এই মন তোমাকে দিলাম পর্ব-০৬

0
2434

#এই_মন_তোমাকে_দিলাম
#পর্বঃ০৬
#Arshi_Ayat

প্রিয়মের পরিচয় পেয়ে আকাশ মনে মনে ভয় পাচ্ছে।প্রিয়ম যদি সব জেনে যায় তবে এতোদিন যেটার ভয় পাচ্ছিলো সেটাই হবে।

আকাশের বিচলিত মুখ দেখে প্রিয়ম আকাশের মুখের সামনে চুটকি বাজিয়ে বলল”আমার পরিচয় তো জানলেন।এবার আপনার পরিচয় বলুন।আর এভাবে সিনক্রিয়েট করার কারণটাও বলুন।”

আকাশ পরিস্থিতি সামলানোর জন্য বলল”আমি রুহির হাজবেন্ড।আর ওর সাথে আমার একটু মনোমালিন্য হয়েছে।আমি ওকে নিয়ে যেতে এসেছি।আপনি দয়া করে আমাদের স্বামী স্ত্রীর মধ্যে আসবেন না।”

এটা বলেই আকাশ রুহির হাত ধরে আবার টানতে লাগলে।টানতে টানতে রুহিকে জোর করে নিচতলায় নিয়ে আসলো।রুহি ছাড়ানোর চেষ্টা করছে।প্রিয়মের মনে হচ্ছে এখানে বিষয়টা অন্যকিছু।আকাশকে কিছুতেই সুবিধার ঠেকছে না প্রিয়মের।প্রিয়মকে চুপ করে দাড়িয়ে থাকতে দেখে আনোয়ার সাহেব বললেন”প্রিয়ম,আমার মেয়েটাকে বাচাও।এই ছেলেটা আমার মেয়েটাকে শেষ করে দিচ্ছে।”অনেকটা অসহায় দৃষ্টিতে বললেন।প্রিয়ম নিচতলায় গিয়ে আকাশের সামনে গিয়ে ওকে থামিয়ে দিলো।প্রিয়মকে দেখে আকাশ রেগে বলল”আপনাকে না বললাম আমাদের মধ্যে আসবেন না।সরুন সামনে থেকে।”

“আমি কি করবো না করবো সেটা আপনাকে জিগ্যেস করবো না ওকে?আর আপনি ওনার হাত ছাড়ুন।উনি যদি স্বেচ্ছায় যেতে চান তবে আমি আপনাদের আটকাবো না।কিন্তু এর আগে আপনি ওনাকে কোনো রকমের জবরদস্তি করতে পারবেন না।”

প্রিয়মের কথায় আকাশ রুহির হাত ছেড়ে দিয়ে ওর দিকে চোখ রাঙিয়ে ইশারা দিলো যেনো কোনোরকম ভেজাল না করে।রুহি আকাশের চোখ রাঙানিতে ভয় পেয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে রইলো।প্রিয়ম এবার রুহিকে উদ্দেশ্য করে বলল”আপনি ভয় পাবেন না।আপনি নিঃসঙ্কোচে বলুন আপনি কি আপনার স্বামীর সাথে যেতে চান?”

রুহি পিছনে তাকিয়ে দেখলো ওর বাবা মা ওর দিকে তাকিয়ে আছে।রুহি বাবা মায়ের দিকে একবার তাকিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে প্রিয়মকে বলল”আমি যেতে চাই না ওর সাথে।ও আমার বাচ্চাকে মেরে ফেলতে চায়।ও বাচ্চাটা রাখতে চায় না।কিন্তু এই বাচ্চাটা আমি চাই।আপনি কিছু করুন।আপনি চলে গেলে ও আমার বাচ্চাকে মেরে ফেলবে।”বলতে বলতেই রুহি কেঁদে দিলো।রুহির এভাবে সবকিছু ফাঁস করে দেওয়াতে আকাশের চেহারায় কাঠিন্য নেমে এলো।রাগে সব ভুলে গেলো।দাঁত কিড়মিড় করতে করতে রুহির হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে যেতে লাগলো।বেশিদূর যেতে পারে দুইপা এগোনোর সাথে সাথেই ওর মুখে একটা ঘুষি পড়লো আচমকাই।আকাশ টাল সামলাতে না পেরে রুহির হাত ছেড়ে দিয়ে মুখ চেপে ধরে বসে পড়লো।প্রিয়ন শক্ত হাতের ঘুষিটা বেশ জোরেশোরেই লেগেছে আকাশের মুখে।আকাশের এমন অবস্থা দেখে রুহির খারাপই লাগছে কিন্তু সে কিছুই বলছে না।বলারই বা কি আছে!অন্যসময় হলে ঠিকই প্রতিবাদ করতো।কিন্তু আজ পরিস্থিতিটা অন্য।পেছন থেকে আনোয়ার সাহেব আর রুনা বেগম রুহির সাথে এসে দাড়ালেন।রুহি মায়ের কাঁধে মাথা রেখে কান্না করে দিলো।আর রুনা বেগম মেয়ের মাথায় হাত দিয়ে রাখলেন।

আকাশ ঘুষি খেয়ে দুইমিনিটের মাথায় উঠে দাড়িয়ে যে-ই প্রিয়মকে আক্রমণ করতে যাবে প্রিয়ম আকাশের পেট বরাবর হাটু দিয়ে আঘাত করলো।আকাশ পেট ধরে দূরে সরে গেলো।প্রিয়ম আকাশের কাছে এসে ওর কলার ধরে বলল”পুলিশ এমনি এমনি হয় নি।সো যা করবি সাবধানে করবি।”

বলে প্রিয়ম আশেপাশে তাকিয়ে একটা দড়ি পেলো দাড়িটা দিয়ে শক্ত করে আকাশের হাত পা বেধে থানায় ফোন দিলো।
————————
অরুণী ক্যাম্পাসে এসে দেখলো প্রণয় বন্ধুদের সাথে দাত কেলাচ্ছে।অরুণী ওর কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল”কি বলবেন বলেন।”

প্রণয় অরুণীর দিকে তাকিয়ে বন্ধুদের ইশারা দিলো চলে যাওয়ার জন্য।বন্ধুরা চলে যাওয়ার পর প্রণয় বলল”কেমন আছো অরুণী?”

“ভালো।”

“জিগ্যেস করলে না আমি কেমন আছি?”

“প্রয়োজন মনে করি না।” অরুণী কাটখোট্টা ভাবে জবাব দিলো।

“তুমি এতো কঠিন কেনো অরুণী?”

“আমি এমনই।”

“একটু নরম স্বরে কথা বললে কি হয়?

” আমি বলতে পারি না।”

এতটুকু বলে অরুণী ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আবার বলল”কিছু বললে তাড়াতাড়ি বলুন।আমার ক্লাস আছে।”

অরুণীর এমন ব্যাবহার প্রণয়কে কষ্ট দেয় কিন্তু তবুও প্রণয় হাসিমুখে মেনে নেয়।ওই যে কথায় বলে না ভালোবাসা মানুষকে সব কিছু শেখায়।তেমনই প্রণয়ের ক্ষেত্রেও হয়েছে।প্রণয় কষ্ট পেলেও মুখে হাসি বজায় রেখে বলল”আজ আমার জন্মদিন অরুণী।”

অরুণী ভেবে পাচ্ছে না তো জন্মদিন হলে ওকে বলার কি আছে?অরুণী তবুও ভদ্রতার খাতিরে বলল”শুভ জন্মদিন।”

বলেই প্রণয়কে কিছু বলতে না দিয়ে হাঁটা ধরলো ক্লাসরুমের দিকে।প্রণয় মন খারাপ করে অরুণীর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো।

অরুণী যাওয়ার পরই প্রণয়ের বন্ধুরা চলে আসলো।বন্ধুরা সবাই জানে প্রণয় অরুণীকে ভালোবাসে।এটা নিয়ে প্রণয়কে প্রচুর খোঁচা মারে।এবারও ব্যাতিক্রম হয় নি।বন্ধুমহলের মধ্যে মিনহা প্রণয়কে খোঁচা মেরে বলল”দোস্ত তোর কি এমন বললো যে তোর মুখ এমন চুপসানো।”

প্রণয় মাথা নেড়ে বলল”বেশি বকবক করবি না।চল তোদের ট্রিট দেই।”

ট্রিটের কথা শুনে ফারদিন বলল”চল মামা চল।আজকে পুরা একবছরের খাবার একসাথে খাবো।”

ফারদিনের কথায় বাকি বন্ধুরাও হেসে দিলো।
——————
প্রিয়ম আকাশের হাত বেঁধে থানায় কল করে রিসাদকে আসতে বলল।রিসাদ হলো প্রিয়মের সহকারী।রিসাদ আসতেই প্রিয়ম ওকে থানায় নিয়ে লকাপে ঢুকাতে বলেছে আর ওর নামে একটা জিডি করতে বলেছে।রিসাদ আকাশকে আর দু চার ঘা লাগিয়ে নিয়ে গেলো।আকাশকে নিয়ে যেতেই প্রিয়ম আবার রুহিদের ড্রয়িং রুমে এসে বসলো।সামনে রুহি আর রুহির বাবা মা বসা।প্রিয়ম ই প্রথম শুরু করলো”আঙ্কেল ঘটনাটা যদি একটু খুলে বলতেন তবে ওকে শায়েস্তা করতে সুবিধা হতো।”

রুহি মলিন কন্ঠে বলল”আকাশ আর আমার বিয়ে তিনবছর আগে হয়।পরিবার থেকে সম্পর্ক মেনে না নেওয়ায় আমরা পালিয়ে বিয়ে করি।তারপর আর বাবা মার সাথে যোগাযোগ হয় নি।আকাশের বাসায়ই থাকতে শুরু করলাম।বিয়ের পরের দিনগুলো খুব একটা ভালো না গেলেও একবারে খারাপ যাচ্ছিলো না।তারপর আমাদের প্রথম বাচ্চা যখন আসে আমার গর্ভে তখন আকাশ বলল ও বাচ্চা রাখবে না।এখনো নাকি বাচ্চা নেওয়ার সময় হয় নি।আমার কাছে অনেক রিকুয়েষ্ট করে বাচ্চাটা এবোরশন করালো।সে বার আমি কিছু বলি নি।খুব কষ্ট পেয়েছিলাম।একরকম ডিপ্রেশনেই পড়ে গেছিলাম।ওই ঘটনার প্রায় একবছর পর তিন চার দিন আগে জানলাম আমি আবার কন্সিভ করেছি।খবরটা আকাশকে জানানোর পর আকাশ আবার আগের মতো শুরু করলো সে এই বাচ্চাটা রাখবে না।আমার সাথে খারাপ ব্যাবহার শুরু করলো।তারপর আমি যখন আমার জায়গায় অনড় ছিলাম তখন ও ছলনার আশ্রয় নিয়ে আমাকে হসপিটালে নিয়ে যায় এবোরশন করানোর জন্য।সেটা আমি কোনোভাবে জানতে পেরে এক নার্সের সহযোগীতায় পালিয়ে আসি।আর এখন বর্তমানে এখানেই অবস্থান করছি।”
সবকিছু বলতে বলতেই ওর কপল বেয়ে পানি পড়তে লাগলো।রুহি নিজেকে সামলে নিলো।প্রিয়ম আশ্বাস দিয়ে বলল”আপনি চিন্ত করবেন না।আপনার বাচ্চা ক্ষতি হবে না।আমরা আকাশের বিরুদ্ধে থানায় জিডি করে রেখেছি।ও এখন আর আপনার বাচ্চার ক্ষতি করতে পারবে না।”
তারপর বসা থেকে উঠে দাড়িয়ে আনোয়ার সাহেবকে সালাম করে বলল”স্যার আসি।”

আনোয়ার সাহেব বলল”না বাবা একটু বসো।নাস্তা করে যাও।তোমার সাথে তো তেমন কথাই হলো না।”

প্রিয়ম হালকা হেসে বলল”স্যার আমি বাসা থেকেই নাস্তা করে এসেছি।আরেকদিন আসবো।এখন থানায় যেতে হবে।”

তারপর প্রিয়ম চলে যেতেই রুহি নিজের ঘরে ফিরে গিয়ে বালিশ ধরে কাঁদতে লাগলো।আর আনোয়ার সাহেব হতাশ ভঙ্গিতে নিজের ঘরে চলে গেলেন।রুনা বেগমও কিচেনে চলে গেলেন।
———————
অরুণী ভার্সিটির সামনে থেকে রিকশা নিলো রুহিদের বাড়ি যাওয়ার জন্য।এখন বিকেল চারটা।সন্ধ্যা পর্যন্ত সে আর রুহি একসাথে ঘুরবে।

এদিকে প্রণয় অরুণীকে পুরো ভার্সিটি এরিয়া খুঁজেও পেলো না।ওর বন্ধুরা বলল অরুণী চলে গেছে।প্রণয়ের মন খারাপ হলো।প্রতিটাদিন অরুণী এমন করে।প্রণয়কে ফাঁকি দিয়ে চলে যায়।প্রতিদিনের মতো আজও প্রণয় মন খারাপ করে বাড়ির দিকে রওনা হলো।

অরুণী রুহিদের বাসার সামনে এসে দরজা নক করতেই রুনা বেগম খুলে দিলেন।অরুণী মিষ্টি হেসে বলল”আন্টি রুহি কি করে?”

“শুয়ে আছে।সকাল থেকে কিছুই খায় নি।”

অরুণী রুহির ঘরের দিকে যেতে যেতে রুনা বেগমকে বলল”আন্টি দুই প্লেট ভাত দেন।আমিও খাই নি।আমি আর রুহী একসাথে খাবো।”

রুনা বগেম মুচকি হেসে কিচেনে চলে গেলেন।আর অরুণী রুহির ঘরে এসে দেখে রুহি চোখের ওপর হাত দিয়ে শরীর টান করে শুয়ে আছে।অরুণী রুহির মাথায় হাত দিতেই রুহি চোখ থেকে হাত সরিয়ে মলিন হেসে বলল”কখন আসলি?”

“মাত্রই।তুই নাকি সারাদিনে কিছু খাস নি?”

“আমার আবার খাওয়া!” রুহি তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল।

“থাপ্পড়িয়ে তোর চাপার দাঁত ফেলে দেবো।না খেয়ে থেকে কি বোঝাতে চাস যে তোর মতো দুখী আর কেউ নেই?আরে খোঁজ নিয়ে দেখ তোর চেয়েও শত কষ্টে মানুষ হাসিমুখে বেঁচে আছে।তাহলে তুই কেনো পারবি না?তুই মানুষ না?আর না খেয়ে থাকলে কি সব ঠিক হয়ে যাবে?কেনো নিজের শরীর কে কষ্ট দিচ্ছিস আর এখন তো তুই একা নেই সাথে তোর বাচ্চাটাও আছে।নিজেও কষ্ট পাচ্ছিস ওকেও দিচ্ছিস।এমন হলে এবোরশন ই করে ফেল।কি দরকার তোদের রেশা রেশির স্বীকার এই মাসুমকে করার।ওর তো কোনো দোষ নেই তবে ওকে কেনো কষ্ট দিবি?তোর ওকে কষ্ট দেওয়ার কোনে হক নেই।” অরুণী প্রচন্ড রেগে কথাগুলো বলল।তারপর ব্যাগ নেই রুহির ঘর থেকে চলে যেতে নিলেই রুহি দ্রুত উঠে অরুণীকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল”সরি,আর এমন হবে না।আমি আর না খেয়ে থাকবো না।প্লিজ রাগ করিস না।কথা বল।”

অরুণী রুহির দিকে তাকিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে বলল”ওয়াদা?”

“ওয়াদা।”
তারপর দুইবান্ধুবী কান্না করে দিলো।এর মধ্যেই রুনা বেগম খাবার নিয়ে চলে এলো।ওরা দুইজনই ফ্রেশ হয়ে খেতে বসে পড়লো।খাওয়ার মাঝখানেই রুনা বেগম অরুণীকে সকালের ঘটনাটা বলল।অরুণী সব শুনে দাত কিড়মিড় করে বলল”আমও থাকলে ওর যে কি করতাম আমি নিজেও জানি না।বেয়াদব, অসভ্য।”

আরো কিছুক্ষণ গালাগালি করে অরুণী খাওয়া শেষ করলো।তারপর দুইবান্ধবী বেরিয়ে পড়লো।
——————-
সারাদিনে আকাশের খবর না পেয়ে নাতাশা কিছুটা চিন্তিত!আকাশ কি কিছু করতে পারলো কি না কে জানে!

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে