হৃদয়ের ঠিকানা পর্ব-০২

0
1398

#হৃদয়ের_ঠিকানা
২য় পর্ব
লেখনীতেঃ #রাফিজা_আখতার_সাথী
,
আমি কোনোভাবে বলার চেষ্টা করলাম,
– কাইফ ভাইয়া তুমি আমার নিঃশ্বাস নেওয়ার সময়টুকু তো দাও। তাহলেই না বলবো আমার মনের কথা!

আমার কথা শুনে শয়তান লোকটা এবার নিজেকে একটু সরিয়ে নিলো। তবুও পুরোপুরি আমাকে ছাড়লোনা। ওনাকে জন্য বললাম,

– কলেজের একটা ছেলেকে আমি পছন্দ করি কাইফ ভাইয়া।

আমি ভেবেছিলাম এই কথা শুনে আমাকে আরো শক্তি দিয়ে জানালার সাথে চেপে ধরবে কিন্তু আমার ধারণা ভুল প্রমাণ করে দিয়ে আমাকে সম্পুর্ন ছেড়ে দিয়ে নিজের সিটে বসে রইলো।

আমি এবার একটু ভয় পেলাম, এই ভেবে যে তুফানের আগে হয়তো সবকিছু শান্ত থাকে। কিন্তু না এবারের ধারণাও ভুল হলো। সে একমনে গাড়ি চালাতে লাগলো। আমি এবার আরো দুষ্টুমি করে বললাম,
– তার নামটা শুনবেনা কাইফ ভাইয়া?

– নাম শুনে আমি কি করবো? তোর ভালোবাসার মানুষ তুইই বরং তার নাম, ধাম মুখস্থ করে রাখ।

আমি লজ্জা পাওয়ার অভিনয় করে বলি,
– শুধু মুখস্থ কি বলছো কাইফ ভাইয়া। আমিতো তার নাম আমার বুখস্থ করে ফেলেছি। এই বুকের মধ্যে তার নাম, ধাম সব আছে।

এবার কাইফ ভাইয়া রাগান্বিত চোখে আমার দিকে তাকালো কিন্তু তৎক্ষনাৎ একটা হাসি দিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে আবার গাড়ি চালানোয় মন দিলো। আমিও চুপচাপ বসে রইলাম। কাইফ ভাইয়া হঠাৎ সামনের মোড় থেকে ইউটার্ন নিয়ে বাসার দিকে গাড়ি চালাতে লাগলো। আমি একটু অবাক হয়ে বললাম,
– বাসায় যাবে নাকি আবার!

– হ্যা যাবো।

– কিছু কি ফেলে এসেছো নাকি? মামীকে বললেই তো ড্রাইভারকে বলে অন্য গাড়ি দিয়ে তোমার কাছে জিনিসটা দিয়ে যেতো।

– আমি কি বলেছি কিছু ফেলে এসেছি? সব সময় এতো বেশি কথা কেন বলিস তুই? আমি তোকে বাসায় রেখে আসতে যাচ্ছি।

– তোমাদের ফেয়ারওয়েলে আমাকে নিয়ে যাবেনা তাহলে?

মন খারাপ করে বললাম।

কাইফ ভাইয়া একটু তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল,

– তাদের সাথে বলেছিলাম আমি আমার ভালোবাসার মানুষকে নিয়ে যাচ্ছি কিন্তু তুই আমার ভালোবাসা হলেও আমিতো তোর কেও না!

– আমি তোমার ফুফুর মেয়ে কাইফ ভাইয়া। বোন হিসেবেও তো আমাকে নিয়ে যেতে পারো!

– না পারিনা। কারণ ওরা সবাই জানে আমরা একে অপরকে ভালোবাসি। তাই আমি চাইনা তোর গায়ে কলঙ্ক লাগুক।

আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম,
– এর সাথে কলঙ্কের কি সম্পর্ক কাইফ ভাইয়া।

কাইফ ভাইয়া গাড়ি আবার সাইড করে রেখে বলল,

– আজকে তোকে প্রেমিকা হিসেবে ওখানে নিয়ে যাবো। কিন্তু কিছুদিন পর যখন ওরা জানবে তুই অন্যকাওকে ভালোবাসিস, তার সাথে বিয়ে করছিস তখন সবাই তোর চরিত্রের দিকে আঙুল তুলবে। আমি কাইফ বেচে থাকতে তোকে অপমান করা সহ্য করতে পারবোনা রে সাওদা।

একনাগাড়ে কথাগুলো বলে কাইফ ভাইয়া আমার দিকে তাকালো। চোখগুলো রসগোল্লার মত টসটসে হয়ে আছে। একটু টোকা লাগলেই যেন রস সব গাল বেয়ে পড়বে। লোকটার চোখের পানির থেকেই তার মুখের কথাগুলো আমার মনে আঘাত হেনেছে। একটা মানুষ আমাকে এতো ভালোবাসে কেন? আমার কাছে কি আছে যে তাকে দেবো! না আছে বাবা না আছে মা, তাদের বাসায়ই বড় হয়েছি আর এখন তার সাথেই বিয়ে করবো এই চিন্তা আমি করতে পারিনা। মামীর কাছে আমি ছোটো হয়ে যাবো। এই জন্য মিথ্যা আমাকে বলতে হবে। মাঝে মাঝে আমার মনে হয় নিজের গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে কাইফ ভাইয়াকে জড়িয়ে ধরে তার বুকের মধ্যে মাথা রেখে চিৎকার করে বলি, আমি তোমাকে ভালোবাসি কাইফ ভাইয়া, আমার মত কেও তোমাকে ভালোবাসতে পারবেনা।
কিন্তু আমি পারিনা। তারা আমাকে আশ্রয় দিয়েছে, তাদের এতো বড় সুযোগ আমি নিতে পারিনা। আমার বিবেক আমাকে এটা করতে দেয়না। তাই মাঝে মাঝে আমি সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগি, কি করবো কি করবোনা।

এতো আজকেই বলতে ইচ্ছা করছিলো আমি তাকে ভালোবাসি কিন্তু পারলাম না।

কাইফ ভাইয়া আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,

– জানিস সাওদা, আমার বড্ড কষ্ট হচ্ছে রে। তোর বয়স যখন ১০/১১ বছর তখন থেকেই আমার মনে তোর জন্য অন্য এক অনুভুতির স্থান আছে। আজও একটুও অনুভূতি কমেনি, বরং যত দিন গেছে আরও চেয়েছি তোকে কাছে পাওয়ার। এখনতো তুই প্রাপ্ত বয়স্ক তাই তোকে মনে কথা বলেই দিলাম। তুই ভাবিস না আমি কষ্ট পাচ্ছি। আমার বরং খুশিই লাগছে যে তুই নিজের জীবনসঙ্গী পছন্দ করেছিস।

আমি গলা টেনে বললাম,

– তোমার কথা আজকাল খুব উলটা-পালটা হচ্ছে কাইফ ভাইয়া। একটু আগেই বললে তোমার কষ্ট হয়, আবার এখন বলছো আমি জীবনসঙ্গী বেছে নিয়েছি তাই তুমি খুশি। নিজের কথায় ঠিক থাকো কাইফ ভাইয়া, নাহলে তোমার বউ পালিয়ে যাবে বাপের বাড়ি। হিহি।

জানি আমি যেটা বললাম এটা কাইফ ভাইয়ার কাছে মজার কিছু না। তবুও বললাম। আমার কাছে যেন সবকিছুই তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। পেয়েও হারিতে ফেলতে চাওয়ার যন্ত্রণা যে কতটা কষ্টের আমি বোঝাতে পারবোনা।

কাইফ ভাইয়া গাড়ি না চালিয়ে চুপ করে বসে রইলো। আমি বললাম,

– বাসায় যেওনা কাইফ ভাইয়া। তুমি আমাকে তোমার অনুষ্ঠানে নিয়ে চলো। একদিন নাহয় তোমার প্রমিকা সেজে রইবো।

আমার কথা বলা শেষ হতে না হতেই কাইফ ভাইয়া গাড়ি চালানো শুরু করলো। আমার সাথে আর একটা কথাও বললো না সে৷ সোজা বাসার সামনে গাড়ির পার্কিং করে বলল,

– বিকালে তোকে ঘুরতে নিয়ে যাবো, তবুও ওখানে তোকে নিয়ে যেতে পারবোনা। আমার বিবেক আমাকে তোকে নিয়ে যেতে দেবেনা। তুই বাসার ভিতরে যা।

আমি মন খারাপ করে বাসার ভিতরে চলে এলাম। একটু কান্নাও পেলো, কিন্তু এই কান্নার কোনো মানে নেই। আমি নিজেই যে দোষী।

বাসায় ঢুকতেই মামী আমাকে দেখে বলল,

– কিরে মা তোরা চলে এলি যে! কাইফ কোথায়?

আমি মন খারাপ করে বললাম,
,
– কাইফ ভাইয়ার সাথে আমার ঝগড়া হয়েছে তাই আমাকে এখানে ফেলে চলে গেছে। বলেছে আমাকে নিয়ে যাবেনা। আমি নাকি সবার সামনে ঝগড়া করবো।

মামীর সাথে সত্য বলতে পারিনি। বলতে পারিনি তার ছেলে আমাকে ভালোবাসে। যদি বলি হয়তো ভেবে নেবে আমি কাইফ ভাইয়াকে ফাদে ফেলেছি। তাই একটু মিথ্যা বলতেই হলো।

আমি সোজা নিজের ঘরে চলে এলাম। দরজা আটকে দিয়ে, খাটে উপড় হয়ে শুয়ে নিজের কপালের জন্য কাদতে লাগলাম। ইশ! আজকে যদি আমার বাবা মা বেচে থাকতো তাহলে কতই সহজে কাইফ ভাইয়াকে নিজের মনের কথা বলে দিতে পারতাম।

কাদতে কাদতে কখন ঘুমিয়ে পড়লাম জানিনা। মামীর ডাকে ঘুম ভাঙলো। দরজা খুলে দেখলাম মামী খাবার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে বলল,

– ওয়াসরুম থেকে মুখ ধুয়ে আয় ভালো করে। আমি তোকে খাইয়ে দেবো।

বাধ্য মেয়ের মত ওয়াসরুম থেকে আমার হাত মুখ ধুয়ে এসে খাটে বসলাম। মামী আমার পাশে বসে প্লেটে থেকে এক লোকমা খাবার তুলে আমার মুখের সামনে ধরলো। আমি খাবার গালে নিলাম।

মামী একটু অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
– মারে তুই কাদছিস কেন? আমার পাগল ছেলেটা কি তোকে বড্ড কষ্ট দিয়ে ফেলল? ও আজকে আসুক তারপর দেখাবো মজা।

আমি মামীকে বলি,
– না না মামী, তুমি কাইফ ভাইয়াকে কিছু বলিওনা। আমিতো বাবা-মায়ের জন্য কাদছি।

আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

– তাহলে বোধহয় আমি আর তোর মামা তোর বাবা মায়ের জায়গা নিতে পারিনি।

– তা না মামী। আমি সেই ভাবে কিছু বলতে চাইনি। তুমি তো আছোই। এখন আমাকে খাইয়ে দাওতো বড্ড খিধা পেয়েছে।

মামী আমাকে পরম যত্ন করে খাইয়ে দিতে লাগলো। এই মানুষটা আমাকে এতো ভালোবাসে তাহলে কেন আমাকে বউমা হিসেবে মানবেনা! আমার বাবা মা নেই সেজন্য। নাকি আমার মন থেকেই তাকে নিয়ে এমন উল্টোপালটা ভেবে বসে আছি।

যায়হোক মামীকে একটু ঝালিয়ে দেখি। মামীকে বললাম,

– মামী তোমার ছেলের জন্য কেমন বউ পছন্দ?

– সে আর শুনে কি করবি। আমিতো পছন্দ করেই রেখেছি। সে যেমনই হোক তাকেই আমার ছেলের সাথে বিয়ে দেবো। আমার ঘর আলোকিত করার জন্য সেই লক্ষি মেয়েটাকেই লাগবে।

মনটা একটু খারাপ হলেও লোক দেখানো একটা হাসি দিলাম। মামী তাহলে তার ছেলের বউকে পছন্দ করে বসে আছে আর আমি জানিই না।
,
আর কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ খেয়ে নিলাম।
,
🍁
সকালে ঘুম ভাঙতেই আমার বান্ধবী রিয়া ফোন দিয়ে বললে এখনি রেস্টুরেন্টে তার সাথে দেখা করতে,কারণ সে নাকি কাইফ ভাইয়ার সন্ধান পেয়েছে।

কালকে থেকে কাইফ ভাইয়ার কোনো খোজ নেই। সেই যে আমাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে গিয়েছে আর তাকে ফোনে পাওয়া যায়নি। এমনকি সে নাকি তাদের ফেরারওয়েলেও যায়নি। রিয়ার ফোন পেয়ে আমি ফ্রেস হয়েই একটা অটো ভাড়া নিয়ে বের হয়ে পড়লাম। প্রায় ২০ মিনিট পর রিয়ার বলা রেস্টুরেন্টে পৌছালাম।

ওকে দেখলাম রেস্টুরেন্টের এককোনে বসে আছে। আমি দৌড়ে ওর কাছে গিয়ে ওকে বললাম,
– শিগগিরি বল কাইফ ভাইয়াকে কোথায় দেখেছিস?

– আরে দোস্ত শান্ত হ। সে ঠিক আছে এবং সুস্থ আছে। তুই চিন্তা করিস না। আগে বল তুই কাকে ভালোবাসিস।

– এটা কেমন কথা? তুই জানিস না বুঝি!

– জানি তবুও একবার বল।

আমি মাথা নিচু করে বলি,
– কাইফ ভাইয়াকে ভালোবাসি দোস্ত। কিন্তু আমি বলতে পারিনা। মামী আমাকে ভুল ভাবতে পারে। যদি ভাবে তার খেয়ে তার সাথেই অন্যায় করছি তাহলে সে খুব কষ্ট পাবে। আমি চাইনা আমার মামীর কোনো কষ্ট হোক মনের ভিতর।তাই কাইফ ভাইয়া বা মামী কাওকেই বলিনি আমার মনের কথা। যাদের খাই তাদের সাথে এতো বড় বেইমানি করতে পারবোনা দোস্ত।

এক নিঃশ্বাসে সব বলে মাথা উঠিয়ে দেখি সামনে রিয়া নেই। তার জায়গায় বসে আছে কাইফ ভাইয়া। চোখ দুটো লাল টকটকে।। ওনাকে দেখেই তোতলাতে শুরু করে দিলাম। এবার আমার কি হবে!
,
,
চলবে
,
বানান ভুল হলে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে