অনুতপ্ত পর্ব-০৯(শেষ পর্ব)

0
1605

#অনুতপ্ত শেষ পর্ব
#সাদমান হাসিব

রুবাইয়া অপেক্ষা করছিল সিরাতের জন্য, সিরাতের পছন্দের সবকিছু রান্না করেছে। সিরাত শুটকি মাছের ভুনা আর গাজরের পায়েস খুব পছন্দ করত এই দুইটা জিনিস রুবাইয়াত মন দিয়ে খুব যত্ন করে রান্না করেছে। অপেক্ষা করছে ছেলে কতক্ষণে বাসায় ফিরবে।
গাড়ির হর্ন শোনা যাচ্ছে, মনে হয় সিরাত এসেছে, এটা ভেবে রুবাইয়া গেটের কাছে দৌড়ে গেল।
ছয় বছর পরে আদরের ছেলেকে দেখতে পাবে রুবাইয়া তাই সে খুশি। গাড়ি থেকে আরাফ বের হলো তারপর এক বিদেশিনি মেয়ে তারপর সিরাত বের হলো, সিরাতকে দেখে রুবাইয়া তারাতাড়ি এগিয়ে গিয়ে সিরাতের মুখে হাত বুলাচ্ছে, আর বলছে।

বাবা তুই আমাকে ভুলে গিয়েছিস, তোর জন্য আমি প্রতিরাতে কান্না করি। তুই জানিস তোর ছোটবেলার ফটো আমি বুকে নিয়ে ঘুমাই, তুই কেন আমাকে ভুলে গেলি।

উফ আম্মু তুমি এত বেশি বেশি করছো কেন, আমি এখন ছোটটি নাকি, ওদিকে সরে যাও বাসায় ঢুকতে দিবেনা।

সিরাতের এমন ব্যবহারে রুবাইয়া স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সিরাত এর বউ ক্যামেলিয়া রুবাইয়াকে দেখে বলল,

সিরাত এটা তোমার মাম্মি?

হ্যাঁ আমার আম্মু এটা।

রুবাইয়া কোন কথা বলতে পারতেছে না সিরাতের এই ব্যবহারে, তার মনে হচ্ছে বিদেশিনী মেয়েটা কে, কিন্তু কিছুই জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করছে না।

আরাফ তার মাকে বলল, কি হলো দাঁড়িয়ে আছো কেন যাও খাবার রেডি করো ভাইয়া ভাবীর জন্য। ওরা এতদূর থেকে এসেছে আর তুমি এখানে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে।

রুবাইয়া আরাফকে বলল, তুই দেখলি না সিরাত আমার সাথে কি রকম ব্যবহার করুন, মায়ের সাথে কেউ এরকম ব্যবহার করে। আমি তোদের জন্য কি না করেছি, আজ তোরা প্রতিষ্ঠিত হয়ে মাকে দেখতে পারিস না।

আম্মু এখন কাহিনী রাখো তো, তোমার এ কাহিনী সারাজীবন শুনে এসেছি। দাদি কিন্তু তোমার চেয়ে বেশি কষ্ট করে আব্বুকে মানুষ করে তারপরও তুমি তাদেরকে শান্তি দাও নি। এখন তুমি কিভাবে শান্তি আশা করো? এরচেয়ে ভালো কিছু আশা করতে পারো না।

দুই ছেলের এমন অপমানে রুবাইয়া কষ্টের সাগরে নিমজ্জিত হচ্ছে, তাহলে কি সিরাত বিদেশিনী মেয়েটাকে বিয়ে করে নিয়ে এসেছে আমাকে না জানিয়ে, রুবাইয়া ভাবছে।

খাবার টেবিলে সিরাতকে রুবাইয়া জিজ্ঞেস করলো, তুই বিয়ে করে ফেলেছিস একটাবার মাকে জিজ্ঞেস করার কথা মনে করলি না।

তোমাকে কি জিজ্ঞেস করবো আমার ভালো লেগেছে আমি বিয়ে করেছি।

আমি তোর মা, তোকে আমি মানুষ করেছি, বিয়ে করার মত এতবড় সিদ্ধান্ত আমাকে ছাড়া নিলি।

তুমি আমাকে মানুষ করেছ মা হও যেটুকু করার করেছ, সেটা তোমার দায়িত্ব। আর যেটুকু লেখাপড়া করিয়েছ তার বেশিরভাগ অবদান আমার বাবার। তার বদলে চাকরি তুমি করেছ না হলে চাকরি পেতে না, আর যা টাকা আব্বু ব্যাংকে রেখেছিল, সেগুলো খরচ করে আমাদের দুই ভাইকে পড়িয়েছো।

তোর বাবা যা টাকা রেখেছিল সেগুলো দিয়ে তোদের পড়ালেখা হয়নি, আমি চাকরি করে তোদের পড়িয়েছি।

আচ্ছা হয়নি, তুমি না হয় চাকরি করে পড়িয়েছো, আমার বাবার যে ফ্ল্যাটটা ছিল, সেই ফ্ল্যাট তো বিক্রি করে দিয়েছো, সেই টাকা কি করেছো। এত কথা বলতে এসো না, সারাজীবন বেশি কথা বলেছো, এখন ছেলেদের সাথে চুপচাপ থাকবে তাদের সংসারে।

রুবাইয়া আর সহ্য করতে পারলো না, তার রুমে গিয়ে দরজা লাগিয়ে চিৎকার করে কান্না শুরু করছে।

আরাফ মনে মনে ভাবছে এগুলো তোমার পাওনা ছিল, তুমি আমার বাবা দাদির সাথে এমন করেছো তাই ফিরে পাচ্ছো।

সিরাত দুই মাসের ছুটিতে এসেছে আরাফ তার ভাইকে বললো, সে একটা মেয়েকে ভালোবাসে তার বাবা সেনাবাহিনীর মেজর। মেয়েটা চাচ্ছে তাদের বাসায় বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যেতে।

ঠিক আছে সামনের শুক্রবার আমরা মেয়ে দেখতে যাবো, তুই জানিয়ে দে তাদের।

আরাফ বৃষ্টিকে দেখা করতে বলল পার্কে, দুজনে অনেকক্ষণ কথা বলে যে যার বাসায় চলে আসলো। বৃষ্টি তার বাবাকে বললো আরাফের কথা, আরাফ তাকে ভালোবাসে আরাফ একজন ইঞ্জিনিয়ার। তার সংসারে মা আর ভাই, ভাই অস্ট্রেলিয়ায় সিটিজেন হয়ে গেছে। সবকিছু শুনে মেজর মোহাম্মদ ওবায়দুল ইসলাম সামনের শুক্রবার আরাফকে আসতে বললেন।

ক্যামেলিয়া সিরাত ও আরাফ বৃষ্টিকে দেখতে যাবে রুবাইয়াকে কেউ কিছু বলল না। যেদিন দেখতে যাবে সেদিন শুধু বলল, আমরা মেয়ে দেখতে যাচ্ছি তোমাকে সাথে নিতাম, কিন্তু একটা কারণে নিলাম না।

রুবাইয়া জিজ্ঞেস করল কি কারণ, আমি কি বুড়ো হয়ে গেছি, দেখতে খারাপ আমাকে সাথে নিয়ে গেলে তোরা লজ্জা পাবি, আমি কিন্তু শিক্ষিত মূর্খ নয়।

সিরাত তখন বলল, তুমি মূর্খ না শিক্ষিত সেটা জানি, কিন্তু অশিক্ষিতের মত কাজ করেছ। অতীতে সেই খারাপ রেকর্ড তোমার আছে। বৃষ্টির বাবা একজন সরকারি কর্মকর্তা, তোমাকে সাথে নিয়ে গেলে যদি চিনতে পারে ঘুষ গ্রহণ করার দায়ে তুমি জেলে গিয়েছিল। তখন কিন্তু চাইবে না বৃষ্টিকে আরাফের সাথে বিয়ে দিতে। তাই নিজের ছেলের ভালো চিন্তা করে না যাওয়াই ভালো বৃষ্টিদের বাসায়।

রুবাইয়া আঘাতের পর আঘাত পাচ্ছে, তার মনে হচ্ছে অতীত স্মৃতি, বাবুর মায়ের সাথে করা অন্যায় আচরণগুলো সৃষ্টিকর্তা তার ছেলেদের মাধ্যমে প্রতিশোধ নিচ্ছে। না হলে নিজের পেটের ছেলে হয়ে শত্রুর মতো ব্যবহার কেন করছে তার সাথে। যে সিরাতকে এত আদর করে সে মানুষ করছে, সেই আদরের সন্তানের দ্বারাই রুবাইয়া বারবার অপমানিত হচ্ছে।

সিরাত বৃষ্টিদের বাসায় এসে বৃষ্টির বাবার সাথে কথা বলে বিয়ে একরকম পাকাপাকি করে ফেলল। বৃষ্টির বাবা অমত করেনি, ছেলে ইঞ্জিনিয়ার নিজস্ব ফ্ল্যাট আছে। আরাফ কিছুদিন ধরে নিজের ফ্ল্যাট কিনেছে। বৃষ্টির বাবা বলল দুইদিন পর তারা আরাফের বাসায় যেয়ে আংটি পড়িয়ে আসবে। বৃষ্টিকে ক্যামেলিয়া ও সিরাতের অনেক পছন্দ হয়েছে আর বিশেষ করে বৃষ্টির বাবা অনেক ধনী এটা দেখেই সিরাতের বেশি পছন্দ হয়েছে।

দুইদিন পর বৃষ্টির বাবা যখন আরাফের বাসায় আসলো সিরাত আরাফ তার মাকে বলল, তুমি সামনে এসো না। যদি চিনে ফেলে তাহলে আমার সাথে বৃষ্টিকে বিয়ে দিবেনা। রুবাইয়া রুমে দরজা বন্ধ করে পুরনো স্মৃতিগুলো মনে করছে, সে তার পাপের শাস্তি পাচ্ছে নিজের ছেলেদের অবহেলায়। বৃষ্টির বাবা এসেছে, আরাফ হোটেল থেকে উন্নত মানের খাবার কিনে এনেছে। বৃষ্টির বাবা-মা জিজ্ঞেস করলো, কই বিয়ান সাহেবাকে তো দেখছি না, বিয়ান সাহেবা কই।
সিরাত বৃষ্টির বাবাকে বলল, আম্মু অনেক পর্দা করে তাই সে রুমে আছে আম্মু কারো সামনে আসেনা।
এটা শুনে বৃষ্টির মা বললো তাহলে আমি যাই বিয়ান সাহেবার সাথে দেখা করে আসি।

বৃষ্টির মা আসার আগেই সিরাত তার মাকে বলল, আমরা তাকে বলেছি তুমি পর্দাশীল কারো সামনে যাও না, তাই বৃষ্টির মা তোমার সাথে দেখা করতে আসছে। আমরা যা বলেছি তুমি তাই বলবে, তুমি পর্দা করো কারো সামনে যাওনা।

রুবাইয়া চোখের পানি মুছে বললেন, ঠিক আছে চিন্তা করিস না আমার জন্য তোদের কোন ক্ষতি হবে না।

আসসালামু আলাইকুম বিয়ান সাহেবা, কেমন আছেন।

আলহামদুলিল্লাহ ভালো, আপনি কেমন আছেন।

আলহামদুলিল্লাহ আমিও ভালো আছি, আপনি নাকি পর্দা করেন তাই বৃষ্টির বাবার সামনে যাচ্ছেন না, আমি চলে আসলাম আপনার সাথে দেখা করতে। কি ব্যাপার আপনি কি অসুস্থ চোখে এমন লাল কেন।

হ্যাঁ আমি অসুস্থ মাথা ব্যথা, তাই চোখ দিয়ে পানি পড়ছে।

রুবাইয়া বৃষ্টির মায়ের সাথে মিথ্যা কথা বলল, সে চায় না তার জন্য তার ছেলের বিয়ে ভেঙে যাক। রুবাইয়ার আজ খুব কষ্ট হচ্ছে, সে ভাবতেছে, মানুষ কেন অহংকার করে হিংসা জিদ করে। এই অহংকার এর বশবর্তি হয়ে তার কপালে আজ একটা দুর্দশা। আরাফের বিয়ে হয়ে গেল, সিরাত বিদেশ চলে গেছে। সংসারের যাবতীয় কাজ রুবাইয়ার করতে হয়। বৃষ্টি সারাদিন শুয়ে থাকে মোবাইল টিপে, বান্ধবীদের সাথে ঘুরতে যায়। খাবার সময় সবকিছু ডাইনিং টেবিলে নিয়ে সবাইকে বেড়ে খাওয়াতে হয় রুবাইয়ার। কেউ তাদের বাসায় এসে মনে পড়বে রুবাইয়া বাসার কাজের মহিলা। রুবাইয়া কখনো এত কাজ করেনি, সে আরাম-আয়েশে জীবন পার করেছে। কাজ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে বৃষ্টিকে বলল, একটা কাজের মানুষ রাখো, তোমাদের তো আর টাকা পয়সার অভাব নেই, আমাকে এত কষ্ট করাচ্ছো কেন, তোমরা চাইলেই তো কাজের মহিলা রাখতে পারো।

বৃষ্টি তখন বললো, কাজের মানুষ রাখার কি দরকার। আপনি আছেন না, শুয়ে-বসে খাবেন সেটা কি হয়।

রুবাইয়া রেগে বলে, আমার ছেলের রোজগার আমি খাই, তুমি আমাকে খোঁটা দিচ্ছ কেন? এত কাজ করাতে হলে তোমার মাকে এনে কাজ করাও।

বৃষ্টি খুব ক্ষেপে গেল তার মাকে এনে কাজ করাতে বলাতে। আরাফ বাসায় এলে রুবাইয়া ছেলেকে বলে, তোর বউ আমাকে খাবার খোঁটা দেয়,কাজের মহিলা মনে করে। তখন বৃষ্টি দৌড়ে এসে বললো, তোমার মা বলেছে আমার মাকে এই বাসায় এসে কাজ করতে। তোমার মা নয়তো আমি দুজন থেকে একজন থাকবো এই বাসায়, তার সঙ্গে আমি থাকব না।

তখন আরাফ বলল, মা তুমি এখনো ভালো হলে না, জানি জীবনে আর ভালো হবে না। ছেলের বাসায় কাজ করতে তোমার কষ্ট লাগে তাইনা, আমার দাদি ও তো কাজ করেছিল তার কি কষ্ট লাগেনি। তুমিতো সুস্থ-সবল আছো কাজ করে খাও, আর না হলে বাসা থেকে চলে যাও তোমার বাবার বাসায়। তোমার বাবা বেঁচে না থাকলেও তোমার ভাই বেঁচে আছে সেখানে চলে যাও। রুবাইয়ার মনে পড়ে গেল সে বলেছিল তার সন্তান বা ছেলের বউ যদি বলে তাকে বাসা থেকে চলে যেতে তাহলে সে সাথে সাথে চলে যাবে। বাবুকে বলেছিল সে তার মায়ের মতো নির্লজ্জ নয়। রুবাইয়া তার ভাইয়ের বাসায় যেয়ে অপমানিত হবে না, তার এখন বয়স হয়েছে কোথাও চাকরি করতে পারবেনা, এত কষ্ট নিয়ে বেঁচে থাকা যায় না। সে সিদ্ধান্ত নিল এ জীবন আর রাখবে না। সারারাত কেঁদে কেঁদে কাটিয়ে দিয়ে ভোরে সিরাত এর কাছে ফোন করলো, বলল তুই আমাকে তোর কাছে অস্ট্রেলিয়া নিয়ে যাবি, আমি আরাফের বাসায় থাকবো না, আরাফ আমাকে বাসা থেকে চলে যেতে বলছে। তোর কাছে নিয়ে না গেলে আমি এ জীবন রাখব না। সিরাত বলে, তোমাকে অস্ট্রেলিয়া নিয়ে আসব কেন তুমি যখন আরাফের বউয়ের সাথে মিলেমিশে থাকতে পারো না ক্যামেলিয়ার সাথে কিভাবে মিলেমিশে থাকবে। তোমার যা ইচ্ছা তাই করো। তোমার সব আমার জানা আছে, তুমি কারো সাথে কখনো মিলেমিশে থাকতে পারবেনা। সিরাতের এমন তীক্ষ্ণ কথায় রুবাইয়ার বেঁচে থাকার ইচ্ছা ধূলিসাৎ হয়ে গেল, সে বাসা থেকে বের হয়ে গেল ঢাকার অদূরে নদীতে গিয়ে ঝাঁপ দিল। সে জানে তার ছেলেরা যাকে খুঁজবে না তাই মরে গেলেও তার লাশ কেউ খুঁজে বের করবে না। আরাফ ও তার বউ সকালে উঠে দেখল তার মা বাসায় নেই, বৃষ্টি ভাবলো যাক ঝামেলা চুকে গেছে। আরাফ কয়েকদিন পর তার মাকে না পেয়ে খোঁজখবর করল, কিন্তু কোথাও পেল না। বেওয়ারিশ লাশ হয়ে রুবাইয়া পঁচা গলা শরীরে হয়তো কোথাও দাফন হয়েছে। অহংকার হিংসা জিত মানুষের জীবন টাকে নরক করে দেয়, এভাবে শাস্তি দুনিয়াতে পেয়ে যায়। মানুষ যারাই অহংকার করুক মানুষের সাথে খারাপ ব্যবহার করুক এই শাস্তিটা আল্লাহতালা তাদের দুনিয়াতে দিয়ে নেয়।

সমাপ্ত

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে