#অন্তরালের সত্যি
#নুরুন্নাহার তিথি
#সূচনা_পর্ব
১.
বড় কাকা যেদিন নিজের বিয়ে করা দ্বিতীয় স্ত্রীকে নিয়ে বাড়ির চৌকাঠে দাঁড়ালেন, সেদিন আমি বাদে সবাই হতবিহ্বল ও বাকরুদ্ধ হয়ে গেছিলো। আমি তখন সবে কথা বলা শিখেছি তাও আধো আধো ভাবে। চৌকাঠে মায়ের শাড়ির আঁচল ধরে দাঁড়িয়ে ড্যাবড্যাব করে নতুন বউকে দেখছিলাম বড় কাকার পাশে। মায়ের কোলে তখন আমার বছর খানেকের ছোট বোন কাঁদছিল। হয়তো আমার ছোট বোনটা কাকাকে দেখে কোলে উঠতে চাইছিল! আমি ও আমার বোনটা কাকার কোলে চড়ে বাহিরে যাওয়ার জন্য পা’গল প্রায় ছিলাম। ছোট বোনটার থেকেও আমি বেশি আহ্লাদি ছিলাম কাকাদের জন্য । হবো নাই বা কেনো? আমার দাদার বংশে আমি ও আমার বোন ছাড়া কারো মেয়ে বাচ্চা নেই।
কাকা ভিতরে আসতে চাইলে আমার মা আমাকে নিয়ে সরে দাঁড়ায়। দাদি তখন ডাইনিং রুমের চেয়ারে বসে ছিল। কাকার দ্বিতীয় স্ত্রী কাকার পেছোন পেছোন চৌকাঠ পেরিয়ে সবার আগে আমার মায়ের পা ছুঁতে নিলে আমার মা সাথে সাথে সরে যায়। এরপর কাকার দ্বিতীয় স্ত্রী দাদিকে সালাম করতে গেলে দাদি দূর থেকেই হুংকার ছাড়ে।
–এই মেয়ে! তুমি আমার ধারে কাছেও আসবে না আর আমার পা ছোঁয়া তো দূর। আমার সংসারে অশান্তির বীজ বুনে দিয়েছো তুমি। তছনছ করে রেখেছো সবটা।
কাকাও তার মায়ের হুংকারে ভয় পেয়ে আর আগানোর সাহস পায়নি। আমি দাদির হুকার শুনে কেঁদে উঠি তখন আমার বাবার চাচাতো ভাই তুরাগ ও মামাতো ভাই মামুন চাচ্চু আমাকে সেখান থেকে কোলে করে নিয়ে যায়। আমার ছোট চাচ্চু তখন চোখ মুখ শক্ত করে অটল হয়ে খিঁচে দাঁড়িয়ে ছিল। ছোট চাচ্চু বড় কাকার দিকে ঘৃণার দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে।
দাদি চেয়ার থেকে উঠে এসে বড় কাকার গালে সপাটে তিন চারটা চ’ড় বসিয়ে দিয়েছে। আমার মা শাশুড়ির রণমূর্তি দেখে মুখে হাত দিয়ে দিয়েছে। বাড়িতে তখন আমার বাবা ছিল না। আমার বাবা চাঁদপুর ছিল তখন চাকুরী সূত্রে। মা তৎক্ষণাৎ বাবাকে ফোন করে জরুরী ভিত্তিতে বাড়ি আসতে বলেন। বাবা কারন জিজ্ঞাসা করলে মা সংক্ষেপে বলেন,
–রাশেদ ভাই তো সর্বনাশ করে ফেলেছে। আম্মা অনেক রেগে আছে। আব্বা বাড়িতে নাই। আব্বা সদরে গেছে কাজে। তুমি জলদি আসো।
বাবা চিন্তিত হয়ে বলেছিলেন,
–কি করেছে রাশেদ? তুমি তো জানো আমি কালকেই মাত্র বাড়ি থেকে চাঁদপুর এলাম। এখন আবার বাড়ি আসবো?
মায়ের তখন অতো বুঝানোর সময় নেই। আসার ছোট বোন তারিন তখন মায়ের কোলে চিৎকার করে কাঁদছে। মা এটুকু বলেন,
–সংসার ভাঙার পথে। জলদি আসো। চাঁদপুর থেকে বাইরোডে বা ভেঙে ভেঙে লঞ্চে করে আসো। আমি দেখছি থামাতে পারি কিনা।
মা তারিনকে আমার দশম শ্রেণীতে পড়ুয়া ছোট চাচ্চু শাহিনের কোলে দিতে নিলে যখন দেখে সে রক্তচক্ষু নিয়ে তার মেঝো ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে তখন আর সাহস পায়না। মামুন চাচ্চুকে ডাক দিয়ে তারিনকে দেয়।
মা গিয়ে দাদিকে পেছোন থেকে ভয়ে ভয়ে ধরে বলে,
–আম্মা একটু শান্ত হোন। আপনার প্রেশার বেড়ে যাবে। আপনার বড় ছেলেকে খবর দিয়েছি। সে রওনা করেছে।
দাদি আমার মায়ের উপর চিৎকার করে বলেন,
–মুরাদকে আসতে বলছো কেনো তিহার মা? মুরাদ আমাকে থামাতে পারবে না। আমি আজ একটা হেস্তনেস্ত করেই ছাড়বো। ওর (বড় কাকার দিকে আঙুল তুলে) এতো বড় সাহস হয় কি করে যে সে আমাদের পারিবারিক মর্যাদার অসম্মান করে? আমার পরিবারে অশান্তি করে। আমি কি জবাব দিবো মেঝো বউয়ের কাছে? আমার শিক্ষাকে অপমান করেছে এই কু’লাঙ্গা’র। আমি আমার সব ছেলেকে ন্যায়ের পথ দেখিয়েছি আর এই রাশেদ আমার শিক্ষা ভুলে আমাকে অপমান করলো। স্ত্রী ও এক ছেলে রেখে সে কিভাবে আবার বিয়ে করতে পারলো?
আমার মা দাদীকে ছেড়ে দূরে গিয়ে দাঁড়ায়। মা খুব ভয় পেয়ে গেছে। আমার মা বিয়ে করে এ বাড়িতে এসেছে চার বছর। যৌথ পরিবার বলে মা কখনো কুকথা বা গলা উঁচু করেনি। শাশুড়ি যেমনে বলেছে তেমনে চলেছে। আমার দাদীর মন অনেকটা নারিকেলের মতো। উপরের আবরন শক্ত কিন্তু ভিতরে নরম। আমার বাপ-চাচা ও ফুফিরা দাদীকে খুব ভয় পায়। দাদী প্রচন্ড জিদ্দি মহিলা। অন্যায়ের সাথে আপোষ করেনা। সেই অন্যায় যদি নিজের রক্তও করে তবুও সে ছাড় দেয়না।
আমার দাদী কখনো তার পুত্রবধুদের উপর অ’ত্যাচার করেনি। অ’ত্যাচার করলে আমার মা চার বছর যাবত শাশুড়ির সাথে থাকতে পারতো না। বাবা তো বিয়ের আগে থেকে চাঁদপুরে চাকুরী করে। সপ্তাহে দুইদিন বাসায় থাকে। মা কখনো বাবার কান ভাঙানোর চেষ্টাও করেনি। আমার নানা ও নানী আমার মাকে বলে দিয়েছে যেনো শাশুড়ির মন যুগিয়ে চলে আর শাশুড়িকে মায়ের জায়গা দেয়। আমার মা তাই করেছে। বাবাও মাকে বলেছিল মা যেনো তার পরিবারকে আগলে রাখে। আমার দাদী যেমন শাশন করতো তেমন আদরও করতো।
বাবা মায়ের ফোন রাখার পর তাড়াতাড়ি করে বাবার মামাকে ফোন করে বলে,
–মামা আপনি কই? আম্মা নাকি অনেক রেগে আছে। রাশেদ জানি কি করেছে। আপনি এখনি ঢাকার জন্য রওনা করতে পারবেন? আপনার বু্বুরে তো আপনি চিনেনই।
বাবার মামা বলেন,
–মুরাদ আমি তো চাঁদপুরে আছি এখন। তুমি সদরঘাট আসো। এখনি দশ মিনিটে মুন্সিগঞ্জের জন্য ছোট লঞ্চ ছাড়বে। প্রথমটাই ধরতে হবে।
বাবার মামা তৎক্ষণাৎ রওনা হয়। বাবার মামা মানে আমার দাদীর ভাই জানে তার বুবু শুধু শুধু রেগে যায়না। উনারা দুইজন দশ মিনিটের মধ্যে কিভাবে যে লঞ্চঘাটে পৌঁছেছে আল্লাহ্ জানে। চাঁদপুর থেকে দেড় ঘন্টায় মুন্সিগঞ্জ এসে তারপর এক ঘন্টার কমে নারায়ণগঞ্জ আসে। তারপর সেখান থেকে সিএনজি নিয়ে আমাদের বাড়িতে আসে।
বাবা ও দাদীর ভাই মানিক দাদা এসে পৌঁছাতে পৌঁছাতে বিকেল গড়িয়ে গেছিলো। ওরা এসে দেখে বড় কাকা(রাশেদ) সে হাঁটু গেড়ে দাদীর পায়ের কাছে বসে কাঁদছে। আর বড় কাকার দ্বিতীয় বউ দরজার কাছে বসে আছে। তার মুখ নিকাব দিয়ে ঢেকে রাখা। আমার মাও তার চেহারা দেখেনি।
বাবাকে দেখে আমি খাট থেকে নেমে বাবাকে জড়িয়ে ধরলাম। বাবা আমাকে কোলে নিয়ে কপালে চুমু দিয়ে মায়ের কাছে দিয়ে সে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছে। ইতিমধ্যে আমার দাদাও বড় কাকাকে নিজের জালি বে’ত দিয়ে পি’টিয়ে এখন সোফাতে কপালে হাত রেখে বসে আছে। বাবা মায়ের কাছ থেকে সবটা জেনে বড় কাকাকে মেঝে থেকে উঠিয়ে একটা রুমে নিয়ে যায়। ফুফিরাও রওনা করেছে একটু আগে।
বাবা বড় কাকাকে বন্ধ ঘরের ভিতর নিয়ে খাটে বসিয়ে নিজে তার সামনে চেয়ার টেনে বসে গম্ভীর হয়ে জিজ্ঞাসা করে,
–কেনো করলি এটা? তোর একবারো তোর মায়ের শিক্ষা ও পরিবারের শিক্ষার কথা মনে পড়লো না? দুই বছরের ছেলে শাহাদাতের কথা মনে পড়লো না? তোর প্রেগনেন্ট বউ সানজির কথা মনে পড়লো না? কেমনে পারলি? তুই তো এমন ছিলি না? বল?
বড় কাকা আমার বাবার হাত ধরে ঝরঝর করে কেঁদে বললেন,
–ভাই বিশ্বাস করেন, আমি চরম বাধ্য ছিলাম। বিনাদোষে আমাকে দোষী বানিয়ে দিয়েছে ওরা। এক বছর আগে আমাকে বাধ্য করেছিল বিয়ে করতে। আমি চাইনি বিয়ে করতে। আমার ছেলেকে আমি কতো ভালোবাসি তা তো আপনি জানেনই। আমাকে ব্ল্যাকমেইল করেছে ওরা।
আমার বাবা এটুকু জানেন তার ভাই তাকে মিথ্যা বলবে না। ছোট থেকেই বড় কাকা বাবার কাছে তার সব কথা প্রকাশ করে।
এতো কিছুর মধ্যে বড় কাকার প্রথম স্ত্রী সানজি নেই। সে যে চার মাস আগে বাপের বাড়ি গেছে আর আসেনি। সানজি কাকি দুই মাসের প্রেগনেন্ট এখন।
চলবে ইনশাআল্লাহ,