হঠাৎ_হাওয়া (২৪)
__অন্তিম পর্ব
মায়া সাবধানে ধীরে সুস্থে বাইরে বেরিয়ে এলো, ও যদিও গাড়ি নিয়ে এসেছে তবুও হাটছে, এলোমেলো চলন, বড় রাস্তা পার হতে গিয়েই মায়ার মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো,নিজেকে সামলে কোনোরকম বাসায় পৌঁছে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলো।
মায়া ভেতরে যাওয়ার পরেও অনেক্ষণ হিমালয় মায়ার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে রইলো, মেয়েটা একটা পাগল কখন কি করে বোঝা যায় না দুশ্চিন্তা লেগেই থাকে,এতদিনের রাগ অভিমান ক্ষোভ থেকেই হিমালয় মায়াকে এতগুলো কথা শুনিয়েছে, আসলে ধ্রুব যে অর্নাকে ভালোবাসে সেটা তো মায়া জানে না, আর এবার ধ্রুব একদম সিরিয়াস অর্নার পাস্ট জেনেও সে অর্নাকেই চায় কম দিন ধরে তো অর্নার পেছনে ঘুরছে না ধ্রুব কিন্তু অর্নাই জড়তা কাটিয়ে সায় দিচ্ছে না, হিমালয় জানে মায়া আবার ওর কাছে আসবে তখন আর মায়াকে ফেরাবে না।হিমালয় কে সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণ করে দিয়ে মায়া আর একবারো হিমালয়ের কাছে গেলো না,শুধু তাই নয় হিমালয়ের সাথে কোনো প্রকার যোগাযোগ মায়া করলো না তবে হিমালয় জানতে পারলো মায়া ঢাকাতেই আছে।কিছু কিছু সম্পর্কের মান অভিমান এমন হয় যে অপরপক্ষের কাছে নিজের সমস্ত সত্ত্বা বিলীন করে দিলেও সামনে থেকে গিয়ে বলা যায় না কতটা ভালোবাসা অন্তরে পোষা আছে, মায়া আর হিমালয়ের ও তাই হলো কেউ আর অভিমান ভেঙে দাড়াতে পারলো না।
মায়ার সাথে হিমালয়ের আবার দেখা হলো দিহান আর কথার বিয়েতে, মায়াকে দেখে সবাই চমকে উঠলো, ও কালো রঙের একটা জামদানি শাড়ি পড়ে এসেছে কোনো সাজ নেই গায়ে, একটুও না ওকে কতটা কাহিল লাগছে হিমালয় এবার থাকতে না পেরে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো
—তোমার কি হয়েছে মায়া? এমন দেখাচ্ছে কেন
মায়া খুব স্বাভাবিক ভাবে জবাব দিলো
—বাবা, একটু অসুস্থ তো তাই একটু চিন্তা হয়।
মায়া হিমালয় কে পাশ কাটিয়ে কথার কাছে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরলো, কথা হুট করে কেদে ফেললো,মায়া হেসে বলল,
—তোমার জন্যে আমি এই পৃথিবীতে সবচেয়ে চমৎকার কিছু সময় কাটিয়েছি তুমি কি তা জানো?
—আর আমার জন্যেই তুমি সব খুয়েছো মায়া।
—তোমার আর দিহানের জন্যে আমি খুবই খুশি।
মায়া সবার সাথে দেখা করলো পুষ্প আর নিরবও এসে পরেছে, মিষ্টির হালকা ফোলা পেটে হাত বুলিয়ে মায়া মিষ্টি কে জড়িয়ে ধরলো।
অর্নার সাথেও চোখে চোখ পড়তে হাসি ফিরিয়ে দিলো,মায়া কথার বাবার সাথেও কুশল বিনিময় করলো তারপর হিমালয়ের বাবা মায়ের সামনে গিয়ে দাড়ালো, হিমালয়ের মায়ের সাথে মাঝে একবার মায়ার কথা হয়েছিলো তিনি ক্ষমা চাইলেন তার ছেলের স্বাভাবিক জীবনের আবদার করলেন, মায়া তো চেষ্টাও করলো কিন্তু সব কি ওর ইচ্ছে মতো আর হয়?যদিও হিমালয়ের এটাই ধারণা তবুও তা তো আর সত্যি না। হিমালয়ের বাবা খুব স্নেহের সাথে মায়ার মাথায় হাত রাখলেন,
—তুই এত্ত শুকিয়ে গেছিস কেন মায়া? তুই কি অসুস্থ?খাওয়া দাওয়া ঠিক মত করিস না?
—উহুহ জানেনই তো বুদ্ধিমতীদের মস্তিষ্কে কত গ্লুকোজ এর প্রয়োজন, তাই সব খাবার মাথায় চলে যায়,
তারপর দুজনেই শুকনো করে হাসলো।মায়া সবার সাথে দেখা করে বাবার অসুস্থতার অজুহাত দিয়ে না খেয়েই বিদায় নিলো।
হিমালয় মায়ার পিছু পিছু বাইরে এসে বললো,
—মায়া দাঁড়াও
মায়া অনিচ্ছা সত্ত্বেও থমকে দাড়ালো, এই ডাক উপেক্ষা করার ক্ষমতা ওর নেই,মায়া হিমালয়ের সামনে চোখে চোখ রেখে বলল,
—কিছু বলবেন?হিমালয়?
হিমালয় চমকে তাকালো ওর মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেলো মাথার মধ্যে চিনচিন একটা ব্যাথা হলো,এই মেয়ে অসম্ভব জেদী ইচ্ছে করেই এসব করে,
—তুমি কি নিজের যত্ন নাও না?
—হু নিই তো।
—তাহলে শরীরের এই হাল কেন?
—আসলে আগে আশে পাশে ডাক্তাররা থাকতো তো তাই সুস্থ থাকতাম এখন সব রোগীরা থাকে তাই আমিও অসুস্থ থাকি।
—ধ্রুব অনেক রিসার্চ করেছিলো সাহিত্যের ব্যাপারটা নিয়ে কিন্তু..
—ও…আমি যাই আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে,
মায়া আরো কিছুক্ষণ দেরি করলে হয়তো ধ্রুব আর অর্নার এনগেজমেন্টটার সাক্ষী হতে পারত অর্না শেষ মেষ সমাজ সংসার এর ভয় ভুলে শ্রুব কে আপন করে নিয়েছে।
হাসপাতালের কেবিনে মায়ার হাত মুঠোবন্দী করে দাঁড়িয়ে আছে সাহিত্য, ওর ইচ্ছে করছে এক্ষুনি একটা চড় ঠাটিয়ে মায়ার গালে লাগাতে, কিন্তু পারছে না মেয়েটা না খেয়ে না খেয়ে এতটাই দুর্বল হয়ে গেছে যে নাকের ভেতর নল দিয়ে খাবার দেওয়া হচ্ছে,স্যালাইন দেওয়া হয়েছে। এই মেয়েটা এত বেয়াদব কেন?
মায়া জ্ঞান ফিরে দেখলো ওর সামনে কতগুলো চেনা মুখ কিন্তু এদের কাউকেই মায়া চায় না মায়া চোখ বন্ধ করে ফেললো,এত আলো অসহ্য লাগছে ও ঘুমিয়ে পড়লো।সন্ধ্যায় মায়ার পুরোপুরি জ্ঞান ফিরলো, এখন অনেকটাই সুস্থ সে তবুও মাথা তুলতে পারছিলো না, খুব কাঙ্খিত একটা হাতের ছোয়া পেলো যে ওর পালস চেক করছে,কথা মায়াকে উঠে বসিয়ে মুখের কাছে স্যুপ ধরলো মায়া কোনো কথা না বকে খেয়ে নিলো, হুট করে মায়া ওর বা হাতে দিকে তাকিয়ে আতকে উঠলো! ওর হাতের অনামিকায় হিমালয়ের দেওয়া আংটিটা নেই!মায়া এবার কেদে ফেললো ওই একটাই তো জিনিসই তো ছিলো মায়ার কাছে হিমালয়ের দেওয়া! সেটাও, সেটাও হারালো হিমালয় মায়াকে দেখে বলল,
—কেমন আছো মায়া এখন?
মায়া ক্লান্ত কণ্ঠে বলল
—আমার আংটিটা কোথায়!
সাহিত্য পাশে থেকে বললো
—বেচে দিয়েছি তোর চিকিৎসার জন্যে অনেক টাকা খরচ হলো তোর আংটি বেচেই বিল করছি হসপিটালে তোর কোনো সমস্যা?
—সাহিত্য আমার আংটিটা কই?
হিমালয় আবার জিজ্ঞেস করলো,
—তুমি কেমন আছো মায়া?
মায়া আড়চোখে তাকিয়ে হিমালয় কে দেখলো হিমালয় যথেষ্ট শান্ত কন্ঠে কথা বলছে তাও মায়ার গা শিরশির করে উঠলো এটা কোনো ঝড়ের পূর্বাভাস নয় তো!
মায়া তাও অনেকটা সাহস সঞ্চয় করে বলল,
—আপনাকে কেন বলবো? আপনি কি ডাক্তার?
আবির পাশে থেকে বললো
—হুম কালই জয়েন করেছে।
ধ্রুব বললো
—তোমার কি কান্ডজ্ঞান নেই মায়া? কতদিন না খেয়ে থেকে নিজের এই হাল করেছ?
হিমালয় বললো তোরা একটু রুম থেকে যা তো,সবাই বিনাবাক্য ব্যয় করে চলে গেলো,মায়া করুন চোখে সাহিত্যের দিকে তাকালে সাহিত্য ও মুখ ঝামটা মেরে চলে গেলো মায়া এবার কান্না আর আটকে রাখতে পারলো না ওর সাথেই এমন হয় কেন?
—আর ঠিক কতভাবে তুমি একজন মানুষকে মারতে চাও মায়া? এর চেয়ে একবারে মেরে ফেলো,
মায়া মাথা নিচু করে রইলো,
—আমার আংটি টা কই?
—আংটি আংটি করে পাগল হয়ে যাচ্ছো কেন?
—ওটা আমার চাই
—আংটি আমার কাছে।আংটির প্রতি এত দরদ কিসের যখন মানুষ টাই অবহেলিত?
—মানুষ টা তো আর এখন আমার নয়, তাকে আকড়ে ধরার অনেক মানুষ আছে,আমার বেচে থাকার জন্যে ওই আংটিটাই চাইই
—তাহলে মরতে যাচ্ছিলে কেন?
—আমি কেন মরতে যাবো?আত্মহত্যা মহাপাপ
—থাপ্পড় মেরে গাল লাল করে দেবো বেয়াদব মেয়ে আবার কথা প্যাচাও।
—আপনি এখন আর আমাকে থাপ্পড় মারতে পারেন না আপনার থাপ্পড় খাওয়ার অনেক মানুষ আছে
হিমালয় আর কোনো ভুল বোঝাবুঝি বাড়াতে চায় না মায়া কে শিক্ষা দিতে গিয়ে ওর নিজেরই উচিত শিক্ষা হয়েছে,
—ধ্রুব অর্না কে ভালোবাসে কথার বিয়ের দিন একটু দেরী করলেই ওদের এনগেজমেন্টটা দেখে যেতে পারতে, কিন্তু তুমি তো তা করবে না, তুমি তো তাই করবে যা তোমার মন চায়?
—মানে কি!?
—মানে বোঝার ক্ষমতা আছে তোমার?
মায়া মাথা নিচু করে বললো
—নষ্ট হয়ে গেছে আমার সব ক্ষমতা এত ক্ষমতা আমার নেই,যার হুট করে বিয়ে ঠিক হয় আর ঠিক বিয়ের দিন জানতে পারে না তার বিয়েটা হবে না, বাড়ি থেকে পালাতে হয়,যে মেয়েটা একজনকে পাগলের মত ভালোবাসে তাকে ছাড়া একটুও থাকতে পারে না সেই ভালোবাসার মানুষটার ভালো থাকার জন্যে যখন হাজারটা গড়া স্বপ্ন ভেঙে ফেলতে হয়,একই ঘরের দরজা আটকে যখন মা ছেলে দুজনেই পা ধরে বসে সসম্পূর্ণ ভিন্ন আবেদন নিয়ে আসে,সবচেয়ে কঠিন সময়ে পাশে থাকা মানুষটার যখন দূরারোগ্য অসুখ হয়, ভালোবাসার মানুষ যখন তার সামনে অন্য কাউকে বাচার অবলম্বন বলে তখন আর ওই মেয়েটির বোঝার ক্ষমতা থাকে না।আর থাকে না,
মায়া শব্দ করে কাদতে কাদতে কথাগুলো বলল,হিমালয় মায়ার মাথায় হাত রাখলো সান্ত্বনা দিলো না, এই মেয়েটাকে কি বলবে সে? কি? সে তো সজ্ঞানে কখনো ওকে কষ্ট দিতে চায় নি, কেন ও ছেড়ে গেলো তাই তো হিমালয়ের এত অভিমান হলো।
—আর কেদো না, আংটিটা ফিরিয়ে দেবো
মায়ার চোখ চকচক করে উঠলো
—তবে কথা দিতে হবে আংটির মতো করে আংটিদাতাকেও আকড়ে ধরতে হবে, এক মুহুর্তের জন্যেও কাছ ছাড়া করা যাবে না।
মায়া আহ্লাদে ঠোঁট বাকিয়ে কেদে ফেললো, হিমালয় মুখ এগিয়ে বলল,
—কি রাগ হচ্ছে?
—উহুহ কষ্ট হচ্ছে খুব কষ্ট,
—সব কষ্ট ভুলিয়ে দেবো, তোমার মত করর,এখান থেকে রিলিজ হলে কাজী ডেকে আগে বিয়ে হবে তারপর অনুষ্ঠান হলে হবে না হলে নাই,তোমাকে শক্ত করে বেশে ফেলতে হবে তোমার বড্ড পালিয়ে যাওয়া স্বভাব।
শেষ
সামিয়া খান মায়া