অন্তরালের সত্যি পর্ব – ০৫

0
1183

#অন্তরালের সত্যি
#নুরুন্নাহার তিথি
#পর্ব-৫

সানজি কাকি তাে তার বাবা ও ভাইয়ের সিদ্ধান্ত মেনে নিজের বাপের বাড়িতেই থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সানজি কাকির বড়বোন নিঃসন্তান। আর ছোট বোনের তিনটা সন্তান। শাহাদাতকে সানজি কাকির বড়বোন অনেক আদর-যত্ন করলেও শাহাদাত তার বাবাকেই খোঁজে। মাহাদী মামা ও সানজি কাকির বোনদেরর স্বামীরা শাহাদাতকে দেখে রাখতেন। সানজি কাকি প্রতিদিনই কান্না করতেন। কান্না করাটাই স্বাভাবিক। এদিকে আমার দাদীও দাদার অগোচরে কাঁদতেন। তিনি অন্যায় মাফ করতে পারেননি কিন্তু একজন মা হিসেবে সন্তানের অধঃপতন ও দূরত্ব অসহনীয় কস্টের।

বড়কাকা অর্পাকে ডিভোর্স দিতে পারবেন না আর সানজি কাকিকে ডিভোর্স দিতে চাননা। আর সানজি কাকিও ডিভোর্সের কোনো রকম পদক্ষেপ নেননি আর না নিয়েছেন তার পরিবার। বড় কাকা এখন ছন্নছাড়া জীবন অতিবাহিত করছেন। বড় কাকা অর্পার সাথে যোগাযোগ ছিন্নও করতে পারছিলেন না পুরোপুরি। তাও বড় কাকা মাস ছয়েকের জন্য নিরুদ্দেশ হয়েছিলেন আর নিজের মোবাইল ফোন বিক্রিও করে দিয়েছিলেন।
ছয় মাস পর যখন নতুন ফোন কিনে পুরাতন সিমকার্ড লাগান তখন সে প্রথমে সানজি কাকিকে ফোন করেছিলেন। সানজি কাকির তখন ৮মাসের প্রেগনেন্সি। সানজি কাকি বড় কাকাকে ডেলিভারির দিন আসতে বললেন। জরায়ুতে পানি শুকিয়ে যাওয়ার দরুন ৯ মাসের আগেই সিজার করতে হবে সানজি কাকির এটাও জানিয়েছিলেন।

ডেলিভারির দিন বড় কাকা হাসপাতালে গেলেও সানজি কাকির কাছে মাহাদী মামা ও সানজি কাকির বড় বোন যেতে দেননি। কয়েক ঘা লাগিয়েও দিয়েছিল সাথে অপমান তো করেছিলই। বড় কাকা সারারাত অপেক্ষা করে ভোরের দিকে আবারো যেখান থেকে এসেছিলেন সেখানে চলে যান। সানজি কাকির ছোট ছেলে রনি হবার পরে দাদা-দাদী, মা-বাবা, ছোটকাকা আমরা সবাই দেখতে গিয়েছিলাম। তখন তারা ঝামেলা সৃষ্টি করেননি।

এদিকে অর্পা বড় কাকার অন্য বন্ধুদের কাছে তার সাথে হওয়া অন্যায় নিয়ে কথা রটালেন। বড় কাকা যে ছয়-সাত মাস যাবত কোনো যোগাযোগ রাখেননা তাও জানালেন সকলকে। যাতে বড় কাকা কারো সাথে যোগাযোগ করলেই তারা অর্পাকে জানায়। হয়েছিলও তেমন। অর্পা ও অনিক মিলে বড় কাকা যেই মেসে থাকতেন সেখানে যান। এরপর অনিক অনেক হু*মকি ধ*মকি দিয়ে অর্পাকে বড় কাকার সাথে একটা হোটেলে রেখে আসেন। আর কিছু দিনের মধ্যেই থাকার জায়গা খুঁজতে বলে এসেছিলেন।

আমার দাদা এদিকে যে বাড়ি বানানোর জন্য ব্যাংক থেকে লোন নিয়েছিলেন তার অর্ধেকও তখন যোগান হয়নি বিধায় তিনি ওই ঝামেলার পুকুরটা বিক্রি করার কথা ভাবলেন। পুকুর বিক্রি তিনি কমেই করে দিলেন। যেই দামে কিনেছিলেন তার থেকে কিছুটা বেশিতে। কারন তার তখন লোন পরিশোধ করতে হতো। ব্যাংক লোন পরিশোধ করে ২০০৪ সালের ডিসেম্বরে দাদা ও দাদী হজ্জে যান।

সানজি কাকিদের বাড়িতে আমার বাবা তার ভাতিজাদের দেখতে যেতেন ও ঈদের জামা-কাপড় দিতে যেতেন। সানজি কাকিকে আমার দাদীও বলেছিলেন আমাদের বাড়িতে চলে আসতে কিন্তু সানজি কাকি দাদীকে মানা করে দিতেন বা তার বাবা ও ভাইয়ের কথা বলতেন।

সময় গড়াতে লাগলো। সবকিছু এমনেই পেরিয়ে যাচ্ছিলো। আমার পরিবারের কেউ তখনো বড় কাকার দ্বিতীয় বিয়ে করার অন্তরালের সত্যি জানতেননা। ওই বিয়ের পেছোনে যে এতো বড় ষড়যন্ত্র ছিল তা আমরা কেউই টের পাইনি। বড় কাকা রনির জন্মের পর সানজি কাকিদের বাড়িতে অনেকবার গিয়েছিলেন কিন্তু দুইবার তিনি অপমানিত হয়ে ফিরেও এসেছিলেন আর কয়েকবার রাস্তা থেকে ফিরে এসেছিলেন। কিন্তু একবার তিনি তার ছোট ভায়রাকে অনুরোধ করে ছোট ছেলেকে দেখতে পেরেছিলেন।
সেদিন সানজি কাকির বাবা-মা, ভাই, বড়বোন, ও বড় দুলাভাই বাড়িতে ছিলেন না। তারা সবাই মাহাদী মামার জন্য মেয়ে দেখতে গিয়েছিলেন। সানজি কাকির ছোটবোন অসুস্থ থাকায় যাননি। সানজি কাকি তখন দুই ছেলেকে নিয়ে বাসায় তার এক চাচির সাথে ছিলেন। বড় কাকা সেদিন প্রথমবার তার তিন মাসের শিশুসন্তানকে কোলে নেন। বড় কাকা সানজি কাকিকে সব সত্য জানাতে চাইলেও সানজি কাকি সেসব শুনতে অপরাগ ছিলেন তাই বড় কাকার কথার কোনো মূল্যই রয়নি।

শাহাদাত অনেকদিন পর বাবাকে পেয়ে বাবার কোল থেকে নামতেই চাইছিল না কিন্তু সানজি কাকির বাবা-মা ও ভাইয়েরা আসার সময় হয়ে গিয়েছিল তাই সানজি কাকির ছোট বোনের স্বামী তাড়াতাড়ি করে বড় কাকাকে সেখান থেকে নিয়ে এসেছিলেন।
বড় কাকাকে ওদের বাড়িতে এনেছিলেন বলে সানজি কাকির ছোট বোনের স্বামীকে সানজি কাকির ভাই ও বড় বোন ব*কাঝকাও করেছিলেন। ছোট বোনের স্বামী তখন কিছু বলেননি।

দাদা-দাদী হজ্জ থেকে তার নাতি-নাতনিদের জন্য যা যা এনেছিলেন সব পৌঁছে দেন। সানজি কাকিদের বাড়িতেও জায়নামাজ, খেঁজুর, জমজমের পানি, পাঞ্জাবীর কাপড়, টুপি, আতর সবকিছু ছোট কাকাকে দিয়ে পৌঁছে দিয়েছিলেন। দাদা-দাদী সবার জন্যই এগুলো এনেছিলেন।

এরপর আবার রোজার ঈদে আমার বাবা সানজি কাকিদের বাড়িতে জামা-কাপড় নিয়ে গেলে বাবাকে উদ্দেশ্য করে ভিতরের ঘরে সানজি কাকির বোনেরা নানান কথা বলছিলেন। তাদের কথার ধরন ছিল তাচ্ছিল্যতা। বাবা সেসব শুনে সেখানেই শপিং ব্যাগ গুলো ফেলে চলে আসেন। আমার নানা রোজার মধ্যে মারা গেছিলেন তাই আমার মা ও বাবার মন এমনিতেও খারাপ ছিল আর তারউপর তাদের আড়ালে খোঁচা দেয়া কথা! এরপর বাবা আর কোনোদিনও সানজি কাকিদের বাড়িতে যাননি।

২০০৮ সালে বাবা চাঁদপুর থেকে ঢাকা চলে আসেন। চাঁদপুরের মানুষজন বড় কাকার বিষয়টা নিয়ে ঘাঁটাচ্ছিল আর আমার ছোট কাকাও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন দূরে। বাসায় বৃদ্ধ দাদা-দাদী ও মা আমাদের নিয়ে থাকতেন। আমার বাবার মামাতো ও চাচাতো ভাইয়েরাও পড়ালেখার সুবাদে এখানে থাকতেন আর পড়ালেখার সুবাদে তারাও চলে গিয়েছিলেন। বাবা ঢাকা এসে তার এক বন্ধুর সাথে শেয়ারে বিজনেস ও টিউশন করাতেন। পুরো সংসার বাবার আয়ের উপর ও বাড়ি ভাড়া থেকেই চলতো। এক বছর পর বাবা দাদা যেই স্কুলে হেডমাস্টার ছিলেন সেখানে জয়েন করেন।

এর মধ্যে ২০০৯ সালের দিকে চার বছরের রনিকে ও শাহাদাতকে নিয়ে সানজি কাকি ও তার বাবা আমাদের বাড়িতে আসলেন। আমার দাদা যেনো তার নাতিদের নামে কিছু সম্পত্তি লিখে দেন তার জন্য। আমার দাদা তাদের বললেন,

–আমি আমার সম্পত্তির এখনো ভাগ করিনি। আর আমি ও আমার স্ত্রী এখনো জীবিত। মেঝোবউমা যদি এই বাড়িতে থাকে তখন সম্পত্তি যতো বছর পরই ভাগ হোক আমি সুবিচার করবো।

সানজি কাকির পরিবারের সাথে এই নিয়ে অনেক কথাবার্তা হয়। তখন দাদীর ভাই মানিক দাদা আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন। মূলত সানজি কাকির পরিবার আসবেন বলেই মানিক দাদা ও তার স্ত্রীর আসা আমাদের বাড়িতে। মানিক দাদা বললেন,

–সানজি এখনে থাকবে না অথচ সম্পত্তি চাইছে এটা কেমন কথা? শ্বশুর-শাশুড়ির খেদমত করবে না কিন্তু দিনশেষে যে বউ বাড়ি দেখেশুনে রাখে তার সাথে তুলনা তো দিতে পারেন না। সানজি এখানে থাকুক। আমার বুবু ও দুলাভাই তার নাতি-নাতনিদের কাছে পাক। তারপর পরেরটা দেখা যাবে। হুট করে এসে সম্পত্তি চাইলেন আর তা দিয়ে দিলো এমন তো না। রাশেদকেও এই বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হয়েছে তাহলে সানজি কি হিসেবে এসব বলে আর আপনারাই বা কেনো বলছেন? সানজি এখানে থাকলে আমরা তো তার অনাদর করবো না।

সানজি কাকির বাবা অনেক বলেছিলেন সেসব নিয়ে। নাতিদের হক নিয়ে। তিনি তার মেয়েকে এখানে রাখতে নারাজ। এখানে নাকি ভালো শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান নেই। রাস্তাঘাট ভালো না। আরো কতো কিছু।

আমার মাও ভিতরের ঘরে সানজি কাকিকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন,
–সানজি থেকে যাও। ছেলেরা তার দাদাবাড়িকেও জানুক।

সানজি কাকি বলেছিলেন,
–না ভাবী। শাহাদাতকে মিরপুরের ভালো স্কুলে ভর্তি করেছি। ওখানে লেখা-পড়ার মান ভালো। এখানে আপনার দেবরকে ছাড়া ভালো লাগেনা।

মা আর কথা বাড়াননি। আর দাদাও সানজি কাকির পরিবারকে শর্ত দিয়েছেন,
“যদি মেঝোবউ এখানে নাতিদের নিয়ে থাকে তবেই তারা আমার সম্পত্তির ভাগ পাবে।”

বিকেলে উনারা চলে যায়। বাবা উনাদের সামনে পরতে চাননি কারন ওইদিনের কথাগুলো তিক্ত ছিল অনেক। বাবা বাসায় এসে সব শুনে দাদী ও মায়ের সামনে বললেন,

–রাশেদের বিয়ের মেয়ে দেখতে যে গিয়েছিলেন তখন একবার শুধু মেয়ের ডিটেইলস টা আমাকে জানাতেন। সত্যি বলছি, মাহাদীকে আমি চিনি কমতো বছর হলো না। ওর পরিবারকেও আমি চিনি। বড়বোনের জামাই তো ঘরজামাই। রাশেদকেও এমনটাই করতে চেয়েছিল। ছোটবোন নিজেই বাপের বাড়িতে পরিমিত পরিমান থাকে আর ওর ছোটবোনের স্বামী তার বউকে বছরের পর বছর বাপের বাড়িতে থাকতে দেয়না। আমি আগে জানলে আপনাদের মানা করতাম সানজির সাথে রাশেদের বিয়ে দিতে। এখন রাশেদ কোন এক অর্পার ভেজালে ফাঁসলো! রাশেদের যদি সানজির সাথে সংসার না করার থাকতো তো বিয়ে নাই করতো। আপনার মেঝো ছেলেও ভালো না আর মেঝো বউও না। আমি ভেবেছিলাম রাশেদ অর্পার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিবে তাই সানজিদের বাড়িতে শাহাদাতকে ও রনির জন্য যেতাম কিন্তু তারা আমাকে নিয়ে যেভাবে বসার ঘরে বসিয়ে ভেতরের ঘরে থেকে জোড়ে আলোচনা করে অপমান করলো তার পর ওদের বাড়িতে আমি আর যাবো না। আল্লাহ্ জানে ভবিষ্যৎে আরো কতোকিছু হয়।

চলবে ইনশাআল্লাহ,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে