Monday, October 6, 2025







বাড়ি"ধারাবাহিক গল্প"শেষ রাতশেষ রাত পর্ব-৩০+৩১+৩২

শেষ রাত পর্ব-৩০+৩১+৩২

#শেষ_রাত
#পর্বঃ৩০
#সাইয়ারা_হোসাইন_কায়ানাত

‘ধ্রুব ভাইয়ের কি হয়েছে রে অনু? ইদানিং খুব ব্যস্ত থাকে মনে হচ্ছে। এখানেও তো তুলতুলের কাছে বেশি আসে না।’

ভাইয়ার কথায় খানিকক্ষণের জন্য আমি হাত আপনাআপনি থেমে গেল। নিজের অজান্তেই বুক চিড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো। নিজেকে যথাসাধ্য সংযত করে আবারও তুলতুলের জামা কাপড় ভাঁজ করে ব্যাগে গুছিয়ে রাখতে লাগলাম। ভাইয়ার প্রশ্নাত্মক চোখ জোড়া এখনও প্রতিত্তোরের আশায় স্থির চেয়ে আছে আমার দিকে। তবে আমি প্রত্যুত্তর করলাম না। তুলতুলের সকল জিনিসপত্র ব্যাগে গুছিয়ে বেডের পাশে রাখলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই তুলতুলকে নিয়ে আবারও বাড়ি ফিরবো। বিষাদ আর একাকিত্বে ঘেরা বাড়িটা আবারও তুলতুলের প্রাণোচ্ছল হাসিতে মুখরিত হয়ে উঠবে। স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলে তুলতুলের ঘুমন্ত মুখের দিকে একনজর চাইলাম। তিনদিন ধরে মেয়েটা হসপিটালের কেবিনে পরে আছে। অথচ ধ্রুবর দেখা পাওয়া যেন দুষ্কর হয়ে উঠেছে এই সময়টায়। উনি এতটা বেখেয়ালি বা ব্যস্ত আগে ছিলেন না। তুলতুলের অসুস্থতার সাথে সাথেই যেন ওনার ব্যস্ত পালা দিয়ে বেড়েছে। সারাদিনে তাকে একবার দেখতে পাওয়া-ই ভীষণ ভাগ্যের ব্যাপার হয়ে গেছে সবার জন্য। ভাইয়া সোফায় বসে ফোন টিপছে। আমি নিঃশব্দে এসে ভাইয়ার পাশে বসলাম। ঠোঁটের কোণে ম্লান হাসির রেখা টেনে নিয়ে সহজ গলায় বললাম-

‘উনি কিছুদিন ধরে অফিসের কাজে একটূ ব্যস্ত তাই তুলতুলের সাথে বেশি সময় কাটাতে পারে না।’

ভাইয়ার ফোনের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখেই বলল- ‘সত্যি-ই ব্যস্ত না-কি তুই আবার ওনার সাথে কোনো ঝামেলা টামেলা পাকিয়েছিস!’

ভাইয়া কথাটা বলেই মাথা তুলে আমার দিকে সন্দেহের দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। আমি কিছুটা সময় চুপ থেকে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললাম-

‘তোর কি মনে আমি সব সময় শুধু ঝামেলা-ই পাকাই!’

‘ধ্রুব ভাইয়ের মতো ভালো আর শান্তশিষ্ট স্বভাবের মানুষ কখনও ঝগড়াঝাটি করবে বলে মনে হয় না। আর তুই হলি পেত্নি। পেত্নিরা সবার সাথে ঝামেলা করে বেড়াবে এটাই তার আসল কাজ।’

আমি জ্বলন্ত চোখে ভাইয়ার দিকে চাইতেই ভাইয়া জোরপূর্বক দাঁত বের করে হাসলো। সোফা থেকে উঠে ফোন পকেটে রাখতে রাখতে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল-

‘বিকেল হয়ে গেছে চল এখন তোকে তোর শ্বশুর বাসায় দিয়ে আসি। বাকি সত্য কথা অন্য আরেকদিন বলবো।’

আমি ভ্রু কুচকে তিক্ত গলায় বললাম- ‘এসব তোর সত্য কথা!’

ভাইয়া কিছুই বললো না। আমার দিকে চেয়ে দাঁত কেলিয়ে হাসলো। আমাকে রাগানোর মিশন কমপ্লিট হয়েছে তার।
ভাইয়া ঘুমন্ত তুলতুলকে খুব সাবধানে কোলে নিয়ে অন্য হাতে ব্যাগ তুলে নিলো। আমি দ্রুত পায়ে ভাইয়ার কাছে এসে বললাম-

‘ব্যাগটা আমার কাছে দে। তুই তুলতুল আর ব্যাগ একসাথে নিতে পারবি না।’

‘তোর এত পাকনামি করতে হবে না। আমার যথেষ্ট শক্তি আছে। আমি তোর মতো বাতাসের সাথে উড়ে বেড়াই না। যা সর।’

ভাইয়া আর এক মুহুর্ত দেরি না করে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল। আমি একমনে তাকিয়ে রইলাম ভাইয়ার যাওয়ার পানে। চোখের সামনে ভাসছে ভাইয়ার কাঁধে চড়ে ঘুরেবেড়ানোর স্মৃতিগুলো। বেশিদিন তো না এইতো সেদিনের-ই তো কথা। এই রুম থেকে ওই রুমে যেতেই ভাইয়ার কাঁধে চড়ে যেতে হয়েছে। আমার চেয়েও বেশি ভাইয়া আনন্দ পেতো আমাকে তার কাঁধে চড়িয়ে। আর এখন আমার সেই জায়গাটা আমার মেয়ে পেয়েছে। চোখের সামনেই যেন আবারও আমার ছোটবেলা দেখতে পাচ্ছি। ভাইয়া কর্কশ গলায় আমাকে ডাকলো। আমি ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে এলাম। মুচকি হেসে ভাইয়ার পিছু পিছু হাঁটা শুরু করলাম।

বৃষ্টিস্নাত বিকেল। ঘন্টা খানেক হলো বৃষ্টি থেমে প্রকৃতি শান্ত হয়েছে। মেঘহীন ঝকঝকে পরিষ্কার আকাশ। ঝিরিঝিরি হিম শীতল বাতাস বইছে চারপাশে। কোলাহলপূর্ণ শহরটাতে ঝুপ করেই নিরবতা নেমে গেল। বৃষ্টি ভেজা পিচঢালা রাস্তার পাড় দিয়ে নিঃশব্দে হাঁটছে লাজুক প্রেমিকা আর তার পাশেই মুগ্ধ নয়নের প্রেমিক পুরুষ। বৃষ্টির স্নিগ্ধতায় মেতে উঠেছে প্রেমিক প্রেমিকার মন। আমি মুগ্ধ হয়ে গাড়ির জানালা দিয়ে বাহিরের দৃশ্য দেখছি। রাস্তায় জমে থাকা পানিতে গাঁ ভিজিয়ে পথশিশুরা খেলছে। কি সুন্দর প্রাণখোলা তাদের হাসি৷ এই হাসিতে নেই কোনো চিন্তা কিংবা বিষাদের ছোঁয়া। সব কিছুর মাঝে আচমকাই আমার দৃষ্টি আটকে গেল দুটো মানুষের দিকে। রাস্তার পাশে ফুটপাত দিয়ে পাশাপাশি হাঁটছে দু’জন। লাল জামা পড়া খোলা চুলের মেয়েটা এক নজরে তাকিয়ে আছে তার পাশে হাঁটতে থাকা মানুষটার দিকে। খুব মনোযোগ দিয়েই শুনছে মানুষটার কথা। ক্ষনিকের জন্য নিজের চোখদুটোকে অবিশ্বাস করতে ইচ্ছে হলো এই মুহুর্তে। ঝট করেই আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম। আবারও পূর্নাঙ্গ দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে দেখতে চাইলাম মানুষটাকে। তবে তা আর সম্ভব হলো না। ঘুমন্ত তুলতুলের তোয়াক্কা না করেই গাড়ির স্পিড আগের চেয়েও বাড়তে লাগল। আচমকাই ভাইয়া হড়বড়িয়ে বলে উঠলো-

‘অনু শোন না তোকে তো একটা কথা বলতে ভুলেই গেছি। মনে আছে একটা মেয়ে দেখতে গিয়েছিলাম! তারা তো বিয়ের কথা ফাইনাল করতে চাচ্ছে৷ তোর কি মনে হয় আমার এখন বিয়ে করা উচিত? কয়েকমাস হলো আব্বুর ব্যবসায় মন দিয়েছ। এখনই সবাই বিয়ের জন্য উঠে পরে লেগেছে। খুব জলদি হয়ে যাচ্ছে না! কিরে কথা বলছিস না কেন? তোকে কিছু বলছি আমি। আমাকে একটু সাহায্য কর।’

হঠাৎ করেই ভাইয়ার এমন ব্যবহারে আমি কিছুটা বিস্মিত হলাম। মাথাটা এলোমেলো লাগছে। আমি কি সত্যিই দেখলাম না-কি আমার মনের ভুল ছিল! মানুষটা কি সত্যিই এখানে ছিল! আমি আর বেশিক্ষণ এসব নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে পারলাম না। ভাইয়ার উদ্ভট আচরণ আর একনাগাড়ে কথা বলায় অতিষ্ঠ হয়ে গেলাম। তুলতুলও এবার নেড়েচেড়ে উঠলো। আমি বিরক্ত হয়ে চাপা কন্ঠে বললাম-

‘ভাইয়া! তোর বকবক বন্ধ কর তো। আর গাড়ির স্পিড কমা। তুলতুল ঘুমাচ্ছে দেখছিস না! আর বিয়ে নিয়ে তোর এত মাথা ঘামাতে হবে না। আব্বু আম্মু যা সিদ্ধান্ত নিবে তোর সেটাই মানতে ব্যস।’

ভাইয়া গাড়ির স্পিড কমিয়ে আমতা আমতা করে বলল- ‘আমি তো তোর মতামত চাচ্ছিলাম।’

‘এখন মন দিয়ে গাড়ি চালা এসব নিয়ে বাসায় যেয়ে কথা বলবো।’

ভাইয়া আর কথা বাড়ালো না। চুপ থেকেই পাড় করলো সারা পথ। কেমন যেন চিন্তিত লাগছে ভাইয়াকে। বাসায় এসে তুলতুলে কোলে নিয়ে নির্বিকার ভঙ্গিতে আমার রুমে চলে আসলো। মনি মা সাথেও কেমন নির্লিপ্ত ভাবেই কথা বলল।

‘অনু একটু এদিকে আয়। আমার পাশে বস।’

আমি তুলতুলের গায়ে কাঁথা জড়িয়ে দিয়ে ভাইয়ার দিকে চাইলাম। বিছানার এক কোনে পা ঝুলিয়ে বসেছে। দারুণ আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি ভাইয়ার পাশে এসে বসলাম। বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

‘কিছু বলবি?’

ভাইয়া কিছু বলল না। মাথা নিচু করে চুপচাপ দু’হাত এক করে বসে রইলো। খানিকক্ষণ ইতস্তত করে আমার হাত আলতো করে ধরলো। নিজের দু’হাতের মুঠোয় আমার বা হাত আগলে নেয়। নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে একমনে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমার ভ্রু জোড়া কুচকে এলো। ভীষণ কৌতূহল নিয়ে দেখছি ভাইয়াকে। এর আগে কখনও ভাইয়া এমন ব্যবহার করে নি। আমার সাথে কথা বলতে তার এতো জড়তা কাজ করেনি। তাহলে আজ কেন এমন করছে?

‘অনু আমি জানি তোর বিয়েটা অন্য সব বিয়ের মতো স্বাভাবিক না। তুই একমাত্র তুলতুলের জন্যই এই বিয়েতে রাজি হয়েছিস। অনেক কিছু বিসর্জন দিয়েছিস এই সম্পর্কের জন্য। এই ক’দিন তোর পাগলামো দেখেই আমি বুঝেছি তোর জন্য এই পরিবার কতটা গুরুত্বপূর্ণ। আসলে এই পরিবারের প্রতিটা মানুষই ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য। ওনারা সবাই খুব ভালো সেটা আমরা ছোট থেকেই জানি। তোকেও খুব ভালোবাসে সবাই৷ বিশেষ করে মনি আন্টি। ওনার মতো ভালো মানুষ পাওয়া মুশকিল। আর..’

ভাইয়াকে মাথ পথে থামিয়ে দিয়ে আমি বললাম-

‘আর তোর ধ্রুব ভাইও খুব ভালো। কিছুক্ষণ আগেই হসপিটালে ওনার প্রসংশা করলি। আমার সব মনে আছে৷ তাই এখন আবার শুরু করিছ না। আমি জানি সবাই ভালো। এখন আসল কথায় আয়। বল কি বলবি!’

ভাইয়া আমার হাত আরও শক্ত করে চেপে ধরলো। চোখমুখে গাম্ভীর্যতা এনে ভারী কন্ঠে বলল-

‘আমার কাছে সবার উপরে তুই। তোকে কেউ কষ্ট দিলে আমি তাকে কখনোই ছাড়বো না। সেটা আমার ভালো ধ্রুব ভাই হোক বা অন্য কেউ। এখন থেকে একটা কথা মাথায় ডুকিয়ে রাখ। তোর কোনো দরকার বা কোনো ঝামেলা হলে তুই আমাকে অবশ্যই জানাবি। আমি জানি তোর ধৈর্য্য শক্তি অনেক। তুই চাপা স্বভাবের মেয়ে। তবে আমার কাছে কোনো কিছু লুকানোর চেষ্টা করিস না। মনে রাখিস তোর পাশে কেউ না থাকলেও আমি সব সময় থাকবো।’

আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম ভাইয়ার কথা শুনে। আমার আর বুঝতে কষ্ট হলো না ভাইয়া রাস্তায় ধ্রুবর সাথে মেয়েটাকে দেখে ফেলেছে৷ আমি নিজের হতভম্ব ভাব কাটিয়ে যথাসম্ভব স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলাম। মৃদু হেসে বললাম-

‘তুই হয়তো কোনো কিছু নিয়ে ভুল বুঝছিস ভাইয়া। কেউ আমাকে কষ্ট দিবে না৷ শুধু শুধু চিন্তা করিস না তো।’

‘হ্যাঁ আমিই যেন ভুল হই। সব কিছু ভুল হয়ে যাক শুধু তুই হ্যাপি থাকলেই হবে।’

রাত নয়টায় বাসায় ফিরলেন ধ্রুব। তুলতুলকে দেখেই খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেলেন তিনি। মেয়েকে কোলে নিয়ে বেশ কিছুক্ষন সময় আদর করার পর শান্ত হয়ে বসলেন। তবে তুলতুল তার পাপার গলা জড়িয়ে ধরে থাকলো আগের মতোই। আমি দূর থেকে তাদের দু’জনকে দেখলাম। তাদের দেখে মনে হলো কত বছর তুলতুল বাসায় এসেছে। বাচ্চা মেয়েটাও অসুস্থতা থেকে বেরিয়ে একটু বেশিই চঞ্চলতা দেখাচ্ছে। আমি এগিয়ে গেলাম তাদের কাছে। ধ্রুবর দিকে চেয়ে ক্ষীন স্বরে বললাম-

‘কিছুদিন ধরে আব্বুর সাথে আসেন না যে কোনো কিছু হয়েছে!’

ধ্রুব তুলতুলকে বিছানায় বসিয়ে গালে চুমু দিয়ে ভ্রুক্ষেপহীন গলায় বললেন-

‘আমার কাজ থাকে তাই আমি অফিসেই থেকে যাই৷ তুলতুলকে কখন নিয়ে এসেছেন হসপিটাল থেকে? আমি তো কিছুই জানি না।

‘আপনার হয়তো খেয়াল নেই তবে আপনাকে জানানো হয়েছিল। আর বিকেলেই ভাইয়া নিয়ে এসেছে। আপনার কথাও জিজ্ঞেস করেছিল। তুলতুলের সাথে দেখা করতে যাননি তাই।’

আমার কথায় ধ্রুবর মুখশ্রীতে পরিবর্তন হলো। ঠোঁটের কোণে ঝুলে থাকা হাসি মিলিয়ে গেল ধীরে ধীরে। অনুভূতিহীন হয়ে কিছুটা সময় চুপ থেকে বললেন-

‘অফিসে কাজের চাপ বেশি তাই যেতে পারিনি।’

আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। ধ্রুব জঘন্যতম একটা কাজ করলেন। মিথ্যা বললেন তিনি। যে জিনিসটা আমি সব চেয়ে বেশি ঘৃণা করি ধ্রুব সেইটাই করলেন। আমাকে মিথ্যা অযুহাত দেখাচ্ছেন! আমি তো দেখেছি তিনি অফিসে ছিলেন না। আর আব্বুও তো বলেছেন অফিসে কাজের তেমন চাপ নেই। তাহলে কেন তিনি মিথ্যা কথা বলছেন আমাকে? আর ওই মেয়েটা!

‘তুলতুলের আম্মু? কোথায় হারিয়ে গেলেন! আপনাকে একটা কথা বলার ছিল।’

আমি ধ্রুবর দিকে চাইলাম। ক্ষীণ স্বরে বললাম- ‘জ্বি বলুন।’

ধ্রুব হাসলেন। আমার দিকে খানিকটা এগিয়ে এসে ফিসফিস করে বললেন-

‘আমি আপনাকে ভালোবাসি। আর আপনিও আমাকে ভালোবাসেন।’

আমি নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে রইলাম। আজ আর কিছু বললাম না৷ কিছু বলতে ইচ্ছে করলো না। বার বার মনে হচ্ছে তার মিথ্যা কথা আর রাস্তায় মেয়ের পাশে হাঁটার সেই দৃশ্যটা। কে ওই মেয়েটা যার কারণে উনি আমাদের সবাইকে মিথ্যা কথা বলছেন? আমার কি ওনাকে জিজ্ঞেস করা উচিত? কিন্তু কোথাও যেন একটা বাঁধা কাজ করছে।
আচমকাই তুলতুল অস্পষ্ট উচ্চারণে বলল- ‘ভালোবাসি’

পর পর কয়েকবার তুলতুল এই শব্দটা-ই উচ্চারণ করলো। ধ্রুব হেসে ফেলল শব্দ করে। আমি ব্যস্ত ভঙ্গিতে তুলতুলকে কোলে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। এখনও ধ্রুবর আকর্ষণ কাড়া হাসির তীক্ষ্ণ শব্দ তীরের মতো কানে এসে বাজছে।

চলবে….

#শেষ_রাত
#পর্বঃ৩১
#সাইয়ারা_হোসাইন_কায়ানাত

‘অনন্যা তুই কি ধ্রুবকে অবিশ্বাস করছিস?’

বিশ্বাস! বিশ্বাস খুব ছোট একটা শব্দ। তবে এর মর্যাদা রক্ষা করা খুব খুব খুব কঠিন। ঠিক তেমনি কারও মনে নিজের প্রতি বিশ্বাস জাগানোটাও ভীষণ কষ্টকর। ভালোবাসা ছাড়া বিশ্বাস হয়। তবে বিশ্বাস ছাড়া ভালোবাসা কিংবা সম্পর্ক কোনোটা-ই হয় না। ধ্রুব আর আমার সম্পর্কটা বিশ্বাস দিয়েই শুরু হয়েছে। ধ্রুব একদিনে আমার মনে তার জন্য বিশ্বাস জাগায়নি। দিনের পর দিন তার ব্যবহারে মাধ্যমেই আমার মনে তার প্রতি বিশ্বাস জাগিয়েছে। এতদিনে একটু একটু করে জন্মানো বিশ্বাস এক পলকের একটা দৃশ্য দেখে কিংবা তার একটা মিথ্যা শুনেই ভেঙে যাওয়া কি ঠিক! অন্য সবাই হয়তো কোনো কিছু যাচাই-বাছাই না করেই পুরনো সকল কথা ভুলে শুধু এবং শুধু মাত্র একটি মিথ্যাকে গুরুত্ব দিয়েই মানুষকে ভুল বুঝে বসে থাকে। আমরা মানুষ জাতি বরই অদ্ভুত। কেউ আমাদের সারাজীবন আগলে রাখলে সেটা আমরা মনে রাখি না। যেই না একদিন মানুষটার কোনো ভুল সামনে আসলো অমনি তার হাজারটা ভালো কাজ ভুলে শুধু খারাপটাই মনে রাখতে শুরু করি। তবে আমি পারলাম না সবার মতো হতে। আমার পক্ষে সম্ভব হলো না ধ্রুবকে অবিশ্বাস করা। বিয়ের পর থেকে আমার প্রতি ধ্রুবর ভালোবাসা, কেয়ার, বিশ্বাস সব কিছু ভুলে শুধু মাত্র একটি মিথ্যাকে গুরুত্ব দিতে পারলান না। আমাকে আমার প্রাক্তনের সাথে দেখেও যে মানুষটা আমাকে অবিশ্বাস করেনি, আমি কীভাবে সামান্য একটা বিষয়ে তাকে অবিশ্বাস করবো! প্রতিদিন একটু একটু করে আমার মনে তিনি নিজের জন্য জায়গায় করে নিয়েছেন। বিশ্বাস তৈরি করেছেন। বিচ্ছেদের দাহনে পুড়ে বিধ্বস্ত হয়ে যাওয়া আমিটাকে খুব সুন্দর করে সামলে নিয়েছেন। সেই মানুষটা এত সহজে আমাকে ঠকাবেন এটা মেনে নেওয়া যায় না। কল্পনাও করা যায় না। তিনি মিথ্যা বলেছেন এটা আমি জানি। হয়তো তার পেছনে যথাযথ কোনো কারণ আছে। তুলতুলকে দেখতে না এসে তিনি একটা মেয়ের সাথে বাহিরে হেঁটেছেন এর পেছনেও নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। খুব বড়সড় কারণ আছে। তা নাহলে তিনি কখনই তুলতুলের অসুস্থতায় নিজেকে আড়াল করতে পারতেন না। যে মানুষ তুলতুলের হাল্কা সর্দিকাশিতে অস্থির হয়ে পরে সে মানুষ কখনোই তুচ্ছ কারণে তুলতুলকে উপেক্ষা করবেন না। হয়তো সঠিক সময় আসলেই তিনি সবটা খুলে বলবেন। মিথ্যার আশ্রয় কেন নিয়েছেন তা-ও বলবেন। এখন শুধু সঠিক সময়ের অপেক্ষা। নিজের মস্তিষ্কে জেগে ওঠা প্রশ্নে আমার মন খুব সুন্দর করে উত্তর দিলো-

“নাহ, আমি ধ্রুবকে অবিশ্বাস করছি না। করতে পারি না। ধ্রুবকে অবিশ্বাস করা যায় না। কিছুতেই না। পুরো পৃথিবী আমাকে ঠকালেও ধ্রুব কিছুতেই আমাকে ঠকাবেন না। আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবেন না। তাকে অবিশ্বাস করা যায় না। তাকে শুধু বিশ্বাস করা যায়৷ ভরসা করা যায়।”

মন থেকে আসা প্রত্যুত্তরের বিপরীতে আমার মস্তিষ্ক তখন পালটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো আমার দিকে- “শুধুই কি বিশ্বাস আর ভরসা করা যায়! ভালোবাসা যায় না?”

এই প্রশ্নের জবাবে আমি শুধুই হাসলাম। যে হাসির মানে হতে পারে অনেক কিছু। যে হাসির মানে আমি বের করতে চাই না। যে হাসিকে শুধুই প্রশ্রয় দেওয়া যায়।

————————

‘কিরে কখন আসবি তোরা? আমরা বেরিয়ে গেছি তো।’

ফোন রিসিভ করতেই অপরপ্রান্ত থেকে ভাইয়ার দুর্বল কন্ঠস্বর ভেসে আসলো। আমি কল লাউডস্পিকারে দিয়ে ফোন ড্রেসিং টেবিলের উপরে রাখলাম। আয়নার দিকে চেয়ে চুল ঠিক করতে করতে বললাম-

‘এই তো রেডি হচ্ছি একটু পরেই বেরিয়ে যাবো।’

‘আচ্ছা জলদি কর। নাহলে আজ সারারাত শপিংমলেই থাকতে হবে। ভাল্লাগে না এসব মার্কেট ফার্কেট করতে। তোরা-ই তো বিয়ে ঠিক করলি তাহলে তোরা একা একা কেন মার্কেট করতে পারবি না! একদম দল বেধে সবাইকে কেন নিয়ে যেতে হবে? আর আমাকেই বা কেন যেতে হবে?’

ভাইয়া আক্রোশ ভরা কন্ঠে একের পর এক কথা বলেই যাচ্ছে। ভাইয়ার রাগ দেখে আমি নিঃশব্দে হাসলাম। বিয়ে নিয়ে ভাইয়া বিব্রতবোধ করছে। সব কিছুতেই অস্বস্তি প্রকাশ পাচ্ছে। আমি সেটা বুঝতে পারছি। হয়তো বিয়ের সময় এমন হওয়াটা-ই স্বাভাবিক। জীবনের সবচেয়ে বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নার্ভাস তো লাগবেই। এটাই স্বাভাবিক। আমি ভাইয়ার অস্বস্তি কিংবা চাপা রাগ কোনটাই পাত্তা না দিয়ে সহজ গলায় বললাম-

‘কারণ বিয়েটা তোর একার হলেও মার্কেট সবার-ই করা লাগবে। আর তুই কি পুরনো জামাকাপড় পরেই বিয়ের দিন ভাবির বাসায় যাবি না-কি!’

‘এই চুপ থাকতো পেত্নি। প্যাচাল না পাইরা জলদি আয়।’

ভাইয়া ক্ষিপ্ত গলায় কথাটা বলেই খট করে ফোন রেখে দিলো। আমি মৃদু হাসলাম। রেডি হয়ে রুম থেকে বের হবো ঠিক তখনই ধ্রুব আমাকে ডাকতে ডাকতে হন্তদন্ত হয়ে রুমে ডুকলেন। আমাকে দেখে আচমকাই থমকে দাঁড়িয়ে গেলেন তিনি। আমি কৌতূহলী চোখে ওনার দিকে চাইলাম। দরজার সামনে স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। চোখের মনিজোড়া স্থির নিষ্পলক। ওনাকে এভাবে দেখে আমি ভ্রু জোড়া নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলাম-

‘কিছু বলবেন?’

আমার প্রশ্নের জবাবে ধ্রুব কিছু বললেন না। আগের মতোই ফ্যালফ্যাল করে আমার দিকে চেয়ে আছেন। আমি কয়েক পা এগিয়ে এসে আবারও মিহি কন্ঠে প্রশ্ন করলাম-

‘কি হলো কিছু বলছেন না কেন?’

ধ্রুব সঙ্গে সঙ্গেই তার দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলেন। হঠাৎই দরজা বন্ধ করে দিয়ে একদম আমার সামনা-সামনি এসে দাঁড়ালেন। খানিকটা ঝুঁকে এসে মুখোমুখি হয়ে কন্ঠে বিস্ময় নিয়ে বললেন-

‘কালো ড্রেস আর হাল্কা সাজে তোমাকে এত সুন্দর লাগে আগে জানতাম না। অবশ্য না সাজলেও তোমাকে সুন্দর-ই লাগে। তবে আজ একটু ভিন্ন লাগছে। এখন থেকে তুমি সব সময় আমার সামনে কালো জামা পড়ে থাকবে। ঠিক আছে?’

আমি ওনার বুকে হাল্কা ধাক্কা দিয়ে সোজা করে দিলাম। উনি কপাল কুচকে ফেললেন৷ দু-হাত আড়াআড়ি ভাবে ভাঁজ করে আমার দিকে সরু দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। আমি ওনার চাহনি উপেক্ষা করে সন্দিহান কন্ঠে বললাম-

‘একই জিনিস প্রতিদিন দেখতে বা খেতে কখনোই কারো ভালো লাগে না। একটা সময় পর সেই জিনিসটার প্রতি একঘেয়েমি চলে আসবে এটাই স্বাভাবিক৷’

কথাটা বলে আমি চলে যেতে নিলেই ধ্রুব আমার হাত ধরে ফেললেন। আমি পেছন ফিরে তাকাতেই আমার হাত টান দিয়ে আবারও তার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিলেন। খানিকক্ষণ স্থির চোখে চেয়ে থাকলেন। ওনার এমন নিষ্পলক চাহনিতে ক্ষীণ অস্বস্তি বোধ করলাম আমি। মাথা নিচু করে আমার দৃষ্টি নামিয়ে নিতেই ধ্রুব তার দু’হাতে আমার গাল ধরে তার মুখোমুখি করে করে অত্যন্ত শীতল কন্ঠে বললেন-

‘তুমি কোনো জিনিস না যে তোমার প্রতি আমার একঘেয়েমি চলে আসবে। তুমি প্রতিদিন কালো জামা পরলেও আমার একঘেয়েমি আসবে না। আর জামা না পড়লেও একঘেয়েমি আসবে না।’

ধ্রুবর কথায় আমার চোখ রসগোল্লার মতো বড় হড় হয়ে গেল। বিস্ফোরিত চোখে ওনার দিকে তাকালাম৷ ওনার বুকে থাপ্পড় দিয়ে নাকমুখ ছিটকে বললাম-

‘ছিঃ আপনি এত নির্লজ্জ টাইপ কথাবার্তা বলেন কিভাবে! অসভ্য লোক।’

ধ্রুব নিজের কথা বুঝতে পেরে থতমত খেয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললেন-

‘আরে এটা তো এমনি কথার কথা বললাম।’

আমি আর কিছু বললাম না৷ অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। ধ্রুব মিনিট খানেক সময় ইতস্তত করে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য গাঢ় স্বরে বললেন-

‘যাইহোক কোথায় যেন ছিলাম! অহহ হ্যাঁ মনে পরেছে। তুমি কোনো জিনিস না যে প্রতি আমার একঘেয়েমি চলে আসবে। বুঝতে পেরেছো! আমি তোমাকে ভালোবাসি মানে তোমার সব কিছুকেই ভালোবাসি। তুমি যেমনই হও না কেন তোমাকেই ভালোবাসি। আর আমার ভালোবাসার কোনো নির্দিষ্ট কারণ নেই। আমি প্রতিদিন তোমাকে নতুন নতুন করে ভালোবাসতে শুরু করি। এসব ড্রেস কিংবা সাজগোছ তো জাস্ট ক্ষনিকের ভালো লাগার জন্য। চোখের মুগ্ধতার জন্য।’

ধ্রুব থামলেন। কিছুক্ষন চুপ থেকে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন-

‘অনেক কথা বলে ফেললাম এবার একটা চুমু দিন তো তুলতুলের আম্মু।’

ধ্রুব নিচু হয়ে তার গাল আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। আমি কয়েক মুহুর্ত শান্ত চোখে ওনার গালের দিকে স্থির চেয়ে থাকলাম। এখন আর আগের মতো অবহেলায় বেড়ে ওঠা সেই অবাঞ্ছিত দাঁড়ি গুলো নেই। খুব সুন্দর করে ছাটাই করা খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে ঢেকে আছে তার ফর্সা গাল। বারান্দার দরজা আর জানালা দিয়ে আচমকাই দমকা হাওয়া এসে এলোমেলো করে দিলো আমাকে। বাতাসের সাথে আসা বেলি ফুলের তীব্র সুগন্ধে সম্মোহিত হয়ে গেলাম আমি। দমকা হাওয়ার মতোই এলোমেলো হলো আমার মনের সকল অনুভূতি। ঝড় বইতে শুরু করলো। অনুভূতিরা মিছিলে নামলো। ধ্রুব নামক মিছিল। এই মিছিল যেন থেমে যাওয়ার নয়। খুব ভয়ংকর একটা কাজের দিকে নির্ভয়েই পা বাড়ালাম আমি। ধ্রুবকে এবং নিজেকে প্রচন্ডরকম অবাক করে দিয়ে সত্যি সত্যিই একটা অঘটন ঘটিয়ে ফেললাম। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যিই আমি এই প্রথম ওনার গালে নিজের ঠোঁট ছুঁয়ে দিলাম। আমার নরম সরম ঠোঁট জোড়া আকষ্মিকভাবেই ওনার নিষ্ঠুর ধারালো গাল ছুঁয়ে দিল। এই প্রথম বুঝি আমি ওনার দিকে পা বাড়ালাম। ধ্রুবর সাথেই তাল মিলিয়ে সম্পর্কের সিড়িতে কয়েক ধাপ এগিয়ে গেলাম। ধ্রুবর কেঁপে উঠেছিল তখন। তারপর হুট করেই আবারও থমকে গেলেন। কিছুক্ষণ সেভাবেই দাঁড়িয়ে থেকে ঝট করেই কয়েক পা পিছিয়ে গেলেন তিনি। ভূত দেখার মতো অবিশ্বাস্য চোখে আমার দিকে চাইলেন। এমন ভয়ংকর একটা কাজ করে আমি অদ্ভুত ভাবেই নিজেকে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক রূপেই আবিষ্কার করলাম। আমার উচিত ছিল লজ্জায় লাল হয়ে মাথা নুয়ে ফেলা। অথচ আমি স্বাভাবিকভাবেই ওনার বিস্ফোরিত চোখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। মুহুর্তের মধ্যেই যেন কান দুটো লাল হয়ে লজ্জায় মিইয়ে গেলেন তিনি। কি অদ্ভুত! ধ্রুব লজ্জা পাচ্ছে। ভীষণ লজ্জা পাচ্ছে। তার চাহনিতে স্পষ্ট লজ্জার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। তার লাল লাল কান দুটো বলে দিচ্ছে তিনি লজ্জা পাচ্ছেন। ইশ! ভীষণ অনুচিত কাজ কিরে ফেললাম বোধহয়। আমার লজ্জা পাওয়ার কথা ছিল অথচ সেখানে ধ্রুব লজ্জা পাচ্ছে। কি অদ্ভুত! মনে মনে অজানা আনন্দের উপস্তিতি টের পেলাম। আমি হাসলাম ধ্রুবর লজ্জা দেখে। নিজের কাজের জন্য অনুশোচনা কিংবা লজ্জিতবোধ না করে ভেতর ভেতর আমি উল্লাসিত অনুভব করলাম। ধ্রুব হয়তো ভাবেনি আমি সত্যি তার কথা মেনে নিবো।

‘কিরে কই তোরা! আজ কি মার্কেটে যাবি না-কি বাসাতেই বসে থাকবি!’

বাহির থেকে মনি মা’র তীক্ষ্ণ কন্ঠস্বর ভেসে আসতেই ধ্রুব অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন। অবিন্যস্ত দৃষ্টিতে আশেপাশে চোখ বুলিয়ে হন্তদন্ত হয়েই রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন উনি। আমি তাকিয়ে রইলাম ওনার যাওয়ার দিকে। মুচকি হেসে আমিও ওনার পেছন পেছন গেলাম। ধ্রুবকে দেখে মনি মা তিক্ত গলায় বললেন-

‘অনুকে ডাকতে গিয়ে তুই কোথায় উধাও হয়ে গেছিলি? একটা কাজও কি ঠিক মতো করতে পারিস না!’

ধ্রুব কিছু বললেন না। চুপ করেই দাঁড়িয়ে রইলেন। আব্বু তুলতুলকে কোলে নিয়ে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন-

‘তোমার এই গাঁধা ছেলেকে দিয়ে কখনও কোনো কাজ ঠিক মতো হয়েছে সেটা দেখেছো!’

মনি মা আব্বুর কথা পাত্তা দিলেন না। ধ্রুবর দিকে খানিক্ষন তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে থেকে এগিয়ে এসে চিন্তিত গলায় বললেন-

‘ধ্রুব তোর কান লাল হয়ে আছে কেন? আর মুখটাও তো কেমন যেন লাগছে। তোর কি শরীর খারাপ করেছে? এল্যার্জির সমস্যা হয়েছে না-কি!’

মনি মা’র কথা শুনেই ধ্রুব বিষম খেলেন। কাঁশতে কাঁশতে অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বললেন-

‘কিছু না মা কিছু না৷ দেরি হয়ে যাচ্ছে তো। জলদি আসো। আমি গাড়িতে অপেক্ষা করছি।’

ধ্রুব কথা গুলো বলেই আমার দিকে চেয়ে শুকনো ঢোক গিলে হনহনিয়ে চলে গেলেন। ধ্রুবর এমন হাল দেখে আমার প্রচন্ড হাসতে ইচ্ছে হলো৷ হাসতে হাসতে মাটিতে গড়াগড়ি খেতে মন চাইলো৷ কিন্তু আফসোস এখন আর তা করা সম্ভব না। আমি নিজেকে যথাসাধ্য স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলাম। মনি মা আবারও চিন্তিত গলায় বললেন-

‘এই ছেলের কখন কি হয় কিছুই বুঝি না৷’

‘কি আর হবে! তোমার ছেলে তোমার মতোই আধপাগল হয়েছে।’

আব্বুর কথায় মনি মা তেঁতে উঠলেন। আবারও শুরু হলো তাদের কথা কাটাকাটি। আমি সেদিকে মন দিলাম না। ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে ধ্রুবর পিছু পিছু বেরিয়ে গেলাম। আমার পেছনেই মনি মা রাগে গজগজ করে এটা ওটা বলতে বলতে আসছেন। আব্বুও মনি মা’র রাগে ঘি ঢালার জন্য প্রস্তুত হয়েই পেছন পেছন আসছেন। সারা রাস্তা ধ্রুব আর একটা কথাও বলেন নি। আমি পুরোটা সময়েই তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। খেয়াল করছিলাম তার আড়চোখে তাকানো। কিছুক্ষণ পর পরেই আড়চোখে আমার দিকে চাইতেন। আমার চোখাচোখি হতেই লজ্জায় আবারও দৃষ্টি সরিয়ে নিতেন। আমি ধ্রুবকে যত দেখছি ততই অবাক হচ্ছি। আমার চুমু দেওয়াতে তিনি এতটা লজ্জা পাবেন তা ভাবিনি।

‘কেমন আছো ধ্রুব?’

মেয়েলী সুরেলা কণ্ঠস্বর শুনে আমি শাড়ি দেখা বাদ দিয়ে চমকে পেছন ফিরে চাইলাম। হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে সেদিন রাস্তায় ধ্রুবর পাশে দেখা মেয়েটা। ধ্রুব পেছন ফিরে মেয়েটার দিকে চাইলেন। সাথে সাথেই মেয়েটার মুখের হাসি আরও প্রসারিত হলো। ধ্রুব কিছুটা অবাক হয়ে মেয়েটাকে প্রশ্ন করলেন-

‘তুমি এখানে কি করছো লিনা?’

#শেষ_রাত
#পর্বঃ৩২
#সাইয়ারা_হোসাইন_কায়ানাত

‘তুমি এখানে কি করছো লিনা?’

ধ্রুব সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে লিনা নামের মেয়েটার দিকে প্রত্যুত্তরের আশায় চেয়ে থাকলেন। মেয়েটার ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি দেখা দিলো। পরক্ষণেই সেই হাসি ছড়িয়ে পরলো সারা মুখ জুড়ে৷ মেয়েটার হাসিতে তার চোখদুটোও হেসে ফেলল। ইশ, কি সুন্দর হাসি! তবুও মনে হচ্ছে এই হাসিতে প্রাণ নেই। কেমন যেন প্রাণহীন হাসি মনে হচ্ছে। মুখ হাসলো। ঠোঁট হাসলো। তার চোখদুটোও হাসলো তবে তার মন থেকে যেন হাসি আসলো না। ধ্রুবর প্রশ্নে মেয়েটা বেশ নম্রতা সহকারে জবাব দিলো,

‘ফ্রেন্ডের বিয়ে তাই মার্কেট করতে এসেছিলাম।’

মেয়েটা থামলো। সচেতন চোখে আমার দিকে চাইলো একবার। চোখের মনিজোড়া তীক্ষ্ণ হলো। চোখদুটোতে ঝলঝল করে জ্বলে উঠলো কৌতূহলের তারা। ঘাড় বাঁকিয়ে ধ্রুবর দিকে চেয়ে কৌতুহলী হয়ে আবারও প্রশ্ন করল-

‘এটা-ই কি তুলতুলের আম্মু?’

ধ্রুব মৃদু হাসলেন। আমার দিকে চেয়ে চোখেমুখে লাজুক ভাব এনে মাথা দুলালেন। আমি তাকিয়ে আছি মেয়েটার দিকে। ধ্রুবর জবাবে মেয়েটার ভাবভঙ্গি বোঝার চেষ্টা করলাম। তবে আমি ব্যর্থ হলাম মেয়েটার মনের ভাব বুঝতে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই মেয়েটা ফের প্রশ্ন করলো,

‘তোমরা ঘুরতে বেরিয়েছিলে বুঝি?’

‘নাহ, শাকিল মানে অনন্যর ভাইয়ের বিয়ে তাই সবার সাথে মার্কেট করতে এসেছি।’

ধ্রুবর প্রতিত্তোরে মেয়েটা মলিন মুখে বলল-

‘অহহ, আন্টিও এসেছে!’

‘হ্যাঁ এসেছে। এখন বোধহয় অন্য কোথাও শাকিলের বউয়ের জন্য বিয়ের কেনাকাটা করছে।’

ধ্রুবর কথা শেষ হতেই আব্বু আমাদের কাছে আসলেন। লিনার দিকে খানিক্ষন ভ্রু কুচকে তাকিয়ে থেকে উৎকন্ঠিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন-

‘তুমি নিপার বড় মেয়ে এনি না?’

‘নাহ নাহ আংকেল আমি লিনা। এনি বড় আপুর নাম।’

লিনা বেশ অস্বস্তি নিয়ে কথাটুকু বলেই চুপ করে গেল। মাথা নিচু করে মেঝেতে তার দৃষ্টি স্থির করলো। অস্বস্তিতে মিইয়ে যাওয়া তার চোখ দুটো প্রাণপণে গোপন করার চেষ্টা করছে। বিনাকারণেই মেয়েটার এমন অস্বস্তি বোধ করা ঠিক স্বাভাবিক মনে হলো না আমার কাছে। কিছু একটা বিষয় তো আছেই যা মেয়েটার অস্বস্তির আর তার দৃষ্টি লুকানোর কারণ।
নিজের ভুল বুঝতে পেরে আব্বু অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে হাসলেন। ভুল শুধরে নেওয়ার জন্য ইতস্তত করে বললেন-

‘অহহ, বড় হয়ে গেছো তাই চিনতে পারিনি। তাছাড়া তোমাদের চেহারা একই রকম দেখা যায়। যাইহোক কখন আসলে? মনির সাথে দেখা হয়েছে?’

‘আন্টির সাথে অন্যদিন দেখা করবো। এখন আমাকে যেতে হবে। ধ্রুব আমার সাথে একটু আসো তো জরুরি কাজ আছে।’

লিনা হড়বড়িয়ে কথা গুলো বলেই পেছন ফিরে হাঁটা শুরু করলো। ধ্রুব স্তম্ভিত হয়ে কয়েক সেকেন্ড লিনার দিকে তাকিয়ে রইলেন। পরক্ষনেই নিজেকে স্বাভাবিক করে তুলে হাল্কা হেসে বললেন-

‘তোমরা মার্কেট করো আমি আসছি।’

আমার কিংবা আব্বুর প্রতিত্তোরের অপেক্ষা না করেই ধ্রুব লিনার পেছন পেছন চলে গেলেন। আমি নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে ঠিক আগের মতোই চেয়ে রইলাম। মুখ দিয়ে টু শব্দটিও বের করলাম না। লিনা আর ধ্রুবর এমন ব্যবহারে আব্বু নিজেও যেন হতভম্ব হয়ে গেলেন।

‘তুই লিনাকে চিনিস?’

আব্বুর প্রশ্নে আমি ডানে বায়ে মাথা নাড়লাম। যার অর্থ আমি চিনি না। আব্বু চোখেমুখে চরম বিরক্তি ভাব নিয়ে এসে বাজখাঁই গলায় বললেন-

‘কেমন গাঁধা ছেলে জন্ম দিয়েছে তোর মনি মা আমি বুঝি না। কই মেয়েটাকে তোর সাথে একটু পরিচয় করিয়ে দিবে এইটুকু বুদ্ধিও এই ছেলের মাথায় নেই। গাঁধা কোথাকার।’

আব্বুর কথায় আমি ম্লান হাসলাম। যদিও হাসিটা শুধু মাত্র আব্বুকে দেখানোর জন্যই। আব্বু হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন-

‘লিনা হলো নিপার মেয়ে। বিয়েতে যে এসেছিল ধ্রুব খালা নিপা। মনে আছে? ওই যে কুটনী টাইপের মহিলাটা যে ছিল ওঁরই ছোট মেয়ে। যাইহোক এদের কথা বাদ দিয়ে এখন কি কেনার বাকি আছে কিনে নে। বাকিদেরও খুঁজতে হবে আবার।’

কুটনী টাইপের মহিলা!! আব্বুর কথা শুনেই আমি হেসে ফেললাম। তবে হাসিটা বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারলাম না। অজানা কারনে মুহুর্তেই সেই হাসি ঠোঁটে মিলিয়ে গেল। আব্বুর দিকে চেয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে আবারও শাড়ি দেখতে লাগলাম। একটার পর একটা শাড়ি উলটে পালটে দেখছি তবে কোনটাই ভালো লাগছে। মন বসছে না কিছুতেই। আচমকাই যেন ফুরফুরে মেজাজটা ভীষণ বাজে ভাবেই বিগড়ে গেল। ধ্রুবর এভাবে চলে যাওয়াতে বিষন্নতায় আঁধার হয়ে এলো মন। সব কিছুতেই বিষাদের ছায়া। পুরো পৃথিবীটা-ই যেন এলোমেলো লাগছে।

‘কিরে মা, কিছু পছন্দ হচ্ছে না?’

আব্বুর কন্ঠ শুনে আমি আব্বুর দিকে চেয়ে উদাসীন ভঙ্গিতে দু’দিকে মাথা নাড়লাম। আব্বু মুখ গম্ভীর করে আমার পাশের টেবিলে বসে শাড়ি দেখতে লাগলেন। মিনিট খানেক পেরুতেই কালোর মাঝে লাল সুতোর কাজ করা একটা শাড়ি নিয়ে বললেন-

‘এই নে এটায় তোকে দারুণ মানাবে।’

আমি সরু চোখে শাড়িটার দিকে একমনে তাকিয়ে রইলাম। বাপ ছেলে দেখতে যেমন একই রকম তেমনি তাদের পছন্দও এক রকম। তবুও একথা তারা মানতে রাজি না। আব্বু গলা পরিষ্কার করে ভারী কন্ঠে বললেন-

‘কি! আমার পছন্দের উপর বিশ্বাস হচ্ছে না? তাহলে শুনে রাখ আমি-ই কিন্তু তোর মনি মা আর মোহনার জন্য সব সময় মার্কেট করি। মোহনা শাড়ি কিনলে সব সময় আমাকে সাথে নিয়ে যেতো। আমার মতো না-কি অন্য কেউ শাড়ি পছন্দ করে দিতে পারে না। মোহনা তো নেই তাই এখন আর কেউ বায়না করে না মার্কেটে নিয়ে যাওয়ার জন্য।’

শেষ কথাটুকু বলতে গিয়ে আব্বুর গলারস্বর ধরে এলো। মেয়ে হারানোর কষ্ট মনে পরতেই চোখদুটো চিকচিক করে উঠলো। দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো অন্যদিকে। পুরুষদের কাঁদতে হয় না। নিজের কষ্ট প্রকাশ করতে হয় না। এটাই হয়তো নিয়ম। আর এই নিয়ম মানতেই আব্বু নিজেকে সামলে নেওয়ার যথাসাধ্য চেষ্টা করছে। সন্তান হারানোর কষ্ট বুকে চাপা দিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে চাইছে। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। পরক্ষণেই ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলিয়ে নিয়ে মুগ্ধ গলায় বললাম-

‘কে বলল পছন্দ হয়নি! আমি তো ভাবছিলাম তুমি এত তাড়াতাড়ি এমন সুন্দর একটা শাড়ি কিভাবে পছন্দ করলে। আর মনে মনে তোমাকে নিয়েই প্রতিবার মার্কেটে আসার চিন্তাভাবনা করছিলাম। তুমি থাকলে শাড়ি খুঁজতে খুঁজতে আমার মাথা আর এলোমেলো করতে হবে না।’

আব্বু হাসলেন। সহজ সরল হাসি। এই মানুষটার প্রতি আমি ছোট থেকেই ভীষণ রকম দূর্বল ছিলাম। ছোট বেলা ওনাকে দেখলেই রহিম আংকেল, রহিম আংকেল বলে গলা জড়িয়ে ধরে থাকতাম। অন্য কারও সাধ্য ছিল না ওনার থেকে আমাকে ছাড়িয়ে নিতে। একটা সময় এসে দেখা গেল এই প্রিয় মানুষ গুলোর সাথেও দূরত্ব তৈরি হয়েছে। সেই দূরত্ব মুছে এত গুলো বছর পর অপ্রত্যাশিত ভাবে আবারও খুব গাঢ় সম্পর্ক হলো। আগের থেকেও মজবুত হয়েছে এবারের সম্পর্ক।

———————

বিকেল গড়িয়ে রাত হলো। সূর্য ডুবে চাঁদের আলোয় ঝলমলিয়ে উঠলো চারদিক। দেয়াল ঘড়িটা শব্দ তুলে এগিয়ে চলছে তার নির্দিষ্ট গতিতে। সময় গড়িয়েছে অনেকটা অথচ ধ্রুব এখনও বাসায় ফেরেনি। চাঁদের আলো আজ পৃথিবীকে মুগ্ধ করতে পারেনি। আর না পারছে সব সময়ের মতো আমার মনকে মুগ্ধ করতে। ধ্রুবকে ছাড়া চাঁদের আলোও আজ ফ্যাকাসে মনে হচ্ছে। মনের কোণে জমতে থাকা বিষাদের ছায়ায় পুরো পৃথিবীটা-ই নিস্তব্ধতার চাদরে মুড়ে গেল। ভয়াবহ নিরবতার নিচে চাপা পরল এই শহর। যেদিকে দৃষ্টি যায় সেদিকেই শুধু বিষন্নতা, উদাসীনতা আর দীর্ঘশ্বাস। এই দীর্ঘশ্বাসের কি মানে! ধ্রুবহীন কিছুটা সময় কেন এত উদাসীন লাগছে? ধ্রুবহীন আকাশের তারা গুলোও কেন আজ আলোহীন? মন খারাপের অসুখ হয়েছে আমার! তবে কি ভালোবেসে নিজেকে দূর্বলতাকে প্রশ্রয় দিলাম? আত্মসমর্পণ করলাম ধ্রুবর কাছে! নিজের সুখ, দুঃখ, হাসি, কান্না সব কিছুই তুলে দিলাম ধ্রুবর হাতে। কোনো কিছুতেই এখন আর আমার নিয়ন্ত্রণে নেই। সব কিছুতেই এখন ধ্রুবর নিয়ন্ত্রণ। ধ্রুব চাইলেই আমাকে ভেঙে গুড়িয়ে দিতে পারে একমুহূর্তেই। আমাকে ভেঙে গুড়িয়ে দেওয়ার অস্ত্র আমি তার হাতে তুলে দিয়েছি। ধ্রুব কাছে থাকলে আমার সব কিছুই তখন রঙিন হয়। ধ্রুব হাসলে আমি হাসি। ধ্রুব দূরে গেলেই ভীষণ রকম মন খারাপে হাহাকার করে ওঠে ভেতরটা। ভালো লাগারা তখন গাপটি মে’রে বসে থাকে মনের এক কোণে। ধ্রুবকে নিজের থেকে দূরে কিংবা অন্য-কোনো মেয়ের সঙ্গে কল্পনা করাই নিজের জন্য ভয়াবহ ধ্বংসের মনে হয়।

কলিংবেল বেজে উঠল। বারান্দায় থেকে বেরিয়ে এলাম ড্রয়িংরুমে। দরজা খুলতেই ধ্রুবর ক্লান্ত মুখখানা আমার দৃষ্টি কেড়ে নিল। ধ্রুব তাকিয়ে থাকলেন আমার দিকে কিছুক্ষন। আমি সরে দাঁড়াতেই ক্লান্ত ভঙ্গিতে ভেতরে চলে এলেন। রুমে এসে ধ্রুব অলস ভঙ্গিতে বিছানায় বসলেন। ঘাড় ঘুরিয়ে পুরো রুমে নজর বুলিয়ে নিলেন একবার। তুলতুলকে রুমে না দেখে ক্ষীণ গলায় প্রশ্ন করলেন-

‘তুলতুল ঘুমিয়ে পরেছে?’

আমি টেবিল থেকে পানির গ্লাস নিয়ে ওনার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে শান্ত গলায় বললাম-

‘হ্যাঁ মনি মা’র কাছেই ঘুমিয়ে পরেছে। আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন আমি টেবিলে খাবার দিচ্ছি।’

ধ্রুব আমার হাত থেকে গ্লাস নিয়ে গটগট করে গ্লাসের সব পানি শেষ করতে লাগলেন। স্থির দৃষ্টিতে খানিকক্ষণ ধ্রুবর দিকে চেয়ে থেকে আমি রুম বেরিয়ে রান্নাঘরের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালাম।

‘বারান্দায় চলে এলেন যে! ঘুমাবেন না?’

ধ্রুবর উপস্থিতে ঘাড় বাঁকিয়ে একঝলক তার দিকে তাকিয়ে আবারও দৃষ্টি দিলাম অদূর আকাশে। গোলাকার ঝলমলে চাঁদটা কৃষ্ণবর্ণের মেঘের আড়ালে লুকিয়ে গেছে। ঠোঁট হাল্কা প্রসারিত করে মিহি কন্ঠে বললাম-

‘আপনি ঘুমিয়ে পরুন। আমি কিছুক্ষণ পর ঘুমাবো।’

ধ্রুব কিছু বললেন না। আগের মতোই আমার পাশে রেলিঙের উপর হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছেন। তার দৃষ্টি এখনও আমার দিকেই তা বুঝতে আমার মোটেও অসুবিধে হচ্ছে না। আর অন্য সময়ের মতো তার চাহনিতে অস্বস্তিও লাগছে না।
তিনি খানিক্ষন নিশ্চুপ থেকে গাঢ় স্বরে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন আমার দিকে।

‘আপনি কি আমাকে কিছু বলবেন তুলতুলের আম্মু? মানে আপনার কি কিছু জিজ্ঞেস করার আছে?’

ধ্রুবর প্রশ্নের জবাবে আমি অত্যন্ত স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললাম-

‘নাহ তো। কিছু বলার থাকলে তো বলতাম-ই।’

আমার কথায় ধ্রুব সন্তুষ্ট হলেন না। দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। হতাশ গলায় বললেন-

‘আপনার কিছু বলার না থাকলেও আমার অনেক কিছুই বলার আছে।’

‘হুম বলুন আমি শুনছি।’

ধ্রুব আমার দিকে ফিরে ঘুড়ে দাঁড়ালেন। অপরাধীর ন্যায় মাথা নিচু করে নিম্ন স্বরে বললেন-

‘আসলে আমি আপনাকে কিছু মিথ্যা কথা বলেছি। আর সেটা লিনার জন্য বলতে হয়েছে।’

‘মিথ্যা কথা বলেছেন! তার জন্য যথেষ্ট কারণ হয়তো আপনার কাছে আছে। আর সেই কারণটা-ই হয়তো আমার কাছে ব্যাখ্যা করতে চাচ্ছেন!’

ধ্রুব মাথা তুলে আমার দিকে অবাক চোখে তাকালেন। নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে বললেন-

‘লিনার সম্পর্কে জেনেছেন নিশ্চয়ই! আম্মুর ফুপাতো বোনের মেয়ে। একটা ছেলের সাথে ওর সম্পর্ক ছিল। দু’বছর আগে সকলের অমতে পালিয়ে গিয়ে বিয়েও করে তারা দুজন।’

ধ্রুবকে থামিয়ে দিয়ে আমি নির্লিপ্ত কন্ঠে বললাম-

‘মিথ্যে বলার সাথে এসবের কি সম্পর্ক!’

চলবে…

পূর্ববর্তী নিবন্ধ
পরবর্তী নিবন্ধ
গল্প পোকা
গল্প পোকাhttps://golpopoka.com
গল্পপোকা ডট কম -এ আপনাকে স্বাগতম......
RELATED ARTICLES

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments

Md masrur Hasan mahi على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
আমিনুল ইসলাম على প্রয়োজন পর্ব: ৩০ ( অন্তিম)
সাজিবুল ইসলাম على ধর্ষিতাবউ২ ৯ তথা শেষ পর্ব
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
Nita Sarkar على স্বপ্নীল ৬৮
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على রহস্য শেষ_পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على অলক্ষ্যে তুমি পর্ব-০৬ এবং শেষ পর্ব
Nazmun Nahar Akhi على Psycho_is_back? part_7
Nazmun Nahar Akhi على Dangerous_Villian_Lover part 2
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على জানালার ওপারে পর্ব-১৭ এবং শেষ পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على লীলা বোর্ডিং ১২১৫ পর্ব-১১ এবং শেষ পর্ব
মিজানুর রহমান রাহুল على সেই তুমি পর্ব-০১
@feelings على প্রহেলিকা
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Nusrat jahan على coffee & vanilla Part-10
Pallabi Roy على স্বপ্নীল ৬৮
M.D Mahabub على The_Villain_Lover Part_2
Labani sarkar على Dangerous_Villain_Lover part 23
MD Akas Apc على বিবেক
Tanisha Ahmed على Devil love part-18 
Aius Barmon shorob على নারীর দেহকে নয়
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Priya Banerjee على devil love married life last part
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Riya Biswas على তুমি রবে ৫২
Mohammad Adib على তুমি রবে ৬০
Avni Ayesha على তুমি রবে ২৮
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
সুমিত على তুমি রবে ২৮
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
Samiah Begum على তুমি রবে ৫১
biddut das rocky على নর নারী
গল্প পোকা على নষ্ট গলি শেষ পর্ব
Md Jobayer Hossain Shohag على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على দুই অলসের সংসার
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤৪২.
A.J.S Rakib على মন ফড়িং ❤৪২.
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
Samiya noor على গল্পঃ ভয়
Sadikul على গল্পঃ ভয়
Samia Islam على গল্পঃ ভয়
শূন্য মায়া على মন ফড়িং ❤ ৪০.
Sutapa biswas على মন ফড়িং ❤৩৯.
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৮.
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৭
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
Siyam على বিবেক
Sudipto Guchhait على My_Mafia_Boss পর্ব-৯
saptami karmakar على devil love married life last part
saptami karmakar على devil love married life last part
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ২৬.
Shreyashi Dutta على  বিয়ে part 1
Sandipan Biswas على  বিয়ে part 1
Paramita Bhattacharyya على অনুরাগ শেষ পর্ব
জামিয়া পারভীন তানি على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
মায়া على মন ফড়িং  ২২
সুরিয়া মিম على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على মন ফড়িং ২১
গল্প পোকা على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
Sahin ssb على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৮. 
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৭.
Jannatul Ferdous على খেলাঘর পর্ব-৩৫
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ফাল্গুনের_ফুল last_part_8
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ছাত্রী যখন বউ পাঠঃ ১
গল্প পোকা على বাজির প্রেম পাঠঃ ১
Foujia Khanom Parsha على মা… ?
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৮
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
Ibna Al Wadud Shovon على স্বার্থ