#অর্ধাঙ্গিনী
#নুসাইবা_ইভানা
#পর্ব-৫৫
নিজের বোনের লাশের পাশে বসে আছে অন্তর। একজন ভাইয়ের জন্য এর চেয়ে বড় যন্ত্রণার আর কী হতে পারে? মেয়ে হলে নিশ্চিত অন্তর এখন হাউমাউ করে কাঁদত। পুরো হাসপাতাল ভারী হয়ে উঠত অন্তরের আত্মচিৎকারে। কিন্তু ছেলে মানুষ যে এভাবে কাঁদতে পারে না! কষ্টে তাদের দম বন্ধ হয়ে আসে, বুকে ব্যথা হয়; তবুও শব্দ করে কাঁদে না তারা। অন্তর রিতুর মুখটা সাদা কাপড়ে ঢেকে দিল। তার বোন, যাদের জন্য মারা গেল, তারা তো এখনো জীবিত! আচ্ছা, এই সমাজে বিচারব্যবস্থা এত দুর্বল কেন? ধর্ষক দিব্যি ঘুরে-ফিরে মাথা উঁচু করে বাঁচে। আর ভিকটিম হয়তো সুইসাইড করে, নয়তো বেঁচে থাকলে সমাজের মানুষগুলো তাদের মেরে ফেলে!
জাহিন অন্তরের সাথে সাথে সবকিছু সামলে নিচ্ছে। রিতুকে কবরস্থ করে এসে অন্তরের পাশে বসল। অন্তরের চোখে তখন জ্বলন্ত অগ্নিশিখা, হৃদয়ে দহনের অনল। জাহিন অন্তরের কাঁধে হাত রেখে বলল, “তুই এভাবে ভেঙে পড়লে আঙ্কেল-আন্টিকে কে সামলাবে?”
অন্তর হঠাৎ জাহিনের গলা চেপে ধরে বলল, “তোর বেড়াল কী করছিল সেই স্থানে?”
জাহিন ঠান্ডা মাথায় বলল, “তুই কি পাগল হয়েছিস! ম্যারিনো বাসায়। পৃথিবীতে একরকম দেখতে বেড়ালের অভাব নেই!”
“তাহলে রিতু তোর নাম কেন নিতে চাইছিল?”
“রিতু আমাকে ভালোবাসে, তুই জানিস তো। হয়তো শেষবার আমার সাথে কথা বলতে চাইছিল। বিশ্বাস কর, রিতু বেঁচে থাকলে আমি রিতুকেই বিয়ে করতাম। তুই নিজেকে সামলে নে, আমি রিতুর সাথে অন্যায়কারীদের বিরুদ্ধে প্রমাণ একত্র করি। এদেরকে ছাড়ব না।”
“আমি কী করে নিজেকে সামলাব! আমার ফুলের মতো নিষ্পাপ বোনটাকে ওরা কলুষিত করেছে। মেরে ফেলেছে আমার বোনটাকে। ওই তো সেদিন আমার বোনটা ফুচকা খাওয়ার বায়না ধরল। আমাকে মান্নাতের সাথে কথা বলতে হবে। হতে পারে, যারা মান্নাতের সাথে এই জঘন্য কাজ করেছে, তারাই রিতুর সাথে এমনটা করেছে। আমার বোনটা ফুটে ওঠার আগেই ঝড়ে গেল। পৃথিবীতে থাকা মানুষ নামক পশুগুলো বাঁচতে দিল না আমার বোনটাকে।”
“ওদেরকে আমি ছাড়ব না। বাসায় চল।”
🌿
সায়না নয়নার সাথে কথা বলা শেষ করে মিতা বেগমের রুমের দিকে চলে গেল। নয়না খাবার শেষ করে উঠে বসল, সুন্দর দেখতে একটা জলপাই রঙের শাড়ি পরল। চুলগুলো আঁচড়ে বেণী করে নিল। ঠোঁটে হালকা করে লিপস্টিক লাগাল। আয়নায় নিজেকে দেখে নিয়ে সরে এল। আবার গেল আয়নার সামনে। ড্রেসিং টেবিল থেকে কাজল তুলে চোখে লাগাল। শেষবারের মতো নিজেকে আয়নায় দেখে হিজাব ঠিক করে নিল।
পেছন থেকে মেহনুর বলে উঠল, “বয়স কম হলেও ছেলে বশ করার কলাকৌশল ঠিকই জানো দেখি।”
“আপু, আপনি!”
“তা, এত সাজগোজ করে কোথায় যাচ্ছ?”
“ওনার সাথে একটু বাইরে বের হব।”
“তুমি কি এই সংসার সামলাতে পারবে?”
“পারব না কেন? না পারলেও ধীরে ধীরে শিখে নেব।”
“তোমার বরকে খুশি করতে পারো তো?”
নয়না শক্ত গলায় বলল, “এসব কেমন কথা, আপু! আমার বর আর আমার মধ্যকার বিষয় নিয়ে কথা বলার আপনি কে? আমরা কে কাকে কতটুকু খুশি করতে পারব, সেটা আমরা দু’জন জানলেই হবে। আমার দেরি হচ্ছে, আমি বের হব।”
“তো, তোমাকে ধরে রেখেছে কে?”
“আমার রুম থেকে আমি চলে যাব, আপনি কী করবেন?”
মেহনুর বেরিয়ে গেল। যেতে যেতে বলল, “বয়সের চেয়ে কথার ধার বেশি। এঁচড়ে পাকা মেয়ে।”
নয়না রুমের দরজা বন্ধ করে বেরিয়ে এল। মেহনুর আর জাহিন—এই দুটো মানুষকে ঠিক বুঝতে পারে না নয়না। উদ্ভট লাগে দু’জনকেই।মিতা বেগমের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দু’জনে বেরিয়ে পড়ল।
সায়না বলল, “ভাবি, তুমি তোমার দেবকে বোঝাবা।”
“এত পাগল হয়ে যাচ্ছ কেন? পুরুষ মানুষ যদি একবার বুঝতে পারে তুমি তার জন্য পাগল, তাহলে সে তোমাকে মূল্য দেবে না। নিজের ব্যক্তিত্ব ধরে রেখে তারপর প্রেম-ভালোবাসা।”
“কিন্তু ওই ডাক্তারকে আমার চাই-চাই।”
“বুঝলাম, চাও; তাই বলে উন্মাদ হওয়া যাবে না।”
“আচ্ছা, ভাবি, এখন থেকে কম কম ভালোবাসা প্রকাশ করব।”
নয়না জিয়ানকে কল করল।জিয়ান নয়নার কল কেটে দিয়ে ব্যাক করল। এই বিষয়টা ভালো লাগে নয়নার। পুরুষ মানুষের ছোট ছোট কাজেও যত্ন লুকিয়ে থাকে।নয়না রিসিভ করে বলল, “আসসালামু আলাইকুম।”
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম, মেরি জান। কতদূর এসেছ?”
“আগে বলুন, সকাল-সকাল আমাকে না বলে কোথায় চলে গিয়েছিলেন?”
“নাহিদের সাথে দেখা করলাম, সেখান থেকে নাহিদকে নিয়ে অনিকেতের বাসায় এসেছি।”
“তো, বলে যাওয়া যায় না বুঝি?”
“তুমি ঘুমাচ্ছিলে, তাই ডিস্টার্ব করিনি। আচ্ছা, শোনো, তুমি ভিডিও কল করো। আমিই করছি।”
“ভিডিও কল কেন?”
“দেখতাম বউটাকে কেমন লাগছে। সেই সকালে এক নজর দেখে এসেছি, এখন তো মন পোড়ে দেখার জন্য।”
“আহাগো। শুনুন, আমি তো আসছি, সরাসরি দেখতে পাবেন। মোবাইলে দেখতে হবে না।”
“হবে না কেন! আমি দেখবই।”
“কী বাচ্চামো করছেন! আপনি কিন্তু পাইলট রেজা চৌধুরী, ভুলে যাচ্ছেন?”
“তোমার কাছে আমি শুধুই তোমার হ্যাসবেন্ড, যে কখনো তোমার কাছে বাচ্চাদের মতো আবদার করবে, আবার কখনো রোমান্টিক বরের মতো আদরে ভরিয়ে দেবে।”
“চুপ করুন, পাশে সায়না আছে তো। মুখে কিছু আটকায় না?”
“এমন কী বললাম! আমি কি বলেছি তোমাকে কোলে নিয়ে ঠোঁটে চুমু খেতে ইচ্ছে করে? নাকি বলেছি তোমার কোমড়ের তিলটা আমাকে আকর্ষণ করে? নাকি বলেছি…”
কথা শেষ হওয়ার আগেই নয়না বলল, “চুপ করুন, বেশরম লোক।”
“বউয়ের কাছে আবার কিসের শরম! শরম তো সব লুটিয়ে দিয়েছি তোমার ওপর, বউ।”
“আপনি শুধরাবেন না?”
“কোনো চান্স নেই, উল্টো বিগড়ে যাব। সামলাতে পারবে তো?”
“আপনাকে আমি কেন সামলাব! আপনি কি ফিডার খাওয়া বাচ্চা নাকি!”
“ফিডার খাওয়া বাচ্চা না হই, পুরো আস্ত বউকে খেয়ে ফেলা রোমান্টিক বর তো।”
নয়না খট করে কল কেটে দিল। লোকটার মুখে কিছু আটকায় না। যা মুখে আসে, তাই বলে!সায়না বলল, “এত লজ্জা পেতে হবে না, পিচ্চি ভাবি। আমি এসব কিছুই শুনিনি। আহা, কী রোমান্টিক প্রেম! তবে জানো, আম্মু কী বলে?”
“কী বলে, ফুপ্পি?”
“বিয়ের প্রথম বছর থাকে রসমালাইয়ের মতো প্রেম, দ্বিতীয় বছর থাকে মিষ্টির মতো প্রেম। এরপর পুরো জীবন করলার মতো।”
নয়না হেসে বলল, “দারুণ কথা তো। তবে একসাথে থাকতে থাকতে তো একজন আরেকজনের অভ্যাস হয়ে যায়।”
“সবার হয় না। বর্তমানে যে হারে ডিভোর্স বেড়েছে! কেউ কম্প্রোমাইজ করতে রাজি না। অথচ কম্প্রোমাইজ না করলে বিবাহিত জীবন মেন্টেন করা যায় না। যেকোনো একজনকে হালটা ধরতেই হয়। সবাই এখন বেটার খুঁজে, যাকে পেয়ে যায়, তার কদর কমে যায়।”নয়না বলল, “হয়তো।”
গাড়ি এসে অনিকেতের বাসার সামনে থামল।🌿
অনিকেত কফিতে চুমুক দিতে দিতে বলল, “দেখ, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমি বিয়ে করব না। আমি সিরিয়াসলি বলছি, আমি বিয়ে করব না। আর করলেও আমার মতো অসহায় কাউকে করব। আমি ছেলে মানুষ, সফল একজন ডাক্তার, তারপরও আমাকে যদি রিজেক্ট হতে হয় পিতৃপরিচয়ের জন্য, তাহলে আমার মতো অবস্থানের মেয়েদের কী ফেস করতে হয়!”
“এসব ইমোশনাল কথাবার্তা বাদ দে। আমি ফুপির সাথে কথা বলব। তোকে সায়না ভালোবাসে, তোর ওকেই বিয়ে করতে হবে।”
“আমি তো ভালোবাসি না। কারণ আমি ভালোবাসার সীমারেখা জানি।”
“তুই মিথ্যে বলছিস। তুই জানিস, তুই ভুল। সায়নাকে তুই অল্প হলেও মনে জায়গা দিয়েছিস। নিজের মনের সাথে কেউ মিথ্যে বলতে পারে না!”
“আমি বিয়ে করব না।”
সায়না রুমে ঢুকেই বলল, “মগের মুল্লুক তো বিয়ে করবে না! বিয়ে করতেই হবে। আজ এক্ষুনি বিয়ে করব। ভাইয়া, কাজিটাজি কী কী লাগে, নিয়ে আসুন। আজ ডাক্তার অনিকেত মাহমুদের সাথে সায়নার বিয়ে। ব্যাস, এরপর আর কোনো কথা শুনব না।”
#চলবে