Monday, October 6, 2025







শেষ রাত পর্ব-২+৩

#শেষ_রাত
#পর্বঃ২
#সাইয়ারা_হোসাইন_কায়ানাত

‘এই বার তুমি চলে গেলে আমাকে আর কখনও ফিরে পাবে না সাদাফ।’

আমার কথায় সাদাফ মিষ্টি করে হাসলো। আমার পাশে বসে নরম স্বরে বলল-

‘পারবে না-কি আমাকে ছেড়ে থাকতে?’

আমি শান্ত চোখে চেয়ে রইলাম সাদাফের হাসি মুখের দিকে। ওর এই স্বভাবটা সব সময় আমার মন খারাপের কারণ হয়। অভিমান আর রাগের কারণ হয়। এই মানুষটার সঙ্গে যতই সিরিয়াস কথা বলি না কেন তার মধ্যে কোনো প্রকার প্রতিক্রিয়া কিংবা ভাবাবেগ দেখা যায় না। সব সময়ই একটা গাঁ ছাড়া ভাব তার মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। যেন কিছুই হয়নি। কোনো কিছু নিয়েই তার কোনো মাথা ব্যথা নেই। সব কিছুই যেন স্বাভাবিক। অতি স্বাভাবিক। আমি নিজেকে যথাসাধ্য শান্ত রাখার চেষ্টা করে বললাম-

‘তুমি কি কখনও আমাকে নিয়ে সিরিয়াস ছিলে সাদাফ?’

‘এভাবে কেন কথা বলছো অনন্যা? আমি তোমাকে ঠিক কতটা ভালোবাসি তা নিশ্চয়ই তোমার অজানা নয়। তবুও কেন এসব কথা বলছো?’

সাদাফের কথায় আমি তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে হাসলাম। হাসলো বিষন্ন মনটাও। সাদাফের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলাম অদুরে। চাপা কষ্ট বুকে রেখে কঠিন গলায় বললাম-

‘তোমার মাস্টার্স কমপ্লিট হয়েছে দেড় বছর হলো। অথচ তুমি এখনও ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনো প্রকার চিন্তাভাবনা করছো না। কয়েক দিন পর পর ট্যুরে যাচ্ছো আর আমার সাথে সপ্তাহ খানেকের জন্য যোগাযোগ একেবারেই বিছিন্ন করে দিচ্ছ। যা এক প্রকার বিচ্ছেদের মতোই। তোমার সাথে যোগাযোগ করতে চেয়ে আমি বরাবরই ব্যর্থ হই। হতাশ হই। অভিমান নিয়ে বসে রই। কিন্তু এতে তো তোমার কিছুই যায় আসে না। তুমি তোমার মতোই বন্ধুদের সঙ্গে বেশ আনন্দে থাকো। তোমাকে আমি আগেও বলেছি আব্বু আম্মু আমার বিয়ের জন্য পাত্র দেখা শুরু করে দিয়েছে। অথচ এসব নিয়েও তোমার কোনো প্রকার মাথা ব্যথা নেই। এত কিছুর পরেও আমি কিভাবে ভেবে নিবো তুমি আমাকে নিয়ে সিরিয়াস! তুমি কি সত্যিই আমার বিষয়ে সিরিয়াস?’

‘শোনো অনন্যা এত চিন্তা করে লাভ নেই। আমি তো বলেছি তোমার বিয়ে ঠিক হওয়ার আগেই আমি তোমার বাসায় বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে হাজির হবো।’

সাদাফের কথায় আমি হতাশ হলাম। বুক চিড়ে বেরিয়ে এলো এক হতাশ ভরা নিঃশ্বাস। চোখ বন্ধ করে নিজেকে সামলালাম। ক্লান্ত গলায় বললাম-

‘কোনো বেকার ছেলের সাথে আমার বাবা কি মনে করে আমাকে বিয়ে দিবে শুনি!’

সাদাফ আমার দিকে ফিরে বাঁকা হয়ে বসলো। বরাবরের মতোই শান্ত ও ভ্রুক্ষেপহীন মুখে আমার দিকে চাইলো। অতি সহজ ভঙ্গিতে বলল-

‘আব্বুর এত বড় ব্যবসা সবটাই তো আমার। যাইহোক এখন এসব কথা রাখো। আর এক ঘন্টা পরই আমার ফ্লাইট। আমার ফ্রেন্ডরা সবাই হয়তো এয়ারপোর্টে অপেক্ষা করছে আমার জন্য। আমাকে এখন যেতে হবে। আর হ্যাঁ, এসব নিয়ে তুমি এতো প্রেশার নিও না তো অনুপাখি। আমি কয়েকটা দেশ ঘুরেই এক দেড় মাসের মধ্যে ফিরে আসবো৷ এসেই প্রথমে তোমার সাথে দেখা করবো প্রমিজ। তবুও এত চিন্তা করো না প্লিজ।’

ধপধপ করেই রাগে উঠে গেল আমার মাথায়। সব সময় শান্ত, চুপচাপ মেয়ে হয়েও আমিটা-ও রেগে গেলাম৷ চোখমুখ শক্ত হয়ে এলো। দাঁতে দাঁত চেপে রাগান্বিত কন্ঠে বললাম-

‘আমি তো বলেছি এবার চলে গেলে তুমি আমাকে আর কখনও ফিরে পাবে না। প্রতিবারের মতো আমি আবারও তোমার কথায় গলে গিয়ে নতুন করে রিলেশন শুরু করবো না। আর অপেক্ষাও করবো না তোমার জন্য৷ প্রতিবারের মতো তোমার সাথে যোগাযোগ করার জন্য ব্যস্তও হবো না।’

আমার রাগ প্রকাশ করা ব্যর্থ হলো। মনে মনে আফসোস হলো ভীষণ। কেন রাগ প্রকাশ করলাম এই নির্বিকার মানুষটার সামনে!! সাদাফ তার স্বভাবগত হাসি দিয়ে বেঞ্চি থেকে উঠে দাঁড়ালো৷ আমার দিকে কয়েক সেকেন্ড হাসি মুখে তাকিয়ে রইলো নিঃশব্দে। হয়তো এবারও আমার কথা, আমার অভিমান উপেক্ষা করে তার বিদায় নেওয়ার সময় এসেছে। সাদাফ পেছন ফিরে চলে যেতে যেতে বলল-

‘তা না হয় আমি আসলেই দেখে নিবো অনুপাখি।’

আমি স্থির চেয়ে রইলাম সাদাফের যাওয়ার পথে। কয়েক সেকেন্ডের মাঝেই চোখের আড়াল হয়ে মানুষটা। সেই সাথে আড়াল হলো আমার ভালোবাসা৷ আমার অনুভূতি, আমার সবটা। চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে এলো আমার। বুকে তীব্র ব্যথা অনুভব করলাম। মনের ব্যথা। বিচ্ছেদের ব্যথা। সকল কষ্ট যেন অশ্রুবিন্দু হয়ে উপচে পরতে চাচ্ছে আমার চোখদুটো দিয়ে। এই মানুষটার অপেক্ষায় থাকা আমার জন্য দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। প্রতিবার হতো সপ্তাহ খানেকের বিচ্ছেদ। আকাশস্পর্শী পর্বতের সমান অভিমান নিয়ে অপেক্ষা করেছি তার ফিরে আসার। সব কিছু ভুলে আবারও তার ভালোবাসায় ডুবে গিয়ে নতুন করে শুরু করেছি সবটা। কিন্তু আজকের বিচ্ছেদ দীর্ঘদিনের৷ আজকের দূরত্ব কয়েক কিলোমিটার কিংবা শহরের নয়। যোজন খানিক দূরত্ব নিয়ে পাড়ি জমিয়েছে ভিন্ন দেশে। আমার সকল অনুভূতি, অভিমান আর সকল অপেক্ষাকে তুচ্ছ করে দিয়ে চলে গেছে মানুষটা। অসহ্য যন্ত্রণায় বিষিয়ে উঠলো আমার মন। মাথা নিচু করে দুহাতে মুখ চেপে বসে রইলাম পার্কের বেঞ্চিতে। ঠিক তখনই কেউ একজন আমার এলোচুল আলতো করে টেনে ধরলো। অস্পষ্ট স্বরে আধো আধো গলায় ডাকলো-

‘মাম্মা! মাম্মা!’

আমি ঝট করেই চোখে মেলে তাকালাম। সিলিং-এর ঘুর্নায়মান পাখার দিকে চেয়ে ঘনঘন শ্বাস নিতে লাগলাম। হু হু করে উঠলো৷ আমার বুকের ভেতর। সেই বিষাক্ত দিনের মতোই তুলতুলের প্রথম মাম্মা মাম্মা ডাক কানে এসে বারি খেল। বিষাক্ততা কেটে গেল তুলতুলের মিষ্টি, আদুরে ডাকে। সকাল শুরু হলো খুবই বিচিত্রতার সঙ্গে। অন্য সব সকাল থেকে বড্ড বেশিই ভিন্ন হলো আজকের সকাল। অন্যান্য সকালের মতো পাখির কিচিরমিচির ডাক কিংবা আম্মুর চিল্লাচিল্লিতে ঘুম ভাঙলো না। আজ ঘুম ভেঙেছে তুলতুলের মায়া কাড়া ডাকে। তার জুতার পে পু শব্দ আর দরজায় পরা মৃদু আঘাতের শব্দে। ঘাড় কাত করে পাশে তাকাতেই চোখের সামনে একজন ঘুমন্ত মানুষের মুখ ভেসে উঠলো। ধ্রুবর মুখের দিকে কয়েক সেকেন্ড স্থির চেয়ে রইলাম৷ পরপর কয়েকবার চোখের পলক ফেলেই ধরফরিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসলাম। কয়েক মিনিট সময় লাগল এই নিষ্ঠুরতম সত্যটা মেনে নিতে। অবশেষে বুঝলাম আজ থেকে এটাই হবে আমার নতুন জীবন। আমার নতুন সকাল। প্রতিটি সকালে এই মানুষটার ঘুমন্ত মুখ দেখেই আমাকে অভ্যস্ত হতে হবে। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। চুলগুলো হাত খোঁপা করে গায়ে ভালো করে ওড়না জড়িয়ে নিলাম। দরজায় আবারও আঘাত পরছে। অনবরত পে পু শব্দ বেজেই যাচ্ছে। আমি মুচকি হাসলাম। বিছানা থেকে উঠে এসে দরজা খুলে তাকালাম সেদিকে। ছোট্ট একটা লাল পরি পেছন ঘুরে দাঁড়িয়ে আছে। একা একাই হেলছে দুলছে। জুতোজোড়ায় নিজের ইচ্ছায় চাপ দিয়ে পে পু শব্দ তুলছে। দরজা খুলে গেছে তা হয়তো পরিটা টের পায়নি। আমি দরজায় একটু শব্দ করে তার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করলাম। সঙ্গে সঙ্গেই তুলতুল তার পে পু জুতো পড়া পায়ে ছোট ছোট কদম ফেলে ভেতরে আসলো। খুশিতে আত্মহারা হয়ে জড়িয়ে ধরলো আমার পা। দু হাত উঁচু করে কোলে আসার জন্য ‘মাম্মা’ ‘মাম্মা’ বলে অনুনয় করল। আমি কোলে তুলে নিলাম তাকে। কি সুন্দর সকাল! মিষ্টি একটা সকাল। অন্যসব সকাল থেকে বড্ড বেশিই সুন্দর আর পবিত্র। আমি তুলতুলকে কোলে নিয়ে বিছানায় এসে বসলাম। একটু পরেই তুলতুল হামাগুড়ি দিয়ে আমার কোল থেকে নেমে গেল। পরমুহূর্তেই লাফিয়ে পরলো ধ্রুবর বুকে। ছোট ছোট হাতে ওনার গালে থাপ্পড় দিয়ে অনবরত ডেকে যাচ্ছে-

‘মাম্মা.. মাম্মা ঘুম ওঠ।’

আমি মৃদু হাসলাম। বুঝলাম তুলতুল ধ্রুবকেও মাম্মা বলেই ডাকে। তুলতুলের ডাকে ধ্রুব চোখমুখ কুচকে ফেললেন। চোখ ছোট ছোট করে দৃষ্টি দেয় তার বুকে উপর বসে থাকা তুলতুলের দিকে। খানিকটা বিস্মিত হয়ে ঘুম জড়ানো কন্ঠে জিজ্ঞেস করল-

‘আম্মু তুমি রুমে আসলে কীভাবে? আর দরজাই বা খুললে কীভাবে?’

‘আমি দরজা খুলেছি।’

আমার কথা শুনেই ধ্রুব চমকে গিয়ে আমার দিকে তাকালেন। চোখজোড়া বড় বড় করে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে এক প্রকার লাফিয়ে উঠে বসলেন তিনি। তুলতুলকে কোলে আগলে নিয়ে নিজের শার্ট ঠিক করতে করতে অপ্রস্তুত হয়ে বললেন-

‘অহ আপনি! আপনি আমার বউ! কাল আমাদের বিয়ে হয়েছে তাই না!!’

মনে মনে আমি ভীষণ অবাক হলাম। কিন্তু প্রকাশ করলাম না। ওনার কর্মকাণ্ড আর এসব অদ্ভুত কথা শুনে আমি কি বলবো ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না। হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে খুবই সহজ ভঙ্গিতে বললাম-

‘আমি সঠিক জানি না। আমি জানলে আপনাকেও জানিয়ে দিবো।’

আমি আর কোনো কিছুই না বলাম। আর ওনার প্রতিত্তোরে অপেক্ষাও করলাম না। উঠে চলে এলাম ওয়াশরুমে। আমি নিশ্চিত উনিও এখন সাদাফের মতোই স্বাভাবিক হয়ে গেছেন। ভাবলেশহীন ভাবেই হয়তো তুলতুলের সঙ্গে খেলা শুরু করেছে। সাদাফের মতোই ধ্রুবর মধ্যে গাঁ ছাড়া ভাব পরিপূর্ণ। সাদাফের এই একটা স্বভাবই আমার ভীষণ অপছন্দ ছিল। ওর এই স্বভাবের কারণেই আমি দিনের পর দিন কষ্ট পেয়েছি। আর এখনও পাচ্ছি। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস ধ্রুবর মাঝেও সাদাফের এই গুণটা ভরপুর। এইদিক দিয়েই এই মানুষ দুটোর মাঝে দারুণ মিল। এইটাই হয়তো আমার নিয়তি।

সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হলো। দুপুর থেকে দীর্ঘ কয়েক ঘন্টা যাবত স্টেজের সোফায় বসে আছি মূর্তির ন্যায়। শরীরের প্রতিটি অঙ্গ যেন অকেজো হয়ে গেছে। পাথরের মতো শক্ত হয়ে গেছে শরীর। এটা বৌভাতের অনুষ্ঠান তো নয় যেন কোনো অত্যাচার চলছে। মনে হচ্ছে কোনো ভুলের জন্য খুব কঠোর শাস্তি দেওয়া হচ্ছে আমাকে৷ মানুষ আসছে কথা বলছে, গিফট দিচ্ছে আর তার বিনিময়ে আমি খুব কষ্টে নিজের সাথে যুদ্ধ করে একটু মুচকি হাসার চেষ্টা করছি। নতুন বউদের এতটা শাস্তি দিয়ে বিয়ের অনুষ্ঠান করা একমুহূর্তে আমার কাছে নেহাৎই বোকামি মনে হচ্ছে। খুবই বড় ধরনের বোকামি। আর আমার পাশের জন মানে ধ্রুব মশাই তিনি বিন্দাস তার বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলছেন। হাসিঠাট্টায় মেতে উঠেছেন তিনি। মাঝেমধ্যে ওনার বন্ধুরা আমাকে ইঙ্গিত করে ধ্রুবকে ক্ষেপাচ্ছেন। এতে ধ্রুব হাসছেন কিন্তু কিছু বলছেন না। আমিও সব শুনে না শোনার ভান ধরে রইলাম।

‘কিরে, তুই এখনও এখানে আড্ডা দিচ্ছিস কেন? বউমাকে নিয়ে ওদের বাসায় যা। শাকিল তো সেই কখনই তুলতুলকে নিয়ে ওদের বাসায় রওনা হয়ে গেছে। আর তুই এখনও মেয়েটাকে বসিয়ে রেখেছিস। মানে তুই কি আমার ছেলে!! আমি তো এমন বেখেয়ালি ছিলাম না তোর বয়সে। তুই কার মতো হলি! নিশ্চয়ই তোর মায়ের মতো।’

আব্বু মানে ধ্রুবর বাবা ভীষণ আক্ষেপ নিয়ে কথা গুলো বললেন। ধ্রুব তার আড্ডা থামিয়ে দিলেন। আর তার বন্ধুরা মিটমিট করে হাসছেন। ধ্রুবকে বসে থাকতে দেখে তিনি আবারও কড়া গলায় বললেন-

‘এখনও হ্যাবলার মতো বসে আছিস কেন! যা তাড়াতাড়ি বউমাকে নিয়ে। ওদের বাসায় হয়তো সবাই অপেক্ষা করছে তোদের জন্য।’

অবশেষে রওনা হলাম নিজের বাসার উদ্দেশ্যে। কাল অব্দি আমি যে বাসার মেয়ে ছিলাম আজ সেই বাসার অতিথি হয়ে যাচ্ছি। এটাই হয়তো মেয়েদের জীবন। গাড়িতে বসতেই শরীর ব্যথা খুব খারাপ ভাবে আঁকড়ে ধরেছে আমাকে। অনুষ্ঠানের ধকলে ক্লান্ত হয়ে পরেছে শরীরের প্রতিটি অঙ্গ। ভীষণ ক্লান্তিতেই ঘুমে চোখদুটোর পাতা জড়িয়ে যাচ্ছে৷ ঝিমঝিম করছে মাথাটা কিন্তু ঘুমানোর ভরসা পাচ্ছি না৷ ব্যথায় ছটফট করছি ঠিক তখনই একটা হাত এসে খুব যত্নে আমার মাথাটা নিয়ে তার কাধে রাখলেন। আমি কিছু বলার আগেই ধ্রুব বেশ শীতল কন্ঠে বললেন-

‘অসুবিধে নেই। আপনি নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারেন।’

অজানা কারণেই আমি কিছুটা ভরসা পেলাম। ধীরেধীরে চোখদুটো বন্ধ করে নিলাম। ঠিক কতক্ষণ ঘুমালাম জানি না। তবে ঘুম ভাঙলো ধ্রুবর ডাকে।

‘এই যে মিসেস! ঘুম থেকে উঠুন। আপনাদের বাসায় চলে এসেছি।’

আমি তাড়াতাড়ি করেই ওনার কাধ থেকে মাথা সরিয়ে নিলাম। ওনার দিকে কিছুটা অস্বস্তি নিয়ে তাকিয়ে গাড়ি থেকে নেমে গেলাম নিঃশব্দে।

ফ্রেশ হয়ে ড্রয়িং রুমে এসে ধ্রুব, তুলতুল আর ভাইয়া কাউকেই দেখতে পেলাম না। রান্নাঘরে এসে মা’কে জিজ্ঞেস করলাম-

‘মা তুলতুল কোথায়!’

মা রান্নার কাজ করতে করতে বললেন-

‘শাকিল আর ধ্রুবর সাথে হাঁটতে বেরিয়েছে।’

‘রাতের বেলা তুলতুলকে বেহিরে নিয়ে যেতে নিষেধ করলে না কেন?’

আমার কথায় মা কিছুটা অবাক হলেন। আমি নিজেও খানিকটা অবাক হলাম। আমার মধ্যে মাতৃত্ব বোধ চলে এসেছে। মা আমাকে নিয়ে যেভাবে চিন্তা করে আমিও ঠিক সেভাবেই চিন্তিত হলাম তুলতুলের জন্য। মা-ও হয়তো অবাক হলেন তার মেয়ের এই মাতৃত্ব বোধ দেখেই।

‘তুলতুল জেদ ধরেছিল। শাকিলের কোল থেকে নামছিলোই না তাই বাধ্য ওকে নিয়ে গেছে।’

আমাদের কথার মাঝেই এক আন্টি এসে রান্নাঘরে উপস্থিত হলেন। বিয়ে উপলক্ষেই বাসায় মেহমান গিজগিজ করছিল। অনেকে চলে গেছেন। তবে অল্প কয়েকজন রয়ে গেছে। হয়তো বাকিরা কাল সকালেই চলে যাবেন। আন্টি আমাদের সামনে এসে খানিকটা মুখ বিকৃত করে মা’র উদ্দেশ্যে বললেন-

‘বাচ্চাওয়ালা সংসারে তোমার মাইয়ার বিয়া না দিলেই পারতা নাহার। মাইয়া তো আর পইচা যায় নাই যে এক বাচ্চার বাপের লগে বিয়া দিতে হইলো। আমারে বললেই আমি ভালো পাত্র খুঁজে দিতাম।’

চলবে….

#শেষ_রাত
#পর্বঃ৩
#সাইয়ারা_হোসাইন_কায়ানাত

‘তুলতুল ওনার প্রথম সংসারের মেয়ে না। বরং আমিই ওনার প্রথম এবং একমাত্র স্ত্রী। আর তুলতুল ওনার বড় বোনের মেয়ে। যে কি-না তুলতুলকে জন্ম দিতে গিয়েই মারা গেছেন। তবে হ্যাঁ তুলতুল এখন থেকে আমাদের মেয়ে। আমার মনে হচ্ছে আপনার মাথায় কিছু ভুল ধারণা বাসা বেধেছিল আন্টি। আশাকরি সেই ভুল ধারণা এখন চলে গেছে। আর আন্টি আপনি তো বড় মানুষ। তাই বলবো অবুঝের মতো সঠিক বিষয় না জেনেই কাউকে কিছু বলবেন না।’

আন্টি মুখ অন্ধকার করে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। মুখ দিয়ে আর দ্বিতীয় কোনো বাক্য বের করার সাহস বোধহয় পেলেন না। আমি পেছন ঘুরে ড্রয়িং রুমের জন্য পা বাড়াতেই মুখোমুখি হলাম ধ্রুবর। দারুণ শান্ত শীতল তার চাহনি। চোখ দুটো যেন কিছু বলতে চাইছে আমাকে। কিন্তু কি? আমি বুঝতে পারলেন না। আমার চোখাচোখি হতেই ওনার দৃষ্টি নামিয়ে নিলেন। পাশেই ভাইয়া তুলতুলকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি মলিন হাসলাম৷ হাত বাড়িয়ে তুলতুলকে নিজের কাছের নিতে চাইলাম৷ তুলতুল অনায়াসেই আমার কোলে আসলো৷ আশ্চর্যজনক ভাবেই মেয়েটা আমার কোল থেকে হাত বাড়িয়ে আন্টির কোলে যাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলো। আমি কপাল কুচকালাম। একটু আগেই তো আন্টি তুলতুলকে তুচ্ছ করে কথা বললেন। আর এই মেয়ে কি-না তার কোলেই যেতে চাইছে!! আমাকে অবাক করে দিয়ে আন্টি হাসি মুখেই তুলতুলকে কোলে নিলেন। খুব আদুরে গলায় কথা বলতে লাগলেন তুলতুলের সঙ্গে। আমি নিঃশব্দে দেখলাম কিন্তু তেমন কিছু বললাম না। ধ্রুবর দিকে ফিরে তাকাতেই খেয়াল করলাম তিনি এখানে নেই। চলে গেছেন হয়তো কিছুক্ষণ আগেই। আমি আর সেদিকে পাত্তা দিলাম না। উনি ওনার মতো থাকবেন। আমি তার বিষয়ে কোনো প্রকার নাক গলাবো না এটাই তো ছিলো আমাদের শর্তে। আমি ছোট একটা শ্বাস ফেলে ভাইয়ার সঙ্গে চলে গেলাম।

রাতের খাবার শেষ হয়েছে প্রায় ঘন্টা খানেক আগে। তবুও আমি ড্রয়িং রুমে ঠায় বসে আছি। এর কারণ হলো আমার রুমে যেতে ইচ্ছে করছে না। ধ্রুব আমার রুমে থাকায় অস্বস্তিবোধ করছি খুব৷ ভেবেছিলাম তুলতুল আমাদের সাথেই থাকবে আমার রুমে। কিন্তু তা আর হলো না। তুলতুল ভাইয়ার গলা জড়িয়ে ধরে অনেক আগেই ভাইয়ার রুমে ঘুমিয়ে গেছে। খুব চেষ্টা করেও তাকে আনা গেল না। আর কোনো উপায় না পেয়ে হতাশ হয়ে আমার রুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালাম। রুমের পাশে বেশ খানিকটা সময় পায়চারি করে অবশেষে রুমে গেলাম। রুমের ভেতরে আসতেই আমার মেজাজ খারাপ হলো। তরতর করে মাথায় রক্ত উঠে গেল। শরীরের প্রতিটি শিরায় শিরায় বয়ে গেল অবাঞ্ছিত রাগ, জেদ আর ক্ষোভ। জীবনে প্রথম আমার এতটা রাগ উপলব্ধি করলাম৷ রাগের চোটে সাথেই সাথেই আমার মাথায় যন্ত্রণা শুরু হলো। কোনো কিছু না ভেবেচিন্তেই ছোঁ মেরে ধ্রুবর হাত থেকে আমার ডায়েরিটা ছিনিয়ে নিলাম। ধ্রুব মাথা তুলে নির্বিকার ভঙ্গিতে আমার দিকে তাকালেন। থরথর করে কাঁপতে লাগলো আমার হাত। হাতের ডায়েরিটার দিকে এক নজর তাকিয়ে রাগে গর্জে উঠে বললাম-

‘আমার ডায়েরি ধরার অনুমতি আমি কাউকে দেইনি। আপনার মধ্যে কি এই কমনসেন্স টুকু নেই যে কারও পারমিশন ছাড়া তার পারসোনাল জিনিস ধরতে হয় না৷’

‘তুলতুলের আম্মু, আমি শুধুমাত্র বোরিংনেস কাটানোর জন্যই ডায়েরিটা সামনে দেখে পড়তে বসছিলাম।’

ধ্রুব সহজ সরল স্বীকারোক্তি আমার রাগ বৃদ্ধির কারণ হলো। পুরনো বিষাক্ত স্মৃতি গুলোর কথা মনে পড়তেই রাগ বাড়তে লাগলো। আমি এমনটা ছিলাম না। কখনই না। রাগ প্রকাশ করা আমার স্বভাবের মধ্যে কখনোই ছিল না। কিন্তু আজ পারলাম না নিজের রাগ সামলিয়ে রাখতে। কিছুতেই পারলাম না আমি নিজেকে কন্ট্রোল করতে।

‘কারও পারসোনাল ডায়েরি পড়া কোনো গল্পের বই পড়ার মতো না। নিজের বোরিংনেস কাটানোর জন্য হয়তো গল্পের বই পড়া যায়। তবে কারও একান্ত ব্যক্তিগত অনুভূতি গুলোর ব্যবহার করা মোটেও সামান্য বিষয় না।’

আমি রাগে ফুসতে লাগলাম। তবে ধ্রুব মাঝে কোনো প্রকার ভাবান্তর ঘটলো। ঠিক যেন সাদাফের মতোই নির্বিকার, নির্লিপ্ত। সব কিছুই স্বাভাবিক যেন কিছুই হয়নি। কিছু ঘটেই নি এখানে।

‘আপনি শুধু শুধুই রেগে যাচ্ছেন তুলতুলের আম্মু। ডায়রি পড়ায় কোনো সমস্যা হওয়ার কারণ তো আমি দেখছি না। আপনার প্রাক্তনের কথা তো আমি আগে থেকেই জানি। তবে আপনার প্রাক্তন যে এতটা বেপরোয়া তা এখন জানলাম।’

আমার রাগের পরিমাণ আরও বৃদ্ধি পেল। কিছু বলার শক্তি পেলাম না। গলার মাঝেই আটকে গেল সকল কথা। অসহায় বোধ করলাম রাগ প্রকাশ করতে না পেরে। দুচোখ দিয়ে উপচে পরতে লাগলো নোনাজল। আর কোনো কথা না বাড়িয়ে ছুটে চলে আসলাম বারান্দায়। দরজা লাগিয়ে নিজেকে বন্দী করে নিলাম অন্ধকার বারান্দার মাঝে। এই অন্ধকারটাই এখন আমার শান্তির জায়গায়। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার জায়গা।

একুশ দিন আগের স্মৃতি গুলো চড়ে বসলো মাথায়। বিচ্ছেদের দাহনে পুড়তে লাগলো আমার মন। কে বুঝবে এই অসহ্য যন্ত্রণা! মানুষটা কি আদোও জানতে পেরেছে আমার বিয়ের কথা! সত্যি সত্যি আমাদের বিচ্ছেদে কথা? আমার ব্যর্থতা আর তার বেখেয়ালির কথা! বারান্দার এক কোণে চুপটি মেরে বসলাম। মাথায় তীব্র যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। বিষাক্ত স্মৃতি গুলো মস্তিষ্কে দিশেহারা হয়ে ছুটে চলছে। সব কিছুই যেন এলোমেলো লাগলো।

একুশ দিন আগে,

আচমকাই চুলে টান পড়ায় আমি মাথা তুলে তাকালাম। সাথে সাথেই ছোট্ট বাচ্চা একটা মেয়ে তার আধো আধো গলায় ‘মাম্মা’ বলে ডাকলো আমায়। আমি থমকে গেলাম। অদ্ভুত এক অনুভূতির সঙ্গে পরিচিত হলাম। জীবনে প্রথম মাম্মা ডাক শোনার এক অদ্ভুত অনুভূতি। হাতের উল্টো পিঠে চোখের জল মুছে নিজেকে স্বাভাবিক করে নেওয়ার চেষ্টা করলাম খুব। বাচ্চা মেয়েটা আবারও আমায় ‘মাম্মা’ বলে ডাকলো। আমি তার মাথায় হাত বুলিয়ে বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম-

‘তুমি এখানে একা কেন বাবু?’

আমার কথা শুনে মেয়েটা কি বুঝলো জানি না। তবে দেখে মনে হলো বেশ খুশি হয়েছে। আমার জামা টেনে ধরে কোলে উঠতে চাইলো। ছোট্ট বাচ্চা আমার বরাবরই খুব ভালো লাগে। আর এই মেয়েটা একটু বেশিই মায়াবী আর কিউট। তাই হয়তো আমার মন খারাপ নিমিষেই উবে গেল। আমি তাকে কোলে নিতেই এক মধ্যবয়সী মহিলার কন্ঠস্বর শুনতে পেলাম-

‘নতুন নতুন হাঁটা শিখেছে। তাই বাহিরে আসতেই বেশি তরতর করা শুরু করেছে পাকনিটা।’

আমি নিখুঁত চোখে দেখতে লাগলাম ভদ্রমহিলাকে। কেন যেন খুব পরিচিত মনে হচ্ছে। তিনিও আমার দিকে কিভাবে যেন তাকিয়ে আছেন। খানিকটা সময় পর ভদ্রমহিলা উৎকন্ঠিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন-

‘তোমার নাম কি অনন্যা! তোমার মায়ের নাম নাহার না!’

আমি চমকাল। থমথমে গলায় ছোট করে ‘হুম হুম’ বললাম। সঙ্গে সঙ্গেই তিনি আমার পাশে বসে পরলেন। খুশিতে আত্মহারা হয়ে আমাকে হাল্কা জড়িয়ে ধরে বললেন-

‘আমি তোর মনি আন্টি। ভুলে গেছিস! ছোট বেলা তো মনি আন্টি মনি আন্টি বলে জান দিয়ে দিতি।’

আমি হতভম্ব হয়ে বসে রইলাম। মেয়েটা এখনো আমার কোলে বসে আছে। আমার চুল গুলো নিয়ে খেলছে। আমি কিছুটা সময় চুপ থেকে ভাবলাম। তারপর হাসি মুখে বললাম-

‘চেনা চেনা লাগছিল কিন্তু অনেক দিন পর দেখলাম তোমায় তাই প্রথমে চিনিতে পারিনি। কিন্তু এই বাবুটা কে?’

‘আমার নাতনি পূর্নতা। ডাকনাম তুলতুল।’

আমি হাসলাম। তুলতুলের নরম গালে হাত রেখে বললাম-

‘তুলতুল নাম কে রাখলো! অনেক কিউট নাম।’

‘কে আবার ধ্রুব।’

আমি মৃদু হাসলাম। তুলতুলকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম-

‘তুলতুল কি মোহনা আপুর মেয়ে?’

আমার কথা শোনার সাথে সাথে খেয়াল করলাম মনি আন্টির চোখে জল এসে পরলো। আমি কৌতূহলী চোখে চেয়ে রইলাম ওনার দিকে। তিনি কিছুটা সময় নিয়ে মলিন মুখে বললেন-

‘হুম মোহনার মেয়ে। কিন্তু মোহনা বেঁচে নেই অনু। তুলতুলের জন্মের কয়েকঘন্টার মাথায় আমার মেয়েটা আমাদের ছেড়ে চলে গেছে৷’

আমি থমকে গেলাম। হঠাৎ করেই যেন গুলিয়ে গেল সব কিছু। ছোট বেলা মোহনা আপুর কাছে এটা ওটা নিয়ে বায়না করেছি অনেক। দেখা হলেই তার পিছু পিছু লেগে থাকতাম। যেদিন শুনেছিলাম ওনারা সবাই ঢাকা থেকে চলে যাবেন সেদিন খুব কান্না করেছিলাম। শুধু মাত্র মোহনা আপুর জন্য। আজ শুনছি সেই হাস্যজ্বল কিশোরীটা নেই। বুকটা ধক করে কেঁপে উঠলো আমার। পনেরো বছরে একটা বারও দেখার সুযোগ পেলাম না মোহনা আপুর। তবুও সেই পুরনো মায়াটা আবারও জাগ্রত হলো। চুলে টান পড়ায় আমার হুশ ফিরলো। তুলতুলের দিকে তাকাতেই মন খারাপেরা ঝেঁকে বসলো আমার মাথায়। তুলতুলের কথা ভেবেই বিষাদে ছেয়ে গেল আমার মন। মা ছাড়া কিভাবে ছিল এই টুকু বাচ্চা মেয়েটা! আর বাকিটা জীবনই বা কিভাবে থাকবে! নিজেকে কোনো রকম সামলিয়ে ক্ষীণ স্বরে প্রশ্ন করলাম-

‘তুলতুলের বাবা কোথায়?’

মনি আন্টি তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে হেসে বলল-

‘বিয়ে করেছে দু-মাসে হলো। তুলতুল এতদিন আমার কাছেই ছিল। কিন্তু ওর বাবার বিয়ের পর ওনাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে তুলতুল নিয়ে একেবারের জন্য ঢাকা চলে এসেছি। আমি চাই না তুলতুল ওর বাবার পরিচয় জানুক। যে কিনা নিজের সন্তানের কথা ভাবার সময় পায় না তার পরিচয় নিয়ে বড় না হওয়াই ভালো।’

দীর্ঘশ্বাস ফেললাম আমি। আর কোনো কথা বাড়ালাম না এই বিষয় নিয়ে। মনি আন্টি আর তুলতুলকে নিয়ে বাসায় চলে আসলাম। এতগুলো বছর পর মনি আন্টিকে দেখেই আমার মা কেঁদেকেটে বুক ভাসালেন। তারপর সবাই মিলে আবারও পুরোনো দিনের মতো আড্ডার আসর জমালেন। তবে এবার নতুন সদস্য হিসেবে তুলতুলও আছে সবার মাঝে। এতে যেন সবার আনন্দের পরিমাণ আরও দ্বিগুণ হলো।

কি অদ্ভুত মায়ায় জড়িয়েছে মেয়েটা আমার সাথে। প্রতিদিন আমার সাথে দেখা না করলেই তার চেচামেচি শুরু হয়। খেলাধুলা, খাওয়া দাওয়া সব কিছু বন্ধ করে সারাক্ষণ মাম্মা মাম্মা বলেই কান্নাকাটি করে মেয়েটা। জেদ নিয়ে বসে থাকে সারাদিন। মনি আন্টি বাধ্য হয়েই তুলতুলকে নিয়ে প্রতিদিন আমাদের বাসায় আসেন। ঘন্টা খানেক সময় থেকে চলে যেতে চাইলেই আবারও তুলতুলের পাগলামো শুরু হয়। এভাবেই যাচ্ছিলো কিছুদিন। তারপর একদিন হুট করেই মনি আন্টি আম্মুর কাছে তার ছেলের জন্য আমার হাত চাইলেন। আমাকে তার ছেলের বউ করে তুলতুলের মা হওয়ার সুযোগও দিতে চাইলেন। আমার হাত ধরে অনুরোধ করলেন তিনি। তবে আমি কিছু বললাম না। হতভম্ব হয়ে শুধু শুনে গেলাম মনি আন্টির কথা। রাত হতেই অস্থির হয়ে গেলাম সাদাফকে খুঁজেতে। বার বার ফোন করে তার সাথে কথা বলতে চাইলাম। কিন্তু অসহায় হলো আমার ভাগ্য। বরাবরের মতোই ব্যর্থ হলাম সাদাফের সাথে যোগাযোগ করতে৷ এই প্রথম ভীষণ ভীষণ ভীষণ কষ্ট হলো সাদাফের বেখেয়ালিতে। তার বেপরোয়া স্বভাবের জন্য নিজেকেই খুব দূর্ভাগা মনে হলো। ঘর বন্দী করে নিলাম নিজেকে। দিনের পর দিন হন্য হয়ে সাদাফের সাথে একটু কথা বলার সুযোগ খুঁজে বেড়াতাম। রাতের পর রাত নির্ঘুম কাটাতে লাগলাম। কান্না করে দুচোখ ফুলিয়ে আবারও চোখে পানির ঝাপটা দিতে বসে থাকতাম। তবুও ফিরে পেলাম না আমার ভালোবাসা। আর না যোগাযোগ করতে পারলাম সাদাফের সঙ্গে। অভিমান নিয়ে বলা আমার কথাটাই যেন এবার সত্যি হতে লাগলো। সত্যিই মনে হতে লাগলো সাদাফ ট্যুর থেকে ফিয়ে এসে আমাকে আর পাবে না। অভিমানে বলা কথা এভাবেই সত্যি হয়ে যাবে জানলে কখনোই মুখ দিতে এই কথা বের করতাম না। আর অন্যদিকে তুলতুলের প্রতিও আমার মায়া জন্মে গেল। মেয়েটা আমার কাছেই মায়ের ভালোবাসা খুঁজে বেড়াতো৷ আর মনি আন্টি!! তার ভালোবাসার কাছে আমি বরাবরই অসহায়। কোনো কিছুই আর আটকানোর সম্ভব হলো না। একদিন হুট করে মনি আন্টি ফোন করে বললেন-

‘অনু মা একটু কষ্ট করে তোদের বাসার কাছে যে রেস্টুরেন্ট আছে সেখানে যাবি! আর তিনদিন পরেই তো বিয়ে। আমি চাই ধ্রুবর সাথে বিয়ের আগে তুই একবার দেখা করে নে। আমার এই অনুরোধটা তুই রাখ।’

অনুরোধ! ওনার মুখে কি অনুরোধ শব্দটা মানায়!! মোটেও না। যে মানুষটা আমাকে নিজের মেয়ের জায়গায় বসিয়েছে আধোও কি তার কথার বিপক্ষে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব??
আমি ক্ষীণ স্বরে জিজ্ঞেস করলাম-

‘কখন যেতে হবে মনি আন্টি!’

মনি আন্টি খুশি হয়ে বললেন-

‘আধ ঘন্টার মধ্যে গেলেই হবে। আমি ধ্রুবকে বলবো তোর জন্য অপেক্ষা করতে। তাই তাড়াহুড়ো করার দরকার নেই।’

আমি ফোন রেখে আয়নার সামনে এসে দাঁড়ালায়। আয়নায় নিজেকে দেখতেই বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। মাত্র ষোলো দিনেই শরীরের স্বাস্থ্য হ্রাস পেয়েছে অস্বাভাবিক মাত্রায়। চোখের নিচে পরেছে নিখুঁত কালো কালির রেখা। ঠোঁট মুখ শুকিয়ে একদমই বিধস্ত অবস্থা। এভাবে কি ধ্রুবর সামনে যাওয়া ঠিক হবে?? আকাশপাতাল চিন্তাভাবনা করে অবশেষে রওনা হলাম। প্রায় চল্লিশ মিনিট সময় নিয়েছি রেস্টুরেন্টে আসার জন্য। রেস্টুরেন্টে আসার সাথে সাথেই মনে পরলো আমি ধ্রুবকে চিনি না। ছোট বেলা দেখেছিলাম কিন্তু বড় হওয়ার পর দেখা হয়নি। রেস্টুরেন্টের ভেতরে এসেই থমকে দাঁড়ালাম। আশেপাশে নজর দিয়েও কাউকে ধ্রুব হিসেবে চিনতে পারলাম না। হঠাৎ করেই খেয়াল করলাম কর্নারের একটা টেবিল থেকে এক লোক হাতের ইশারায় আমাকে ডাকছে। আমি কিছুক্ষন চেয়ে থেকে সেদিকে পা বাড়ালাম। টেবিলের সামনে এসে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইলাম। এই মানুষটাই ধ্রুব কি-না তা নিয়ে এখনও ক্ষীণ সন্দেহ আছে।

‘কিরে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? বসে পর।’

চলবে…

পূর্ববর্তী নিবন্ধ
পরবর্তী নিবন্ধ
গল্প পোকা
গল্প পোকাhttps://golpopoka.com
গল্পপোকা ডট কম -এ আপনাকে স্বাগতম......
RELATED ARTICLES

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments

Md masrur Hasan mahi على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
আমিনুল ইসলাম على প্রয়োজন পর্ব: ৩০ ( অন্তিম)
সাজিবুল ইসলাম على ধর্ষিতাবউ২ ৯ তথা শেষ পর্ব
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
Nita Sarkar على স্বপ্নীল ৬৮
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على রহস্য শেষ_পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على অলক্ষ্যে তুমি পর্ব-০৬ এবং শেষ পর্ব
Nazmun Nahar Akhi على Psycho_is_back? part_7
Nazmun Nahar Akhi على Dangerous_Villian_Lover part 2
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على জানালার ওপারে পর্ব-১৭ এবং শেষ পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على লীলা বোর্ডিং ১২১৫ পর্ব-১১ এবং শেষ পর্ব
মিজানুর রহমান রাহুল على সেই তুমি পর্ব-০১
@feelings على প্রহেলিকা
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Nusrat jahan على coffee & vanilla Part-10
Pallabi Roy على স্বপ্নীল ৬৮
M.D Mahabub على The_Villain_Lover Part_2
Labani sarkar على Dangerous_Villain_Lover part 23
MD Akas Apc على বিবেক
Tanisha Ahmed على Devil love part-18 
Aius Barmon shorob على নারীর দেহকে নয়
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Priya Banerjee على devil love married life last part
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Riya Biswas على তুমি রবে ৫২
Mohammad Adib على তুমি রবে ৬০
Avni Ayesha على তুমি রবে ২৮
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
সুমিত على তুমি রবে ২৮
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
Samiah Begum على তুমি রবে ৫১
biddut das rocky على নর নারী
গল্প পোকা على নষ্ট গলি শেষ পর্ব
Md Jobayer Hossain Shohag على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على দুই অলসের সংসার
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤৪২.
A.J.S Rakib على মন ফড়িং ❤৪২.
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
Samiya noor على গল্পঃ ভয়
Sadikul على গল্পঃ ভয়
Samia Islam على গল্পঃ ভয়
শূন্য মায়া على মন ফড়িং ❤ ৪০.
Sutapa biswas على মন ফড়িং ❤৩৯.
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৮.
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৭
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
Siyam على বিবেক
Sudipto Guchhait على My_Mafia_Boss পর্ব-৯
saptami karmakar على devil love married life last part
saptami karmakar على devil love married life last part
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ২৬.
Shreyashi Dutta على  বিয়ে part 1
Sandipan Biswas على  বিয়ে part 1
Paramita Bhattacharyya على অনুরাগ শেষ পর্ব
জামিয়া পারভীন তানি على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
মায়া على মন ফড়িং  ২২
সুরিয়া মিম على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على মন ফড়িং ২১
গল্প পোকা على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
Sahin ssb على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৮. 
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৭.
Jannatul Ferdous على খেলাঘর পর্ব-৩৫
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ফাল্গুনের_ফুল last_part_8
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ছাত্রী যখন বউ পাঠঃ ১
গল্প পোকা على বাজির প্রেম পাঠঃ ১
Foujia Khanom Parsha على মা… ?
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৮
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
Ibna Al Wadud Shovon على স্বার্থ