#হৃদয়াক্ষী
#পর্ব_০৫
#সারিফা_তাহরিম
‘আমি না বুঝতে পারছি না। কে এই ছেলে?’
তখন পেছন থেকে কেউ একজন বলল,
‘আমি।’
দিনা চকিতে পেছনে ফিরল। পূর্ণতা আর মিফতাও বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে তাকিয়ে রইলো। অচেনা এক ছেলে কিছুটা মুখে একটা হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটা সুন্দর দেখতে। দিনা তার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
‘ কে আপনি? কেন এমনটা করেছেন? আমার ফ্রেন্ডের জীবনটাকে নরক বানানোর জন্য উঠে পড়ে লেগেছেন?’
পূর্ণতারও রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। এই ছেলেটা সেই ছেলে জানতে পেরে রাগে হতবিহ্বল হয়ে পড়ছে। মিফতা ভ্রু কুচকে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে আছে। অবস্থা বোঝার চেষ্টা করছে। তবে দিনার প্রশ্নে ছেলেটাকে আরেকটু বিব্রত দেখাল। খানিক বিস্মিতও হলো। সে মাথা চুলকে বলল,
‘ দিনা, তুমি কী বলছো আমি আসলেই বুঝতে পারছি না। আমি তো এতদিন ধরে তোমাকে চিঠি পাঠাতাম। তোমার ফ্রেন্ডদেরকে না। চিঠিগুলো কি তুমি পাও নি?’
চিঠি! শব্দটা শ্রুতিপথে প্রবেশ করতেই এক অদ্ভুত শিহরণ বয়ে গেল দিনার মাঝে। প্রায় দুই মাস ধরে তার কাছে চিঠি আসছে। চিঠিগুলোতে প্রেরকের নাম থাকতো না। এক প্রকার উড়ো চিঠি বলা যায়। প্রথম প্রথম পাত্তা দিত না দিনা। ধীরে ধীরে চিঠিগুলো পড়া তার অভ্যাসে পরিণত হলো। চিঠিগুলো পেলে ভালো লাগতো। ক্রমান্বয়ে তা উত্তেজনায় রূপ নিতে থাকে। চিঠিগুলোর লেখায় এক ধরনের নেশা কাজ করতো। দিনার আসক্তি হয়ে গিয়েছিল সেই নেশায়। দিনার মনে পড়ে দুই মাস আগের সেদিনের কথা। ১৪ই ফেব্রুয়ারি ছিল সেদিন। সেই সময় বইমেলা চলছিল। সেদিন দিনা মিফতা আর তাদের আরেকজন বান্ধবী রুমি বইমেলায় গিয়েছিল। বেশকিছু বই কিনে বাসায় ফিরেছিল। বাসায় গিয়ে যখন বইগুলো বের করে দেখছিল, তখন সাদাত হোসাইনের ‘ছদ্মবেশ’ বইটি খুলে দেখতে নিতেই একটা চিরকুট বেরিয়ে এলো। ছদ্মবেশ বইয়ে তো এখন লেখকের চিরকুট দেওয়ার কথা না। তাহলে এটা কিসের চিরকুট! কৌতুহলী চোখে চিরকুটটা হাতে নিল দিনা। অন্য কারো চিরকুট ভুলবসত তার কাছে চলে আসেনি তো! কিন্তু চিরকুট খুলতেই তার ভ্রম ভেঙে গেল। শুরুতেই গোটা গোটা অক্ষরে লিখা, ‘প্রেয়সী দিনা’। অর্থাৎ চিরকুটটা ভুল করে আসেনি, বরং দিনার উদ্দেশ্যেই চিঠিটা লিখা হয়েছে। চিঠিটা ছিল এমন,
‘প্রেয়সী দিনা,
ভালোবাসা দিবসের রঙিন সূচনায় ভালোবাসার প্রহর গুণে একটি আবদার নিয়ে এসেছি। তুমি কি আমার এলোমেলো মনের ছোট্ট আবদারটা রাখবে? প্রথম দেকগা থেকেই ভার্সিটির প্রাঙ্গণে তোমার প্রতিটি কার্যকলাপে আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলি। অচেতন মনে বারবার তোমাকে খুঁজি। চোখের পেলব এক হতেই তোমার ছবি ভেসে উঠে রঙিন ক্যানভাসে। শ্যামাঙ্গিনী, তুমি এত সুন্দর কেন? তোমার নয়ন জোড়ার তীব্র সম্মোহনী শক্তি যে আমাকে গ্রাস করে তা কি জানো? শ্যামাঙ্গিনী শুনো, প্রতিটি বসন্তের সন্ধ্যায় আমার কাঁধে মাথা এলিয়ে মুগ্ধ নয়নে তোমার মুখটা দেখার সুযোগ করে দিবে? আমার এই ছোট্ট আবদারটা রাখবে?’
এটুকুই ছিল প্রথম চিঠিটা। কোনো নাম ছিল না। কোনো ঠিকানা ছিল না। শুধু একটা নিঃসংকোচ আবেদন। ভারি অবাক হয়েছিল দিনা। প্রথমে ভেবেছিল কেউ হয়তো মজা করছে। এর কয়েকদিন পরে আবারও চিঠি আসলো। সেই চিঠির সারমর্ম ছিল এমন, চিঠিদাতা অর্থাৎ প্রেরক দিনার ভার্সিটিরই একজন। দিনার আশেপাশেই প্রায় সময় থাকে। তবে যতদিন অবধি দিনা তাকে খুঁজে বের করতে চাইবে ততদিন অবধি সে নিজের পরিচয় দিবে না। যখন সে বুঝতে পারবে দিনা তার পরিচয় জানতে চাইছে তখনই সে সামনে আসবে। এমন করে প্রায় সময়ই দিনা চিঠি পেত। কখনো বেঞ্চের উপর, কখনো খাতার ভাঁজে, কখনোবা সিনিয়র আপুদের হাত থেকে। মাঝে মাঝে বইও গিফট পেত, সেই বইয়ের ভেতরে থাকতো রঙিন কাগজে লিখা চিরকুট। দিনা সেই চিরকুটগুলো পড়ে লজ্জা পেত। পুলকিত হতো। সবগুলো চিঠি এন্টিকের সুন্দর একটা বক্সে জমিয়ে রেখেছে সে। দু একদিন চিঠি না পেলে আগের চিঠিগুলো আবার পড়তো।
হ্যাঁ বেশ কিছুদিন ধরে দিনা সেই ব্যক্তিকে খুঁজছিল। কিন্তু এখন হুট করে তার দেখা পেয়ে যাবে ভাবেনি। সে বিস্ময়ের সপ্তম আকাশে বিরাজ করছে। এই মানুষটাকে সে চিনে। তার নাম ইরাফ রহমান। ইংরেজি বিভাগে চতুর্থ বর্ষে পড়ে। দিনা নবীন বরণ প্রোগ্রামে তাকে প্রথম দেখেছিল। এই মানুষটার প্রতি কেন যেন একটা আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছিল মনের কোণে। সেই ব্যক্তি যে দিনাকে চিঠি দিত তা সে কস্মিনকালেও ভাবেনি। প্রথমে ব্যাপারটা বোধগম্য হলো না। পরক্ষণে ইরাফের কথা বুঝতেই শিরদাঁড়া এক শীতল শিহরণ বয়ে গেল। সে মিইয়ে যাওয়া কণ্ঠে বলল,
‘ চিঠিগুলো আপনি দিতেন?’
ইরাফ আলগোছে হেসে সম্মতি জানালো। আসলে দিনাদের আলোচনা পুরোপুরি শুনেনি। শুধু দিনার বলা ‘ আমি না বুঝতে পারছি না। কে এই ছেলে’ কথাটি শুনেছিল। সে মনে করেছে চিঠিদাতার কথা বলছে দিনা। তাই সে মনের মাঝে সাহস জুগিয়ে নিজের পরিচয় দিয়ে দিল। মিফতা আর পূর্ণতা চিঠির ব্যাপারে জানতো। অন্য সময় হলে এতক্ষণে পূর্ণতা আর মিফতা দিনার সাথে দুষ্টুমি করা শুরু করতো। কিন্তু একটু পরেই ক্লাস শুরু হয়ে যাবে দেখে তারা আর কথা বাড়াল না। দিনাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মিফতা তাড়া দিয়ে বলল,
‘ দিনু রে, দেরি হয়ে যাচ্ছে। ক্লাস শুরু হয়ে যাবে। চল তাড়াতাড়ি।’
দিনা যেন সম্বিৎ ফিরে পেল। তাড়াহুড়ো করে ক্যাফেটেরিয়া থেকে বের হতে যাবে তখন পেছন থেকে ইরাফ মিহি কণ্ঠে আবেগ জড়িয়ে বলল,
‘আমার আবদারটা রাখবে না শ্যামাঙ্গিনী?’
দিনা পেছন ফিরে তাকাল। ইরাফের সুমধুর কণ্ঠে বলা কথায় সামান্য লজ্জা পেল দিনা। লাজুক হেসে বলল,
‘ভেবে দেখব মিস্টার।’
দিনা আর দাঁড়ালো না। তাড়াতাড়ি প্রস্থান করল। ইরাফ প্রসন্ন হাসলো। সম্মতিসূচক উত্তরের আভাস সে পেয়ে গেছে। আজ দিনটা একটু বেশি সুন্দর মনে হচ্ছে। চারপাশে যেন প্রতিধ্বনিত হচ্ছে,
‘বাতাসে বহিছে প্রেম, নয়নে লাগিল নেশা
কারা যে ডাকিল পিছে, বসন্ত এসে গেছে…’
_______
পূর্ণতা, দিনা আর মিফতা ক্লাস শেষে ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে এলো৷ পূর্ণতার বাসা ভিন্ন পথে তাই সে মিফতা আর দিনাকে বিদায় জানিয়ে রিকশার জন্য হাঁটতে শুরু করল। এই মুহূর্তে তার মন বেশ ফুরফুরে। তার বন্ধুমহলের সাথে থাকলে মন ভালো হতে বাধ্য। ইরাফ আর দিনার বিষয়টা নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ দুষ্টুমি করেছিল মিফতা আর পূর্ণতা। ইরাফ যথেষ্ট ভালো ছেলে। দিনা আর ইরাফের যে পরস্পরের প্রতি ভালো লাগা কাজ করে তাতে মিফতা আর পূর্ণতা মনে মনে বেশ খুশি হয়েছে। তাদের দুজনকে বেশ মানাবে। কথাটা ভাবতেই হালকা হাসলো সে। আরও কয়েক কদম এগিয়ে যেতেই দেখল কেউ একজন তার দিকেই এগিয়ে আসছে। আকাশি রঙের শার্ট আর কালো প্যান্ট। শার্টের হাতা কনুই অবধি সুন্দর করে গোটানো আর চাপ দাঁড়িতে ঘেরা মুখে স্নিগ্ধ হাসি। সুদর্শন এই পুরুষটিকে প্রথমে চিনতে পারলো না পূর্ণতা। কিয়ৎক্ষণ পরে মনে পড়লো, এই সেই ব্যক্তি যার সাথে পূর্ণতা সারাজীবন আবদ্ধ হয়ে আছে। কথাটি মনে পড়তেই গম্ভীর হয়ে উঠলো পূর্ণতা।
অরিত্রকে না দেখার ভান করে রিকশার জন্য দাঁড়াল। কিন্তু এই পাশে কোনো রিকশা দেখতে না পেয়ে বিরক্ত হলো পূর্ণতা। এখন আবার এত বড় রাস্তা পার হতে হবে। ততক্ষণে অরিত্র তার কাছে এগিয়ে এসে বলল,
‘আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছো পূর্ণতা?’
পূর্ণতা আর চোখে তাকালো। পরক্ষনেই চোখ সরিয়ে নিল। অরিত্রের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। রোদের আলোয় তা চিকচিক করছে। ক্লান্ত শরীরেও তাকে স্নিগ্ধ লাগছে। এই সময়ে এমন ক্লান্ত অবস্থায় অরিত্রকে দেখলে যে কোনো মেয়েরই ইচ্ছে করবে ওড়নার আঁচলটুকু দিয়ে দায়িত্ব সহকারে পরিশ্রান্ত মুখখানা মুছে দিতে। কিন্তু পূর্ণতা তা করল না। বরং খানিকটা রাগ হলো। লোকটাকে এমনিতেই দেখতে ইচ্ছে করে না। তবুও কেন সে দেখা করতে আসে! পূর্ণতার রাস্তার দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ওয়ালাইকুম আসসালাম। আসসালামু আলাইকুম। আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি।’
অরিত্র মৃদু হেসে বলল,
‘ওয়ালাইকুম আসসালাম। তোমার দৃষ্টি দেখে মনে হচ্ছে তুমি আমার সাথে না এই ব্যস্ত সড়কে চলমান গাড়িগুলোর সাথে কথা বলছো। যাই হোক, এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে রিকশা পাবে না। উল্টো এই গরমে ঘেমে নেয়ে ক্লান্ত হয়ে উঠবে। রিকশার জন্য রাস্তা পার হতে হবে। চলো।’
পূর্ণতা কথা না বাড়িয়ে কয়েক পা এগিয়ে গেল। রাস্তায় গাড়ি ছুটে চলেছে ব্যস্ত গতিতে। একটু অসাবধান হলেই মুহূর্তের মধ্যেই বিপদ ঘটে যেতে পারে। অরিত্র দুপাশে মাথা ঘুরিয়ে রাস্তার গাড়ি দেখে নিল। রাস্তা পার হওয়ার সময় দায়িত্বশীলভাবে আলতো করে পূর্ণতার হাত ধরলো। পূর্ণতা শিহরিত হলো। চমকে তাকালো অরিত্রের দিকে। না, মানুষটা দেখে শুনে রাস্তা পার হতে ব্যস্ত। অন্য কিছুর জন্য না বরং পূর্ণতার সাবধানতার জন্য তার হাত ধরেছে। পূর্ণতাও সাবধানে রাস্তা পার হলো। রাস্তা পার হয়ে বিপরীত পাশে আসতেই অরিত্র পূর্ণতার হাত ছেড়ে দিল। পূর্ণতা তার হাতটা গুটিয়ে নিল। আরেক হাতে মাথা থেকে হালকা সরে যাওয়া ওড়নাটা আরেকটু টেনে নিল। রিকশার জন্য অপেক্ষা করতে করতে অরিত্র বলল,
‘ আমার সাথে দেখা হওয়াটা হয়তো তোমার ভালো লাগেনি। কিন্তু সত্য কথা বলতে তোমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে তোমার সাথে দেখা করাটা আমার উদ্দেশ্য ছিল না। অফিসের কাজে সামনের ব্যাংকটাতে আসতে হয়েছিল। রিকশার জন্য হেঁটে আসতেই দেখলাম তুমিও রিকশার জন্য দাঁড়িয়ে আছো। রিকশা নেওয়ার জন্য রাস্তা পার হতে হতো। আর এত বড় রাস্তা তুমি একা পার হওয়াটা সেফ না। তাই এগিয়ে আসলাম।’
পূর্ণতা মনে মনে বলল, ‘আমি কি বাচ্চা নাকি যে রাস্তা পার হতে পারব না?’ কিন্তু মুখে কিছু বলল না। একটু পরে একটা রিকশা পাওয়া গেল। পূর্ণতা রিকশা উঠে অস্বস্তি নিয়ে এক পাশে চেপে বসলো। এই লোকটার সাথে একই রিকশায় যাবে! ভাবতেই অস্বস্তি হতে লাগলো। বিষয়টা অরিত্রের চোখ এড়ালো না। সে স্মিত হেসে বলল,
‘তোমার পথসঙ্গী হতে আমার ইচ্ছে করে। ভীষণ ইচ্ছে করে। কিন্তু সেটা তোমাকে অস্বস্তিতে ফেলে নয়। আমার পথের সাথী হওয়ার ইচ্ছে পূরণের চেয়ে তোমার স্বস্তিটাই আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তোমার স্বস্তির জন্য প্রয়োজনে আমি বন্ধু হয়েই থাকব প্রেমিক পুরুষ হয়ে নয়। তুমি পারলে বন্ধু ভেবে হলেও আমার উপর রাগটা কমিয়ে এনো।’
শেষের কথাগুলো বলার সময় অরিত্রের হাস্যোজ্জ্বল মুখটা নিভু নিভু হয়ে এলো। অরিত্র দীর্ঘশ্বাস ফেলে রিকশার ভাড়া দিয়ে দিল। পূর্ণতা বারণ করলেও শুনলো না। তারপর হালকা হেসে বলল,
‘ সাবধানে যাবে। বাসায় গিয়ে আমাকে কল করবে।’
চলবে…