আমার শহরে তোমার নিমন্ত্রণ পর্ব-০২

0
4515

#আমার_শহরে_তোমার_নিমন্ত্রণ
লেখক- এ রহমান
পর্ব ২

অবশেষে সেই মুহূর্ত এলো। আমি মাথা নিচু করে বসে আছি। আমার পাশে জারিফ আর সামনে কাজি সাহেব। রাত প্রায় ২ টা বাজে। আমার বিয়েটা হয়ত স্মরণীয় হয়ে থাকবে। মাঝ রাতে বিয়ে। নাতি নাতনির জন্য একটা সুন্দর গল্প তৈরি হতে যাচ্ছে। কাজি সাহেব কি যেন অনেক জোরে জোরে পড়ছেন। কানে আসলেও মাথায় ঢুকছেনা। কি হচ্ছে এই মুহূর্তে তা বোঝার চেষ্টা করছি। একটু পর পর আম্মু কেদে উঠছেন। কাদার কি আছে। ছোট বেলাতেই আমাকে বলেছিল একদিন বিয়ে হবে। আমি এ বাড়ি ছেড়ে অন্য বাড়িতে চলে যাব। তাহলে আজ কেন সবাই এতো কাঁদছে। কাজি সাহেব জারিফ কে উদ্দেশ্য করে বললেন “বল বাবা কবুল”। জারিফ মাথা নিচু করেই কবুল বলল। এবার আমার পালা। তাই নিজেকে প্রস্তুত করে নিলাম। কিন্তু এখন কি এমন হল যে মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছেনা। কোন আওয়াজই করতে পারছিনা। কিন্তু কেন? বেশ করে প্রস্তুতি নিলাম তো। তাহলে? সব কেমন এলোমেলো লাগছে। বুকের মাঝে কেমন যেন অজানা এক অনুভুতি। ভালো লাগা না খারাপ লাগা বুঝতে পারছিনা। জোরে জোরে কয়েকবার নিশ্বাস নিয়ে বলতে যাব তখনি কেন যেন চোখ থেকে উছলে পানি বের হয়ে গেলো। কাঁদতে চাইছিনা। তবুও চোখের পানি যেন বাধ মানছেনা। এই জন্যই বোধহয় মেয়েরা কবুল বলার সময় কান্নায় ফেটে পড়ে। সবাই আমার জন্য অপেক্ষা করছে। ফুপু মাথায় হাত দিয়ে বলল “বল মা। ভয় পাস না।“ জারিফ নিরব দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। বুকের মাঝে সাহস সঞ্চয় করে এক নিশ্বাসে বলে ফেললাম। কিন্তু বিপত্তি হল তারপর।

চোখ খুলে দেখি আমি বিছানায় শুয়ে আছি আর সবাই আমাকে ঘিরে দাড়িয়ে আছে। কিছু বুঝে উঠতে পারলাম না। আমি তো কবুল বলছিলাম। তাহলে এখন শুয়ে আছি কেন? আর সবাই এভাবে তাকিয়ে আছে কেন? ছোট মা কোথা থেকে এক গ্লাস পানি হাতে ছুটে এসে আমার সামনে গ্লাস টা ধরে বললেন “খেয়ে নে মা।“ আমি গ্লাস টা নিয়ে খেয়ে নিলাম। ফুপু আমার মাথায় হাত দিয়ে বলল “তুই ঠিক আছিস?” আমি মাথা নেড়ে হ্যা বললাম।কি হচ্ছে বোঝার জন্য আশে পাশে চোখ বুলাতেই দেখলাম জারিফ কৌতূহলী দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে। চোখে চোখ পরল।আবার সেই অনুভুতি তাই নামিয়ে নিলাম। সব আয়োজন শেষ এখন বিদায়ের পালা।
সবাই কাঁদতে ব্যাস্ত। আমাকে জড়িয়ে ধরে সবাই কাঁদছে পালাক্রমে। এতো কাদার কি আছে। মরে তো যাইনি। শহরে যাচ্ছি। আবার আসব কয়দিন পর। নতুন জায়গায় বেড়াতে যাচ্ছি। মন ভরে গেলে আবার আসব। তারপর আবার যাব। এটাই তো নিয়ম। আব্বুকে এভাবে কখনও কাঁদতে দেখিনি। আব্বু আমাকে জড়িয়ে ধরে কাদছেন। তার কান্না দেখে নিজেকে আর সামলাতে পারলাম না। চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। সীমা আর ফুপু আমাকে টেনে গাড়িতে উঠালেন। গাড়িতে উঠিয়ে দিয়ে ফুপু পিছনের গাড়িতে গিয়ে বসলো। সীমা ভালো করে চারিদিকে দেখে নিলো কেউ আছে কিনা। তারপর আমার কানের কাছে এসে “আচ্ছা বল তো তুই কি ইচ্ছা করে অজ্ঞান হয়েছিলি নাকি সত্যি সত্যি?”। “কি যা তা বলছিস?” ধমক দিয়ে বললাম। “ও ! আমি এখন যা তা বলছি। আর তুই কবুল বলার পর যে জারিফ ভাইয়ার কোলে গিয়ে শুয়ে পড়লি। ভাইয়া তোকে কোলে তুলে এনে বিছানায় শুয়ে দিলো। তাতে কিছু হলনা।“ আমি তার দিকে অসহায় হয়ে তাকালাম। তার মানে কবুল বলার পরে আমি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। তাও আবার জারিফ ভাইয়া্র কোলে! ছি ছি! কি একটা পরিস্থিতি। না জানি আমার সম্পর্কে কি ভেবে বসে আছে। আর উনি আমাকে কেন কোলে তুলে নিলো। মানুষটাও না আজব! সবার সামনে এভাবে কেন কোলে তুলে নিবে। ভাবতেই সাইফ ভাই বলল “সীমা তুই সামনে বস।“ সীমা বের হয়ে সামনে বসে পড়ল।
জারিফ গাড়ি ড্রাইভ করতে চাইলো। “ নতুন বউকে পিছনে রেখে সামনে বসে ড্রাইভ করবি শালা। যা পিছনে বউয়ের কাছে বস।“ সাইফ ভাইয়া ধমক দিয়ে বললেন। জারিফ কিছু না বলে বিরক্ত হয়ে পিছনে এসে বসলো আমার পাশে। সাইফ ভাইয়া গাড়ি ড্রাইভ করছে। প্রায় ৫ ঘণ্টা জার্নি করতে হবে। কিন্তু রাতে ঠিক মতো ঘুম না হওয়ায় চোখ জুড়ে রাজ্যের ঘুম নেমে এলো। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি বুঝতে পারিনি।
আশে পাশে কোলাহল কানে আসতেই বিরক্ত হয়ে চোখ খুললাম। কিন্তু কোথায় আছি তা বুঝতে পারলাম না। বোঝার চেষ্টা করতেই যা দেখলাম। তা মোটেও আমার হজম হলনা। আমি জারিফের বুকে আর জারিফ আমার মাথা টা এক হাতে চেপে ধরে আছে যাতে পড়ে না যাই। অস্বস্তি হচ্ছে। মাথাটা তুলতেও পারছিনা। মাথা তুলে কিভাবে তার সাথে চোখ মেলাবো। কেন যে ঘুমাতে গেলাম। আর এই লোকটাও বটে। কি দরকার ছিল এভাবে বুকের মাঝে মাথাটা চেপে ধরার। চারিদিকে চোখ ঘুরাতেই সামনের আয়নায় চোখ গেলো সাইফ ভাইয়া আমাদের দিকে মাঝে মাঝে তাকাচ্ছে আর মুচকি হাসছে। এবার বোধহয় আমি লজ্জার মাথা খেলাম। তাড়াতাড়ি করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে গিয়ে বিপত্তি হয়ে গেলো। জারিফের শার্ট এর বোতামে আমার চুল আটকে গেলো। আমি সেদিকে তাকিয়ে চুল খোলার জন্য জোরে টান দিলেই বোতাম টা ছিঁড়ে গেলো। জারিফ খুব শান্ত দৃষ্টিতে একবার আমার দিকে তাকাল তারপর বোতামের দিকে তাকিয়ে বোতাম টা হাতে নিয়ে আমার সামনে ধরে “নাও। এটা যত্ন করে রেখে দাও। এতদিন এসব নিয়ে আমার মাথা ব্যাথা ছিল। এখন আর নেই। এখন এসব তোমার মাথা ব্যাথা। বাসায় গিয়ে সুন্দর করে লাগিয়ে দিবে কেমন?” আমি কিছু না বলে তার হাত থেকে বোতাম টা নিয়ে মাথা নাড়ালাম। সে আমার দিক থেকে চোখ ঘুরিয়ে সামনের আয়নায় সাইফ ভাইয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে দুজনে শব্দ করে হেসে দিলো। আমি ভীষণ লজ্জায় পড়ে গেলাম। কি থেকে কি হয়ে গেলো। কেন যে ঘুমাতে গেলাম। সব নষ্টের গোঁড়া ওই ঘুম। আর কিছুতেই ঘুমান যাবেনা।
গ্রামে থাকলেও চা খাওয়ার অভ্যাসটা আমার একটু বেশিই। বিয়ের জন্য আজ সকাল থেকে একবারও চা খাওয়া হয়নি। মাথাটা ধরে গেছে। বারবার মাথায় হাত দেয়াটা বোধহয় কোনভাবে জারিফের চোখে পড়ল। সাইফ ভাইয়াকে উদ্দেশ্য করে বলল “সামনে গাড়িটা একটু থামা। চা খাওয়া দরকার।“ সাইফ ভাইয়া চায়ের দোকান থেকে একটু দূরে দাঁড়ালো। আমাদের দুজনকে চা এনে দিলো। আমরা গাড়িতে বসেই চা খাচ্ছি। আর ওরা দুজন সামনে চায়ের দোকানে দাড়িয়ে সিগারেট টানছে আর সাথে চায়ে চুমুক দিচ্ছে। আমি তাকিয়ে আছি তাদের দিকে।

মেয়েটা আমার দিকে যেভাবে তাকিয়ে আছে তাতে বেশ বুঝতে পারছি বিষয়টা ওর পছন্দ হয়নি। “তোর বোনের জন্য আমাকে এতদিনের সখ মনে হয় বিসর্জন দিতে হবে।“ আমি ফারিয়ার দিকে তাকিয়েই সাইফকে বললাম। “আমার মনে হয়না এসব নিয়ে ও কোন ঝামেলা করবে। ও তো তেমন মেয়ে না।“ সাইফ শান্ত ভাবে বলল। “এতদিন মেয়ে ছিল। এখন বউ হয়েছে। বউরা মেয়েদের থেকে সব সময় আলাদা হয়। বউ হওয়া মাত্রই মেয়েরা একটা আলাদা ক্যারেক্টারে ঢুকে যায়।আমি তার চোখ দেখে বেশ বুঝতে পারছি” “কিরে! তুই কি আমার বোনের প্রেমে পড়ে গেলি নাকি?” সাইফ ভাইয়ার কথায় জারিফ বাস্তবে ফিরে এলো। তার দিকে তাকিয়ে অসহায় ভাবে বলল “আমি প্রেমে পড়লেও বা কি? তোর বোনকে শেখাতেই প্রেমের বয়স পার হয়ে যাবে।“ বলেই দুজন হাসতে লাগলো।
দীর্ঘ ৫ ঘণ্টা জার্নি করে অবশেষে পৌছালাম তার শহরে। রাত হয়ে এসেছে। গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির দরজায় দাড়িয়ে আছি। আমার শাশুড়ি মা কিছু আচার অনুষ্ঠান পালন করবে।তিনি বাটিতে কিছু মিষ্টি এনে আমাদের দুজনকে খাওয়ালেন। তারপর সবাই মিলে আমাকে ঘরে নিয়ে গেলো। শাশুড়ি মা কিছু কাপড় হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন “ফ্রেশ হয়ে এগুলো পরে নিচে আসো।“ আমি মাথা নেড়ে ফ্রেশ হতে গেলাম। ওয়াশ রুমের অবস্থা দেখে বেশ বুঝতে পারছি ব্যাচেলর ব্যাচেলর একটা ভাব। পুরো ওয়াশ রুম শুধু ওনার জিনিস পত্র। সব কিছু নিজের মতো করে সাজিয়ে নিলাম। সাথে আমার জিনিস পত্র গুলও রেখে দিলাম। ফ্রেশ হয়ে নিচে গেলাম। নতুন বাড়ি কিছুই চিনিনা। তবুও কাজ করার আর তর সইলনা। খুজে খুজে রান্না ঘরে চলে গেলাম। বাটিটা হাতে নিতেই শাশুড়ি মা এসে চিৎকার দিলেন। “কি করছ? কাজের জন্য অনেক লোক আছে। তোমাকে কাজ করতে হবেনা। তুমি শুধু মন দিয়ে পড়বে।“ আমি কিছু না বলে চুপচাপ দাড়িয়ে থাকলাম।

ওয়াশ রুমে ঢুকেই অবাক হয়ে গেলাম। সব কিছু সাজানো। আমার অগোছালো কাপড় গুলোও নেই। আমার বুঝতে বাকি রইলনা কার কাজ এটা। আম্মুর জেদে বিয়েটা তো করলাম ঠিকি। কিন্তু বউ কি সে আমার হতে পারবে? আমি কি আদৌ তাকে নিজের মনে জায়গা দিতে পারব। ভালবাসতে পারব তাকে? এতো কিছু জানিনা। মেয়েটা আমার হাত ধরে আমার উপরে ভরসা করে এতদুর এলো। তাকে আগলে রাখা আমার দায়িত্ব। ভালবাসাটা না হয় পরে দেখা যাবে। একটু মুচকি হেসে জারিফ বলল “ #আমার_শহরে_তোমার_নিমন্ত্রণ পিচ্চি।“
চলবে…………

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে