মরীচিকার সংসার পর্ব-০৪ এবং শেষ পর্ব

0
19

#মরীচিকার_সংসার (শেষ)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি

আমার মরীচিকার সংসার তার নিজ গতিতে চলছে। সেই একই নিয়ম। ঘরের সমস্ত কাজ করো। রাতে সবার অভিযোগ শোনো। স্বামীর মাঝে মাঝে গায়ে হাত তোলা সহ্য করো। সব মিলিয়ে মানিয়ে নিয়ে, আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে কোনরকম টিকে আছি। আমি জানি এভাবে শত শত মেয়েরা মেনে নিয়ে, মানিয়ে নিয়ে জীবন কাটিয়ে দেয়। যাদের সন্তান আছে তারা তো ভুলেও সামনে পা বাড়ায় না। বাড়াতে চায় না।

অতঃপর এই মরীচিকার সংসারে আমার সাথে এমন একটি ঘটনা ঘটলো যে আমি বাধ্য হলাম নিজের কথা ভাবতে। সারাজীবন সংসার, পরিবার, সমাজ নিয়ে তো অনেক ভাবলাম। এবার আমাকে আমার কথা ভাবতে হবে। সেটা আমি বুঝে গেলাম। গত সাতদিন হলো আমার ননদ এই বাড়িতে এলো। সবকিছু ঠিকঠাকই ছিলো। মায়ের সাথে তাল মিলিয়ে আমাকে কথা শোনানো, সমস্ত কাজে হুকুম করা। সব মিলিয়ে আমার জীবন যেমন ছিলো তেমনই। তবে একদিন বিকালবেলা ননদের কান্নার শব্দ পেয়ে অবাক হলাম। ঘটনাচক্রে সেদিন পলাশও বাড়িতে ছিলো। ননদের কান্না দেখে সবাই তার কাছে গেলাম। পলাশ বিষ্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করে,“তোর কি হয়েছে? কান্না করছিস কেন?”

“আর বলিস না বাবা। ওর কানের দুল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।”
শাশুড়ী মা ননদের হয়ে জবাব দিলো। পলাশ কিছুটা হতবাক হলো। বিরক্তি নিয়ে বললো,“এই বাড়ি থেকে আর কত কানের দুল হারাবে।”

“এবার হারাইছে বলে তো আমার মনে হয় না। আমার মনে হয় তোর বউ কিছু একটা করেছে।”
শাশুড়ীর এই কথায় পলাশ তৎক্ষনাৎ জিজ্ঞাসা দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকায়। আমি বোকার মতো সবার মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। ননদ তৎক্ষনাৎ বলে উঠে,“আগেরবার বলছিলো ওটা তার কানের দুল। আমার নয়। আমি নিশ্চিত তখনই তার আমার কানের দুলের উপর নজর পড়েছে। সেই সরিয়েছে।”

“তোমরা আমাকে চোর বলছো?”
আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম। সেই মূহুর্তে শাশুড়ী তেলেবেগুনে জ্ব লে উঠলো। পলাশ থামিয়ে বলে,“রিমি তুমি যদি নিয়ে থাকো তাহলে দিয়ে দাও।”

পলাশের কথায় এবার আর আঘাত পেলাম না। এখন এসব সয়ে গেছে। এই মানুষটার একের পর এক ব্যবহার, বারবার বুঝিয়ে দিয়েছে এই মানুষটি আমার আপন কেউ নয়। যাই হোক, কানের দুল নিয়ে ঘরে বিশাল হট্টগোল বেধে যায়। অতঃপর সেই কানের দুল আমার ঘরেই পাওয়া যায়। আমি বুঝতে পারলাম, এটা ননদের কাজ। আমাকে ছোট করার। কানের দুল আমাদের ঘরে পাওয়ার পর পলাশ আমাকে জিজ্ঞেস করে,“এসব কি রিমি? তুমি?”

“আমি এটা এখানে রাখিনি। আর আমি এটাও জানি তোমরা আমার কথা বিশ্বাস করবে না। কাজটা যে তোমাদের।”
আমার কথাটি মাটিতে পড়তে পারলো না, তার মাঝে শাশুড়ী তেলেবেগুনে জ্ব লে উঠে। সে বলে,“মুখ সামলে কথা বল ছোটলোক। চো রের বাচ্চা চোর। সেদিন নিজের প্রমাণ করে দুলটা নিতে চাইছিলো আর আজ চুরি করে ফেললো।”

“খবরদার আম্মা। ভুলেও আমাকে চোরের বাচ্চা বলবেন না। আমার বাবা, মা যথেষ্ট সৎ মানুষ।”
আমি কথাটি বলার সঙ্গে সঙ্গে পলাশ গালে থাপ্পড় বসিয়ে দিলো। আমার অপরাধ আমি চুরি করে আবার বড় গলায় কথা বলেছি। পুরো বিকাল জুড়ে তাদের আমার উপর অকথ্য গালা গালি, অপবাদ চললো। আবার আমার বাবাকে ডেকে বিচার বসাতে চাইলো। এবার আর আমি সহ্য করলাম না। কানের দুলগুলো কেড়ে নিয়ে বললাম,“আমার বাবাকে ডেকে পাঠাতে হবে না। আমি চলে যাচ্ছি। তোমাদের মতো নোংরা মানুষের সাথে যতই মানিয়ে নেই না কেন? কখনো একসঙ্গে থাকা হবে না। আমি বুঝতে পেরেছি।”

“কি বললে তুমি?”
পলাশ রাগান্বিত গলায় বললো। এবার আমিও দুইটা গা লি দিয়ে বললাম,“যা শুনছিস তাই। ধৈর্যের একটা সীমা থাকে। এভাবে প্রতিদিন কু কুরের মতো ব্যবহার করা। একটার পর একটা অপবাদ দেওয়া। সব মিলিয়ে তোমরা আমার জীবন নরক বানিয়ে ফেলেছো। এখন আমার বাবাকেও ছাড়ছো না। এভাবে চললে আমার বাবার এই বাড়িতে এসে আমার বিচার করতে করতে ম রতে হবে। আর আমাকে তো জীবিত অবস্থায় নরক যন্ত্রণা ভোগ করতে হবে। অনেক হয়েছে আর নয়। সবকিছুর একটা সীমা থাকে। তোমরা আমাকে পুরোপুরি ছাড়তেও চাও না আবার ভালোভাবে বাঁচতেও দাও না। এতদিন তোমার মা তোমার হাতে মা র খাইয়ে মজা নিতো। আজ বোনের শখ হয়েছে তাই চুরির অপবাদ দিলো। এখন আমার বাবাকে ডেকে এনে যা নয় তাই বলে অপমান করবে তাই তো?”
একটু থেমে আবারও বললাম,“না। সেটা আর হচ্ছে না। অনেক হয়েছে। আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে অনেক কাটিয়েছি তোমার বাড়ি। আর নয় তো। এবার আমার মুক্তি প্রয়োজন। এই নরক থেকে।”
এই পর্যায়ে কান্না করে দিয়ে বললাম,“যেদিন এই বাড়িতে বউ হয়ে এসেছি সেদিন চোখে অনেক স্বপ্ন ছিলো। মা নেই, শাশুড়ীর মাঝে মাকে খুঁজে নিবো। ননদকে বোনের মতো ভালোবাসবো। কিন্তু পরিশেষে কি হলো? আসলে একপাক্ষিক কোনকিছু হয় না। তাছাড়া যদি এই বাড়ির একজন অন্তত আমার হয়ে লড়াই যদি করতো। তেমন কেউ নেই। যার হাত ধরে আমি এই বাড়িতে এসেছি, সেই তো আমাকে ভালোবাসে না, বিশ্বাস করে না। তার চোখে আমি অপরাধী, আমি শুধু তার প্রয়োজন। এমন এক অপ্রয়োজনীয় ঘরে কেন থাকবো? একটা যন্ত্রণাময় সংসারে।”

আমার কথার জবাবে পলাশ এবং তার মা চ্যাতে যায়। তারা অকথ্য ভাষায় আমার সাহস নিয়ে কথা বলতে শুরু করে। আমিও তাদের জবাব দিয়ে দেই। সেই সাথে বলি,“এই কানের দুল আমার মায়ের। সেটা তোমরা চুরি করেছো। আজ আবার সেটা দিয়ে আমাকে চোর বানাতে চাচ্ছো। সমস্যা নাই। আমাকে চোর বানানোর প্রয়োজন নেই। এটা আমি তোমাদের চোখের সামনে দিয়ে নিয়ে যাচ্ছি এখন। এটা আমার মায়ের। এটা আমার। তোমাদের কারো না। তাই আমাকে বাধা দিও না। উল্টা চুরির দ্বায়ে জে লে যাবে। অনেকদিন সহ্য করেছি। আর নয়। আমার মায়ের জিনিস অনেক ভোগ করেছো। এবার বাদ দাও। মানুষের যখন সহ্যের সীমা পার হয়ে যায় তখন সে কি করতে পারে সেটাও তোমরাও দেখে নাও।”
এখানে অনেক তর্ক বিতর্ক চলে। অবশেষে তাদের সবাইকে সুন্দরমতো জবাব দিয়ে আমি ঘর থেকে বের হলাম। আমি বুঝে গিয়েছি, এই সংসারে আমি টিকতে পারবো না।আমি যতই চুপচাপ সব মেনে নিচ্ছি ততই তাদের অত্যাচারের পরিমান বাড়ছে। শারীরিক মানসিক সব অত্যাচার তারা করছে। এই অসুস্থ পরিবেশে আমি সারাজীবন কাটাতে চাই না। তাই আজ নিজেকে শক্ত করে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
__
বাড়ির দরজায় আমাকে দেখে ভাবী মুখটা কালো করে ফেললো। তাকে পাত্তা না দিয়ে আমি ভেতরে আসলাম। বাবা আমাকে দেখে জড়িয়ে ধরলো। ইতিমধ্যে পলাশ তাকে ফোন দিয়ে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করে আমার নামে বদনাম করে দিয়েছে। তাই বাবা সব জানে।এজন্যই ভাবী আমাকে দেখে খুশি হতে পারলো না। আমি বাবার দিকে তাকিয়ে অসহয় গলায় বললাম,“বাবা আমি আমার সব দিয়ে ওখানে টিকে থাকার চেষ্টা করেছি। কিন্তু আজ আর পারছি না বাবা। আমাকে ক্ষমা করে দাও। আমি ঐ বাড়িতে আর মানিয়ে নিয়ে, মেনে নিয়ে থাকতে পারছি না বাবা।”

কথাগুলো বলে বাবাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিলাম। দিনের পর দিন কতটা যন্ত্রণা সহ্য করে ওখানে টিকে ছিলাম সেটা বললাম বাবাকে। এসব শুনে ভাবী বলে,“সংসার করবা না তো কি আমাদের ঘাড়ের উপর বসে খাবা? হায়রে আমার পোড়া কপাল, এক বুড়ার জন্য বাঁচি না এখন আবার মেয়ে এসে ঝুটছে।”

একটু থেমে পুনরায় বললেন,“আমার সংসারে এসব চলবে না। আসছো ভালো। একবেলা খেয়ে বিদায় হও।”
এবার প্রথমবারের মতো আমার বাবাও জবাব দিলেন। সে বললেন,“এটা তোমার বাড়ি নয় যে আমার মেয়েকে তাড়িয়ে দিবে। এখন অব্দি এই বাড়িটা আমার নামে। তাই তোমাদের অসুবিধা হলে তোমরা বাড়ি ছাড়তে পারো।”

“কি? বাবা এই কথা আপনি বললেন? যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা? আপনি বললেন এটা? আচ্ছা তা এটা নাহয় আপনার বাড়ি কিন্তু গিলেন কার টাকায়? সেটা তো আমার স্বামীরই।”
এই কথা বলে ভাবী একের পর এক আমার বাবার খাওয়া নিয়ে খোঁটা দিতে লাগলো। যা মেয়ে হিসাবে আমার শোনা কষ্টকর। আমিও বলে দিয়েছি, আর খাবে না। আমরা বাবা, মেয়ে নিজেদের ব্যবস্থা নিজেরা করবো। তাদের টাকায় কেনা খাবার খাবো না। আমরা আমাদেরটা ম্যানেজ করে নিতে পারবো। ভাবী এরপর আর কিছু বলতে পারলো না। চুপ করে নিজের ঘরে গেলেন।

পরিশেষে, আমি নিজের যোগ্যতা অনুযায়ী ছোট একটি কাজ যোগাঢ় করে নিয়েছি। সেই সাথে আবার মাস্টার্সে ভর্তি হয়ে নিয়েছি। আমার বাবা এবং আমি আমার টাকায় মোটামুটি ভাবে জীবন কাটাচ্ছি। ভাবী আমাদের সাথে তর্ক করে আলাদা হয়ে গেছেন৷ আমরাও তাদের আর বাধা দেইনি। অন্যদিকে পলাশ কয়েকবার নিতে আসছিলো কিন্তু যাইনি। আমি জানি পলাশের মতো মানুষ কখনো শুধরাবে না। তার পরিবারও ঠিক হবে না। এদের মতো পরিবারে যারা পড়ে সেই মেয়েরাই জানে জীবন কত কষ্টের। এদের কপালে সারাজীবনে কখনো সুখ জোটে না। তবে শেষ বয়সে যখন বিছানায় পড়ে তখন শাশুড়ীরা মা মা বলে কেঁদে ম রে। তখন যে অপমান, অপদস্ত করা বউরাই কাজে লাগে। পলাশরাও সেই যুগে শুধরে যায়। যখন একটা মেয়ের জীবনের সব রঙঢঙ করার সময় শেষ হয়ে যায়। তবে যুগের সাথে সমাজ পরিবর্তন হচ্ছে। ধীরে ধীরে সম্পূর্ণভাবে পরিবর্তন হবে এই আশা নিয়েই আমি সমাজের মানুষের কটুক্তিগুলোকে এড়িয়ে গিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। জীবনের রঙঢঙ উপভোগ করতে এগিয়ে যাচ্ছি সামনের পথে।

(সমাপ্ত)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে