#হৃদয়ের_ঠিকানা
৬ষ্ঠ পর্ব
লেখনীতেঃ #রাফিজা_আখতার_সাথী
,
অল্পসময়ের মধ্যে ড্রাইভার ফিরে আসলো। গাড়িতে তেল ভরে আবার চালানো শুরু করলো। আমি পূর্বের ন্যায় বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকলাম, পূর্বের ন্যায় ভাবনায় হারিয়ে গেলাম,
‘ছাদের দোলনায় বসে দুল খেয়ে চলেছি, কাইফ ভাইয়ার কাধে মাথা রেখে। ফুরফুরে বাতাসে আমার চুল বারবার কাইফ ভাইয়ার মুখের সামনে চলে যাচ্ছে আর আমি সেগুলো ঠিক করে নিচ্ছি৷ একসময় কাইফ ভাইয়া বিরক্ত হয়ে বলল,
– চুলগুলো ইচ্ছামত উড়তে চাই তাহলে কেন বারবার ওদেরকে বাধা দিচ্ছিস! সবাইকে কি তোর মত গাধী ভেবেছিস নাকি যে চুপচাপ থাকবো আজীবন।
আমি কথা বলার মত অবস্থায় নেই। আজকে আমার জন্মদিনে যত সারপ্রাইজ পেয়েছি তা কি আমার জন্য অনেক নয়! কাইফ ভাইয়া বলল,
– অনেকে বলে ভালোবেসে চাঁদ হাতে এনে দিতে পারবো, অনেকে বলে ভালোবাসা পেতে সাত সমুদ্র তেরো নদী পার হতে পারবো কিন্তু আমি এগুলো চাইনা।
এই কথা শুনে কাইফ ভাইয়ার উপরে একটু রাগ হলো। লোকটা একটুও রোমান্টিক নয়, দূর। কিন্তু আমাকে হালকায় অবাক করে দিয়ে বলল,
– আমি জ্যোৎস্না রাতে চাদের আলোয় তোর সাথে স্নান করতে চাই, সমুদ্র-নদীতে তোর সাথে ভাসতে চাই। তোর দুঃখের সময় হাসির কথা বলে খিলখিল করে হাসিয়ে দিতে চাই।
আমি মুগ্ধ শ্রোতার মত শুনেই চলেছি। এতো মধুর কথা না শুনে উপায় আছে! আমাকে চুপ থাকা দেখে কাইফ ভাইয়া বলে,
– হঠাৎ তুই কি একটু বেশিই লজ্জা পাচ্ছিস? আমরা একে অপরকে ভালোবাসি এটা তো নতুন ঘটনা না। হ্যা, এটা ঠিক যে প্রকাশ করতে দেরি হয়েছে কিন্তু অনুভুতি তো অনেক পুরোনো।
আমি এবার একটু কিছু বলার প্রস্তুতি নিলাম। আমিও কাইফ ভাইয়ার মত মিষ্টি কথা বলার চেষ্টা করি একটু। কাইফ ভাইয়ার দুইহাত আমার হাতের মুঠোয় নিলাম। যদিও আমার পিচ্চিপিচ্চি হাতে কাইফ ভাইয়ার হাত ঠিক ভাবে ধরলো না। তবুও জোগেজাগে হাত ধরে বললাম,
– তুমি আমার জীবনের প্রথম পুরুষ যাকে দেখে হাজার বছর বাচতে ইচ্ছা করে কাইফ ভাইয়া, সবসময় তোমার সাথে সময় কাটাতে ভালোবাসি। একদিন আমি তোমার বউ হবো হয়তো সেদিন আমার সব চাহিদা পুরোন হবে, তোমাকে আরও নতুনভাবে ভালোবাসতে শিখবো। তোমার প্রতি আমার ভালোবাসার কোনো শেষ হবেনা। ভালোবাসা শিখতে শিখতেই আমার জীবনের সমাপ্তি ঘটবে তবুও তোমাকে ভালোবাসার চাহিদা কমবেনা।
কাইফ ভাইয়া আমার কথা শুনে আমাকে জ্বালাতন করার জন্য বলল,
– তোর কথায় মজা নেই সাওদা। তুই বরং চুপ থাক আমি রোমান্টিক কথা বলি তুই আমার কাধে মাথা রেখে শুনতে থাক।
আমি আর কথা বাড়ালাম না। আজকের এই শুভ দিনে আমি তার সাথে মিষ্টিমিষ্টি ঝগড়াও করতে চাইনা। আজকের এই দিনে আমি তাকে হাজার বার নতুনভাবে চিনতে চাই।
কাইফ ভাইয়া নিজের পা দিয়ে দোলনার গতি একটি বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
– আর হয়তো দুইতিন বছর পর তোর কোলে আমার ছেলে, আমার মেয়ে ঘুমিয়ে থাকবে। আমরা তিনজন মিলে জ্যোৎস্নার আলো দেখবো। মাঝে মাঝে চাঁদ মামা মেঘের আড়ালে চলে যাবে, আমি পাগল প্রেমিকের মত তোকে বলবো, দেখো দেখো তোমার আর আমার সন্তানের সৌন্দর্যের কাছেও ওই আকাশেএ চাঁদ লজ্জা পাচ্ছে তাই নিজেলে লুকিয়ে নিচ্ছে। আমার এমন রকবাজি কথায় তুই বারবার লজ্জায় পড়বি, এখন যেমনটা পড়িস সারাক্ষণ।
আমি বললাম,
-মোটেও না। এসব মিছেকথায় আমার মন জয় করা যাবেনা বলে দিলাম।
কাইফ ভাইয়া একটু হাসি দিয়ে বলল,
-জয় করার বাকি আছে বুঝি?
আমি আবারও চুপ করে রইলাম। বারবার তার প্রশ্নে উত্তত আমার কাছ থেকে পালিয়ে যায়।
কাইফ ভাইয়া আমাকে বলল,
– সাওদা আমার সাথে বিয়ে করবি এখনি?
আমি অবাক হলাম না একটুও বরং বিরক্তি নিয়ে ভ্রু কুচকে জিজ্ঞাসা করলাম,
– কথা খুজে পাচ্ছোনা বুঝি কাইফ ভাই! কথা না খুজে পেলে বলো আমি একটা গান গেয়ে তোমার সময় পার করিয়ে দিচ্ছি।
এরপর কাইফ ভাইয়া যেটা বলল সেটা শুনে আমার বুকটা আৎকে উঠলো। সে স্বাভাবিক গলায় কিছু একটা বলল, যেটা শুনে যেন আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। আমি কোনোরকমে বললাম,
– আমার সাথে আজকের দিকে মজা করবেনা কাইফ ভাইয়া। আজকে তুমি আমাকে সে খুশি দিয়েছো সেটা ধূলিস্যাৎ করে দিওনা। আমি সহ্য করতে পারবোনা।
কাইফ ভাইয়া আবারও স্বাভাবিক গলায় বলল,
– তুই ঠিকই শুনেছিস সাওদা আমার ক্যান্সার। ডাক্তার বলেছে ১ থেকে ৫ বছর পর্যন্ত আর বাচবো সর্বোচ্চ। আর এটাই সত্যি।
এরপর কাইফ ভাইয়া তার পকেট থেকে একটা কাগহ বের করে আমার হাতে দিয়ে বলল,
– এই দেখ রিপোর্ট।
আমি রিপোর্টটা ফেলে দিলাম। উঠে দাঁড়িয়ে কাইফ ভাইয়ার গালে ঠাস করে একটা চড় দিয়ে বললাম,
– তুমি ১ বছর পর বা ১০ বছর পর সেটা কেন আমাকে বললে। উপরওয়ালা তো সবাইকেই নিজের কাছে নিয়ে নেবেন তাহলে তোমাকেও নেবেনা কেন! তুমি নিজের ডেট নিজেই বলে দিলে। কেন আমাকে সুখের থাকার সময়টুকু দিলেনা। তুমি যতদিন বেচে থাকবে ততদিন আমি মরবো, তুমি যেদিন মারা যাবে সেদিন আমিও শেষ হয়ে যাবো। বেচে থেকেও বেচে থাকবোনা, মরেও মরবোনা।
কাইফ ভাইয়া আমার চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বলল,
– আমি চেয়েছিলা তোক ভালো না বাসতে কিন্তু আমি পারিনি। নিজেকে হারানোর দিন যত এগোচ্ছে তোকে কাছে পাওয়ার নেশা ততটা ভর করছে।
আমি কাইফ ভাইয়ার হাত ধরে বলি,
– আমি তোমার সাথে কালকেই বিয়ে করতে চাই কাইফ ভাইয়া। কেও জানবেনা তোমার আমার বিয়ে। প্লিজ কাইফ ভাইয়া। তুমি যতদিন আছো ততদিন তোমাকে আমি নিজের করে পেতে চাই। তোমাকে মন ভরে ভালোবাসতে চাই, তোমার ভালোবাসায় নিজেকে রাঙাতে চাই। দেবে কি আমার সেই ভালোবাসা!
নিজ স্বার্থ স্বার্থ সবার কাছেই প্রিয় হয়। কাইফ ভাইয়া নিজের সম্পর্কে সব জেনেও আমাকে দূরে ফেলে দিতে পারছেনা। এটাই ভালোবাসার জোর।
পরদিন সকালে নিজেকে হালকা সাজালাম। আজকের দিনটা আমি একটু সাজতে চাই। চোখের জল কমছেনা, তবুও আমি সাজবো। কাইফ ভাইয়াকে পেয়েও না পাওয়ার মত ঘটনা ঘটবে আমার সাথে।
কাইফ ভাইয়া আর আমি বের হয়ে পড়লাম কাজী অফিসের উদ্দেশ্যে। সাথে মিতু আপু এবং কাইফ ভাইয়ার কয়েকজন ফ্রেন্ডও গেলো।
কাজী অফিসে কলম যেন হাতেই থাকতেই চাইছিলো না। মন আর মস্তিষ্ক যেন আলাদা কথা বলছে। তবে আমার মনই শেষ পর্যন্ত জয়ী হলো। আমার ভালোবাসা জয়ী হলো। কি আছে কপালে জানিনা কিন্তু এখন সে আমার। মৃত্যু ছাড়া কেও আমাদের আলাদা করতে পারবেনা। হ্যা মৃত্যু, একটা দীর্ঘশ্বাস বের হবেই।
সবাই হাত তালি দিয়ে আনন্দ করতে লাগলো। কিন্তু আমার মনে সুখের ভিতর ও দুঃখ। হঠাৎ কাইফ ভাইয়া হোহো করে হাসতে লাগলো।
তার হাসি যেন আমার বুকের ভিতর কাটার মত গিথে চলেছে। কষ্টের পরিমান তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। কিন্তু এরপর যা বলল তাতে ওই লোকটার গালে চড় মারা ফরজ হয়ে গেছে।
সে নাকি কালকে রাতে আমাকে পরীক্ষা করার জন্য বলেছিলো তার ক্যান্সার। আসলে সে নাকি দেখতে চেয়েছিলো সে মারা যাবে জানার পরও আমি তাকে বিয়ে করবো কিনা।
আমার ভাবনা আমাকে কাজটা করতে বাধ্য করলো। কাজী অফিসের ভিতরেই কাইফকে একটা চড় দিয়ে হাওমাও করে কাদতে লাগলাম। ওই জানোয়ার টা কি জানে গতরাত আমার জন্য কতটা কষ্টের ছিলো, ওই অমানুষটা কি জানে একটা সেকেন্ড আমার কাছে একটা বছরের মত লেগেছে।
আমি নিজেকে ঠিক রাখতে পারলাম না, অকথ্য ভাষায় গালি দিতে লাগলাম,
– জানোয়ার, কুত্তা দুই জানিস আমি কতটা কষ্টে ছিলাম। ভেবেছিলাম এই বুঝি আমার জানটা বের হয়ে যায়। আর তুই সারারাত মজা করে ঘুমিয়েছিস আমাকে কষ্ট দিয়ে। তোর এই অপরাধ কিভাবে মাফ করবো বল। তুই তো বললে আমি এমনিতেই তোকে বিয়ে করতাম, এতো নাটক করার কি দরকার ছিলো।
মিতু আপু বলল,
– তোমার মামী জানার আগে এই কথা ভেবেছিলে কখনো? ছেলেটা তোমার জন্য বছরের পর বছর কষ্ট পেয়েছে আর তুমি একরাত কষ্ট করবেনা।
আমি কাদতে মিতু আপুকে বলি,
– এই অমানুষ লোকটা তো নিজের মনের কথা প্রকাশ করতো কিন্তু আমি যে পারতাম না। তাহলে কষ্টটা তার বেশি।।মনে রাখবেন আপু। একদিন ওর এই মিথ্যার জন্য ওকে আর আমাকে সারাজীবন আলাদা হয়ে থাকতে হবে।
আমার কথা শুনে সবাই চুপ হয়ে গেলো। সবাই বুঝতে পেরেছে মজা করতে করতে তারা লিমিট ক্রস করে ফেলেছে। কাইফের এমন কাজ কোনোদিন হয়তো আমাদেরকে আলাদা করে দেবে।’
সেদিনের ভাবনায় সত্যি হয়েছিলো। তার এই মজা একসময় লিমিট পার করে ফেলেছিলো। সে জন্য সে আজও নিজের ছেলে সম্পর্কে জানেনা। আমার সাওয়াম জীবনে প্রথম তার বাবাকে দেখবে। কেমন হবে তার অনুভূতি। আমার অভিমানের কারণে সে ২য় বিয়ে করেছিলো পরীর মাকে? এরপর পরীর জন্ম হয়েছিলো! আমার ভালোবাসা সে ভুলে গেছিলো! সে দোষ করলো, আবার সে নিজেই বিয়ে করলো আর আমি অভিমান করে তার থেকে দূরে থাকলাম গত ৭ বছর, তার ছেলে সম্পর্কে তাকে জানালামই না। তবুও তো তার মত বিয়ে করে ফেললাম না আবার। আমাদের ডিভোর্স তো হয়নি, তার বোঝা উচিৎ ছিলো একদিন আমি তার কাছে ফিরে আসবোই। কেন সে অপেক্ষা করলো না!
,
,
চলবে