অনুভূতির অন্তরালে পর্ব-০৮

0
2338

#অনুভূতির_অন্তরালে
#পর্ব:৮
#Devjani

নিচে নামতেই আরাদ্ধা দেখে ড্রাইভার মুখ ভার করে বসে আছে।তাকে দেখতেই তাড়াতাড়ি উঠে গাড়ি বের করে।আরাদ্ধা গিয়ে উঠে বসে।

ড্রাইভার করিম সবসময়ই হাসিখুশি থাকে। কিন্তু আজ মুখ ভার করে রাখার ব্যাপারটা আরাদ্ধাকে খুব ভাবাচ্ছে।সে জিজ্ঞেস করে,চাচা আপনার কি হয়েছে?মন খারাপ কেন?

করিম মন খারাপ করে বলে, কিছু হয়নি মা।

করিম চাচার মুখ থেকে “মা” ডাকটা আরাদ্ধার মন ছুঁয়ে যায়। মলিন হেসে বলে,মা যখন ডাকলেন বলেন কি হয়েছে?আমি কিন্তু সব বুঝতে পারি।
— আপনি রাগ করবেন।
— আপনি আগে বলেন!

করিম কিছুটা সংকোচ নিয়ে বলে,আপনারা তো মাসের প্রথমদিকে বেতন দেন।মাসের প্রথমে বেতনগুলো সমস্যা মিটাতে মিটাতে এক সপ্তাহে শেষ হয়ে যায়।
— আব্বুকে আপনার বেতন বাড়াতে বলব?
— না মা আমি সেই কথা বলি নি।মাস তো শেষের দিকে।হাতে টাকা তেমন নেই।ছোট মেয়ের জ্বর।টাকার জন্য,,,,,
পুরো কথাটা শেষ করলেন না তিনি।আবার বলেন,চলে এসেছি মা!

আরাদ্ধার মন খারাপ হয়ে যায়। সত্যিই ব্যাপারটা ভেবে দেখে নি। গাড়ি থেকে নেমে হাতের টাকাটা করিমের দিকে এগিয়ে দেয়।বলে,এটা নিন। সমস্যা হলে বলবেন।দোয়া করি আল্লাহ্ আপনার মেয়েকে সুস্থ করে দিক।

করিমের চোখমুখ খুশিতে জ্বল জ্বল করে উঠে। ধন্যবাদ দেওয়ার জন্য মুখ খুলতেই আরাদ্ধা হাত উঁচিয়ে থামিয়ে দেয়। মিষ্টি হেসে বলে, ধন্যবাদ দেওয়ার প্রয়োজন নেই।দোয়া করবেন আমার জন্য।

আরাদ্ধা তাড়াতাড়ি ভিতরে চলে যায়।
মেডিকেল কলেজের হাসপাতাল বিল্ডিং অনেক বড়।এখানকার কিছুই ঠিক ভাবে চিনে না আরাদ্ধা। তৃতীয় বর্ষ থেকে ক্লিনিক্যাল ক্লাস শুরু হলে রোগীদের সাথে সম্পর্ক হয়। কারণ ক্লিনিক্যাল ক্লাস এ্যাটেন্ড করতে হয় ওয়ার্ডে।

আরাদ্ধা বুঝতে পারছে না ইউনিট থ্রি কোথায় খুঁজবে।তার উপর আবার রোগী!
হঠাৎ আরাদ্ধার পাশ কাটিয়ে যাচ্ছিল শ্রেয়ান।আরাদ্ধা ডাক দেয়, ভাইয়া ইউনিট থ্রি কোথায়?

শ্রেয়ান হালকা হেসে আরাদ্ধাকে বলে,চলো দেখিয়ে দিচ্ছি।
শ্রেয়ান আরাদ্ধাকে দেখিয়ে দিয়ে চলে যায়। কিন্তু এই এতো বড় ওয়ার্ডে পরিচিত রোগী কোথায় খুঁজবে?
বিশাল বড় ওয়ার্ডের পূর্ব দিকে ডাক্তাররা বসে।আরাদ্ধা সেদিকে যেতে লাগে। রোদ্দুর ওখানে থাকতে পারে। রোদ্দুরকে জিজ্ঞেস করলে ব্যাপারটা সহজ হয়ে যাবে।
আরাদ্ধা গিয়ে দেখে রোদ্দুর পেছন দিক করে একটা চেয়ারে বসে আছে। আরো অনেকেই আছে।আরাদ্ধা ভদ্রভাবে বলে,মে আই কাম ইন?

তাদের মধ্যে একজন মাথা নাড়িয়ে জবাব দেয়, ইয়েস!
আরাদ্ধা ভিতরে ঢুকে রোদ্দুরকে পেছন থেকে একবার ডাক দিল। কিন্তু কোনো রেসপন্স পেলো না।আরাদ্ধা আবার ডাক দেয়। রোদ্দুর হয়ত শুনেনি।আরাদ্ধা গিয়ে রোদ্দুরের পেছনে দাঁড়ায়। রোদ্দুর গভীর মনোযোগ দিয়ে একটা ছবির দিকে তাকিয়ে আছে।আরাদ্ধা বোঝে ছবির উপর মনোযোগ দেওয়ায় অন্য কোথাও মনোযোগ নেই।
আরাদ্ধা মনের কৌতুহল থেকে ছবিটার দিকে উঁকি দেয়। ছবিতে একটা বাচ্চা মেয়ে হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে।
আরাদ্ধার বুক ধক করে উঠে।আরাদ্ধার মাথায় অনেকগুলো চিন্তা এসে ভড় করে।বাচ্চা মেয়েটা সে। কিন্তু তার ছবি কেন রোদ্দুরের কাছে?আর এত গভীরভাবেই বা কেন দেখছে?

আরাদ্ধার রোদ্দুরের হাত থেকে ছবিটা নিয়ে নেয়। রোদ্দুর চমকে উঠে।আরাদ্ধাকে দেখে ধমক দিয়ে বলে,আরু কি করেছিস এটা?ছবিটা এভাবে টেনে নিলি কেন?বেয়াদব মেয়ে!দে ছবিটা।

আরাদ্ধা মুখ ঘুরিয়ে বলে,দেব না।আগে বলেন আমার ছবি এভাবে দেখছিলেন কেন?

রোদ্দুর আবারও ধমক দিয়ে বলে, নিজের লিমিটের মধ্যে থাক।ছবিটা দে!
— দেব না।
রোদ্দুরের রাগ হলো।আরাদ্ধার হাত মুচড়ে ধরে ছবিটা হাতে নেয়। অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে হনহন করে রুম থেকে।
উপস্থিত একজন ডাক্তার এসে আরাদ্ধাকে উদ্দেশ্য করে বলে,এটা কি ধরনের অভদ্রতা?ওনার সাথে এমন আচরণ করা ঠিক হয়নি।

আরাদ্ধা মৃদু কন্ঠে বলে,সরি স্যার!
— আমাকে নয় ওনাকে গিয়ে বল।
— জ্বী!
আরাদ্ধা হেঁটে বাইরে চলে আসে।দেখে রোদ্দুর পকেটে হাত দিয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।হালকা বাতাসে চুলগুলো উড়ছে।রাগের জন্য হয়ত মুখটা হালকা লাল হয়ে আছে।এই মুহূর্তে রোদ্দুরকে দারুণ লাগছে।অন্য সময় হলে আরাদ্ধা মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতো রোদ্দুরের দিকে। কিন্তু আজ রোদ্দুরকে দেখে কাঁদতে ইচ্ছে করছে তার। রোদ্দুর বিয়ে করছে দেখে নাকি বকেছে বলে বুঝতে পারছে না সে।মনে হচ্ছে কাঁদলে হয়ত মনের যন্ত্রণাটা একটু হলেও কমতো।
আরাদ্ধা পেছন থেকে নিজের নাম ধরে কাউকে ডাকতে শুনে চমকে উঠে। পেছনে তাকিয়ে দেখে রাই দাঁড়িয়ে আছে। চোখের দৃষ্টি শূন্যতায় ভরা। চোখেমুখ লাল হয়ে আছে। অনেক কেঁদেছে হয়ত।হুট করে আরাদ্ধাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয়।
কাঁদতে কাঁদতে বলে,আরু,হাসান আর বাঁচবে না। ডাক্তার বলেছে ওর লিভার শেষ।

আরাদ্ধাও কেঁদে দেয়। হাসানের শোকে না।একটু আগের ঘটনাগুলোর জন্য। কষ্টগুলো কান্না হয়ে বের হচ্ছে।রাই আরাদ্ধাকে টেনে হাসানের কাছে নিয়ে যায়।বলে,তুই এখানে থাক।আমি আসছি।

আরাদ্ধা কান্না বন্ধ করে দেয়। রাইয়ের কথা শুনে অবাক হয়। অস্বস্তি বোধ করছে। কিন্তু বলার আগেই রাই সেখান থেকে চলে যায়।

☆☆☆

— রোদ্দুর!
হঠাৎ রাইয়ের ডাক শুনে পেছনে ঘুরে তাকায় রোদ্দুর। ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তার দিকে।
রাই আস্তে করে বলে,কি ভুল করেছিলাম আমি?

রোদ্দুর রাইয়ের চোখের ভাষা বুঝতে পারে। কিন্তু মুখের ভাষা বুঝতে কষ্ট হচ্ছে। অন্যদিকে তাকিয়ে বলে, মানে?
— সেদিন তুমি ফিরিয়ে দিয়েছিলে বলেই কিন্তু আজ আমার এই অবস্থা সেটা নিশ্চয়ই অস্বীকার করবে না।
— না করবো না। তোমার সাথে যা হয়েছে সেটা সত্যিই খুব খারাপ হয়েছে। কিন্তু সেটার সাথে আমার ফিরিয়ে দেওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। কারণ আমি তোকে নিজের বোনের মতো দেখে এসেছি।ব্যস্!
— কেন দেখলে বোনের মতো।আমি তো কখনো তোমাকে ভাইয়া ডাকিনি।অথচ আরু ভাইয়া ডাকা সত্ত্বেও তুমি ওকে বোনের চোখে দেখো নি।
— সেটা একান্তই আমার ব্যাপার।
— আরু আমার সব শেষ করে দিয়েছে।ওর জন্যই আজ আমার এই অবস্থা।

রোদ্দুর এবার কোনো উত্তর দেয় না। রাইয়ের দিকে একবার তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নেয়।রাই রোদ্দুরের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।হয়ত কোনো উত্তর আশা করেছিল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, শুনলাম তুমি নাকি বিয়ে করছো!

রোদ্দুর তাচ্ছিল্যের হাসি দেয়।বলে,তাহলে তো জানোই। শুধু শুধু আরুকে দোষ দিচ্ছো কেন?আরু কারো কোনো ক্ষতি করেনি।
— আরুকে ঠকাচ্ছো তুমি।আরু কষ্ট পাবে। তুমি বিয়েটা কোরো না প্লিজ।
— তোমাকে বুঝতে খুব কষ্ট হয় আমার। কখনো আরুর দোষ দিচ্ছ।আবার আরুর ভালো চাইছো। বুঝতে পারছি না ব্যাপারটা!আরুকে আমি কোনদিন ঠকাইনি।আরু তো এখন পর্যন্ত আমার মনের কথাগুলোই বুঝতে পারে না।
— তুমি তো আরুকে বকো। কিভাবে বুঝবে?
— আমার এই হুটহাট করে বকা রেগে যাওয়া এই,,, এই অনুভূতির অন্তরালে যে ভালোবাসা লুকিয়ে আছে সেটা আরু কখনো বুঝবে না।
— সেজন্য তুমি অন্য একজনকে বিয়ে করে নিবে?
রোদ্দুর বিরক্তি নিয়ে বলে,আমি কি চাই আর ভবিষ্যতে কি হবে সেটা নাহয় সবার নাজানাই থাক!
রাই পেছন দিকে ঘুরে দাঁড়াতেই দেখে আরাদ্ধা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।রাই কিছু বলার আগেই আরাদ্ধা সেখান থেকে দৌড়ে চলে যায়।
রাই মলিন হেসে রোদ্দুরকে বলে,আরু সরাসরি তোমার মনের কথাই শুনে ফেললো।

আরাদ্ধা দৌড়ে কলেজের বাইরে চলে আসে। রীতিমত হাপাচ্ছে। নিজের কানকে বিশ্বাস করাতে পারছে না একটু আগে রোদ্দুরের বলা কথাগুলো।
হুট করে তার ফোনটা বেজে উঠে। আননোন নাম্বার।আরাদ্ধা কল অ্যাটেন্ড করে।ওপাশ থেকে মেয়েলি কণ্ঠ ভেসে আসে।
,
,
কল অ্যাটেন্ড পেছনে তাকাতেই দেখে শ্রেয়ান মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে আছে।মুখ দেখে মনে হচ্ছে অনেক কিছু বলতে চায়। কিন্তু সংকোচে বলতে পারছে না।
আরাদ্ধা হাসে।বলে, মেয়েদের মতো এভাবে দাঁড়িয়ে আছেন কেন, হুম?একটা সাধারণ কথা বলতে এতো সংকোচ ঠিক না।
শ্রেয়ান অবাক হয়। জিজ্ঞেস করে, তুমি জানো আমি কি বলবো?
আরাদ্ধা শান্তির হাসি দেয়।বলে, জানি তো।আমি ডিএনএ টেস্ট করতে রাজি। আপনার বোন শ্রেয়া ফোন দিয়েছে।
— ওহ্!
— শুনুন আমি আপনার সাথে আলাদাভাবে আমার দেখা করতে পারবো না।আমার বাসায় প্রবলেম আছে।আর অদ্রিকে জানিয়ে দিন প্রোগ্রামটা ক্যান্সেল। নির্বিকার গলায় বলে আরাদ্ধা।
শ্রেয়ান বলে,আমার সাথে আসো।
শ্রেয়ান হাঁটা শুরু করে।আরাদ্ধা শ্রেয়ানকে ফলো করে সামনের দিকে এগোতেই পেছন থেকে রোদ্দুর চড়া গলায় ডাক দেয়,আরাদ্ধা,,,,,!

চলবে,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে