#সে_প্রেমিক_নয়
#Mehek_Enayya(লেখিকা)
#পর্ব ৩১
রাত নয়টা। অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গিয়েছে। এক এক করে সকল অতিথি এসে পরেছে। ইরান সম্পূর্ণ ব্ল্যাক রঙের ড্রেস পড়েছে আজ। ফর্মাল পেন্ট, শার্ট এন্ড ব্লেজার। হাতে ঘড়ি. সেট করা চুল আর মুখে অমায়িক হাসি। রাকিয়া পারে না ছেলেকে কালি দিয়ে ভরিয়ে ফেলে। এখন পর্যন্ত যতগুলো মেয়ে এখানে এসেছে সবাই একবার হলেও ইরানের দিকে তাকাচ্ছে। মনে মনে হিংসায় আনাবিয়াকে নিয়ে জ্বলছে। একজনের সাথে কথা বলছিল ইরান হঠাৎ তার নজর পরে সদর দরজায়। কথার সমাপ্ত ঘটিয়ে সেখানে যায়।
-স্বাগতম হাসিব আলী। আপনার মেয়েকে যে দেখছি না! আসেনি সে?
-আমার মেয়ে দেশের বাহিরে তাই আসতে পারেনি।
ইরান বাঁকা হেসে হাসিবকে বলে,
-আমি তো শুনলাম গতকাল রাতে আপনার মেয়ে ব্যাক করেছে বাংলাদেশে। আবার আমার ভয়ে আসলো না তো?
-আমার মেয়ে তোমাকে কেনো ভয় পাইবে? তুমি বাঘ নাকি ভাল্লুক?
-হতে পারে এর থেকেও ভয়ংকর! থাক বাদ দিন আপনার মেয়ের সাথে উনার অফিসে গিয়েই নাহয় দেখা করে আসবো। ভিতরে আসুন প্লিজ।
হাসিব আলী মুখ গম্ভীর করে ভিতরে চলে যায়। তনুসফা শাড়ী ধরে হাঁটতে হাঁটতে ইরানের সামনে আসে। সহসা বলে,
-তোমার স্ত্রী এখনও আসছে না যে? সময় তো হয়ে যাচ্ছে ফোন করে জিজ্ঞেস করো কোথায় আছে।
-হ্যাঁ।
ইরান ফোন বের করে কয়েকবার কল দেয় আনাবিয়াকে। কিন্তু কল রিসিভ করে না আনাবিয়া। পর পর ছয়বার কল দেয়। আর ছয়বারই শুধু রিং-ই হয়েছে। ইরান এবার চিন্তিত হয়ে যায়। রাকিয়াও চিন্তিত হয়ে বলে,
-বউমা কল ধরছে না?
-না।
-তুই তাহলে নিয়ে আয় বউমাকে।
-ঠিক আছে।
ইরান ফোন পকেটে ভরে বড় বড় পা ফেলে বাহিরে বের হতে নেয়। মুখ্য দরজায় আসতেই সে দেখতে পায় আনাবিয়ার গাড়ি মাত্রই এখানে এসে পৌঁচেছে। আনাবিয়া নিজের ড্রেস ধরে ধীরেসুস্থে বের হতেই ইরান এগিয়ে যায়। চাঁপা স্বরে বলে,
-ফোন কোথায় তোমার আনাবিয়া?
-ফোন আনতে ভুলে গিয়েছি।
-এতো দেরি হলো কেনো? তুমি জানো কত টেনশনে পরে গিয়েছিলাম আমি।
-তৈরি হতে সময় লেগেছে। আপনাকে অপেক্ষা করানোর জন্য ভীষণ দুঃখিত আমি।
-এসো।
রাগে ইরান এতক্ষন আনাবিয়ার দিকে ভালোভাবে তাকায়নি। এখন পূর্ণ দৃষ্টি দিয়ে আনাবিয়াকে দেখতেই ধমকে যায় সে। রয়েল ব্লু রঙের লং গাউন পড়েছে আনাবিয়া। গাঢ় নীলের মধ্যে সাদা সাদা চকচকে ছোট ছোট পাথর গুলো জ্বলজ্বল করছে। ইরান আগেই বলেছিল সম্পূর্ণ শরীর ঢাকা ড্রেস পরিধান করতে হবে। আনাবিয়া সেই কথার মর্যাদা রেখে। বড় হাতাআলা, গলা বন্ধ, কাঁধ থেকে জমিন পর্যন্ত কায়ায় আবরণ জরিত। চুলগুলো মেসি বান করা তার ওপর সাদা পাথরের একটি ক্র্যাউন। মুখে মেকআপ, আর সিম্পল কিছু জুয়েলারি। আনাবিয়া ইরানের চাহনি দেখে মাথা নিচু করে ফেলে। ইরান কিছু বললো না। আনাবিয়ার এক হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে সামনে আগায়।
আনাবিয়া ইরান ভিতরে প্রবেশ করতেই সকল প্রকার বাতি বন্ধ হয়ে যায়। শুধু তাঁদের দুইজনকে আকর্ষণ করে বাতি জ্বালানো হয়। সকলে বড় বড় চোখ করে দুইজনকে দেখছে। কেউ কেউ ভীষণ মুগ্ধ হচ্ছে আবার কেউ কেউ জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে। কয়েকজন ভাবছে এতো সুন্দরী স্ত্রী যদি তারা পেতো! আবার কয়েকজন বলছে ইরানের মতো স্বামী হলে আর কী লাগে! সবাই এক জায়গায় আর তনুসফা শেখ অন্য জায়গায়! খুশি হওয়ার চেষ্টা করেও খুশি হতে পারছে না সে। রাকিয়া তনুসফাকে বলে,
-কত সুন্দর লাগছে ওদের একসাথে! কারো নজর লাগুক।
-নজর লাগবে না আম্মা। নজর লাগবে না।
আনাবিয়ার মুখ থেকে হাসি জেনো সরছেই না। অথচ কিছুক্ষন আগে এই মেয়েটা কত যন্ত্রনাই না সহ্য করেছিল! দেখে বুঝার উপায় নেই। আনাবিয়ার সর্বপ্রথম নজর যায় ওপরে দাঁড়ানো তনুসফা শেখের দিকে। গম্ভীর মুখ করে তাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে সে। আনাবিয়া নিজের ড্রেস ধরে ওপরে যায়। এতদিন পর রাকিয়াকে দেখে জড়িয়ে ধরে।
-কোনো পুতুল লাগছে তোকে আজ!
-ধন্যবাদ মম। তোমাকেও অনেক সুন্দর লাগছে।
-আমি তো একটা জিনিস নিয়ে ভয় পাচ্ছি ভীষণ ভাবে!
-কী সেই জিনিস আম্মা?
-এখানে এতো ভালো মানুষের সাথে না জানে কত খারাপ মানুষও আছে! তোদের ওপর যাতে কারো খারাপ নজর না লাগে।
আনাবিয়া মুচকি হাসে। আড়চোখে তনুসফার দিকে তাকিয়ে শান্ত কণ্ঠে বলে,
-যেখানে ঘরেই শত্রু সেখানে বাহিরের শত্রু তো বিলাসিতা মাত্র! তাছাড়া এখন পর্যন্ত কেউ আমাদের সম্পর্ক নষ্ট করতে পারেনি সেখানে মানুষের খারাপ নজরে নষ্ট হবে এটা ভাবা ভুল মম
-একদম ঠিক বলছে আনাবিয়া। তুমি নিশ্চিতে থাকো আম্মা।
রাকিয়া মাথা নারায়। ইরান আনাবিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে,
-তুমি এখানে থাকো আমি নিচে যাই।
-হুম যান।
ইরান চলে যায়। আনাবিয়া তনুসফার সামনে যেয়ে দাঁড়ায়। তনুসফা নজর লুকানোর চেষ্টা করে। আনাবিয়া বড় একটি হাসি দিয়ে বলে,
-সিস্টার ইন লও আমাকে সুন্দর লাগছে না? আপনার দেওয়া গিফট-ই পরিধান করেছি।
তনুসফা আনাবিয়ার কানের দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে ফেলে। তনুসফা বুঝতে পারছে না এই কানের দুল পরেও আনাবিয়া কিভাবে এতো স্বাভাবিক আছে! আনাবিয়া আলগাস্থে জড়িয়ে ধরে তনুসফাকে। তনুসফার কানে কানে বলে,
-আপনি চালাক তনুসফা শেখ তবে আমার থেকে কম। আপনার সেই চুলকানি পাউডার ওলা ইয়াররিং আপনার রুমেই পেয়ে যাবেন। এখন স্বামীর বড় বোনের কথা অমান্য করতে পারি! ইসস না না। আমি আবার সংস্কারি বউ। তাইতো আপনার দেওয়া গিফট-ই পরেছি।
আনাবিয়া সরে যায়। তনুসফা বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করে,
-তোমার কথার মানে কী? কানের দুল আমার রুমে কিভাবে যাবে? আর তোমার কানেই তো আমার দেওয়া দুল।
-উম আমার কানে আপনার দেওয়া ইরাররিং নয় তবে হ্যাঁ আপনার দেওয়া ডিজাইনের ইরার রিং। আপনারটা আপনাকে ফেরত দিয়ে আমি সেম ডিজাইনের নিজের জন্য আনিয়েছি যাতে আপনি কষ্ট না পান ডিয়ার সিস্টার ইন লও।
আনাবিয়া শেষের কথাটা একটু অভিনয় করে বলে। তনুসফা একটু ভীত হয়ে যায়। আনাবিয়ার মুখের হাসি মিলিয়ে যায়। গম্ভীর ও জেদি কণ্ঠে বলে,
-যদি এই খবর আমার হাসব্যান্ড এবং আপনার একমাত্র ভাই ইরানের কানে যায় তাহলে আপনার কী হবে ভাবতে পেরেছেন তনুসফা শেখ? ইরানের প্রিয়তমা স্ত্রী যাতে ফাঙ্কশনে না আসতে পারে তাই তারই আপন বোন ষড়যন্ত্র করে তার স্ত্রীকে গিফট এর নাম করে ভয়ানক ইরাররিং দিয়েছে! ইরান এটা শুনলে বিষয়টা আসলেই ভয়ংকর এবং এনজয়বেল হবে। তাই না?
তনুসফা চোরা চোখে আশেপাশে তাকায়। আনাবিয়া ধীর কণ্ঠে তনুসফাকে বলে,
-আজ আমার জীবনের অনেক বড় এবং স্পেশাল একটি দিন তাই আপনি বেঁচে গেলেন। কিন্তু এর ফল আপনি পাবেন।
আনাবিয়া ইরানের ইশারা নিচে নেমে যায়। ইরান সকলের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় আনাবিয়াকে। সকলেই আমাবিয়ার রূপে মুগ্ধ। তনুসফা মূর্তির মতো কিছুক্ষন ওপরে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর কাউকে কিছু না বলেই চলে যায় সে। অনেক বেশি হাসি-মজা, নাচগান, খাওয়া-খাওয়ীর মধ্য দিয়ে ফাঙ্কশন শেষ হয়। রাকিয়া শেখ বাসায় যাবেন। কিন্তু কোনো জায়গায়ও তনুসফাকে খুঁজে না পেয়ে বিচলিত হয়ে পরেন সে। ইরান আনাবিয়াকে জিজ্ঞেস করে,
-তুমি একা বাসায় যেতে পারবে না ড্রাইভারের সাথে?
-অবশ্যই। আপনি মমকে দিয়ে আসুন।
-ঠিক আছে। তুমি বাসায় যেয়ে ফ্রেশ হয়ে ঘুমিয়ে পরো কেমন? আমার হয়তো এক দুই ঘন্টার মতো সময় লাগবে ফিরতে।
-এতো সময় কেনো?
-আম্মাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে এসে এখানে আসতে হবে কিছু কাজে তারপরই বাসায় যাবো।
-ওকে।
___________________🌸
রাত বারোটায় বাসায় আসে আনাবিয়া। নিজের রুমে এসে অবাক হয়ে যায় সে। আনাবিয়ার পিছনে পিছনে দুইজন ভৃত্যও এসেছিল মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে তারা। আনাবিয়া ভিতরে প্রবেশ করার আগে তাঁদের দিকে তাকিয়ে ইমপ্রেস হয়ে বলে,
-আপনারা একদম আমার মনের মতো সাজিয়েছেন রুম। আমার অনেক বেশি পছন্দ হয়েছে।
-ধন্যবাদ ম্যাম। আমাদের স্বার্থ আপনার পছন্দ হয়েছে।
-তাজীব ব্রো সময় মতো সব কিছু এনে দিয়েছিল?
-জি ম্যাম। কাঁচা জেসমিন এবং গোলাপ ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে পুরো রুম। এবং আপনার কথা মতো সাদা রঙের মশারি কাপড় টাঙানো হয়েছে বিছানা ও তার আশেপাশে। যেগুলোর মধ্যে জেসমিন ফুলের সুবাস আছে।
-জাস্ট অ্যামেজিং। বলুন আপনারা কী চান?
ভৃত্য দুইজন একজন আরেকজনের দিকে তাকালো। নত হয়ে বলে,
-ম্যাম আমাদের কিছু চাওয়ার নেই আপনার থেকে।
-ওকে। যেদিন আপনাদের কিছু চাওয়ার হবে সেদিন আমার থেকে চেয়ে নেবেন তাহলে?
-ঠিক আছে ম্যাম। এখন আমাদের কাজ কী?
-আমাকে তৈরি হতে সাহায্য করবেন।
আনাবিয়া ড্রেস চেঞ্জ করে ওয়াশরুম চলে যায়। শাওয়ার নিয়ে লাল রঙের ব্লাউজ এবং পেটিকোট পরে বেরিয়ে আসে সে। আয়নার সামনে যেয়ে দাঁড়িয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নিজেকে পরোক্ষ করে নিলো। বিছানায় লাল এবং সাদা রঙের দুইটি শাড়ী রাখা ছিল। যেটা সে ওয়াশরুম যাওয়ার আগে বের করেছে। দুইটা শাড়ী ভালোভাবে দেখে লালটা পছন্দ হয় তার। জামদানি শাড়ী। অনেক বেশি পাতলা যেটা বাসায় পরাই শ্রেয় বাহিরে নয়। আনাবিয়া একজন ভৃত্যকে বলে,
-আমার ব্লাউজের ফিতেটা লাগিয়ে দিন একটু।
-জি ম্যাম।
একজন এগিয়ে এসে লাগিয়ে দেয় ফিতে। আনাবিয়া জহুরি দৃষ্টিতে তাঁদের দিকে তাকায়। তার সমবয়সী হয়তো মেয়েদুটো। একজন হয়তো তার থেকে বয়সে ছোট। আনাবিয়া স্বাভাবিক হয়ে বলে,
-আমি বুঝতেছি না আপনারা এভাবে আঁকড়ে দাঁড়িয়ে আছেন কেনো? আমাকে ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই।
-ম্যাম মালকিনদের থেকে একটু ভয় তো হয়ই।
-ভুলে যান আমি মালকিন ধরুন আমি আপনাদের বান্ধবী। সরি তোমাদের। আমার এখানে কোনো ফ্রেন্ড নেই তোমরা হবে তো?
দুইজন খুশি হয়ে যায় আনাবিয়ার কথা শুনে। উৎফুল্ল হয়ে বলে,
-অবশ্যই হবো ম্যাম।
-তাহলে ম্যাম বলছো কেনো আনাবিয়া বলো।
-না ম্যাম আপনার নাম ধরে ডাকতে পারব না।
-ওকে। তোমরা আমাকে আপু বলবে ঠিক আছে? আমার মনে হয় তোমরা আমার ছোট।
-জি ম্যাম আমার সতেরো বয়স আর ওর বিষ।
আনাবিয়া আয়নার সামনে বসলো। কথার ফাঁকে ফাঁকে তৈরি হতে লাগলো।
-আমি বুঝেছিলাম তোমাদের বয়স এমনই হবে। কিভাবে এখানে এসেছো?
-ও এতিম। আর আমার বাবা আরেক বিয়ে করার পর মা জেদ করে আমাকে এক খারাপ লোকের কাছে বিক্রি করে দেয় টাকার জন্য। তখন একদিন স্যারের সাথে দেখা হয় আমার। সব কিছু বলার পর সে আমাকে এখানে নিয়ে আসে। গ্রামের মেয়ে আমি। অশিক্ষিত ছিলাম। স্যার দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়িয়েছিল তারপর আর পড়তে চাইনি আমি।
আনাবিয়া মন দুঃখিত হয়ে যায় ওদের কথা শুনে। মনে মনে ভীষণ রাগ হলো তার ওদের মা বাবার ওপর। শান্ত কণ্ঠে বলে,
-হতভাগা সেই মা বাবা যারা তোমাদের মতো রাজকন্যা পেয়েও হারিয়েছে!
-আমরা আবার রাজকন্যা!
-নাম কী তোমাদের?
-শিখা এবং আরসি।
-শোনো শিখা, সকল মেয়েই রাজকন্যা। কয়েকজন আছে যারা জন্মগত রাজকন্যা আবার কয়েকজন আছে তাঁদের কষ্ট করে, আপ্রাণ চেষ্টা করে, নিজের বুদ্ধি ঘাঁটিয়ে রাজকন্যা হতে হয়।
-আপনাদের মেয়ে একজন সত্যিকারে রাজকন্যা হবে ম্যাম।
-যদি তার কিসমতে হয় তাহলে হবে। আর ম্যাম বলতে বারণ করেছি কিন্তু!
-সরি আপু।
কথায় আনাবিয়া তৈরি হয়ে যায়। মুখে বিন্দুমাত্র সাজ নেই তার। লাল রঙের শাড়ী। গলায়, কানে, হাতে ও মাথায় টাটকা ফুলের গহনা পরিধান করেছে এই মাত্র সাজসজ্জা। আরসি আনাবিয়াকে দেখে চমকিত হয়ে বলে,
-আপনি অনেক বেশি সুন্দর আপু।
-তুমিও সুন্দর।
-আপু আপনার কানের জ্বালা কমেছে?
শিখার কথায় আনাবিয়া ভাবনায় ডুবে যায়। ফাঙ্কশনে যাওয়ার আগে তনুসফার দেওয়া ইরাররিং পরে সে। কয়েক মিনিটের মধ্যে হঠাৎ করেই তার কান ভীষণ চুলকাতে থাকে। চুলকাতে চুলকাতে একসময় কানে ঘা হয়ে যায়। আনাবিয়া ইরাররিং গুলো ঝটপট খুলে ফেলে। এবং সেইসময়ই বাসায় ডাক্তার আসতে বলে। ডাক্তার আনাবিয়ার কান দেখে বলে এটা একটা বিষাক্ত চুলকানির পাউডারের জন্য এমন হয়েছে। কয়েকটা মলম দিয়ে যায় সে। আনাবিয়া রাগে বসলো না। ডাক্তার যাওয়ার পর পর সেও বেরিয়ে পরে বাসা থেকে। একটা বড় জুয়েলারির দোকানে গিয়ে সেম একই ইরাররিং কেনে। আর তনুসফার দেওয়া ইরাররিং একজন বডিগার্ড এর সাহায্য তার বাসায়ই পাঠিয়ে দেয়।
-আপু?
শিখার কথায় ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসে আনাবিয়া। মৃদু হেসে বলে,
-আমি ঠিক আছি।
হঠাৎ আনাবিয়ার নজর যায় বিছানার কিনারে রাখা প্যাকিং করা একটি বক্সের ওপর। চমকিত হয়ে জিজ্ঞেস করে,
-ওটা কী?
-আপনার যাওয়ার পর কেউ একজন আপনার নামে পার্সেল পাঠিয়েছিল। এটাই সেটা।
-নিশ্চই ইরান পাঠিয়েছে। তোমরা তাহলে এবার যাও গিয়ে ঘুমিয়ে পরো।
-ঠিক আছে।
তারা চলে যেতেই বাতি নিভিয়ে দেয় আনাবিয়া। মম জ্বালিয়ে আলোকিত করে দেয় পুরো রুম। ইরান তাকে এতো বড় একটি সারপ্রাইস দিয়েছে তাহলে তারও তো উচিত তাকে কোনো সারপ্রাইস দেওয়া! তাই আনাবিয়া এটা পরিকল্পনা করেছে। শাড়ী ধরে ধীরেসুস্থে বিছানায় যেয়ে বসে সে। পার্সেলটা হাতে নিয়ে আনমনে লাজে রাঙা হয়ে যায় সে। এক এক করে রেপিং পেপার খুলে ফেলে। ততটা বড় নয় বক্স। কী হতে পারে এটার মধ্যে? আনাবিয়া এক্সসাইটেড দমিয়ে রাখতে পারল না। দ্রুত বাক্সটা খুলে ফেলে। দুইটা কাগজ হয়তো লেটার আর একটা মেমোরি টাইপ কোনো একটা জিনিস। আনাবিয়া ভ্রু কুঁচকায়। প্রথম একটা কাগজ হাতে নেয়। সেটায় লেখা ছিল,
“আজ তোমার এই বিশেষ দিনকে চলো একটি বিষাক্ত দিন বানিয়ে দেই!”
ইতি
সিক্রেট পারসন।
আনাবিয়া উক্ত উক্তিটির মানে বুঝলো না। মাথায় শত খানেক প্রশ্নের মেলা নিয়ে দ্বিতীয় চিঠিটি হাতে নেয়।
“এমপি ইরান শেখ তোমার অতি প্রিয় একজন মানুষ। তোমার মতে সে তোমার কাছে খোলা বই অথচ ইরানের মতে তুমি তার শুধুই শত্রু! ঠিকই আছে শত্রুর মেয়ে আপন কিভাবে হয়। তাই না? তুমি কী জানো তুমি যে উদ্দেশ্যে এই দেশে এসেছো সেই উদ্দেশ্য তোমার অতি নিকটে। তোমার পরিবারের হত্যা ইসরাফ করেনি বরং ইরান করেছে। ইসরাফ বেচারা! সে তো মুখে মুখে ভিলেন। তোমার জীবনের আসলে ভিলেন তোমার স্বামী, প্রিয়তম ইরান শেখ। ইরানই তার বাবার ডান হাত ছিল। বাবার থেকে প্রতিশোধ নিতে সে সবসময় তার সামনে ভালো থাকার অভিনয় করত। ইসরাফ মারামারি করলেও আজ পর্যন্ত একটা খুনও সে করেনি। ইরান কতজনকে মেরেছে সে নিজেও জানে না। বাবার কথা রাখতে কানাডা থেকে এসে ইরান তন্নী ফারুকের মার্ডার করে। জানো তোমার থেকে বড় হতভাগা ও আনলাকি ব্যক্তি এই দুনিয়াতে নেই। অনেক আপসোস হয় আমার তোমার প্রতি আনাবিয়া। আমি জানি তুমি বুদ্ধিমান মেয়ে। সামনে যা করবে নিশ্চই ভেবে চিন্তে করবে।”
আনাবিয়া স্তব্ধ। পর পর আরো কয়েকবার মনোযোগ দিয়ে চিঠিটা পড়ে। চারভাগে বিভক্ত করে দেয় চিতিটা। তারপর ছুঁড়ে নিচে ফেলে দেয়। চিঠির নিচে কয়েকটা ছবিও ছিল। আনাবিয়া কাঁপাকাঁপা হাতে ছবি গুলো হাতে নেয়। ইরান আর তার মা কোনো এক অফিসে বসে কথা বলছে আর কেউ লুকিয়ে ছবি গুলো তুলেছে। আনাবিয়া পাগল প্রায়। বিছানা থেকে নেমে ইরানের ল্যাপটপ বের করে। মেমোরি ভিতরে ঢুকাতেই একটা ভিডিও অন হয়। কাউকে দেখা যাচ্ছে না তবে কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে। আনাবিয়া তার মায়ের কণ্ঠস্বর শুনতে পেলো।
-ইরান শেখের কলিজা দেখছি তার বাপের মতোই ছোট! মরার ভয় থাকলে আমার কাজে বাঁধা দিও না।
-আমার মরার ভয় নেই তবে আমি সামনে আপনার মৃত্যু দেখতে পাচ্ছি।
-একজন সিআইডি অফিসারকে মরার ভয় দেখাচ্ছ! তোমার এই কথা গুলোর ভিডিও করে যদি আমি পুলিশদের দেখাই তাহলে কী হবে ভাবতে পেরেছো?
-বললাম তো ভয় নেই আমার। আর আমার বাবার শত্রুদের কিভাবে সরাতে হয় এটা আমার জানা আছে।
-ঠিক আছে। তুমি তাকে বাঁচানোর প্রয়াস করো আর আমি জেলে ভরার প্রয়াস করি।
-শেষবারের মতো ওয়ারিং দিচ্ছি পিছনে সরে যান।
-সেম টু ইউ।
-ওকে এখন আপনার সাথে যা সেটার জন্য আপনি নিজেই দায়ী।
বন্ধ হয়ে যায় ভিডিও। আনাবিয়ার শরীর বরফের মতো জমে আছে। লড়াচড়া করার মতো শক্তিও পাচ্ছে না সে। নিজেই নিজেকে বিড়বিড় করে বলে,
-আনাবিয়া তুই ইরানকে খারাপ ভাববি না। এইরকম নকলি ভিডিও অহরহ বানানো যায়। তোর ইরান কখনই কাউকে মারতে পারে না সে একজন ভালো মানুষ। তুই নিজেকে স্ট্রং রাখ আর ইরানের ওপরে ভরসা রাখ।
বিছানায় গুঁটিসুটি হয়ে বসে আছে আনাবিয়া। কিছুক্ষন আগে যে চেহারায় লাবণ্যময় ছিল এখন সেই চেহারায় ভীতর ছাপ। একই ভঙ্গিতে বসে থাকে আনাবিয়া। ইরান বাসায় এসেছে। ফোনে কারো সাথে কথা বলতে বলতে নিজের রুমে আসে। কল কেটে ফোন পকেটে রেখে সামনে তাকাতেই চোখ বড় বড় হয়ে যায় তার। প্রিয় ফুলের সুবাস মো মো করছে রুমের চারপাশে। এক পা দু পা হেঁটে বিছানার কাছে যায় আনাবিয়াকে দেখে কিছু সময়ের জন্য নিঃশাস নিতে ভুলে যায় সে। আনাবিয়া আড়চোখে ইরানকে দেখছে।
ইরান আনাবিয়ার নিকটে যেতে নেয় হঠাৎ কিছু মনে পরতেই দূরে সরে যায়। চুলে হাত বুলিয়ে বলে,
-আমি আগে শাওয়ার নিয়ে আসি তারপর কথা হবে।
আনাবিয়া মাথা নারায়। ইরান ড্রেস নিয়ে ওয়াশরুম চলে যায়। এই সময়ের মধ্যে আনাবিয়া সেই চিঠির অংশ, ছবি আর মেমোরি একটা সিক্রেট জায়গায় লুকিয়ে ফেলে। নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে। যদি ইরান দোষী হয় তাহলে তাকে হাতেনাতে ধরে শাস্তি দিতে হবে। আর যদি নির্দোষ হয় তাহলে সত্যিকারের দোষীকে খুঁজে বের করতে হবে।
>>>>চলবে।