Monday, October 6, 2025







শক্তিময়ী পর্ব-০৪

শক্তিময়ী
চতুর্থ পর্ব
বড় গল্প
নাহিদ ফারজানা সোমা

ভাবী নিজের টাকা দিয়ে অদিতির জন্য দুধ কিনলেও সমস্যা। আমাদের স্তম্ভিত করে আনন্দ ভাইয়া বলেন,”তোমার টাকা মানে কি?তুমি কি ইনকাম করো?” অথচ বিয়ের পর থেকে যে কোনো ব্যাপারে তিথি ভাবীর জন্য টাকা খরচ করতে পারলে আনন্দ ভাইয়া ধন্য হয়ে যেতেন। এখনো হন। শুধুমাত্র অদ্বিতীয়ার বিষয় ছাড়া।

আমরা ভাই বোনেরা যখন যেমন পারতাম, অদ্বিতীয়ার জন্য জামা, খাবার,খেলনা নিয়ে যেতাম। ফুপু আর ভাইয়া খুবই রাগ করতেন। এই রাগের রেশ তিথি ভাবী আর অদ্বিতীয়ার উপরে পড়তো প্রবল ভাবে। অদ্বিতীয়ার জন্য দৈনিক আধা লিটার মিল্কভিটা বরাদ্দ। তিথি ভাবীর অনমনীয় মনোভাবের জন্য। আনন্দ ভাইয়া চেয়েছিলেন আধা লিটার দুধ দুইদিন চালাতে হবে।

“বাচ্চাটা ভাত খায় না? ভাত,খিচুড়ি, মাছ, গোশত,ডিম কি খাওয়াচ্ছো না? আবার দুধও খেতে হবে?”

“আমরা সবাই তো সবকিছু খাই, তার জন্য আমাদের জন্য বরাদ্দ দুধে তো টান ধরে না? ”

ভাবতে অবাক লাগে,এই আনন্দ ভাই আর তার বাপ-মা দীনদুঃখী সবাইকে খাওয়ান। যাঁরা পেপার বিল, ডিশ বিল,কারেন্ট বিল দিয়ে যান, কিংবা কুরিয়ারম্যান, কেউ এ বাড়ি থেকে খালিমুখে যেতে পারেন না। এক গ্লাস শরবত হলেও খেয়ে যেতে হয়। এ বাড়িতে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের জন্য ও এক কাপ দুধ বরাদ্দ। এটা অবশ্য তিথি ভাবী প্রচলন করেছিলেন। গরম কালে এই বাড়ির ছাদে আর বারান্দায় অনেক পানির পাত্র রাখা হয়। পাশে টুকরো টুকরো বিস্কিট। কাকসহ অন্য পাখিদের খাওয়ার জন্য। এখানে গৃহকর্মীদের জন্য সবচেয়ে কম দামের পোশাক কেনা হয় না। এমন একটা আদর্শ বাড়িতে আড়াই -তিন বছর বয়সী বাচ্চার খাবার নিয়ে এতো কথা, এতো কার্পণ্য? ভাবাই যায় না।

অদ্বিতীয়ার দুধ জ্বাল দেওয়ার জন্য আলাদা পাতিল,ওর খিচুড়ির জন্য আলাদা পাতিল। পাতিল দুইটা অস্পৃশ্য।

অতি আদরে সমুদ্র খুব বিরক্তিকর চরিত্র হয়ে গেছে। বাড়ির সব মুরগির রান ও খাবে, অন্য কেউ খেতে পারবে না। আনন্দ ভাইয়া মুরগী কেনা ছাড়াও আলাদা করে রান কিনে নিয়ে আসেন। সমুদ্র খায়, কখনো প্রায় পুরা মাংস সহ রানটা বোন প্লেটে রেখে দেয়। যখন তখন অর্ডার, ফ্রাইড রাইস বানাও,চিকেন ফ্রাই করো, বাবা,আজকে পিৎজা এনো, আমার জন্য আস্ত একটা, বাবা,আজ আমার জন্য ড্রোন এনো, বাবা, আমার জন্য রিমোট কন্ট্রোলড হেলিকপ্টার এনো। আমাকেই সাথে নিয়ে যেও,আমি দেখেশুনে কিনবো। ” আনন্দ ভাইয়া মহানন্দে ছেলের সব আব্দার মিটান।ফুপা-ফুপুও। তিথি ভাবী সামাল দিতে চান,পারেন না। সবাই হাঁ হাঁ করে উঠে।

“ও রান পছন্দ করে,তুমি দিতে দিচ্ছ না কেন?”

“বাবা,ও তো এইমাত্র একটা খেলো,আবার রাতে দেওয়া হবে। অন্য পিসও খাক।”

“ওর যতোটা খুশি,ততোটা রান খাবে। সমস্যা আছে কোনো?”

“মা,আপনি দুই ছেলেমেয়েকে মানুষ করেছেন। অতিরিক্ত আব্দারকে প্রশ্রয় দিয়েছিলেন কি? এটা কি বাচ্চার জন্য ভালো?”

“সেই যুগ আর এই যুগ সমান হলো? যুগের একটা দাবী আছে না?”

“মা,সমুদ্র স্বার্থপর হয়ে যাচ্ছে। ও দাদা-দাদীকেও তার পছন্দের জিনিসের ভাগ এক কণাও দিতে চায়না।এটা কি ভালো?”

“আরে মা,আমাদের তিন কাল গেছে,এককাল আছে। নাতি খেলেই আমাদের খাওয়া হয়ে যায়।”

প্রতিটা কথার পেছনেই একটা যুক্তি। আর যখন খারাপ কিছু হয়,ছেলের রেজাল্ট খারাপ হলো,স্কুল থেকে অভিযোগ আসলো যে ছেলে বেশি পাকনা হয়ে যাচ্ছে, বারো ফাট্টাই গল্প করে অন্য বাচ্চাদের সাথে, তখন সব দোষ হয় তিথি ভাবীর। ভাবীর ভুল সিদ্ধান্তের জন্য ছেলে বেপরোয়া হয়ে গেছে, নিজের ছেলের দিকে নজর নেই, এক ফকিরের বাচ্চার জন্য ভাবীর সব মনোযোগ ইত্যাদি। অভিযোগ আনন্দ ভাইয়ের, ফুপা-ফুপু তিথি ভাবীকে বকা দিয়ে কথা বলা পছন্দ করেন না,আবার আনন্দ ভাইয়ের অন্যায় কথার প্রতিবাদও করেন না।

অদ্বিতীয়ার ভাগ্যে দৈনিক একটা ফল ই একটা করে বরাদ্দ আছে, কলা। তিথি ভাবীও তাই নিজে ফলমূল ছুঁয়ে দেখেন না।

আমরা প্রায়ই কাজকর্ম সেরে এই বাসায় চলে আসি,যে যখন পারি।আধাঘন্টার জন্য হলেও। অদ্বিতীয়ার কোণার ঘরে ভাবীকে নিয়ে আড্ডা দিই। ফুপু খুব অভিমান করেন উনার কাছে তেমন বসি না বলে। আমরা ফুপুকে আমাদের সাথে আড্ডা দিতে বলি।ফুপু নাক সিটকান।

সেদিন অদ্বিতীয়ার মুখে কমলার কোয়া তুলে দিলাম। সে চুষে চুষে রস খেলো। কমলা তার জন্য বড় দুষ্প্রাপ্য ফল। বাচ্চাটা চুষে চুষে কমলার রস খাচ্ছে, আনন্দে তার চোখমুখ ঝলমল করছে,আনন্দ ভাইয়া রুমে ঢুকলেন। এই রুম তো তাঁর কাছে বড় অপবিত্র। আর এখন তো তার বাসায় ফেরার কথাও না।

ভাইয়া বললেন,” সমুদ্রের জন্য কি এনেছিস? পরীর জন্য কি এনেছিস? তোর বুড়ো ফুপা-ফুপুর জন্য কি এনেছিস, বল্। ”

আমি নললাম,”তোমাদের জন্য মা আমের দুই পদের আচার পাঠিয়েছেন, সেটা এনেছি।”

“আচার তো সমুদ্র আর পরী খাবে না। ওদের জন্য কি এনেছিস? ”

“ওদের তো কোনো জিনিষের অভাব নেই, ভাইয়া। ”

“আর এই বাচ্চাটার অভাব আছে?নিজের ভাইপো-ভাই ঝির জন্য কিছু আনলি না, একটা রাস্তার ফকিরের জন্য ডজন খানিক কমলা এনে রস খাওয়াচ্ছিস? ”

আনন্দ ভাইয়াকে অদ্বিতীয়া ভীষণ ভয় পায়। বেচারার কচি মুখ কমলার রসে মাখামাখি। ভয়ে তিথি ভাবীর কোলে উঠে বসেছে। বড় বড় চোখ আরও বড় হয়ে গেছে।

আনন্দ ভাইয়া আমার হাতের আধা খাওয়া কমলাটা এক ঝটকায় কেড়ে নিয়ে ছুঁড়ে ফেললেন দূরে। চিৎকার করে বললেন,” একটা অপয়া,ইবলিসের বাচ্চার জন্য সবার এতো দরদ। নিজের বাচ্চাদের খবর নেই, নিজের রক্তের খবর নেই, সারাক্ষণ একটা ইতরের বাচ্চার জন্য সবার মায়া একেবারে ছলকে ছলকে উঠছে। ফেড আপ হয়ে গেছি আমি। এই আপদের মুখ দেখতেও ঘেন্না লাগে আমার। আর তাকে নিয়ে এত মাতামাতি তোদের। আরেকজনের তো স্বামী,নিজের ছেলেমেয়ে নিয়ে কোন মাথা ব্যথা নেই। আমরা মরলাম কি বাঁচলাম, তাতে তার কোন বিকার নেই। আজকে এই আপদ বাচ্চাকে আমি শেষ করে ফেলবো। ”

আনন্দ ভাইয়া অদ্বিতীয়াকে হ্যাঁচকা একটা টান দিয়ে ভাবীর কোল থেকে নামালেন। তারপরে ঘাড়টা ধরে দিলেন একটা জোর ধাক্কা। আমরা কিছু করার আগেই বাচ্চাটা দেওয়ালের সাথে জোরে একটা বাড়ি খেলো। তারপরেও সে ভয়ে চিৎকার করছে না, শুধু ফোঁপাচ্ছে আর চোখ দুটো ভাসিয়ে অঝোর ধারায় পানি পড়ছে।

তিথি ভাবী ছুটে অদ্বিতীয়াকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। হৈ চৈ শুনে অনেকে জড় হয়েছে “অপবিত্র ” ঘরটার দরজায়। ফুপা বললেন,”এসব কি আনন্দ? মেয়েটাকে সহ্য না করতে পারো,ওর থেকে দূরে থাকো। মারধোরের দরকার কি?এতো ছোট বাচ্চাকে মারে কেউ? আর সে তোমার দত্তক কন্যা। তোমার মেয়ে,বুঝেছো?”

আনন্দ ভাইয়া উন্মাদের মতো বললেন,”খবরদার এ কথা বলবে না। আমার এক ছেলে,এক মেয়ে আছে। নর্দমার কীটকে আমি মেয়ে ভাবি না।”

তিথি ভাবী ঠান্ডা গলায় বললো,”অদ্বিতীয়াকে নিয়ে আমি চলে যাচ্ছি। ”

ভাইয়া চিৎকার করে বললেন,” তাই যাও। এমন বৌ আর মা থাকা আর না থাকা একই কথা।”

ফুপু বললেন,”আনন্দ, একদম চুপ। আর তিথি, হাবিজাবি কথা বলো কেনো?তোমার নাড়ি কাটা দুটা ধন আছে। স্বামী,সন্তানের থেকে বাইরের একজনকে মাথায় তোলা…, এটা তো ভালো কোনো কথা হতে পারে না।”

“কার প্রতি কোন দায়িত্বে ফাঁক রেখেছি বলেন? আজ বলতেই হবে। আপনার ছেলে, সমুদ্র, পরী,আপনাদের প্রতি আমার কোন্ দায়িত্বে অবহেলা করেছি আমি, আজ বলেন। আপনার ছেলেকেও বলতে বলেন।”

“আমাদের প্রতি কোনো দায়িত্ব পালন করতে হবে না মা।আমরা এখনো নিজেদের উপরেই নির্ভরশীল। আল্লাহ করেন, অন্যের উপরে নির্ভর করার আগেই যেন আল্লাহ তুলে নেন। তোমার কর্তব্য বা ভালোবাসা নিয়ে আমি প্রশ্ন তোলার কিছু দেখি না। কিন্তু সবার এতো এতো আপত্তি অগ্রাহ্য করে কেন তুমি এই মেয়েকে সংসারে নিয়ে এলে?তোমারতো বাচ্চা ছিলো,তোমারতো বাচ্চা হতো। এক অবৈধ সন্তানকে জোর করে বাড়িতে আনার কি দরকার ছিলো,বলো তো?”

“আপনি বলেন তো মা, এই বাচ্চাটা থাকায় আপনাদের কি সমস্যা হচ্ছে? ও কি ক্ষতি করছে আপনাদের?”

“সে সংসারে একটা উটকো ঝামেলা। ঝামেলাকে কেউ ভালোবাসে না। ”

আমি লজ্জায় আর দুঃখে মরে যাচ্ছিলাম। ফুপু আমাকে বললেন,”তারপর? তোদের আলগা ভালোবাসায় লাভের লাভ কিছু হলো?”

এরমধ্যে অদ্বিতীয়া ঘর ভাসিয়ে বমি করলো। ভাত, ডিম সিদ্ধের বড় বড় টুকরা,সদ্য খাওয়া কমলা সব উঠে এলো। আনন্দ ভাই ছিটকে সরে গেলেন। ফুপুও।

ফুপা বললেন, “মাথায় আঘাত পেয়ে বমি করা তো ভালো কথা না।”

এ কথাতো আমরা সবাই জানি। আনন্দ ভাইয়া বললেন,” খায় কতো,দেখেছো মা? বড়রাও হার মানবে।”

আর আমি এবং ভাবী ভাবছিলাম,রোজী বাচ্চাটাকে কতো অযত্ন করে খাওয়ায়, চিবানোর সময়টুকু দেয় না।

তিথি ভাবী অদ্বিতীয়াকে কোলে নিয়ে আমাকে বললেন,”চল্,হাসপাতালে যাই।”

ভাইয়া হিংস্র গলায় বললেন,”প্রশ্নই উঠে না। ননীর পুতুল।কথায় কথায় ডাক্তার দেখানো লাগবে।”

ফুপু বললেন,”এতো অস্হির হওয়ার কি হয়েছে তিথি? ছেলেপুলে কতো আছাড় খেয়ে পড়ে, ব্যথা পায়, এটাতো স্বাভাবিক ব্যাপার।”

” সমুদ্র বা পরী পড়ে গেলে তাহলে অতো হৈচৈ, শোরগোল উঠে কেন? ডাক্তারের ডাকই বা পড়ে কেন?”

আমাদের হতভম্ব করে দিয়ে আনন্দ ভাইয়া ভাবীর গালে সর্বশক্তি দিয়ে একটা চড় লাগালেন। ভাবী তাল সামলাতে না পেরে পড়ে গেলেন। ফুপা-ফুপু একযোগে দৌড়ে এসে ভাবীকে তুললেন আর ভাইয়াকে খুব জোরে একটা ধমক লাগালেন। ভাবীকে জড়িয়ে ধরে তাঁর গালে চুমু খেয়ে ফুপু বললেন,”কতো সুখী ছিলে তোমরা। এখন এই হতভাগ্য বাচ্চার জন্য স্বামী-স্ত্রীতে কতো দ্বন্দ্ব। কি দরকার ছিলো একে আমদানি করার। বরং ওকে হোমে বা অন্য কোথাও দিয়ে আসো কোর্টের পারমিশন নিয়ে। একে পুষে তোমরাও ভালো থাকবে না, ও-ও ভালো থাকবে না।”

অদ্বিতীয়া আবার বমি করলো।তারপরে একেবারে নেতিয়ে পড়লো। ভাবী হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। অদ্বিতীয়াকে কোলে তুলে বললো,”তোর কাছে এই মুহূর্তে টাকা আছে? তাহলে চল,হাসপাতালে নিয়ে যাই।

হাসপাতালে ডাক্তার সাহেব নানারকম পরীক্ষা করে দেখলেন। বললেন,”মনে হচ্ছে না,ব্রেইন হেমোরেজ বা সিরিয়াস কিছু হয়েছে। বাচ্চার দিকে খেয়াল রাখুন। কোনো অসুবিধা দেখলে ইমার্জেন্সিতে নিয়ে আসবেন।”

ফেরার সময় ভাবী বললেন,”বাসায় ফিরতে ইচ্ছা করছে না। বহুদিন রিক্সায় ঘুরি না। চল্,একটু ঘুরি।”

রিক্সা চলছে। ভাবী নিঃশব্দে কাঁদছে। অদ্বিতীয়া নেতিয়ে আছে মায়ের কোলে।

“অদ্বিতীয়া মামনি, আইসক্রিম খাবি? চকবার,কোণ? আয়,আমরা তিনজন মিলে মজা করে আইসক্রিম খাই।”

বাচ্চাটা আমার কথার উত্তর দিলো না। মায়ের বুকে নেতিয়ে রইলো।বেচারার আর কিছু খাওয়ার শখ নেই।

ভাবী বললেন,” গতরাতেও বাবুর ব্যাপারে ভীষণ রাগারাগি করেছে তোর ভাই। আজ প্র্যাকটিকালি রাগ দেখালো।”

“এভাবে চালিয়ে যেতে পারবে ভাবী?”

“পারবো। পারতে হবে। আমি অদ্বিতীয়ার মা। মা বাচ্চার জন্য যা যা করে, আমি তাই করবো।”

তীব্র মন খারাপ নিয়ে আমরা বাসায় ফিরলাম। ফুপু গম্ভীর। আনন্দ ভাইয়া শুয়ে পড়েছে। পরীকে নিয়ে ওর পরিচর্যাকারী বিন্তি ঘুরে বেড়াচ্ছে। সমুদ্র দাদার পাশে বসে টিভি দেখছে।

সমুদ্র আমাদের দেখে রূঢ় গলায় বললো,”তোমরা কোথায় গিয়েছিলে?আমাকে আর পরীকে নাও নি কেন?”

“ডাক্তার দেখাতে গিয়েছিলাম বাবা। ”

“ডাক্তার দেখাতে এতো টাইম লাগে? লায়ার। সারাক্ষণ শুধু এই পচা মেয়েটাকে নিয়েই থাকে। বাবা ঠিকই বলে, আপদ। এর গলা টিপে মেরে ফেলবো আমি।”

ভাবী সজোরে চড় লাগালেন সমুদ্রকে।

“বেয়াদব ছেলে। ভদ্রতা জানে না। দানব তৈরি হচ্ছে একটা।আরেকবার যদি বেয়াদবের মতো কথা বলতে শুনি, তবে দেখো, তোমার কি করি আমি। নিজেদের হাতে নিজেদের ছেলেকে অমানুষ বানাচ্ছে। ”

সমুদ্র বিচ্ছিরি করে চিৎকার করতে লাগলো, লাথি আর থাপ্পড় দিতে লাগলো ভাবীকে আর আমাকে। ভাবী অদ্বিতীয়াকে আমার কোলে দিয়ে এলোপাথাড়ি মারতে লাগলেন সমুদ্রকে। ভাবীর উপরে যেন ভূত ভর করেছে। এরমধ্যে ভাবী বললেন, “তুমি অদিতিকে নিয়ে ওর ঘরে বসো, বিন্তি,পরীকে নিয়ে অন্য ঘরে যাও। অ্যাই রোজী, তুই যাচ্ছিস কোথায়?তোর সাথে আমার বোঝাপড়া আছে।”

আনন্দ ভাইয়া ছুটে এসে সমুদ্রকে রক্ষা করতে গেলেন। কিন্তু ভাবীর গায়ে অসুর ভর করেছে। ছেলের দুই গালে সমানে চড় দিচ্ছেন আর বলছেন,”আর বেয়াদবি করবি? আদব কায়দা শিখাইনি আমি? ভদ্র হয়ে থাকা ভালো লাগে না?বেয়াদব, স্বার্থপর, অপদার্থ। ”

বিকালের ঘটনায় আনন্দ ভাই লজ্জিত ও অনুতপ্ত হয়েছিলেন। অদ্বিতীয়ার জন্য এতোটুকু নয়,তিথি ভাবীকে চড় দেওয়ার জন্য। এখন জোর করে তিথি ভাবীর হাত থেকে সমুদ্রকে ছাড়ালেন। সমুদ্রের জীবনে এমন অভিজ্ঞতা প্রথম।

ফুপা-ফুপু আর আনন্দ ভাইয়া ব্যস্ত হয়ে পড়লেন সমুদ্রের পরিচর্যায়। ভাবী এবারে সবার সামনে ধরলেন রোজীকে।

“অনেক বাবা-বাছা বলে বুঝিয়েছি তোমাকে। তোমার প্রতিটা সুবিধার দিকে আমি আর মাজেদা বু খেয়াল করেছি। আর তুমি? দেখেছো এই বাড়িতে আমার মেয়ের কোনো দাম নেই, আমার কোনো দাম নেই। তাই তুমিও ছড়ি ঘুরিয়েছো আমার মেয়ের উপরে। তোমাকে রোজ এ বাড়ির পুণ্যবান-পুণ্যবতীরা কাপ ভরে দুধ খাওয়ান, তাও তোমার নিয়মিত ভাগ বসানো লাগবে আমার সোনামনিটার আধা লিটার দুধে।মাছের কাঁটা বাছতে কষ্ট লাগে বলে আমার মেয়েকে মাছ দাওনা, নিজেতো দিব্যি কড়মড়িয়ে মাছ খাও,তখন কাঁটা বাছতে কষ্ট লাগে না? আমার মেয়ে ঠান্ডা কাঁথায় শুয়ে থাকে, ভেজা জামা পরে ঘুরে বেড়ায়, কি করো তুমি তখন? মুখে শুধু ভাত ঢুকাতে থাকো,চিবানোর সুযোগ দাও না বাচ্চাটাকে, বমির সাথে কাঁচা আস্ত ভাত আর ডিম বের হয়েছে। রাতে একা খাটে মেয়েটা ঘুমায়, তুমি ব্যস্ত থাকো এ ঘরে রাত দুইটা পর্যন্ত সিরিয়াল দেখতে। মুখের মধ্যে খাবার ঠেসে দাও,দেখোও না অতিরিক্ত গরম কিনা,বাচ্চা মানুষ খেতে পারবে কিনা। তুমি ঠান্ডা পানিতে গোসল করাও এতোটুকু বাচ্চাকে। সবচেয়ে বড় কথা, তুমি আমার বুকের ধনকে কথায় কথায় মারো, ওর গালে,ওর পিঠে। মনে করো আমি টের পাই না, তাই না? আজ আমি তোমাকে নিমকহারামির শাস্তি কাকে বলে দেখাচ্ছি। ”

ভাবী ভয়ংকর ভাবে রোজীকে মারতে লাগলেন। আমরা বুঝতে পারছিলাম ভাবী হুঁশে নেই। কাউকে মারার বা কটু কথা বলার মানুষ তিথি ভাবী না।
সমুদ্র ভয়ে সিঁটিয়ে আছে। ফুপা-ফুপুও বিভ্রান্ত, কি করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। আনন্দ ভাইয়া যেয়ে নরম গলায় ভাবীকে কি যেন বললেন আর ভাবীকে জড়িয়ে ধরলেন। ভাবী চিৎকার করে রোজীকে বললেন,”এই মুহূর্তে বাড়ি ছেড়ে বের হ, নইলে আমার হাত থেকে তোকে কেউ বাঁচাতে পারবে না। ”

আনন্দ ভাইও সহজ,সরল,পরোপকারী, মিষ্টি বৌয়ের এই ভয়ংকর চেহারা দেখে ঘাবড়ে গেছেন খুব। ভাবীকে তিনি অসম্ভব ভালোবাসেন। যা কিছু কষ্ট দিয়েছেন , অদ্বিতীয়ার জন্য। সেগুলো যে ভুল,এটাও তিনি বুঝতে পারতেন। কিন্তু অদ্বিতীয়ার প্রতি ভীষণ ঘৃণা জমা থাকায় তিনি নিজেকে নিয়ন্ত্রনে রাখতে পারেন না।

ভাবী এক ঝটকায় নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললেন,” আমি তোমাকে ডিভোর্স দিবো। কারণ, তোমার মধ্যে মনুষ্যত্ব নেই। একটা অসহায় বাচ্চা তোমার কাছে এক শক্তিশালী প্রতিপক্ষ। তার খাওয়া-পরা সবকিছুতে তুমি রেশন সিস্টেম চালু করেছো। যার নিজের দুটো বাচ্চা আছে,সে অন্যের বাচ্চাকে কি করে এতো কষ্ট দিতে পারে? কি শিক্ষা দিচ্ছ তুমি তোমার ছেলেমেয়েকে?তুমি তোমার ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকো,আমি আমার মেয়েকে নিয়ে চলে যাবো।”

আনন্দ ভাইয়া “স্যরি” বলে ভাবীকে আবার জড়িয়ে ধরলেন, ভাবী ঢলে পড়লেন। দৌড়াদৌড়ি, হৈচৈ। ভাবীর মুখে পানি ছিটানো হচ্ছে। ফুপা গাড়ি বের করছেন,ভাবীকে হাসপাতালে নিবেন। কে জানে রাতে থাকতে হবে কিনা।আনন্দ ভাইয়া আমাকে বললেন,”সমুদ্র আর পরীকে সামলানোর জন্য তোর ভাবীর মা-বাবা আর বোনদের খবর দে। লাবণীকে চলে আসতে বল্।মায়ের প্রেশার ট্রেশার দেখে দিবে। মা আর বাচ্চা দুটোর দিকে খেয়াল রাখিস। বাবা ফিরে এলে উনার দিকেও খেয়াল করিস।”

ফুপু কাঁদতে কাঁদতে বললেন,”আমার এতো ভালো বৌটা কি একটা কাজ করলো,আমার সুখের সংসারে অশান্তি নেমে এলো ঐ কালসাপের বাচ্চার জন্য। অলক্ষুণে একটা। আজকে মরলেই ভালো হতো।”

আমি বিছানায় শুয়ে থাকা অলক্ষুণে কালসাপটার দিকে তাকালাম। ছোট্ট শরীরটা একদম গুটিয়ে রেখেছে। কপাল ফোলা। চোখের উপর দিয়ে কালো। নরম গালে শুকিয়ে যাওয়া পানির দাগ।

কাছে বসে মাথায় হাত দিলাম। আকাশ পাতাল জ্বর।

চলবে

পূর্ববর্তী নিবন্ধ
পরবর্তী নিবন্ধ
গল্প পোকা
গল্প পোকাhttps://golpopoka.com
গল্পপোকা ডট কম -এ আপনাকে স্বাগতম......
RELATED ARTICLES

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments

Md masrur Hasan mahi على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
আমিনুল ইসলাম على প্রয়োজন পর্ব: ৩০ ( অন্তিম)
সাজিবুল ইসলাম على ধর্ষিতাবউ২ ৯ তথা শেষ পর্ব
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
Nita Sarkar على স্বপ্নীল ৬৮
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على রহস্য শেষ_পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على অলক্ষ্যে তুমি পর্ব-০৬ এবং শেষ পর্ব
Nazmun Nahar Akhi على Psycho_is_back? part_7
Nazmun Nahar Akhi على Dangerous_Villian_Lover part 2
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على জানালার ওপারে পর্ব-১৭ এবং শেষ পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على লীলা বোর্ডিং ১২১৫ পর্ব-১১ এবং শেষ পর্ব
মিজানুর রহমান রাহুল على সেই তুমি পর্ব-০১
@feelings على প্রহেলিকা
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Nusrat jahan على coffee & vanilla Part-10
Pallabi Roy على স্বপ্নীল ৬৮
M.D Mahabub على The_Villain_Lover Part_2
Labani sarkar على Dangerous_Villain_Lover part 23
MD Akas Apc على বিবেক
Tanisha Ahmed على Devil love part-18 
Aius Barmon shorob على নারীর দেহকে নয়
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Priya Banerjee على devil love married life last part
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Riya Biswas على তুমি রবে ৫২
Mohammad Adib على তুমি রবে ৬০
Avni Ayesha على তুমি রবে ২৮
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
সুমিত على তুমি রবে ২৮
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
Samiah Begum على তুমি রবে ৫১
biddut das rocky على নর নারী
গল্প পোকা على নষ্ট গলি শেষ পর্ব
Md Jobayer Hossain Shohag على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على দুই অলসের সংসার
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤৪২.
A.J.S Rakib على মন ফড়িং ❤৪২.
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
Samiya noor على গল্পঃ ভয়
Sadikul على গল্পঃ ভয়
Samia Islam على গল্পঃ ভয়
শূন্য মায়া على মন ফড়িং ❤ ৪০.
Sutapa biswas على মন ফড়িং ❤৩৯.
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৮.
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৭
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
Siyam على বিবেক
Sudipto Guchhait على My_Mafia_Boss পর্ব-৯
saptami karmakar على devil love married life last part
saptami karmakar على devil love married life last part
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ২৬.
Shreyashi Dutta على  বিয়ে part 1
Sandipan Biswas على  বিয়ে part 1
Paramita Bhattacharyya على অনুরাগ শেষ পর্ব
জামিয়া পারভীন তানি على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
মায়া على মন ফড়িং  ২২
সুরিয়া মিম على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على মন ফড়িং ২১
গল্প পোকা على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
Sahin ssb على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৮. 
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৭.
Jannatul Ferdous على খেলাঘর পর্ব-৩৫
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ফাল্গুনের_ফুল last_part_8
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ছাত্রী যখন বউ পাঠঃ ১
গল্প পোকা على বাজির প্রেম পাঠঃ ১
Foujia Khanom Parsha على মা… ?
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৮
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
Ibna Al Wadud Shovon على স্বার্থ