#অনুতপ্ত ৬ষ্ঠ পর্ব
#সাদমান হাসিব
রুবাইয়া খুব ভোরে উঠে তার বাবাকে নিয়ে মানিকগঞ্জ রওনা হলো, সে কতক্ষণে তার শাশুড়িকে নিয়ে আসবে সে চিন্তায় অস্থির। কারণ শাশুড়িকে নিয়ে আসা মানেই ছেলে সিরাতকে ফিরে পাওয়া। সকাল দশটায় শাশুড়ির কাছে এসে পৌঁছালো, আরো আগে আসতে পারতো যানজটের কারণে এক ঘন্টা লেট হয়ে যায়। গাড়িতে বসে সে বারবার বাবুর কাছে কল করছিল একবার খুব অনুরোধ করে সিরাতকে ভিডিও কলে দেখলো। রুবাইয়ার কাছে মনে হচ্ছে এই তিন দিনে সিরাত অনেকটা শুকিয়ে গিয়েছে। আমি সিরাতকে যতই আদর যত্ন করে রাখি মা ছাড়া একটা সন্তান কখনোই সুস্থ সবল থাকতে পারেনা। রুবাইয়া আমাকে কিছু বলল না কারণ সে জানে আম্মুকে না নিয়ে গেলে সিরাতকে কখনোই নিয়ে আসবো না।
এই সকাল বেলা রুবাইয়াকে দেখতে পেয়ে খালা আর আম্মু দুজনেই চমকে উঠলো, ভাবছে আবার কি জানি কি বলতে এসেছে মেয়েটা। কিন্তু তাদের ভাবনা ধূলিসাৎ করে দিয়ে রুবাইয়া আম্মুর হাতে ধরে কেঁদে ফেললো।
আমাকে ক্ষমা করে দেন আমি খুব বড় ভুল করে ফেলেছি, জানিনা কেন এতটা হিংসাত্মক আচরণ করলাম আপনার সাথে। আমার খুব বড় অন্যায় হয়েছে আমি ক্ষমাপ্রার্থী, আপনি এখনই আমার সাথে বাসায় চলেন।
রুবাইয়ার বদলে যাওয়া দেখে খালা আম্মু এবং বাসার অনেকেই বিশ্বাস করতে পারছে না, সবাইকে উদ্দেশ্য করে রুবাইয়া বললো, আমি বাবুর কথা মতো আপনাকে নিতে এসেছি। আপনাকে নিয়ে গেলেই বাবু আমার ছেলেকে নিয়ে ফিরে আসবে, না হলে ফিরে আসবেনা।
রুবাইয়ার একথা শুনে খালা বলে উঠলো ও তাহলে এই কারণ, তুমি নিজ ইচ্ছায় তোমার শাশুড়িকে নিতে আসোনি। তুমি তোমার ভুল বুঝতে পারোনি, এখন আপাকে নিয়ে যাবে দুইদিন পরে আবার বলবে তাকে তাড়িয়ে দিতে।
না খালাম্মা এটা কখনো আর করব না, আমি আমার নিজের ভুল বুঝতে পেরেছি। আগে বুঝতে পারিনি সন্তানের জন্য মায়ের কেমন কষ্ট হয়, এই তিন দিনে উপলব্ধি করতে পেরেছি এই কষ্টটা তাই আমি আর আম্মুকে কখনো তার ছেলেকে ছেড়ে আসতে বলবো না।
খালা আমাকে ফোন দিলো, জানতে চাইল আম্মুকে রুবাইয়ার সাথে পাঠাবে কি পাঠাবে না। আমি খালাকে বলে দিলাম আম্মুকে তার সাথে পাঠিয়ে দাও, শুধু আম্মু নয় খালা ও রুবাইয়ার সাথে ঢাকা আসলো। আমি আজিমের কাছ থেকে ও ভাবীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাসে উঠলাম, দুপুর 2:30 বাস থেকে নেমে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছি, রুবাইয়া কল করে জিজ্ঞেস করতেছে এত দেরি কেন, আমি কেন এখনো আসতেছি না। বললাম এইতো আমি বাসার সামনে সে দৌড়ে গেইটের কাছে আসলো সিরাতকে বুকে জড়িয়ে ধরে অসংখ্য চুমু দিচ্ছে সারা শরীরে। আমি চলে আসলাম ফ্ল্যাটে, আম্মু আমাকে দেখে জড়িয়ে ধরে কান্না করছে।
আমার কলিজার টুকরা তুই আমার জন্য এত কিছু করতে গেলি কেন, এত কিছু করার দরকার কি ছিল, আমি নাহয় থাকতাম তোর খালার কাছে।
তুমি এখন আমাকে ভালোবাসো না তোমার কাছে আমি বড় হয়ে গেছি তাই আমাকে ছাড়া থাকতে পারবে, কিন্তু আমি তো তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না।
কি বলিস তুই তোকে আমি ভালোবাসি না, তুইতো আমার কলিজার টুকরা একটা মাত্র সন্তান, তোকে না ভালোবাসলে কাকে ভালোবাসবো, আমি চাই তোর সন্তানকে নিয়ে তুই সুখে থাক।
শুধু সন্তানকে নিয়ে নয়, সুখে থাকতে হলে তোমাকে প্রযোজন আছে, আমি চাই আমার মা সন্তান স্ত্রী সবাইকে নিয়ে ভালো থাকতে। রুবাইয়া যদি তার ভুল বুঝতে পারে তাহলে দ্বিতীয়বার সে আর এমন করবে না, যদি দ্বিতীয়বার এমন করে সত্যি সত্যি আমি তাকে ডিভোর্স দিয়ে দেবো।
খালা বললেন, বাদ দে বাবা এগুলো বলে না, বৌমা হয়তো এখন বুঝতে পেরেছে।
রুবাইয়া সিরাতকে খাওয়াচ্ছে, তার মাকে পেয়ে সিরাত খুব উৎফুল্ল যতই হোক মায়ের মত আপন কেউ হতে পারে না, আমি যতই আদর করি সে তার মায়ের অভাব ঠিকই বোধ করেছে।
আবার সবকিছু ঠিক হয়ে গেল, রুবাইয়া সত্যি আমার মাকে মেনে নিতে পেরেছে। এখন আর কোন প্রবলেম নেই সংসারে। আমি তাকে বুঝাতে পেরেছি আমিও তাকে অনেক ভালোবাসি, আগে হয়তো রুবাইয়ার মা-বাবা তাকে কুবুদ্ধি দিতো কিন্তু এখন তারা আর কোন ঝামেলা করে না।
আমার চাকরির প্রমোশন হয়েছে, বদলি হয়েছি রাজশাহীতে এবং রুবাইয়া আবার সন্তানের মা হতে চলেছে। আজকে তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো সে আল্ট্রাসনোগ্রাফ করে দেখতে চায় ছেলে হবে না কি মেয়ে হবে, আমরা দুজনে চাচ্ছি একটা মেয়ে হোক। একজন ছেলে একজন মেয়ে নিয়ে সুখের সংসার হবে আমাদের। অফিস থেকে ফিরে সবাই মিলে একসঙ্গে বিকেলের নাস্তা করলাম, সিরাতের এখন ৫ বছর, সিরাতকে স্কুলে ভর্তি করানো হয়েছে। বাসার কাছেই ক্লিনিক আছে সেখানে গেলাম রুবাইয়াকে নিয়ে। মহিলা ডক্টর খুব ভালো অমায়িক প্রেগন্যান্ট অবস্থায় স্ত্রীকে কিভাবে যত্ন নিতে হয় সেগুলোর বিষয়ে আমাকে বোঝাচ্ছে। আমি ডাক্তারকে বললাম, এটা আমাদের দ্বিতীয় সন্তান, আমি জানি স্ত্রীকে প্রেগন্যান্ট অবস্থায় কিভাবে খেয়াল রাখতে হয়। আলট্রাসনো করে জানালো আমাদের দ্বিতীয় সন্তান ছেলে হবে, তবুও আমি খুশি।
রুবাইয়া আমাকে বলল তুমি কি খুশি হওনি বাবু।
কেনো খুশি হবো না ছেলে কিংবা মেয়ে যেটাই হোক সেটা তো আমারই সন্তান।
তোমার তো ইচ্ছে ছিল মেয়ে বাচ্চা হোক।
সবার সব ইচ্ছা পূরণ হয়না, চিন্তার কিছু নেই সময় তো আর চলে যায়নি, নাহয় তৃতীয়বার সন্তান নেবো আমরা।
এটা ঠিক বলেছ দরকার হয় আমরা তৃতীয় সন্তান নেব।
ডাক্তার নাজনিন কামাল, আমাকে আর রুমাইয়াকে তার রুমে ডাকলেন।
দেখুন আমাদের কিছু কথা বলার আছে, ভয়ের কোনো ব্যাপার না, তবুও বলবো ভয় পাবেন না।
রুবাইয়া কিছুটা ঘাবড়ে গেল ডাক্তারের কথায়।
আমি ডাক্তারের কাছে জানতে চাইলাম কি হয়েছে বলুন।
রুবাইয়ার পেটে বাচ্চার পাশাপাশি বড় রকমের একটা টিউমার হয়েছে, যখন বাচ্চার সিজার হবে তখন সেটা কেটে ফেলে দেওয়া হবে।
এইবার প্রেগন্যান্সির পর থেকে রুবাইয়া শরীরটা
সবসময় খারাপ থাকে, তাহলে এই টিউমারের কারণেই রুবাইয়া অসুস্থ থাকতো, এখন বুঝতে পারলাম।
রুবাইয়াত সব খেয়াল আম্মু রাখে, নিজের মেয়ের মত রুবাইয়াকে যত্ন করে। আম্মুর কোন মেয়ে নেই বলে তার মনে আফসোস ছিল, বলতো তোর বাবা বেঁচে থাকলে হয়তো আমার আরো একটা মেয়ে হতো কিন্তু সেই ইচ্ছাটা আমি তোর বউকে দিয়ে পূর্ণ করব। রুবাইয়া সেই ইচ্ছাটা পূরণ করতে পারেননি কারণ রুবাইয়া আম্মুকে মায়ের স্থান দেয়নি কিন্তু এখন রুবাইয়া অসুস্থ হওয়ার পর থেকে আম্মুর আফসোসটা আর নেই সে বলে আমার মেয়ে এটা, আমার মেয়ের সব সেবাযত্ন আমি একা করবো। রুবাইয়াকে দেখি এখন মায়ের প্রতি তার অনেকটাই দায়িত্ব হয়েছে, আম্মুর যদি কোন কিছু দরকার পড়ে রুবাইয়া আমাকে বলে দেয় এটা লাগবে আম্মুর জন্য ওটা লাগবে আম্মুর জন্য।
মাঝেমাঝে রুবাইয়ার মা আমাদের এখানে এসে থাকে, রুবাইয়ার ছোট ভাই বিয়ে করেছে বউ না কি রুবাইয়ার মাকে দেখতে পারে না। তার জন্য আমি বলেছি যদি তাদেরকে না দেখতে পারে ছেলে ছেলের বউকে আলাদা করে দিক, তোমার বাবা মা আলাদা থাকুক সেটাই ভালো হবে যে সন্তান বাবা মাকে প্রাধান্য না দিয়ে স্ত্রীকে প্রাধান্য দেয় সে সন্তানের সাথে বাবা-মার না থাকাই ভালো, তাদের জন্য আমি টাকা পাঠাবো, আমারো তাদের প্রতি দায়িত্ব আছে।
রুবাইয়ার এখন নয় মাস চলে, বাচ্চা হওয়ার ডেট আর কয়েকদিন পরে তার শরীরটা এখন আরো অনেক বেশি খারাপ, আমি সবসময় চিন্তায় থাকি যদি কিছু হয়ে যায় রুবাইয়ার। সে যেমনই থাক তাকে আমি ভালোবেসে বিয়ে করেছি সে আমার স্ত্রী, আর আগে যেমন ছিল তেমন নেই এখন অনেকটা বদলে গেছে। আমার মায়ের সাথে সে মিলেমিশে আছে এতে আমার মনে শান্তি ফিরে আসছে।
ডাক্তার বলেছে পাঁচ থেকে সাত দিনের মধ্যে রুবাইয়ার সিজার করতে, আমি অফিস থেকে 10 দিনের ছুটি নিলাম। রাজশাহীর একটা আধুনিক প্রাইভেট হসপিটালে রুবাইয়াকে ভর্তি করেছি। রাত আটটায় রুবাইয়ার সিজার, ডাক্তার বলেছে ও নেগেটিভ রক্তের জোগাড় করে রাখতে। আমাদের রিলেটিভদের মধ্যে কারো ও নেগেটিভ রক্ত নেই তাই আমি আমার এক ফ্রেন্ডকে বলে রেখেছি রক্ত দিতে, আমার ফ্রেন্ড রক্ত দিতে রাজি আছে। তাকে সন্ধ্যায় বললাম হসপিটালে চলে আসতে, সে এসে রক্ত দিয়ে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর রুবাইয়ার সিজার। আমি অপারেশন থিয়েটারের সামনে পায়চারি করছি খুব অস্থির লাগছে, 40 মিনিট পর নার্স অপারেশন থিয়েটার থেকে বের হয়ে বললেন, আরো এক পাউন্ড ও নেগেটিভ রক্ত দরকার, তাড়াতাড়ি করেন আমাদের এখানে ও নেগেটিভ রক্ত নেই। আমি জলদি রক্তের খুঁজে বের হলাম, চোখের সামনে সবকিছু অন্ধকার লাগছে। কয়েক জায়গায় খোঁজে রক্ত পাওয়া গেল, আমি তাড়াতাড়ি হসপিটালে চলে আসলাম। দীর্ঘ 2 ঘন্টা চেষ্টার পর ডাক্তার অপারেশন থিয়েটার থেকে বের হয়ে বললেন, বাচ্চা সুস্থ আছে কিন্তু বাচ্চার মায়ের অবস্থা তেমন ভালো না। এটা শোনার পর আমার খুব কান্না পাচ্ছে আমি রুবাইয়াকে হারাতে চাইনা অনেক ভালোবাসি তাকে, তার যেন কিছু না হয় সৃষ্টিকর্তার কাছে আমার এটাই চাওয়া। রুবাইয়াকে আইসিইউতে রাখা হয়েছে তার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। আমার দ্বিতীয় সন্তানকে আমি এখনো দেখিনি, যখন রুবাইয়া সুস্থ হবে শুনবো তখনই তার মুখ দেখবো। সারারাত রুবাইয়া আইসিইউতে থেকে পরের দিন সকালে কিছুটা সুস্থ হলো। আম্মু বারবার বলছিল তোর ছেলেকে কোলে নে আমি সেদিকে খেয়াল না করে রুবাইয়ার মাথার কাছে বসেছিলাম। রুবাইয়া যখন কিছুটা সুস্থ সে বাচ্চাকে কাছে নিতে চাইলো, তখন আমি বাচ্চাকে কোলে নিয়ে তার কাছে দিলাম। আম্মু তখন রুবাইয়াকে বলল, তোমার জন্য আমার নাতিকে বাবু এখনো কোলে নেয়নি।
বাবু কি বলো তোমার ছেলেকে তুমি এখনো কোলে নাও নি, এমন পাগলামী কেউ করে।
আমি তাকে বললাম তুমি হয়তো বুঝতে পারো না আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি।
আগে বুঝিনি এখন বুঝি, তাইতো দেখনা এখন কতটা চেঞ্জ হয়েছি।
আবার সবকিছু আগের মতোই চলতে থাকলো, অনেক দিন পার হয়ে গেল কিন্তু আমাদের মনে একটা অপূর্ণ আশা রয়ে গেল। আমাদের আর কন্যা সন্তান হবে না, ডাক্তার বলেছে রুবাইয়া তৃতীয়বার সন্তান নিতে চাইলে তার জীবনে ঝুঁকি আছে সে কারণে মেয়ে সন্তানের আশাটা চিরতরে বাদ দিয়ে দিলাম। রুবাইয়াকে বললাম আমার মায়ের আমি এক ছেলে, তোমার দুই ছেলে। তোমার যদি ছেলেকে বিয়ে দিয়ে ছেলের বউ নিয়ে এসে তাকে আমার মায়ের মত মেয়ে বানিয়ে নিতে পারো তাহলে মেয়ের স্বাদ পূরণ হবে। পারবে না ছেলের বউকে মেয়ে করে নিতে। রুবাইয়া বললো, অবশ্যই পারব, কেন পারব না। আমি আমার ছেলের বউয়ের শাশুড়ি নয়, মা হবো।
চলবে,,,,