অর্ধাঙ্গিনী পর্ব-৫৪

0
96

#অর্ধাঙ্গিনী
#নুসাইবা_ইভানা
#পর্ব -৫৪
সকালের আধো আলো এসে নয়নার মুখে পড়তেই পিটপিট করে চোখ খুললো নয়না। পুরোপুরি ঘুমের রেশ কাটেনি। নয়নার ঘুমকাতুরে নিভু নিভু চোখ নিয়ে হাত দিয়ে জিয়ানকে খুঁজতে লাগলো। কিন্তু তার পাশে কেউ নেই! দ্রুত চোখ খুলে ফেললো। হঠাৎ যেন ঘুম গায়েব হয়ে গেল। কোথায় গেল মানুষটা? গায়ে কম্ফোর্ট টেনে নিজেকে ঢেকে নিলো। বেডের পাশ থেকে শাড়ি তুলে গায়ে জড়িয়ে নিলো। দ্রুত বেড থেকে নেমে কভার্ড থেকে ড্রেস নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল। ফ্রেশ হয়ে বারান্দায়, করিডোরে খুঁজলো। না পেয়ে সোজা নিচে চলে এলো।

মেহনুর তখন পাউরুটিতে মিক্সড ফ্রুট জ্যাম লাগাচ্ছে। একজন সার্ভেন্ট দাঁড়িয়ে আছে, আর কেউ নেই টেবিলের আশপাশে। নয়না সার্ভেন্টের উদ্দেশে বলল, “বাকিরা সবাই কোথায়?”
মেহনুর পাউরুটি থেকে একটা বাইট নিলো। পাউরুটি চিবোতে চিবোতে বলল, “আম্মি আর আঙ্কেল হাসপাতালে। তুমি কাকে খুঁজছো?”

“রেজা কোথায়?”
“রেজা বাসায় নেই?”
“না,” বলেই নয়না উপরে চলে এলো।

বেডের ওপর বসলো মুড অফ করে। নিজের ফোনটা বের করে জিয়ানকে পরপর কয়েকবার কল করলো। ওপাশ থেকে কোনো রেসপন্স নেই। রিং হয়ে কেটে যাচ্ছে। নয়না আয়নার সামনে দাঁড়ালো। আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেকে ভালোভাবে লক্ষ করলো। দু’হাতে মুখ ঢেকে বলল, “আপনি চলে গেলে আমি থাকবো কী করে! আপনাকে যে খুব মিস করবো, মিস্টার প্লেন ড্রাইভার। আজকে দিনটা তো আমাদের হওয়ার কথা ছিল। কোথায় গেলেন আপনি? চলে আসুন প্লিজ। মিস ইউ।” নয়নার চোখের পাপড়ি ভিজে উঠলো চোখের জলে। হঠাৎ তার চোখে পানি কেন এলো! নয়না নিজেও বেশ অবাক হলো!

একজন সার্ভেন্ট ট্রেতে করে নয়নার খাবার নিয়ে এলো। খাবার রেখে বলল, “বড় সাহেব আপনাকে নাস্তা করে রেডি থাকতে বলেছেন।”

“রেজা?”
“জ্বি, বৌমনি।”
“কখন বলল? রেজা কোথায় বের হয়েছে এত সকালে?”
“তা তো জানি না। যাওয়ার সময় বলে গেছেন। নাস্তা করে নিন।”

নয়না সোফায় বসে ট্রের দিকে তাকাতেই অবাক হলো! তার পছন্দের সব খাবার! ক্ষীর, লুচি, মুচমুচে পরোটা, ঘন দুধ চা। সাথে ফ্রেশ অরেঞ্জ জুস। পাশে রাখা দুটো ডার্ক চকোলেট। নয়নার পছন্দের ব্রেকফাস্ট। নয়না মনে মনে বলল, “আচ্ছা, কেউ কি এত ভালোবাসতে পারে? না বলতেই মনের কথা পড়তে পারে? আসলেই কি ভালোবাসা এত মধুর হয়! এসব কোনো কল্পনা নয় তো? নাকি আমার পড়া উপন্যাসের কোনো অধ্যায়? যদি এমনটা হয়, তবে আমি চাই এই কল্পনা কখনো শেষ না হোক। যুগ যুগ আমি উপন্যাসের এই অধ্যায়ে আটকে থাকতে চাই।”

একজন সার্ভেন্ট রুম গোছাচ্ছিল। সে বলল, “বৌমনি, চা ঠান্ডা হয়ে গেছে? গরম করে এনে দিব?”
“না, দরকার নেই।”
“আমি আসি, বৌমনি। দরকার পড়লে ডেকে পাঠাবেন।”
“জ্বি, অবশ্যই।”নয়না মুচমুচে পরোটা চায়ে ডুবিয়ে খেতে খেতে ভাবছে, “আচ্ছা, মাত্র সতেরো বছর বয়সে আমি এমন স্বপ্নের মতো জীবন পেয়ে গেলাম! এই জীবনের আয়ু কত যুগ হবে?” এভাবে ভাবার বাজে অভ্যাস নয়নার। এসব ভাবনার মাঝে ধুম করে একজন রুমে ঢুকে বলল, “আগুন জ্বলছে আমার মনে, আর তুমি নাস্তা করছো সঙ্গোপনে!”
“আপনি?”
“কিসের আপনি? ননদকে কখনো আপনি বলতে হয় না, ডিয়ার ভাবি। তুমি করে বলো।”

“কী করেছি আমি?”
“এটাই তো সমস্যা, ভাবি। তুমি কেন কিছু করছো না! তোমার তো কিছু করা উচিত।”
“কী করা উচিত, কী বলছো তুমি?”
“ইশ, নিব্বি ভাবি পেয়েছি! আমার চোখ দেখে মন পড়তে পারে না।”
“বুঝিয়ে বলো, তাহলে আমি বুঝবো।”
“আচ্ছা, নাস্তা শেষ করে বোঝাচ্ছি।”নয়না ক্ষীর দিয়ে লুচি খাচ্ছিল। এটা তার খুব প্রিয় একটা খাবার। বাঁ হাতে ফোনটা নিলো জিয়ানকে কল করতে। ফোনের স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে জিয়ানের টেক্সট: “জান, নাস্তা করে সুন্দর টুকটুকে বৌ সেজে রেডি হও। আজকে তোমাকে নিয়ে এক জায়গায় যাবো।”

নয়নার ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি ফুটে উঠলো। মন ভালো করার জন্য প্রিয় মানুষের ছোট একটা টেক্সট বা একটা কল যথেষ্ট। কী অদ্ভুতভাবে আমরা নিজের সুখ অন্যের কাছে দিয়ে দিই!
“হাসছো কেন, ভাবি? তোমার এখন প্রেম করতে হবে না। দ্রুত খেয়ে আমার বুকের আগুন নেভাও।”
“যদি নেভানোর বদলে আগুনে ঘি ঢেলে দিই?”
“জ্বলে আঙার হয়ে যাবো।”
নয়না হেসে বলল, “এত ব্যাকুলতা ভালো না, মেয়ে।”
🌿
অন্তর কোনোভাবেই কোনো প্রমাণ ধরে রাখতে পারছে না। সব প্রমাণ কেমন অদ্ভুতভাবে গায়েব হয়ে যাচ্ছে। যে তিনজনের অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছিল, তাদের ডিএনএ ম্যাচ করে রিপোর্ট রেখেছিল, কিন্তু এখন তা পাওয়া যাচ্ছে না! এই কক্ষে আমরা তিনজন ছাড়া আর কেউ আসে না, জানেও না এখানে কী থাকে। তাহলে কি জাহিন আর রাফির মধ্যে কেউ গাদ্দারি করছে? জাহিন তো ক্লিনিকে, বাকি রইলো রাফি। অন্তর নিজের হাত মুষ্টিবদ্ধ করে বলল, “আমার বোনের সাথে অন্যায়কারীকে সাহায্য করা কেউ ছাড় পাবে না। অন্তর বেঁচে থাকতে কিছুতেই না।” অন্তর চোয়াল শক্ত করে আন্ডারগ্রাউন্ডে অবস্থিত রুম থেকে বেরিয়ে এসে একটা সিগারেট ধরালো। মেইন রোডের সাইডে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছে অন্তর। সিগারেট শেষ না করেই ছুড়ে মারলো, সামনে-পিছে না তাকিয়ে।

তুষির হাতে শপিং ব্যাগ। তুষি “মাগো” বলে চিৎকার করলো। তুষির গলার আওয়াজ পেয়ে অন্তর পিছু ফিরলো। তুষি অগ্নিদৃষ্টিতে অন্তরের দিকে তাকিয়ে বলল, “অসভ্যতা করার আর জায়গা পাননি? সকালবেলা রাস্তায় দাঁড়িয়ে অসভ্যতা করছেন? বাড়িতে কি মা-বোন নেই নাকি?”
অন্তর নিজের রাগ কন্ট্রোল করতে পারলো না। তুষির গলা চেপে ধরে বলল, “বাড়িতে মা-বোন আছে বলেই অসভ্যতা কাকে বলে তা দেখাতে পারলাম না।”
ততক্ষণে মানুষ জড়ো হয়ে গেছে। অন্তর দ্রুত গলা ছেড়ে দিয়ে বাইক নিয়ে পালিয়ে গেল, উৎসুক জনতা কিছু বুঝে ওঠার আগেই। তুষি চিৎকার করে বলল, “আরে, দাঁড়িয়ে দেখছেন কী? গুন্ডাটাকে ধরুন।”
ততক্ষণে অন্তর ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে। দর্জির দোকান থেকে ড্রেস আনতে গিয়েছিল তুষি। হাত থেকে ব্যাগটা পড়ে গিয়েছিল। তুষি ব্যাগটা তুলে নিয়ে বলল, “আরেকবার পাই তোকে, তারপর বোঝাবো তুষি কী চিজ।”
🌿
লাবিব জেলে আজ কতদিন। সে বাসার খাবার খায় না কতদিন হলো। কতদিন হলো মায়ের ভালোবাসা পায় না। রাগে চোয়াল শক্ত করে বলল, “তোকে আমি শান্তিতে থাকতে দেবো না, নীলাঞ্জনা। তুই আমার জীবন ধ্বংস করে কী করে শান্তিতে থাকিস, আমি দেখে নেবো। একবার শুধু বের হই এই কারাগার থেকে, তোর সব সুখ কেড়ে নেবো।”

নীলাঞ্জনা মাথা নিচু করে বসে আছে। শিল্পি বেগম রেগে আছেন। নীলাঞ্জনা প্রেগন্যান্ট, এটা শুনেই তিনি রেগে গেছেন। গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, “কয় মাস হলো?”
“দু’মাস।”
“তোর লজ্জা করলো না! এখন তোর এই বাচ্চাকে কী করবি? নষ্ট করা ছাড়া তো আর কোনো উপায় নেই। আমার গর্ভে এমন মেয়ে জন্ম নিলো! তোর মাথায় কোনো জ্ঞান নেই? বিয়ে করে মাস পেরোতে না পেরেই প্রেগন্যান্ট। যা করেছিস করেছিস, আজ সন্ধ্যায় আমি ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিচ্ছি। এটাকে এখানেই শেষ করে ফেল। এমনিতেই ডিভোর্সি মেয়ে, তার ওপর এক বাচ্চার মা হলে আর কেউ নেবে?”
নীলাঞ্জনা গর্জে উঠলো, “আমার বাচ্চা এই পৃথিবীতে আসবে। তাকে আসতেই হবে। আমার আর কাউকে লাগবে না। লাগলে ভিক্ষা করে মানুষ করবো। তবুও আমার সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখাবো। পারবো না আমি আমার নিজের সন্তানকে হত্যা করতে।”

শিল্পি বেগম ঠাস করে চড় বসিয়ে দিলেন নীলাঞ্জনার গালে। “এতই যখন শখ, তখন এত সুন্দর, টাকাওয়ালা ছেলে রেখে গাঁজাখোরের কাছে কেন গেলি? পালিয়ে গেলে মানুষ এমন কারো কাছে যায়, যে পরবর্তীতে বড় কথা বলতে পারে। দেখো, এরজন্য আমি গিয়েছিলাম। তুই কী করেছিস, বংশের মুখে চুনকালি দেওয়া ছাড়া? তোর কথা শুনবো না, সন্ধ্যায় আমার সাথে যাবি।”
#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে