#একমুঠো_বসন্ত
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_১৮
রাহান কফিটা হাত থেকে টেবিলে রাখলো। অদূরে নদীর দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ নিহিলার দিকে এক ফলক তাকালো। নিহিলার দিকে দৃষ্টি আবদ্ধ রেখে মেয়েটির উদ্দেশ্যে বলে উঠল,
“কিছু বলার আছে ?”
মেয়েটি এতক্ষন রাহানের মুখের দিকেই তাকিয়ে ছিল। সে ভেবেছিল রাহান তাকে ফর্মালিটি রক্ষার জন্য হলেও বসতে বলবে কিন্তু না। সামনের সিট্ এর মেয়েটা উঠে যাওয়ার পরেও রাহান তাকে বসতে বললো না। অথচ ঐ মেয়েটা সরে গেছে। রাহানের আবারো ভ্রু কুঁচকালো। তা দেখে মেয়েটি বোকা বোকা হাসলো।
“না অফিসের চেনা তাই ভাবলাম।”
“অফিস আর বাইরে গুলিয়ে ফেলেছেন আপনি। কাজের জায়গা আর বাইরের জায়গা আলাদা। আমি এই আলাদা জায়গা রাখতেই পছন্দ করি। দুই জায়গা সংমিশ্রণ করতে সাচ্ছন্দবোধ করি না।”
মেয়েটি অপমানবোধ করলো। এই একটা মানুষকে নিজের মতো আকর্ষণ করার জন্য কত কিছুই না করলো অথচ এতো দিনে অফিসের সব ছেলেরা তার হাতের মুঠোয় আসলেও যার জন্য এতকিছু সেই ফিরে তাকালো না। মেয়েটি ভাবলো, আচ্ছা মানুষটার মতো সুন্দর বিকল্প অনেক ছেলেই তো তার হাতের মুঠোয় এসেছে। তবুও সে এই মানুষটার পেছনে পড়ে আছে! হয়ত সবাই তার প্রতি আকর্ষণ হয়েছিল কিন্তু এই মানুষটার আচার আচরণ ভিন্ন। তার দিকে অফিসের প্রায় মানুষ তাকাতে বাধ্য হয়েছে কিন্তু এই মানুষটা ছাড়া। তাই বোধহয় মনের ভেতর জেদ চেপে গিয়েছে।
মেয়েটিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রাহান এক কর্মচারীকে ডাক দিল।
রাহান মেয়েটিকে সামনের সিটে বসতে বলে জিজ্ঞেস করলো,
“কী নিবেন?”
মেয়েটি খুশি হয়ে গেল। সে তো এটাই চাচ্ছিল। ভীষণ আগ্রহের সহিত উত্তর দিল ও কফি খাবে। রাহান কর্মচারীকে তা বলে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।
“এ কী কই যাচ্ছেন?”
“আগ বাড়িয়ে এসেছেন যখন ভদ্রতা হিসেবে কফি অর্ডার দিয়েছি। খেয়ে যাবেন।” বলেই মেয়েটিকে ওভাবেই ভাবনার ধ্যানে রেখে রাহান এগিয়ে একদম রেলিং এর পাশে নিহিলার কাছে আরেকটা চেয়ারে বসে পড়লো।
নিহিলাও এগিয়ে এসে বসতেই রাহান কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে সামনের দিকেই দৃষ্টি রেখে প্রশ্নবোধক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“কী ব্যাপার?”
“কিছুই না, স্পেস করে দেওয়া প্রয়োজন মনে হয়েছে বিধায় চলে গিয়েছি।”
রাহান জবাব না দিয়ে মোবাইলের স্ক্রিনে দৃষ্টি দিল।
নিহিলা তাকালো।
“আপনি তো ঠিকই অন্যদের মতো। তাহলে অরিন আহান এতো এমন কেন বলে?”
“কেমন বলে?”
“এই যে অন্যদের চেয়ে আলাদা। গম্ভীর।”
“এটা ওদের ভাবনা।”
“ওদের ভাবতে বাধ্য করেন। নিজেকে এমন করে উপস্থাপন করার কী আছে!”
“আর কী বলে!” রাহান স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলো।
“সেটা ওদের সাথে মিশলেই জানতে পারতেন। আমার কাছ থেকে কেন জানতে চাচ্ছেন।”
“কথা যে তুলেছে তার থেকেই জানতে চাইলাম।”
নিহিলা দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। সে পাশেই বহমান শান্ত নদীটির দিকে দৃষ্টি নিঃক্ষেপ করলো।
“এই যে অন্যদের থেকে আলাদা। মেয়েদের সাথে কথা বলেন না। আকর্ষণ নেই।”
“চাইলে দেখিয়ে দিতে পারি আকর্ষণ আছে কী নেই।” বলতেই নিহিলা স্তব্ধ দৃষ্টিতে রাহানের দিকে তাকালো। তার ভাবনাতে আসেনি এই মানুষটা এমন কথা বলবে! সে তো এমনি মানুষটাকে নাড়িয়ে দেওয়ার জন্য কথাগুলো বলেছিল। নিহিলা দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল।
“এমন গম্ভীর মুখে আপনার এমন কথা মানাই না।”
“কেমন কথা?”
নিহিলা বিরক্ত হওয়ার ভান করে উঠে দাঁড়ালো। সে ভেবেছিল তার উঠে যাওয়াতে রাহানও উঠে দাঁড়াবে কিন্তু না। ছেলেটা ঠিকই নিজের মতো করে কফির কাপে চুমুক দিচ্ছে।
“আশ্চর্য!বাসায় যাবেন না?”
“তোমাকে কি আটকে রেখেছে?”
নিহিলা না পারতে আবারো সামনে বরাবর একই জায়গায় বসে পড়লো। আজকের এই মানুষটা আর এতদিনের মানুষটাকে সে গুলিয়ে ফেলছে।
কফি শেষ করে রাহান উঠে দাঁড়ালো। নিহিলা নিজের আত্মসম্মান নিয়ে বসে রইল। আগেরবার সে উঠার পরেও মানুষটা নিজের মতো করে ছিল তাহলে এইবার সে উঠবে না। নিহিলা তাকিয়ে আছে। রাহান এগিয়ে গেল। মানুষটা তাকে ডাকলোও না। নিহিলা আশেপাশে তাকালো। না, এখন এতো ইগো নিয়ে থাকতে পারবে না। কোন সময় অঘটন ঘটে যায়। নিহিলাও পিছু পিছু গাড়িতে উঠে পড়লো।
———-
রাতে খাবার খেয়ে রুমে আসতেই রিহি একটু পরে ঢুকলো। তা দেখে নিহিলা ভ্রু কুচকাল।
“কী ব্যাপার রিহি? ঘুমাবি না?”
রিহি কাচুমাছু ভঙ্গিতে নিহিলার দিকে তাকালো।
“আজ আমি আমার রুমে থাকবো।”
“কেন? কী ব্যাপার বলতো?”
“আসলে, নিকের সাথে একটু পার্টিতে যাবো।”
“কী বলিস?এতো রাতে ফুপীরা জানতে পারলে কী হবে জানিস?”
“আরে দূর। আহান ভাই সবসময় এসবে থাকে। আর এগুলো এখানে স্বাভাবিক। আর কেউ জানতেও পারবে না। ভোরের আগেই আমি চলে আসবো। কাউকে বলিস না।” বলেই রিহি নিহিলাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বেরিয়ে গেল। নিহিলা কী করবে ভেবে উঠে পারছে না।
কিছুসময় পরে মোবাইলে মেসেজের শব্দে ধ্যান ফিরতেই সে মোবাইলের দিকে দৃষ্টি দিল। মেসেজটা রিহির নাম্বার থেকেই এসেছে। লিখেছে যেন নিহিলা চুপচাপ থাকে।
নিহিলার ইচ্ছে করলো রিহিকে এসব থেকে দূরে সরাতে কিন্তু সে অতিরিক্ত আগ বাড়িয়ে কিছু বলতে গেলেই হিতে বিপরীত হবে ভেবে মাথা শান্ত রাখার চেষ্টা করলো। কিন্তু এসব সে সহ্যও করতে পারছে না।
নিহিলা মায়ের নাম্বারে কল দিয়ে বেশ কিছুক্ষন কথাবার্তা বললো।
“আচ্ছা, ঠিকমতো পড়ছিস তো মা? ঠিকমতো পড়াশোনা করবি। আজ রাখছি। ভালো থাকিস।” বলেই রেহেনা বেগম মোবাইল রেখে দিল।
রেহেনা বেগমের শেষ কথাটা নিহিলার মনে প্রভাব ফেলল। আসলেই কী? সে কী ঠিকমতো পড়ছে? সে তো এখানে পড়াশোনা করতে এসেছিল। এসব ভাবনা আর ঘোরাঘুরির জন্য তো আসেনি! সাফাত ভাইয়ের অনুভূতি ভুলতে পেরেছে ঠিকই কিন্তু আর পড়াশোনাটাই তো ও করতে পারছে না। নিহিলা মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল। এমন করলে তো চলবে না। তার পড়াশোনা করতে হবে।
সকালে নাস্তা সবার সাথে বসেই করলো নিহিলা। যদিও সবাই বলতে যদিও রাহান ভাই ছিল না। তিনি অফিসের কাজে প্রায় এমন বাইরে যান।
নাস্তা করে অরিন আহান যে যার রুমে চলে যেতেই নিহিলা রিনা আহমেদের দিকে তাকালো। এই একটা মানুষকে আগে রাজি করাতে হবে। উনি যদি রাজি হয় তাহলে নিহিলার কাজ হয়ে যাবে।
নিহিলা নাস্তার এটো প্লেটগুলো নিয়ে রিনা আহমেদের পিছু পিছু রান্নাঘরে ঢুকলো। তা দেখে রিনা আহমেদ নিহিলার মুখের দিকে তাকিয়ে এগিয়ে এলেন,
“কিছু বলবি মা?”
নিহিলা হাতে থাকা নাস্তার প্লেটগুলো রাখলো।
“ফুপি আমি একটা কথা বলবো। রাখবে তো?”
“হ্যাঁ, অবশ্যই রাখবো। বল।”
নিহিলা তার হাত বাড়িয়ে দিল।
“আগে কথা দাও।”
“এই যে দিলাম।”
“ফুপি, আমি চাইছি হোস্টেলে উঠে যেতে।”
“সে কী! কেন? কোনো সমস্যা হচ্ছে?”
“আরে না ফুপি। এখন তো চিনে গেছি। আমি মাঝে মাঝে আসবো। তুমি কিন্তু কথা দিয়েছো। না বলবে না।”
রিনা আহমেদ রাজি হলেন না। নিহিলা বেশ কিছুক্ষন বোঝানোর পরে তিনি মুখ ভার করে রাজি হলেন।
“ঠিক আছে। সবসময় এসে এসে দেখে যাবি আমাকে।”
রিনা আহমেদের এই একটা কথায় নিহিলা সস্তির শ্বাস ফেলল। নিহিলা রিনা আহমেদকে জড়িয়ে ধরলো। সে ভাবলো, যেভাবেই হোক তার আজ কালের মধ্যে চলে যেতে হবে। অবশেষে সে এসব থেকে দূরে সরবে। সে মন দিয়ে পড়াশোনা করবে। আর কারোর প্রতি কোনো অনুভূতি আনবে না। এসব আজেবাজে ভাবনা আর মাথায়ও আনবে না। বাকী দিনগুলো হোস্টেলেই কাটিয়ে দিবে।
#চলবে ইন শা আল্লাহ।