এই মন তোমাকে দিলাম পর্ব-০১

0
6414

#এই_মন_তোমাকে_দিলাম♥️
#পর্বঃ০১
#Arshi_Ayat

“আকাশ আমি পারবো না বাচ্চা নষ্ট করতে।এর আগেও তোমার জন্য একটা বাচ্চা নষ্ট করেছি।এবার তুমি আমাকে দিয়ে এটা করাতে পারবে না।”রুহি রেগে বলল।
“দেখো রুহি আমাদের এখনো বাচ্চা নেওয়ার সময় হয় নি।আর এই বাচ্চার খরচ আমি নিতে পারবো না।”

“কেমন বাবা তুমি?যে বাচ্চা বাচাতে চাও না।আর আমাদের বিয়ে তিনবছর হয়ে গেছে।আর কতো সময় লাগবে তোমার বলো?তোমার মা প্রতিটা দিন আমাকে বলে বাচ্চা হয় না কেনো?আমার কি কোনো সমস্যা আছে কি না।আমি কিছু বলি না।এই বাচ্চাটার কথা শুনলে মা অনেক খুশী হবে।তুমি প্লিজ বাচ্চাটাকে নষ্ট করতে বলো না।” রুহি আকাশের দিকে হাতজোড় করে অনুরোধ করলো।

“না,কিছুতেই না।এই বাচ্চা রাখা সম্ভব না।আর মাকে আমি বোঝাবে।তুমি কালই আমার সাথে ডাক্তারের কাছে যাবে।”

“কখনো না।আমি মরে গেলেও যাবো না।”রুহি চিল্লিয়ে বলল।

আকাশের মেজাজ গরম হয়ে গেলো।আকাশ ঠাটিয়ে এক চড় মেরে রুহির চুলের মুঠি ধরে নিজের মুখের সামনে এনে বলল” আমিও দেখি তুই বাচ্চা কিভাবে রাখিস।”

এটা বলে রুহিকে সজোরে ছুড়ে ফেলে হনহনিয়ে চলে গেলো আকাশ!রুহি ড্রেসিং টেবিলের সাথে বাড়ি খেয়ে মাথায় প্রচন্ড ব্যাথা পেলো।প্রচন্ডে কষ্টে চোখ থেকে পানি বেরিয়ে পড়লো।তবে শারীরিক আঘাতে রুহির চোখ দিয়ে পানি বের হয় নি।আঘাতটা ভেতরের!যার ক্ষত কাউকে দেখানো সম্ভব নয়।

তিনবছর আগে পালিয়ে বিয়ে করেছিলো আকাশ আর রুহি।দুজন দুজনকে ভিষণ ভালোবাসতো।সেই ভালোবাসার জোরেই বিয়েটা হয়েছিলো।তখন আকাশের সবে মাত্র চাকরী হয়েছিলো কিন্তু রুহি ইন্টার দ্বীতিয় বর্ষের ছাত্রী ছিলো।দুজনের চোখেই রঙিন স্বপ্ন ছিলো।কেউ কাউকে ছাড়া অন্য কিছু কল্পনা করতে পারতো না।হঠাৎ একদিন বিষয়টা রুহির পরিবারের সবাই জেনে যায়।আর রুহির বিয়ে ঠিক করে।কিন্তু রুহি সেদিন রাতেই আকাশের সাথে পালিয়ে যায়।তারপর আকাশের বন্ধুদের উপস্থিতিতে বিয়েটা হয়।প্রথম প্রথম আকাশের পরিবার সম্পর্ক মেনে নেয় নি কিন্তু পরবর্তীতে যখন দেখছে মেনে না নিলে তাদেরই ক্ষতি ছেলের কামাই খেতে পারবে না।তখন মেনে নেয়।তবে মেনে নিলেও রুহিকে কখনোই ভালো চেখে দেখে নি তারা।রুহি আসার পর বাড়ির চাকর গুলো তাড়িয়ে দিয়েছিলো।প্রথম দিন ওর শ্বাশুড়ি মা বলেছিলো’বউ হয়ে এসেছো এ বাড়িতে।সব কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে।’

রুহি সেদিন মাথা কাত করে সম্মতি দিয়েছিলো যদি শ্বাশুড়ির মন পাওয়া যায় তাই।এরপর থেকে সারাদিন বাড়ির সমস্ত কাজ আর রাতে ভালোবাসার দাবি মেটাতে হতো।তবুও ভালোবাসার দোহাই দিয়ে সব মেনে নিয়েছিলো রুহি।সংসারের কাজে এতো ব্যাস্ত হয়ে গিয়েছিলো যে ইন্টার পরীক্ষার পর আর পড়াই হয় নি।এতোদিনের বাবা মার সাথে অনেকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে রুহি কিন্তু তারাও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলো।রুহির অবশ্য খুব খারাপ লেগেছিলো।কোনো একদিন মনে পড়লেই রাতের অন্ধকারে শব্দহীন ভাবে কাঁদতে সে।এই নিয়ে কখনো আকাশকে কিছু বলে নি রুহি।তার কষ্ট গুলো একান্তই তার ব্যাক্তিগত সম্পদ।এগুলো কখনোই কারো কাছে শেয়ার করা যায় না।আর করলেও কেউ তা অনুভব করতে পারে না।

বিয়ের পর সময়গুলো ভালো খারাপের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলো।হঠাৎ একদিন রুহি মথা ঘুরে পড়ে যাওয়ায় আকাশ ডাক্তার ডেকে এনেছিলো।ডাক্তার চেকাপ করে বলেছিলো বাড়িতে নাকি নতুন অতিথি আসবে।সেদিন যে কি আনন্দ হয়েছিলো রুহির।সেটা একমাত্র রুহিই জানে।কিন্তু সেদিম রুহির বিপরীতে আরেকজন অতিমাত্রায় দুঃখী হয়েছিলো।সে বাচ্চার খবর বাড়িতেও জানায় নি।সবাইকে বলেছিলো রুহির মাথা ব্যাথা ছিলো সেইজন্যই পড়ে গিয়েছিলো।আর রুহিকে বিভিন্ন ভাবে বুঝিয়ে সে বার বাচ্চাটা নষ্ট করে ফেলে।রুহি মুখ বুজে সবটা মেনে নিয়েছিলো সেদিন।তারপর থেকে রুহি প্রতিদিন স্বপ্নে দেখে একটা বাচ্চা ছোট ছোট হাত দিয়ে ওর গাল স্পর্শ করে বারবার বলছে”আম্মু,আম্মু।”আর যতোবারই এই স্বপ্নটা রুহি দেখছে ততবারই রুহি ঘুম থেকে ধড়ফড়িয়ে উঠে বাঁচ্চাটাকে খুজছিলো।কিন্তু হায়!আশেপাশে কোনো বাচ্চা নেই।রুহির ব্যাথিত মাতৃ হৃদয় প্রবল বেদনায় জর্জরিত হয় প্রতি মুহুর্তে।নিজেকে এখনো মাফ করতে পারে নি রুহি।বাচ্চা নষ্ট করার পর থেকে রুহি আকাশের সাথেও কম কথা বলে।কেমন যেনো নিজেকে খুনী মনে হচ্ছে তার!
আজ একবছর পর আবারও আরেকজন আসতে চলছে তবুও আকাশ খুশী না।কিন্তু কেনো?এই প্রশ্নের উত্তর রুহির কাছে নেই।

রুহি চোখ মুছে উঠে দাড়ালো।তারপর ঘরের বাইরে আসতেই শ্বাশুড়ি হুংকার দিয়ে বলল”আমার ছেলেকে কি বলেছো তুমি?ও এভাবে রেগে বেরিয়ে গেলো কেনো?”

“মা আমি কিছুই বলি নি।আপনার ছেলে বাচ্চা রাখতে চায় না।আমি তাকে অনেক বুঝিয়েছি কিন্তু সে কোনোভাবেই বাচ্চা রাখবে না।মা আপনি তাকে একটু বোঝান না!” আকুতি ভরা কন্ঠে রুহি আবদার করলো আশা বেগমের কাছে।

কিন্তু তিনি বিরক্তি কন্ঠে বললেন”তোমার স্বামী তুমি বোঝাও।আমারে বলো কেনো?”

এটা বলে আশা বেগম মুখ ঘুরিয়ে সেখান থেকে চলে গেলো।রুহির চোখ ফেটে কান্না আসছে।কিন্তু কোথাও কিছু একটা বাধা দিচ্ছে সেজন্য কান্নাটা ঠেলে বাইরে আসতে পারছে না।

কোনরকমে নিজেকে সামলে রুহি ঘরের কাজে মনোনিবেশ করে।
—————
নিস্তব্ধ রজনী!রুহি পাশ ফিরে শুশে আছে।ওপাশে আকাশ শুয়ে আছে।এখন কয়টা বাজে রুহির হিসেব নেই।শব্দহীন কান্না কাঁদছে রুহি।কিছু সময় পর আকাশ ধীরে ধীরে রুহির কাধে হাত রাখলো।রুহি কোনোরকমে কান্না লুকিয়ে আকাশের দিকে ফিরলো।আকাশে কিছু না বলে নিজের বুকে আবদ্ধ করলে তাকে।কিছু সময় পর ছেড়ে দিয়ে রুহির হাত দুটো ধরে বলল”মাফ করে দাও রুহি।আমার বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে।আমি একটা ভুল সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছিলাম কিন্তু এখন আমি বুঝতে পারছি নিজের ভুল।আমরা বেবিটা রাখবো।”

রুহি আকাশের কথা শুনে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না।হুড়মুড়িয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে ভেজা কন্ঠে বলল”থ্যাংকিউ সো মাচ আকাশ।আমি জানতাম তুমি এমন করবে না।”

আকাশে হেসে রুহির কপালে চুমু দিয়ে বলল”তাহলে রেডি থেকো কাল সকালে তোমাকে চেকাপ করতে নিয়ে যাবো।দেখতে হবে কোনো সমস্যা হয়েছে কি না?”

রুহি তৃপ্তির হাডি দিয়ে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো।এই জীবনে বাবা মার পরে এই মানুষটাকেই সে এতো ভরসা করে।অতঃপর রাত বাড়ার সাথে সাথে দুজনের মাঝের শাররীক দুরুত্ব ঘুচতে লাগলো কিন্তু মনের দুরুত্ব সে কি ঘুচবে?
——————
রুহি একা হাতে নাস্তা বানিয়ে টেবিলে দিলো।তারপর সবাই নাস্তা খাওয়ার পর নিজেও খেলো।আকাশ রুহিকে রুমে নিয়ে এসে বলল”রেডি হও তাড়াতাড়ি।তোমার চেকাপ করিয়ে অফিসে যেতে হবে।”

রুহি খুশী মনে রেডি হতে লাগলো।
অপর দিকে আকাশ বাইরে গিয়ে নাতাশা কে কল করলো।
“হ্যালো নাতাশা।”

“হ্যাঁ জানু বলো।”

“শোনো তোমার হসপিটালে আসছি রুহিকে নিয়ে।বাচ্চাটা এবোরশন করতে হবে।তুমি কি আছো?”

“ইয়াপ বেবি।তুমি শুধু নিয়ে আসো।বাকি কাজ আমি করছি।”

“ওকে।”
বলে আকাশ কল কেটে দিলো।রুহি রেডি হয়ে বাইরে আসতেই দেখলো আকাশ দাড়িয়ে আছে।রুহিকে নিয়ে রিকশায় উঠে হসপিটালে রওনা হলো।মনে মনে রুহি ভিষণ খুশী।নিজেকে পরিপূর্ণ লাগছে।মা মা ফিলিং হচ্ছে।আর আকাশ ভেতরে ভেতরে জপছে যেনো সবকিছু ঠিকঠাক ভাবে হয়ে যায়।রুহি যদি এসবের কিছু ঘুণাক্ষরেও টের পেতো!
—————
রুহিকে নাতাশার চেম্বারে নেওয়া হলো।নাতাশা রুহিকে বসতে বলল।তারপর রুহিকে প্রশ্ন করলো”কতো মাস চলছে?”

“দুইমাস।”

“আচ্ছা।আপনাকে কিছু টেস্ট দিচ্ছি এক্ষুনি করে নিয়ে আসেন।”

নাতাশা কাগজে কি যেনো একটা লিখে একজন নার্সের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল রুহিকে নিয়ে যেতে।নার্সটা রুহিকে নিয়ে একটা কেবিনে এলো।তারপর একটা চেয়ারে বসতে বলল।নার্সটা কোনো দরকারে বোধহয় বাইরে চলে গেলো।রুহি চেয়ারেই বসে ছিলো।হঠাৎ টেবিলের ওপর থেকল একটা কাগজ রুহিট পায়ের সামনে এসে পড়লো।রুহি সেটা উঠিয়ে টেবিলে রাখতে গিয়ে কাহজের লেখাটায় নজর পড়লো।এটা তো ডাক্তার নাতাশার লেখা।রুহি লেখাটা পড়তেই তার রক্ত হবে হিমশীতল হয়ে গেলো।হাত পা কাঁপছে দ্রুত।কাগজে লেখা ছিলো

“রিতা আপা,রুহি নামের মেয়েটার বাচ্চাটা নষ্ট করে দিন।যেনো সে বুঝতে না পারে।প্রয়োজনে অজ্ঞান করে ফেলুন!”

চলবে…..?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে