#গল্পপোকা_ছোটগল্প_প্রতিযোগিতা_নভেম্বর_২০২০
গল্প:সামিরার ডায়রী
লেখনীতে:রেজওয়ানা ফেরদৌস
ক্যাটাগরী: রোমান্টিক থ্রিলার।
বাসর রাতেই আমার স্বামী মারা যান।পরে জানতে পারলাম উনি ব্লাড ক্যানসারের রোগী ছিলেন।ছেলেপক্ষ তরিঘরি বিয়ে দিতে চেয়েছিল বংশ রক্ষার আশায় যদিও ডাক্তার সময় বেঁধে দিয়েছিল কিন্তুু ওপরওয়ালার অন্য কিছুই মর্জি ছিল।
যা হোক আমার আর বাসরের আদোর সোহাগ কপালে জুটল না।আমি কলঙ্কিনি কঙ্কাবতী হয়েই রয়ে গেলাম শ্বশুরবাড়িতে।
মাসখানেক পর বাবা মা আবারও আসলেন বাড়ি ফিরিয়ে নিতে অবশ্য বিয়ের পরদিনই ওনারা মেয়েকে ফেরত নিতে এসেছিলেন কিন্তুু তখন শোকের ছায়ামহল।আত্মীয়স্বজনরা আর পরশীরা সবাই বলতে লাগল থাকুক না আর দুচারটে দিন।আমারও ভিষন খারাপ লাগছিল অসহায় বুড়ো শ্বশুর শ্বাশুড়িকে দেখে।আমার স্বামীই ছিলেন ওনাদের একমাত্র সন্তান!
আমাদের চারবোনের সংসারে আমিই বড়।শ্যাম বর্ণের মাঝারি গড়নের টানাটানা চোখের ছিপছিপে আমি।পিঠ ছড়ানো একরাশ চুল কোমর ছাড়িয়ে যা আজকাল চোখেই পড়েনা।তবুও আমার বোনদের ধবধবে ফর্সা মুখশ্রী,তাদের লম্বাটে গড়ন অবিকল আমার মায়ের মতন! আমার চেহারা পাত্রপক্ষের কাছে বরাবরই ছিল ডাউনমার্কেট।ছেলেপক্ষ দেখতে আসলেই আমি রিজেক্ট হয়ে যেতাম।বোনদের জন্য সম্মন্ধ আসতে লাগল আর আমার জন্য আটকে যেত।বুঝতাম বিয়ের সুন্দর ধারাবাহিকতার বিশাল ট্রাফিক সিগনাল আমি।
শুধু বাবা একটু বেশিই যেন আমাকে ভালোবাসতেন।বাবার জামা জুতো সব গুছিয়ে রাখতাম আমি।সকালে চা বানানো থেকে রাতের রান্না,ছোট বোনদের কার কি নাস্তা চাই বিকেলে,মায়ের চুলে বিলি কেটে দেওয়া সবটাতেই আমি।আর একটা জগত আছে আমার ছাদবাগানের ফুলগাছেরা।মনখারাপ হলেই আমি ছুটে যেতাম আমার হাসনাহেনার কাছে সব কিছুই বলতাম।আমার হাতে লাগানো দোলোনচাঁপা,কখনও বা কাঁঠগোলাপ,রক্তজবা এমনকি গাঁদা ফুলের গাছগুলোও আমার দুঃখ জমা করে নিত অনায়াসে!
খুব সাজতে ভালোবাসি আমি।সেই ছোট্ট বেলাটি থেকে আশেপাশের বাচ্চারা মিলে রান্নাবাটি খেলতাম আর একটা সংসারের স্বপ্ন দেখতাম!সব চুর চুর করে ভেঙ্গে যাবে এভাবে,কখনই ভাবিনি!
ফিরে এলাম বাবার বাড়ি সব কিছুই আবার আগের মতন।শুধু বুকের ভেতরটায় কি যেন একটা খচ্ খচ্ করতে লাগল।আবার ভার্সিটির ক্লাস করা শুরু করলাম।দেখতে দেখতে মাস গেল বছর গেল।আমার পরের ছোট বোনটার সম্মন্ধ বেশ কয়েকবার ফেরত দেওয়ার পর যখন অনেক বড় ঘর থেকে সম্বন্ধ আসল তখন মা মত দিলেন কিন্তুু বাবা তখনও আমতা আমতা করলেন।
সেদিন বাবা আমার সাথে একা কথা বলতে চাইলেন বললেন সুমি চল ছাদে যাই।বাবাকে পাঠিয়ে এক কাপ চা বানিয়ে বাবার পাশে গিয়ে বসলাম।অনেক্ষণ চুপ থাকার পর বাবা বলে উঠলেন সুমি মা তোর একটা প্রস্তাব এসেছে। আমি আকাশ থেকে পড়লাম! বাড়িশুদ্ধ সবাই জানে আমার ছোট বোন সুরাইয়ার জন্য প্রস্তাব এসেছে।
বাবার কাছে জানতে পারলাম যে ছেলে সুরাইয়াকে প্রস্তাব দিয়েছে সেই ছেলেটার সাথেই সুরাইয়ার দুবছর ধরে সম্পর্ক।ওরা সবটাই জানে।সেই ছেলেরই খালাতো ভাইয়ের পক্ষ থেকে প্রস্তাব এসেছে আমার বিয়ের।ব্যাপারটায় সুরাইয়া আর তার হবু বরের হাত আছে বলেই আমার মনে হল।কারণ আমার বিয়ে না দিয়ে আমার ছোট বোনের বিয়ে দিতে বাবা মা কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না।
“আমাকে মাফ করে দিস মা!আমি তোর জীবনটা তছনছ করে দিলাম!!”এই বলে
বাবা আমার হাতদুটো ধরে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন আমি তখন মনে করতে পারছিলাম না পাথরের মতো বলিষ্ঠ,গাঢ় এলাকার মানুষদের মত কালো রংয়ের আমার সবচেয়ে প্রিয়মানুষ,আমার বাবাটাকে আমি কি বলে সান্তনা দিব!বাবা কেএভাবে শিশুদের মত কাঁদতে আমি কখনই দেখিনি!
জানতে পারলাম আমার সাথে যার বিয়ে ঠিক হয়েছে ওনারও বউ মারা গেছে ছয়-সাত মাস হলো।ছবি দেখলাম ভদ্রলোকের ভিষন রকমের রোগা,ফুলহাতা সার্টেও বোঝা যাচ্ছে।বিশেষত্বহীন মাঝারি গড়নের,মাঝবয়সি সাদাসিধে মানুষ বলেই আমার মনে হলো।তবে চোখ দুটো শুধু ব্যাতিক্রম। মনে হলো হায়না অথবা চিল-শকুনের তীক্ষ্ণ চাহুনি।যেন বুকের ভেতরটা চিঁড়ে খুবলে বের করে নিয়ে আসবে আমার হৃতপিন্ডটাকে!
একই দিনে বিয়ে হয়ে গেল দুই বোনের।আমি পা রাখলাম আমার দ্বিতীয় স্বামীর সংসারে।যেহেতু ছেলেপক্ষ থেকে বিয়ের আগে কথা বলা,এনগেজমেন্ট,হলুদ কোন কিছুই ওরা চায়নি।এদিকে আমারও একমাত্র লক্ষ ছিল বিয়ে করে বাবা-মা কে রেহাই দেই।তাই ছেলে কি করে কেমন কোন কিছুই আমি জানতেও চাইলাম না। বাবামা কে শুধু ছোট্ট করে বলে দিলাম আমি রাজি।
সেই চোখ বন্ধ করে রাজি হওয়াটাই যে আমার জীবনে কাল হয়ে দাঁড়াবে তা কল্পনাও করিনি!
কি হলো ঘুমাবে না?
সিয়ামের ডাক শুনেই ডায়রীটার ফিতা রেখে বন্ধ করে দিলাম।
আমি আর আমার হাজবেন্ড গত পাঁচমাস যাবত এই বাসাটায় আছি।
ভূতের বাড়ি বলে খ্যাত এই বাড়িটা খুব সস্তায় পেয়ে যাই।সিয়াম অফিস থেকে লোন নিয়ে কিনে নেয় এই বাড়িটা।
বাড়ির সদস্য বলতে আমি আর সিয়াম।বিশালাকায় ডুপ্লেক্স এই বাড়িটায় একটা গা ছমছমে ভাব আছ ঠিকই।কিন্তুু আমি খুবই সাহসী টাইপের একটা মানুষ।
বিয়ের বছরখানেক পর দুমাস হলো এই বাড়িটায় উঠেছি।বাড়ির বায়না করা হয়েছে।সিয়াম বলল এত তড়িঘড়ির কিছু নেই তো।কাগজ পত্র সব ঠিক হোক,বাড়ি ঘষামাজা করে নিই,রং করাই তারপরেই উঠব।একদম বাচ্চাসহ।কিন্তুু বাসা দেখতে এসেই আমার আর তর সইল না।কেমন যেন রহস্যময়!
বাড়ির মালিক থাকেন অস্ট্রেলিয়ায়,এখানকার ম্যানেজার ভদ্রলোক বললেন বাসা তো খালিই পড়ে আছে।উঠে পরুন যখন খুশি।
প্রচুর আসবাবপত্রে ঠাসা বাসাটার আন্ডারগ্রাউন্ডও আছে। ওখানের স্টোররুম থেকেই আজ ডায়রীটা আবিষ্কার করেছিলাম।
…………………………………………………………………………
একদল মানুষরুপি দুপেয়ে হায়না আমাকে তাড়া করছে।তাদের সবার সামনের জনের হাতে একটা বড়সড় চাপাতি।রুদ্ধশ্বাসে দৌড়চ্ছি আমি পেছনে শিকারির দল।চিৎকার করছি কিন্তুু গলা দিয়ে কোন আওয়াজই বের হচ্ছে না।চাপাতি হাতের শকুন চোখের গালভাঙা লোকটা বিকৃত ক্রুর হাসিতে আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল।
ঘুমটা ভেঙে গেল আমার।পাশেই বেঘরে ঘুমুচ্ছে সিয়াম।ঘেমে গেছি আমি, প্রচন্ড পানির তেষ্টায় গলাটাও শুকিয়ে কাঠ।আমি ডাকলাম
এ্যাই সিয়াম!সিয়াম
উঁহুঊ
উঠনা,পানি খাব।
নাহ্ উঠল না ও।
বড় দেয়াল ঘড়িটায় পেন্ডুলাম দুলছে।জলজলে লেখা আবছা আলোতেও জানান দিচ্ছে পোনে তিনটা।পাশ টেবিলটায় রাখা জগটায় চোখ পড়ল।নাহ্ পানি নেই একফোঁটা।রুম থেকে বেরিয়ে একপা দুপা ফেলে সিঁড়ি ভাঙতে শুরু করলাম।মুচুড় মুচুড় শব্দ তুলে নিরবতা কাটছিল কাঠের সিঁড়িগুলো।মনে হল প্রতিবার পা ফেলার সময় দুবার করে শব্দ হচ্ছে তার মানে কেউ আসছে আমার পিছন পিছন।আচমকা তাকালাম পিছনে নাহ্ কেউ নেই।গভীর রাতের নিস্তব্ধতার জন্যই বোধ করি এমনটা লাগছে!
ডাইনিং টেবিলের কাছে দৌড়ে যেয়েই গ্লাসে পানি ঢাললাম।দ্রুত মুখ ভরে পরপর দুই ঢোক পানি নিয়ে গিলে ফেললাম।আবার একটু পানি মুখে নিতেই কেমন যেন নোনতা আর পঁচা মাংসের একটা গন্ধ পেলাম পানিতে।মুখ থেকে ঝুপ করে পানিটা ছিটকে ফেলে দিলাম মেঝেতে।তাকিয়ে দেখলাম চাপ চাপ লাল রক্ত সেখানে!
হঠাৎ গালের মধ্যে কি যেন ফোঁটা ফোঁটা পড়ার মত অনুভব করলাম,চটচটে ঠান্ডা কি যেন পরল উপর থেকে।উপরে তাকিয়ে দেখলাম সেই দুটো চোখ নিষ্পলক তাকিয়ে আমারই দিকে,মাগো………..
…………………………………………………………………..
চোখ মেলেই দেখলাম সিয়ামের উদ্বিগ্ন মুখ ঝুকে আছে আমার ওপরে।দারুণ দেখতে ও আমার পুরো বিপরীত।টকটকে ফর্সা লালচে গায়ের রং,ভিষন চোখা নাক আর মায়াময় দুটোচোখের আকর্ষণীয় সুপুরুষ।গুমগুমে কন্ঠস্বর আর লম্বায় প্রায় ছফুটের মতন বাইরে কোথাও বেরুলে আমাকে না দেখে ওকেই দেখে সবাই।
তুলে বসিয়ে দিল আমাকে পিঠে একটা বালিশ দিয়ে হেলানি দিয়ে বলল কেমন লাগছে এখন?
ভালো।
কি হয়েছিল আমার?
কিছুনা।ভয় পেয়েছিলে মনে হয়।আমাকে ডাকলে না কেন?চিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলে ভয়েই!
কিছু ওষুধপত্র আর স্যালাইন চলল।আজ দুপুরে আবার বসলাম ডায়রীটা নিয়ে।দরজাটা বন্ধ করে দিলাম ভেতর থেকে।একজন বয়স্ক ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলা আর তাদের পনের- ষোল বছরের একটা মেয়ে সারাক্ষন আমার চারপাশে ঘুরঘুর করছে।তাদের আদোরের অতিসয্যে একগ্লাস পানি ঢেলে খাবার উপায় নেই।
ডায়রীটা খুলে পড়তে শুরু করলাম পরের থেকে:
বাসরঘরে ঘোমটা টেনে বসে আমি কখন আসবে সে!হঠাৎই ফোনটা বেজে উঠল।ফোন ধরলাম কি হয়েছে আম্মু এত রাতে!
আম্মু কান্না ভরা কন্ঠে বলল মা রে সুরাই পালিয়েছে।
জামাই বাবাজি ফোন করেছিল একটা চিঠি লিখে রেখে গেছে যে ওর পছন্দের ছেলের সাথে পালিয়েছে।
আমার বিস্ময়ের সীমা রইল না!আম্মু কি বল এইসব ওর পছন্দের ছেলের সাথেই তো বিয়ে হলো ও পালাবে কেন?
জানি না কিচ্ছু বুঝতে পারছি না।
আব্বুর কন্ঠস্বর শুনতে পেলাম,আম্মুকে ধমক দিচ্ছে,তুমি আবার কোন্ আক্কেলে সুমিকে ফোন করছ।
মা তুই এত চিন্তা করিস না তো………রাখলাম এই বলে আব্বু ফোন কেটে দিলেন।
আমি খাটের ওপর একা বসে ছটফট করতে লাগলাম কি করি কি করি!
দরজায় খুট করে শব্দ হতেই ঘোমটা আরও খানিকটা টেনে চুপ করে বসে রইলাম।নতুন মানুষকে তো আর হুট করে বোন পালানোর কথা বলা যায় না আবার মনের উথালপাথাল ঝড় বইছে!
সে এসেই সোজা আমার হাত ধরে টেনে হেঁচড়ে দরজার কাছে নিয়ে গেল।ফিসফিস করে বলল চল আমাদের পালাতে হবে।দুদিন পরে আমাদের ফ্লাইট।
কিসের ফ্লাইট কি বলে এইসব!মুখটা তুলে তাকাতেই পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেল আমার!যেন ভূত দেখলাম।আরে এত আমার মৃত স্বামী!
তাহলে কি আমিই মরে গেছি!
চল তাড়াতাড়ি কর সময় নেই।একটা ঝটকা দিয়ে হাতটা ছাড়িয়ে নিলাম।কি করছেন?কে আপনি?আপনি না ক্যান্সারে মারা গিয়েছেন।
সব পরে বলব বেঁচে থাকলে সব জানতে পারবে।এখন কোন কথা নয়।সে আমাকে টানতে লাগল।আমি কিছুতেই তাকে ভরসা করতে পারছিলাম না।
তাকে একটা ধাক্কা মেরে আমি বেরিয়ে গেলাম দরজার বাইরে।তারপর ধুপধাপ করে নামতে লাগলাম সিঁড়ি দিয়ে।নিচের তলায় এসে থমকে দাঁড়ালাম,দেখলাম একটু দূরেই একটা বিবস্ত্র -বিভৎস লাশ পড়ে আছে।শরীরটার বিভিন্ন অংশে খুবলানো গর্ত আর দাগ।সমস্ত শরীর জুড়ে চাপ চাপ লাল রক্তে ভরা।কাটামাথাটায় চোখ পড়লে এবার হিম হয়ে গেল আমার পুরো শরীর।মনে হলো আমাকে কেউ যেন পাথর করে দিয়েছে!নড়তে পারলাম না।সুরাইয়ার সুন্দর মুখটা পরে আছে রক্তে মাখামাখি শরীরটা আলাদা।
কতক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলাম জানি না।সম্বিত ফিরে পেলাম যখন দেখলাম চাপাতি হাতে তীক্ষ্ম চোখের ঐ লোকটা কোত্থেকে যেন সুরাইয়ার পাশে এসে দাঁড়াল তারপর আমার আদোরের বোনটার রক্তাত্ব শরীরটায় একটা লাথি মেরে বিদঘুটে কুৎসিত হাসিতে তাকাল আমার দিকে।
আমার তখন কি হয়েছিল জানি না।মাথায় খুন চেপে গেল বোধহয় ততক্ষণে বুঝতে পারলাম আমার প্রথম স্বামী আমাকে জাপটে ধরে আছে।তার কোমরের দিকে একটা রিভলবার গোঁজা চোখে পরল।আলত হাতে ছাড়িয়ে নিলাম তাকে।কিচ্ছু চিন্তা করলাম না একটানে তুলে নিলাম রিভলবারটা শরীরের সর্বশ্ব শক্তি দিয়ে গুলি করলাম সামনের লোকটাকে!সে হয়ত এতটা আশা করেনি।আমি নিজেও বুঝতে পারিনি অত ভারী একটা রিভলবার জীবনে প্রথমবার হাতে নিয়ে চালাতে পারব তাও আবার নিশানা অব্যার্থ হবে!
চাপাতি হাতে ধরেই দড়াম করে পড়ে গেল লোকটা।কপালটা ফুটো করে এফোড়-ওফোড় করে দিয়েছিলাম।
কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছিলাম।চারপাশের সব কিছু ঝাপসা লাগছিল,একটুও কেঁদেছিলাম বলে মনে পড়ে না।কানদুটো শো শো করছিল।আমার একটা হাত কার যেন একটা হাতকে শক্ত করে আকড়ে ধরা পরম বিশ্বাসে।কে যেন আমাকে ছুটিয়ে নিয়ে চলেছে এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে এ রাজ্য থেকে সেই রাজ্য।
শ্বশুর আব্বা আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন আজ।খুব মনে পড়ছে সরুকে।শুধু আমার স্বামী আর আমি ছাড়া কেউ জানে না কি হয়েছিল তার।ও আরেকজন জানেন আমার পুলিশের আই জি চাচা শ্বশুড়।উনিই এই কেসটার সবটা সামলেছিলেন।আইন বলে সেই গুলি খাওয়া লোকটা আর তার সাঙপাঙরা ক্রসফায়ারে নিহত।এদের মধ্য সুরাইয়ার স্বামীও ছিল।যাকে আমার রূপসী বোকা বোনটি ভালোবেসেছিল অন্ধের মত হৃদয় উজাড় করে।
মেলবর্ণ থেকে দেশে এসেছিলাম অসুস্থ শ্বশুরকে দেখতে।খুব মনে পড়ছে সুরাইয়া কে।ঐ বাসার ঠিকানা নিলাম আমার স্বামীর কাছ থেকে।আজ যাব ওখানে।আমার পার্স ব্যাগে সবসময় থাকে আমার ডায়রীটা।আজকাল কেউ ডায়রী লেখে না।কিন্তুু আমার ভিষন প্রিয়। একদিন টুপ করে মরে যাব তখন আমার হয়ে কথা বলবে এই ডায়রী।
…………………………………………………………………………
ড.গোপীনাথ রায়ের চেম্বার তিনি সিয়ামের মুখোমুখি বসেছেন।
তোমার স্ত্রীর রোগটা আমি ধরতে পেরেছি।তার বোন সুরাইয়ার মৃত্যু ছিল প্রচন্ড ভয়াবহ,নৃশংস এবং মর্মান্তিক।যা কিনা সে নিজের চোখে দেখেছে।প্রচন্ড মানুসিক চাপ তাকে প্রভাবিত করেছে খুবই ধীরে ধীরে।তোমরা যখন দেশের বাইরে বিদেশ বিভূঁইয়ে ব্যস্ততম দিন অতিবাহিত করেছ।দুজনে রাতদিন এক করে অর্থ উপার্জন করেছ,বেচে থাকার তাগিদে নিজেদের টিকিয়ে রাখার তাগিদে তখন সামিরার অবকাশ ছিল না সুরাইয়াকে নিয়ে ভাববার।কিন্তুু গত বছর যখন তোমরা দেশে ফিরলে তোমার অসুস্থ বাবাকে দেখতে এবং উনি চলে গেলেন পরপারে তখনই এই মৃত্যুটা ভিষনভাবে নাড়া দিল সামিরাকে।একটু থামলেন বেটেখাট করে ড. গোপীনাথ।মগে রাখা পানি খেয়ে ভিজিয়ে নিলেন গলাটা।
যা বলছিলাম,আবার বলতে শুরু করলেন গোপীনাথ,তোমার বাবার মৃত্যুটা সাংঘাতিক প্রভাব ফেলল সামিরার মস্তিষ্কে নাড়া দিয়ে টেনে নিয়ে গেল সুরাইয়ার মৃত্যুর কাছে।সামিরা প্রবলভাবে চেষ্টা করল ভুলে থাকতে।মস্তিষ্ক ভুলে গেল কিন্তুু বাধ সাধল মন।ঘুরে ঘুরে স্বপ্নে আসতে লাগল এবং মনকে করে তুলতে লাগল বিক্ষিপ্ত।সেখান থেকেই শুরু হলো তার অসুখটা।
কিন্তুু ও তো আমি ছাড়া কাউকেই চিনতে পারছে না এমনকি ওর বাবা-মাকেও না।আমার শ্বশুর-শ্বাশুড়ি আর সবচেয়ে ছোট শ্যালিকা বেশ অনেকদিন যাবৎ আমাদের সাথে আছে।সুরাইয়ার ছোট বোন সুজানার যখন বিয়ে হয় তখন আমরা মেলবর্নে ছিলাম ,ভালোই আছে ও।বলল সিয়াম।
হুমম্ জানি,আমি কয়েকটা সেশনে কথা বলেছি সামিরার সাথে,বললেন গোপীনাথ।ও নিজের মত করে একটা জগৎ সাজিয়ে নিয়েছে মনে মনে যার অধিকাংশই সামিরার অলিক কল্পনা।
কিছুটা ভেবে বললেন গোপীনাথ,
যেমন ধর, এই বাড়িটা তুমি নতুন কিনেছ যা খুবই রহস্যময়,ভূতুড়ে বাড়ি।তোমাদের অল্প কিছুদিন হলো বিয়ে হয়েছে,কখনও ভাবছে পাঁচমাস হলো এ বাড়িতে উঠেছে কখনও ভাবছে দুমাস।কিন্তুু মানব মস্তিষ্কের বৈচিত্র্যের যে গোলকধাঁধায় সে আটকে গেছে তা থেকে বেরুতে পারছে না।
আর ডায়রীর ব্যপারটা?
ডায়রীটা আমি পড়েছি।কিছু জিনিস মিলিয়ে নেবার জন্যই তোমাকে ডেকেছি সিয়াম।
এখন তুমি গোড়া থেকে আমাকে বলবে।ডায়রীটা অসমাপ্ত,ডায়রীটা যে সামিরার ডায়রী এবং ও নিজেই লিখেছিল এ ব্যাপারে আমার কোনই সন্দেহ নেই।সামিরা নিজেই কোন এক সময় ওর অবচেতন মনে ডায়রীটা ফেলে গিয়েছিল তোমাদের বাড়িটায়। খুব সম্ভবত গত বছর যখন তোমরা দেশে এসেছিলে।
একটু ভেবে নিয়ে বলল সিয়াম,ও হ্যা বাড়িটার ঠিকানা চেয়েছিল আমার কাছে সামিরা তখন।
সিয়াম কথা না বাড়িয়ে বলতে শুরু করল।খুব ছোটবেলায় আমি আমার মাকে হারিয়েছি।বাবা দ্বিতীয়বার বিয়ে করলেন বেশ অনেকগুলো বছর পর।আমার সৎমা আমাকে খুবই আদোর যত্ন করতেন উনি আমাকে টিউসন পড়াতেন।ধীরে ধীরে আমার হৃদয়ের মায়ের শূন্য আসনটায় উনি জায়গা করে নেন।মূলত আমার পীড়াপীড়িতেই বাবা রাজী হন দ্বিতীয় বিয়েতে।পড়াশুনা শেষ করেই আমি বাবার ব্যবসা সামলাতে লাগলাম।
অফিস যাবার পথে একদিন গাড়ি নষ্ট হয়ে গেল ড্রাইভারকে বললাম সারাতে।দেরি দেখেই চড়ে বসলাম একটা লোকাল বাসে।প্রচন্ড ভিড় ছিল বাসে বসার জন্য কোন সিট না পেয়ে দাঁড়িয়ে ঝুলে ঝুলে যাচ্ছিলাম।
হঠাৎই দেখলাম একটা বড়চুলের মেয়ে একহাতে একটা স্যান্ডেল নিয়ে রোগামত একটা ছেলেকে বেধড়ক পেটাচ্ছে।আর সবাই তাকিয়ে তাকিয়ে মজা দেখছে!
কন্টাকটর হাঁক দিল আফা নিচে নামায় লন আমার ব্যাবসা বন কইরেন না,ওস্তাদ বামে চাপান,ভাড়া জলদি।বাসটা থামতেই লোকটাকে মারতে মারতেই নেমে পড়ল মেয়েটা।আমি জানিনা কি মনে করে আমি ও পিছু নিলাম মেয়েটার।
সেই মেয়েটাই কি তোমার স্ত্রী সামিরা? কাঁচাপাকা দাঁড়ির তলে মুচকি হেসে উৎসুক তাকালেন গোপীনাথ।
হুমম্,বাবা সম্পত্তির উইল করলেন কারণ ওনার বয়স হয়ে গিয়েছিল।মাকে শুধুমাত্র একটা বাংলোবাড়ি লিখে দিলেন।ওনার বিশাল সম্পত্তির সবকিছুই লিখে দিলেন আমার নামে।আমার বিয়ের পর আমার সম্পত্তির সমান অংশিদারিত্ত আমার স্ত্রী,সন্তান পাবে।এমনটাই আমি জানতাম।
আমার বিয়ের পর আমাকে অপহরন করা হয়।অনেকদিন আমি বন্দি থাকি মায়ের নামে লিখে দেওয়া বাংলো বাড়িটায়।বাবা তখন অসহায় বৃদ্ধ।পরে আমার বাবার ছোটভাই আমার আইজি চাচার সহায়তায় আমি বেঁচে ফিরে সামিরাকে নিয়ে বিদেশে চলে যাই।আমি ক্যান্সারে মারা গিয়েছি বলে রটনা ছিল।এর সব কিছুর পিছনে ছিল আমার সৎমায়ের প্রথম পক্ষের ছেলে রাজন।ওর কথা আমাদের কাছে গোপন করেছিলেন আমার সৎ মা।রাজনের নীল নকশা ছিল আমার কাছ থেকে জোর করে সব বিষয়সম্পত্তি নিজের নামে করে নিবে।কিন্তুু তখনও সে জানত না উইল অনুযায়ী সবকিছু আমার স্ত্রীর হবে যদি আমি মারাও যাই।
তাই সামিরাকে খুজেঁ বের করে বিয়ের প্রস্তাব দেয় পরবর্তিতে ,আমার সৎভাই রাজনই ছিল সামিরার দ্বিতীয় স্বামী!
হুমম্ সুরাইয়াকে কে বা কারা হত্যা করল?রাজনের কি হয়েছিল তারপর সুরাইয়ার স্বামী সম্পর্কে কিছু জানতে পেরেছিলে?
ডায়রীর ভাষ্যমতে অনেকটাই আমি আঁচ করতে পেরেছি যদিও তবু তোমার মুখ থেকে শুনে মিলিয়ে নিতে চাই বললেন,গোপীনাথ।আর একটা প্রশ্ন,বাসে যে লোকটাকে সামিরা পিটিয়েছিল সেই কি রাজন?
হতে পারে ।আসলে ঐ মুহূর্তে আমার আকর্ষনের কেন্দ্রবিন্দুতেই ছিল সামিরা!রাজনকে আমি প্রথমবার দেখি একটা বড় চাপাতি হাতে সামিরার দিকে এগিয়ে আসছিল।আমার লাইসেন্স করা রিভলবারটা দ্রুত হাতে তুলে নিয়েছিল ও।তবে নিশানা ঠিক করে গুলি করতে আমিও হাত রেখেছিলাম রিভলভারটায়। সুররাইয়ার সাথে ফেসবুকে পরিচয়,প্রেম এবং পরবর্তীতে বিয়ে হয় কুখ্যাত সন্ত্রাসী বাবুলের সাথে।ভুয়া বাড়ি,প্রচুর ধনসম্পত্তির মিথ্যে প্রেমের ফাঁদ পেতেছিল বাবুল,রাজনেরই নির্দেশে।
আমি আর সামিরা যে বাড়িটাতে এখন আছি এই সব কিছুই ঘটেছিল এ বাড়িটাতে।এ বাড়িটাই ছিল মূলত রাজন আর তার সাঙপাঙদের আস্তানা।সামিরার দ্বিতীয় বিয়ে আর সুরাইয়ার একই দিনে বিয়ে হয়।সুরাইয়াকে বিয়ের পর এখানে নিয়ে এসে বাবুল আর তার সাথিরা গণধর্ষণ করে হত্যা করে।রাজনকে সামিরাই গুলি করেছিল তবে আমিও হাত লাগিয়েছিলাম বলল সিয়াম।
ড.গোপীনাথ প্রায় পনের বিশমিনিটের মত নিরবতা পালন করলেন।দেখ সিয়াম আমি অনেক আশাবাদী তুমি তোমার প্রেম ভালোবাসা দিয়ে সামিরাকে সুস্থ করে তুলবে।কারণ তুমি তোমার ভালোবাসা দিয়ে সৎমাকে আপন মায়ের স্থান দিয়েছিলে।উনি রক্তের সম্পর্ককে তুচ্ছ করে তোমাকে বড় করেছিলেন, নিজের ছেলের জায়গায় তোমাকে বসিয়েছিলেন।ভালোবাসার অনেক শক্তি জান তো।শুভকামনা তোমার আর তোমার ভালোবাসার মানুষদের জন্য।
বেঁচে থাকুক ভালোবাসা,বেঁচে থাকুক সামিরার সংসারের সাধ আর আজন্ম লালিত স্বপনগুলো।
দুঃস্বপ্নদের হারিয়ে দিতে কি পারবে
সামিরার স্বপ্নের নায়ক!!!
সিয়াম শুধু একটু মুচকি হাসল ।
(বিঃদ্রঃএই গল্পের প্রতিটি চরিত্রই কাল্পনিক )