছে। তারপর ব্যস্ত কণ্ঠে বলল,
” গাড়িতে ফার্স্ট এইড বক্স আছেনা ইকবাল?”
” আছে, আছে।”
” বের কর।”
ইকবাল উঠে গেল।
ধূসর পুষ্পর ফ্যাঁচফ্যাঁচ কা*ন্নায় বিরক্ত হয়ে বলল,
” তুই কাঁ*দছিস কেন?”
পুষ্প ওড়না নিয়ে নাক মুছে বলল
” ওরতো ব্যা*থা করছে ভাইয়া।”
ধূসর অতিষ্টতায় মাথা নাড়ল।
পিউ ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদ*ছিল। আচমকা ধূসর কোলে তুলল তাকে। হকচ*কিয়ে গলা জড়িয়ে ধরল পিউ। পুরো বিষয়টা মাথায় ঢুকতেই, কা*ন্নাকা*টি বন্ধ,ব্যা*থা শেষ। পিউ বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। চোখ কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসে প্রায়। বিস্ময়াবিষ্ট হয়ে ধূসরের পানে তাকায়। ধূসর ভাই তাকে কোলে তুলেছেন? এ কি সত্যি না কী কল্পনা?
পিউকে দুহাতে নিয়ে গাড়ির দিকে হাঁটা ধরল ধূসর। পেছনে পা মেলাতে মেলাতে আসছে পুষ্প। পথে বোনকে সান্ত্বনা দিচ্ছে ” কিছু হবেনা, কমে যাবে।”
পিউয়ের ওসবে মনোযোগ নেই। সে অবাক লোচনে ধূসরের শ্যামলা চেহারায় চেয়ে থাকতে ব্যস্ত। হাঁটার মধ্যেই ধূসর ফোস করে নিঃশ্বাস ফেলে। পিউয়ের ডাগর ডাগর চোখের দিকে তাকায়। নিরেট স্বরে বলে,
” এত জ্বা*লাস কেন আমায়?”

চলবে,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে