অন্তরালের সত্যি পর্ব – ০৬

0
1117

#অন্তরালের সত্যি
#নুরুন্নাহার তিথি
#পর্ব-৬

সময় তো থামেনা। বড় কাকা প্রায়ই আমাদের বাড়ির আশেপাশে আসতেন সেটা দাদী দেখতেন। দাদী ব্যালকনিতে বিকেলে বসে থাকতেন আর পত্রিকা পড়তেন। বড় কাকা বাড়ির এড়িয়ার কাছে যে আসতেন তাও সন্ধ্যার কাছাকাছি সময়ে তাও দাদী দেখতেন। বড় কাকা মুখে মাস্ক লাগিয়ে রাখতেন যাতে এলাকাবাসী তাকে চিনতে না পারে। আর সানজি কাকিদের ফ্লাটের আশেপাশেও যেতেন। সানজি কাকির ভাই বা বড়বোন বড় কাকাকে বাড়িতে ঢুকতে দিতেন না আর দেখলে অনেক কিছু শুনিয়ে দিতেন। তবে শাহাদাতকে বিল্ডিংয়ের নিচে খেলতে দেখলে শাহাদাতের সাথে কথা বলা খেলা এসব করতেন। শাহাদাতকে দিয়ে মাঝে মাঝে সানজি কাকিকে ও রনিকে ডাক দিয়ে দেখাও করতেন।

অর্পার সাথে তিনি কোনো বাচ্চা নেননি এই কথা গ্রামে মানিক দাদাদের বাড়িতে গিয়ে বড়কাকা বলেছিলেন। মানিক দাদার স্ত্রী বড়কাকাকে তাড়িয়ে দেননি। মানিক দাদা কাজের জন্য চাঁদপুর থাকতেন প্রায়ই। বড়কাকা মানিক দাদার বাড়িতে গিয়ে অনেক থেকেছেন। কিন্তু সে কথা বড়কাকা কাউকে জানাতেও মানা করতেন তাই মানিক দাদার স্ত্রী আমাদের বলতেন না।

২০১২ এর দিকে আমার বাবা অর্পার ভাবী রুনার ভাইয়ের কাছ থেকে জানতে পারলেন সবকিছু। অর্পার ভাবী নিজের স্বামীর ও শ্বশুরের পক্ষে ছিলেন না। অর্পার ভাবী রুনা নিজের সংসার বাঁচাতে এসব কিছু কাউকে বলতে না পারলেও নিজের বাবার বাড়ির মানুষদের জানিয়েছিলেন। আর ২০১২ তে রুনার ভাগিনাকে পড়ানোর জন্য রুনার ভাই আমার বাবার কাছে আসলে, আমার বাবা রুনার ভাইকে পরিষ্কার করে মানা করে দেন তিনি পড়াবেন না। পরে রুনার ভাই আমার বাবার মানা করার কারন বুঝতে পেরে আমার বাবাকে সব সত্য জানান।
ততোদিনে অর্পার সংসার করার ইচ্ছে নষ্ট হতে শুরু করেছিল কারন বড় কাকা পাটকলের এক মেশিনে নিজের ডান হাতের কব্জি পর্যন্ত হারিয়েছিলেন। তারউপর বড় কাকা সন্তান নিতে নারাজ। বড়কাকার ভাষ্যমতে,

“আমার দুই সন্তান আছে। আমি আর সন্তান চাইনা। এখন তোমার ইচ্ছে হলে থাকো নয়তো যাও।”

অর্পা যাতে নিজে সেচ্ছায় চলে যায় সেটার এক কৌশল বাচ্চা না নেওয়া। অর্পা নিজের বাপের বাড়ি এসে পরলেও বড় কাকা কোনো বাঁধা দিতেননা। মানে একপ্রকার টান ছাড়া সম্পর্ক।

আমার বাবা বাড়ি এসে বড় কাকার ব্যাপারে এসব দাদা-দাদীকে জানালে দাদী দুঃখ পেয়েছিলেন। দাদা তখনো নিরব। সে যেনো শুনেও না শোনার মতো।
বড় কাকা একদিন আমাদের বাড়িতে আসলেন অর্পাকে নিয়ে। বড় কাকা এসেছিলেন মাফ চাইতে আর অর্পা এসে আমার মায়ের পা ধরে বসেছিলেন যাতে আমার মা দাদীকে তাদের মেনে নিতে বলেন। কিন্তু দাদী বড় কাকাকে বলে দিয়েছিলেন,

–আমাদের অনুমতি ছিলনা তোমার দ্বিতীয় বিয়েতে। তোমার প্রথম বিয়েতে মেয়ে তুমিই পছন্দ করেছো আর আমরা অনুমতি দিয়েছি। এখন তুমি যদি সানজিকে নিয়ে আসো তবে আমরা তোমাকে মাফ করবো। নতুবা না। আমাদের কমতো অপমানিত হতে হয়নি তোমার জন্য।

বড় কাকা বলেছিলেন,
–আম্মা, সানজি আমার কোনো কথা শুনতেই চায়না। আমি আমার পরিস্থিতি তাকে বলার চেষ্টা করেছি কয়েকবার। শাহাদাতকে দিয়ে সানজিকে ডাকিয়ে এনেও বলতে চেয়েছি কিন্তু সে শুনতে নারাজ। উপরন্তু সে ও তার ভাই-বোনেরা শাহাদাতকেও আমার নামে নানা কথা বলেছে। আমি তাও তার সাথে দেখা করতে গিয়েছি। তিনদিন আগেও গিয়েছিলাম। সেদিন শাহাদাত আমাকে বলেছে, আমি খারাপ। আমি তার মাকে ধোঁকা দিয়েছি। হ্যাঁ মানছি, আমি এসব করেছি কিন্তু সবকিছুর কারন তাকে বলতেও গিয়েছি। ছেলের মুখে এসব শুনে আমি আপনার কাছে মাফ চাইতে এসেছি। আর অর্পাকে আমি আনতে চাইনি। অর্পা কিভাবে জানলো আমি এখানে আসবো আমি তাও জানি না। কাল ফোন করে আমাকে বললো তাকে সাথে নিয়ে যেতে নয়তো থানায় মামলা করবে। আমি তারউপর অত্যাচার করি এটার মামলা করবে! কিন্তু আমি তার সাথে তিন মাস যাবত থাকিই না। আমি নিজের ডান হাতের কব্জি পর্যন্ত হারানোর পর আপনার ও আব্বার কাছে মাফ চাইতে আসতে চাইছিলাম। পরশু রুনা ভাবীর ভাই বলল, বড়ভাইকে নাকি তিনি সব জানিয়েছেন। আমাকে মাফ চাইতে যেতে বললো। আমি সেই সাহসে এসেছি। আমাকে মাফ করে দেন আম্মা। আব্বাতো আমাকে দেখেই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন।

দাদী নিজের চোখের পানি ফেলছিলেন কিন্তু সে কিছু করতে পারেননি সেদিন। আমি তখন ১১ বছরের। ছোটকাকা যখনি খবর পেতেন বড়কাকা বাড়ির আশেপাশে এসেছেন তখনি ছোটকাকা আমাদেরকে বড় কাকার কাছে যেতে মানা করতেন। প্রত্যেক ঈদে বড় কাকা আসতেন বাড়ির সামনে মাদরাসার কাছে আর মাদরাসার ছাত্রদের দিয়ে বলাতেন যে, আমাকে ও আমার বোনকে যেনো একটু মাদরাসার কাছে আসতে বলে।
মাদরাসার ছাত্ররা এটা এসে বাড়িতে বললেই বাবার আগে ছোট কাকা ছুটতেন কে এসেছে দেখতে। আর আমাদেরকে কখনোই যেতে দিতেন না।

এরপর আমি যখন ৯ম শ্রেণীতে উঠি তখন ২০১৪ সালে একদিন আমার সাথে বড়কাকার দেখা হয়। বড়কাকা আগে আমরা যেখানে থাকতাম সেই কলোনিতে প্রায় যেতেন। উনি যাচ্ছিলেন আর আমার দিকে তাকিয়ে থাকতেন। আমি তার দিকে ভ্রুঁ কুঁচকে তাকিয়েছিলাম। আমি প্রথমে তাকে চিনতে পারিনি কারন তাকে ছোটবেলায় দেখার পর ছবির ফ্রেমেই তাকে দেখতাম। আর বড়কাকার সাথে আমার ছোটকাকা কখনো আমাকে ও তারিনকে দেখা করাতেন না। আমি তাই তাকে চিনতে পারিনি তবে চিনা চিনা লাগছিল। এরপর বাঁক ঘোরার পর তার ডান হাত রুমাল পেঁচানো পকেটে রাখা দেখে আমার সন্দেহ সত্যি হয়। বাসায় গিয়ে দাদীকে বলার পর ছোটকাকা যখন শুনে তখন ছোটকাকা আমাকে মানা করেন যেনো বড়কাকা ডাকলেও না শুনি।

২০১৫ সালের দিকে শুনেছিলাম অর্পার সাথে বড়কাকার ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে। অর্পা নিজেই দিয়েছে। যখন দেখলো তার কোনো লাভ তো হচ্ছেই না বরং তার বয়স হুরহুর করে বাড়ছে আর সংসারতো হলো না তখন নিজে সুখে থাকতে বড়কাকাকে ডিভোর্স দেয়। বড়কাকা দীর্ঘ ১২ বছর পর অর্পার থেকে মুক্তি পায়। সে এরপরে সানজি কাকির কাছে গিয়েছিল। সানজি কাকি বড়কাকার সাথে সংসার করতে অস্বিকার করেন। বড় কাকা তাদের কাছে অনেকবার গিয়েছেন যাতে এবার সব ঠিক করে নেন। কিন্তু সানজি কাকির পরিবার নারাজ তাতে। তারা তাদের মেয়ে দিবেন না। শাহাদাত তার বাবাকে ঘৃণা করতে শুরু করেছিল। শাহাদাতকে তার খালা ও মামারা যা বোঝাতো শাহাদাত তাই বুঝতো আর উঠতি বয়সের ছেলেকে যা বলা হয় তারউপর রিয়াকশন সেরকমই হয়।

আমার ও আমার বোনের সাথেও বড় কাকা দেখা করতে চাইতেন। আমার ছোট বোন তারিনকে একদিন একা স্কুল থেকে বাসায় ফিরতে দেখে রাস্তায় ওকে ডাক দিয়ে বলেন,

–কেমন আছো মা?

তারিন বড়কাকাকে চিনতে পারে না। তারিন অচেনা কারো সাথে কথাও বলতে চায়না। তারিন নিজের মতো হাঁটতে থাকে। বড়কাকা তারিনের পেছোন পেছোন হাঁটতে হাঁটতে বলেন,

–আমাকে চিনতে পারোনি? আমি তোমার এক কাকা হই। তোমার বাবার নাম মুরাদ না? তোমার ছোটকাকার নাম শাহিন না?

তারিন তখন অতিরিক্ত ভয় পেয়ে দ্রুত পা চালিয়ে চলে আসে। বড়কাকা ওর পেছোন পেছোন আসতে থাকে। বাসায় এসে সব বলার পর দাদী ব্যালকনিতে যেয়ে দেখেন বড়কাকা গাছের আড়াল থেকে চলে যাচ্ছেন।

চলবে ইনশাআল্লাহ,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে