অনুতপ্ত পর্ব-০৫

0
867

#অনুতপ্ত ৫ম পর্ব
#সাদমান হাসিব

যখন রাত হলো রুবাইয়া বারবার কল দিচ্ছিলো কিন্তু আমি কল রিসিভ করছি না, অনেক রাত হয়েছে বিদায় ফোন বন্ধ করে রেখে দিলাম। এদিকে রুবাইয়া অস্থির হয়ে ছটফট করছে সে, চিৎকার করে কান্নাকাটি করে তার বাবা-মাকে বলছে আমার সিরাতকে এনে দাও, আমি সিরাতকে ছেড়ে থাকতে পারবো না মরে যাব। যেখান থেকে পারো বাবুকে খুঁজে বের করে আমার সিরাতকে এনে দাও।
রুবাইয়ার বাবা রুবাইয়াকে সান্ত্বনা দিয়ে বলছে এত অস্থির হয়ে ভেঙ্গে পরিস না, দেখবি বাবু সিরাতকে রাখতে পারবেন না কালকেই নিয়ে চলে আসবে, এতোটুকু দুধের বাচ্চাকে সে কিভাবে রাখবে।

বাবা তুমি বাবুকে চিনো না, বাবু অনেক জেদি, সে চায় তার মাকে যেন আমি সঙ্গে রাখি আর না হলে আমার ছেলেকে আমার কাছ থেকে আলাদা করবে, সেটাই করে ছাড়বে। আমার ছেলেটা যতই কান্নাকাটি করুক আমার কাছে নিয়ে আসবে না, বাবা-আমার সিরাতের যদি কিছু হয় আমি কিন্তু বাবুকে ছাড়বো না, আমি তার নামে মামলা করব।

ঠিক আছে একটা রাত পার হতে দে, কালকে বাবুকে শেষবারের মতো বলব সে যদি কথা না শুনে আমরা আইনের আশ্রয় নিব।

অনেক রাত হয়েছে সিরাত দুই তিনবার আম্মু আম্মু বলে কান্না করছিল, তখন আমি সিরাতকে নিয়ে কিছুক্ষণ পায়চারি করলাম আর ফিডার খাওয়ানোর পর সে আবার ঘুমিয়ে গেল। এমন করে রাত পার হলো আমার। আমি জানি রুবাইয়া তার বাচ্চার জন্য অস্থির হয়ে ঘুমাতে পারবে না তাকে শাস্তি দিতে আমারও কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু এতোটুকু শাস্তি তার পাওনা, না হলে বুঝবে না সন্তানের জন্য মায়ের কেমন লাগে। আমার আম্মু আমাকে ছাড়া আছে তারও তো কষ্ট হচ্ছে, সেটা তো রুবাইয়া বুঝতে চাচ্ছেনা।

সকালে সিরাতকে নিয়ে আজিম এর সাথে রাস্তায় হাঁটতে বের হলাম, হাঁটতে হাঁটতে দুই বন্ধু গল্প করছি। সিরাত কিন্তু তার মায়ের জন্য তেমন কান্নাকাটি করছে না সে আমার কাছে দিব্যি ভালো আছে। সকালে উঠে তাকে ফিডার খাইয়ে নিয়ে এসেছি।

এদিকে রুবাইয়া সারারাত কান্না করে পার করেছে। সকালে উঠে তার বাবাকে নিয়ে আমাদের সব আত্মীয় স্বজনদের বাসায় খোঁজ করছে, আমার আম্মুর কাছে গেল মানিকগঞ্জে। আমার আম্মু কিছু জানেনা আমার বিষয়ে আমি যে সিরাতকে নিয়ে চলে আসছি, আম্মু বারবার না করল সে আমার বিষয় কিছু জানেনা, কিন্তু রুবাইয়া তার সাথে হুমকি-ধমকি দিয়ে বলল।

আপনাদের আমি দেখে নেব আমার ছেলেকে যদি না পাই।

দুপুরের দিকে খালা আমাকে ফোন দিল, বাবু বৌমা তার বাবাকে নিয়ে আমাদের এখানে আসছিল তোর মায়ের সাথে ঝগড়া করল, বললো, তোর মা নাকি চালাকি করে তোদের লুকিয়ে রেখেছে। আমরা তো জানি না তুই কোথায় আর এমন পাগলামি কেন করছিস, ছোট একটা বাচ্চাকে নিয়ে তুই কিভাবে থাকবি।

খালা এটা পাগলামি না, আমার মায়ের কাছ থেকে সে আমাকে আলাদা করেছে, তার সন্তানকে আলাদা করে সে শাস্তিটা তাকে বোঝাতে চাচ্ছি।

দেখ বাবা তোদের দুইজনের জিদের কারণে ছোট বাচ্চাটাকে কষ্ট দিস না, সিরাতের যেন কোন ক্ষতি না হয়।

তুমি চিন্তা করো না খালা, সিরাত আমার সাথে ভালো আছে, মাঝে মাঝে একটু আম্মু আম্মু করছে আবার ভুলে যাচ্ছে।

বাবা তুই ফিরে আয়, তোর মা না হয় আমাদের কাছে থাকুক।

না সেটা হবে না, তাকে বুঝাতে হবে সন্তানের জন্য মায়ের কেমন লাগে, আমার আম্মুর সাথে রুবাইয়ার কেন জিদ করে, আম্মু তো কখনো রুবাইয়ার সাথে হিংসা জিদ খারাপ আচরণ করেনি, অত্যাচার করেনি। তাহলে কেন সে আমার মাকে দেখতে পারবেনা, তার এই অন্যায় আমি মেনে নেবো না।

সিরাতকে নিয়ে দুই দিন ধরে ময়মনসিংহে আছি, ভাবী পরম যত্নে সিরাতকে সামলাচ্ছে তাই আমার তেমন কষ্ট হচ্ছে না সিরাতকে নিয়ে। আর এমনিতেও আমার ছেলেটা খুব শান্তশিষ্ট তেমন কান্নাকাটি করে না। এরমধ্যে কয়েকবার রুবাইয়ার সাথে আমার কথা হয়েছে, আমি তাকে বলে দিয়েছি যেখানে আমার মা থাকতে পারবে না সেখানে তুমিও তোমার সন্তানকে নিয়ে থাকতে পারবেনা। কিছু বললেই তুমি তোমার বাবার বাড়ি চলে যাবে আমার সন্তানকে সাথে নিয়ে, আমার সন্তানের জন্য তো আমারও কষ্ট হয়, তুমি আমাকে কষ্ট দিতে পারবে, আমি তোমাকে কষ্ট দিতে পারব না সেটা কেমন করে হয়।

দুই দিনে যখন আমি সিরাতকে নিয়ে না ফিরলাম তখন রুবাইয়া তার বাবাকে নিয়ে থানায় আসলো। থানায় এসে কান্নাকাটি করছে ওসির সামনে, ওসি সাবের আহমেদ রুবাইয়াকে বললেন, কি হয়েছে আপনার প্রবলেম কি এমন করে কান্নাকাটি করছেন কেন।

আমার স্বামী শরীফ আহমেদ বাবু, দুইদিন হয় আমার ছেলেকে নিয়ে কোথায় যেন পালিয়েছে। স্যার আমার ১৪ মাসের শিশুটা আমার জন্য কান্নাকাটি করে ছেলেটার কি জানি অবস্থা। প্লিজ স্যার আপনি আমার ছেলেটাকে উদ্ধার করে দিন, বাবুকে বলেন আমার ছেলেকে নিয়ে ফিরে আসতে।

আপনার স্বামী আপনার সাথে ঝগড়া করে ছেলেকে নিয়ে চলে গেছে।

হুম আমার সাথে ঝগড়া করে ছেলেকে নিয়ে গেছে।

ঝগড়াটা কিসের জন্য, কারণটা বলেন।

ওসির সাথে কারণ বলতে যেয়ে রুবাইয়া চুপ হয়ে গেল, সে কিভাবে বলবে তার শ্বাশুড়ীকে তাদের বাসায় রাখবেনা এটা নিয়ে ঝগড়া হচ্ছে।

কি হলো মিসেস রুবাইয়া আপনি চুপ কেন, বলুন কি কারণ, আমাদের আসল কারণটা জানতে হবে, কেন আপনার স্বামী ছোট একটা বাচ্চাকে নিয়ে নিরুদ্দেশ হয়েছে, কোন তো কারণ আছে অবশ্যই।

আমি বলছিলাম আমার শাশুড়িকে সঙ্গে না রাখতে, অন্য কোথাও রেখে আসতে।

অন্য কোথাও রেখে আসতে বলতে কি বলতে চাচ্ছেন বৃদ্ধাশ্রমে, কেন আপনার শাশুড়ি আপনার কি প্রবলেম করেছে, তিনি কি খুব অত্যাচার করে আপনার উপর।

আমার স্বামী আমার চেয়ে আমার শাশুড়িকে বেশি গুরুত্ব দেয়, তাকে আমার চেয়ে বেশি ভালোবাসে। শাশুড়ির বিষয়ে কোনো কথা বললে আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করে। এইজন্য আমি চাচ্ছিলাম শাশুড়ির যেন অন্য কোথাও থাকে।

আপনার শাশুড়ির ছেলেমেয়ে কয়জন।

আমার স্বামী একজনই, বাবুর কোন ভাইবোন নেই।

কি বলেন মিসেস রুবাইয়া, আপনি কিভাবে বলতে পারলেন আপনার শাশুড়িকে নিজ বাসায় না রাখতে। আপনার স্বামী তার একমাত্র ছেলে আর আপনার শাশুড়ির আপনার ওপর নির্যাতন করে না অত্যাচার করে না। তাহলে কেন আপনি তাকে সহ্য করতে পারবেন না। ছেলে তার মাকে ভালোবাসতে পারে, আপনি তার স্ত্রী আপনার প্রতি তার এক রকম ভালোবাসা থাকবে মায়ের প্রতি তার অন্যরকম ভালোবাসা থাকবে, ভালোবাসা আলাদা আলাদা ভাবে ভাগ করা থাকে, সেটা আপনি বুঝতে পারেন না কেন, আপনি তো আর অশিক্ষিত মূর্খ নয়।

রুবাইয়া চুপ করে আছে, ওসি সাবের আহমেদের কথা শুনে, সাবের আহমেদ আগে থেকেই এই ঘটনাটা জানে।

আমি সেদিন কুমিল্লা গিয়েছিলা বড় খালার মেয়ের বাসায়, বড় খালার মেয়ের জামাই পুলিশের এএসপি, তার মাধ্যমেই রুবাইয়াদের থানায় কল করে ওসির সাথে কথা বলানো হয়। দুলাভাই ওসিকে সমস্ত ঘটনাবলি জানায়, আমি আগেই জানতাম আমি যখন সিরাতকে নিয়ে চলে যাব তখন রুবাইয়া থানায় যাবে। তাই আমাদের এখানকার থানায় আর রুবাইয়াদের থানায় দুই ওসির সাথে দুলাভাইকে দিয়ে আলাপ করিয়েছি। এ কারনেই ওসি সাহেব আগে থেকে সব জানে, তাই রুবাইয়াকে চেপে ধরেছে।

মিসেস রুবাইয়া আপনি এসেছেন আইনের আশ্রয় নিতে, আপনার সন্তানকে নিয়ে আপনার স্বামী পালিয়েছে। যখন আদালতে আপনার স্বামী বলবে তার মাকে আপনি বৃদ্ধাশ্রমে দিতে বলেন আপনার সাথে রাখতে চান না তখন আপনি কি জবাব দিবেন। আপনার শাশুড়ি তো আপনার উপর নির্যাতন করেনি অত্যাচার করেনি আপনার সাথে। শুধু জিদের বশবর্তী হয়ে আপনি এমনটা করছেন। যেখানেই যাবেন লোকে আপনাকে ছিঃছিঃ করবে, তাই মন থেকে হিংসা বিদ্বেষ বাদ দিয়ে শাশুড়িকে নিয়ে একসঙ্গে সংসার করেন। আপনার স্বামী তো ভালো আপনার সাথে কোনো খারাপ ব্যবহার করে না, শাশুড়িকে মা ভাবেন তাহলে সংসারে শান্তি ফিরে আসবে। আমি আপনার স্বামীর সাথে কথা বলি, দেখি সে কি বলে।

ওসি আমাকে কল দিলো রুবাইয়া ও তার বাবার সামনে, আমি ওসিকে বললাম, সে যদি আমার মায়ের সাথে খারাপ ব্যবহার না করে আমার মাকে নিয়ে একসাথে সংসার করে তাহলে আমি সিরাতকে নিয়ে ফিরে আসব। নাহলে জীবনেও ফিরে আসবো না, কখনো সে তার সন্তানকে ফিরে পাবে না। যতই আইন আদালত করুক।

রুবাইয়া থানা থেকে বেরিয়ে আসলো, তার বাবা তাকে বলছে কোন অন্যায় ছাড়া তুই যদি এমন করিস কোথাও সঠিক বিচার পাবিনা, সবাই তোর বিপক্ষে কথা বলবে। তোর শাশুড়িকে নিয়ে একসাথে থাকার প্রবলেমটা কি বুঝতে পারছিনা, মানিয়ে নিতে চেষ্টা কর।

রুবাইয়া চুপচাপ তার বাবার কথা শুনে গেলো, কোনো জবাব দিলো না। বাসায় এসে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে বিছানায় শুয়ে ভাবতেছে সত্যি তো আমার শাশুড়ি তো আমার সাথে কখনো খারাপ ব্যবহার করেননি আমিতো তার সাথে খারাপ ব্যবহার করি। আমার শুধু একটাই কষ্ট বাবুর কেন তার মায়ের প্রতি এতো ভালোবাসা, কেন সে আমাকে বেশি ভালোবাসে না। এ জিদ থেকেই আমার মনের ভিতরে হিংসা তৈরি হয়েছে, হিংসা দূর করতে পারিনা, কি করে দূর করব। কিন্তু এখন আমার ছেলেকে নিয়ে সে চলে গেছে আমি কি করবো শাশুড়িকে নিয়ে কি একসঙ্গে থাকতে পারবো, থাকতে না পারলে আমি তো আমার ছেলেকে হারাবো। রুবাইয়া এগুলো ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে গেল, দুই রাত ধরে তার চোখে ঘুম নেই। সন্ধ্যার সময় রুবাইয়ার মা দরজায় নক করছে, রুবাইয়া দরজা খোল দুপুর থেকে কিছু খাস না তোর জন্য নুডুলস রান্না করেছি, দরজা খোল আর দেখ সবকিছু মেনে নিয়ে সংসার কর।

রুবাইয়া দরজা খুলে বলল, আমার খুব কষ্ট হচ্ছে সিরাতের জন্য, খুব কষ্ট হচ্ছে। আমি বাবুকে কল দিচ্ছি ধরছেন না, আমি মরে যাব আমার সোনা মানিককে ছাড়া।

চুপ কর এখন, দেখি আমি বাবুকে কল দেই, ধরে কি না।

শাশুড়ি মায়ের কল, তাই উপেক্ষা করলাম না। রিসিভ করে বললাম, কিছু বলবেন।

কি বলবো সেটা তুমি জানো, রুবাইয়ার খুব খারাপ অবস্থা সিরাতের জন্য, কান্নাকাটি করে না খেয়ে আছে।

বুঝতে পারছি সন্তানের জন্য মায়েদের এমনি হয়। আমার মা ও কিন্তু কান্নাকাটি করছে সেও না খেয়ে আছে সেটা কি আপনারা বুঝেন না।

বুঝেছি বুঝেছি, আমরা রুবাইয়াকে বলেছি সবকিছু মেনে নিয়ে সংসার করতে।

এখন বলে কি লাভ বলেন, এটা যদি আগে বুঝাইতেন তাহলে আর এমন হত না, আপনারা সবাই মিলে তাকে আদর দিয়ে মাথায় তুলে ফেলছেন। বেশি আস্কারা পেয়ে আপনার মেয়ে এমন জেদি হয়েছে।

নাও রুবাইয়ার সাথে কথা বল, আমার শাশুড়ি রুবাইয়ার কাছে মোবাইল দিলো।

আমি শাশুড়িকে বললাম, আমি রুবাইয়ার সাথে কথা বলবো না।

প্লিজ বাবু আমার কথা শোনো, তুমি ফিরে এসো, আমার ভুল হয়েছে। আমি জানি আমার শাশুড়ি আমার সাথে কোন অন্যায় কিছু করেনি, শুধু তুমি তাকে ভালোবাসো বেশি এটার জন্যই তার প্রতি আমার হিংসা হয়। তাই বলেছিলাম তাকে একসঙ্গে না রাখতে, তুমি সিরাতকে নিয়ে চলে আসো, আমরা একসঙ্গে থাকব আর এমন করবো না।

রুবাইয়া তোমাকে আমি চিনি, এটা তোমার মনের কথা না। তুমি শুধু তোমার সন্তানের জন্য এটা বলছো, দুদিন পর আবার আমার মায়ের সাথে এমন করবে, না হলে তোমার বাসায় সিরাতকে নিয়ে চলে যাবে।

আমি আর এমন করবো না, আমি বুঝতে পেরেছি সন্তানের জন্য মায়ের কেমন লাগে। তুমি আমাকে এসে দেখো এই দুইদিনে আমার কি অবস্থা হয়েছে, কান্না করতে করতে আমার চোখের নিচে কালি পড়ে গিয়েছে, আমি বুঝতে পেরেছি কতটা কষ্ট হয় সন্তান ছাড়া থাকতে।

যদি বুঝতে পারো তাহলে তুমি কাল সকালে মানিকগঞ্জ যাও আম্মুকে নিয়ে আসো, তারপর আমি সিরাতকে নিয়ে ঢাকা ফিরব।

ঠিক আছে আমি সকালে যাব মানিকগঞ্জে, আম্মুকে নিয়ে আসব, তার কাছে আমি স্যরি বলবো। তুমি কথা দাও কালকে চলে আসবে তুমি সিরাতকে নিয়ে।
আম্মুকে নিয়ে এসে আমাকে কল দিবে আমি সিরাতকে নিয়ে চলে আসব।

আমি সকালে আম্মুকে আনতে যাব তাহলে তুমি সিরাতকে নিয়ে রাতেই চলে আসো।

না তুমি আম্মুকে নিয়ে আসার পর আমি আসবো।

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে