#সংসার
#পর্ব_২১
#লেখিকা_সুরাইয়া_ইসলাম_সানজি।
আমি জেনি আপুকে সেখানে দেখে আঁতকে ওঠে ওঠি। এখন যদি আকাশ ভাইয়াকে লিনা আপুর রুমে জেনি আপু দেখে তাহলে সে কি করবে জানি না। ভয়ে ভয়ে আমিও সেদিকে পা বাড়াই।
৪১.
জেনি আপু দরজায় নক করতে গেলে হালকা করে দরজা চাপিয়ে রাখার জন্য নক করার আগেই দরজা খুলে যায়। ততক্ষণে আমিও জেনি আপুর পাশে এসে দাড়াই।
দরজা খুললে দেখি আকাশ ভাইয়া লিনা আপুর হাত ধরে বসে আছে আর লিনা আপু কাঁদছে। ভাইয়া হঠাৎ আমাদের রুমে ঢুকতে দেখে অপ্রস্তুত ভাবে ওঠে দাড়ায়। আকাশ ভাইয়ার চোখে জল চিকচিক করছে। জেনি আপু গিয়ে মুখে কিছু না বলে আকাশ ভাইয়াকে জোড়ে একটা থাপ্পড় মারায় ভাইয়া দু হাত পিছিয়ে যায়।
ভাইয়া কাছে এসে জেনি আপুর হাত ধরে বলে-
“জেনি শুন তুই ভুল বুঝছিস। শান্ত হ আমি সব বলছি।”
“কি বলবি তুই হ্যাঁ, কি বলবি?”
জেনি আপুর চিৎকার চেঁচামেচি শুনে পাশের রুম থেকে রুদ্র দৌড়ে আসে। জেনি আপুকে বার বার আকাশ ভাইয়া থামাতে চেষ্টা করছে কিন্তু কে শুনে কার কথা।
রুদ্রকে আসতে দেখে আপু তাকেই খ জড়িয়ে ধরে কেঁদে ওঠে।
“রুদ্র আকাশ আমাকে আবার ঠকিয়েছে। ও এই মেয়েটার সাথে রুমে বসে,,,,
আপু আর কিছু বলতে পারে না, ঢুকরে কেঁদে ওঠে।
জেনি আপুর এইটুকু কথা শুনে রুদ্রের চোখ মুখ লাল হয়ে যায়। রুদ্র জেনি আপু নিজের থেকে ছাড়িয়ে আকাশ ভাইয়া সার্টের কলার ধরে বলে-
“সালা বেইমান, তুই জীবনেও শুধরাবি না। তোদের মতো কিছু পুরুষের জন্য পুরুষ সমাজের আজ কলঙ্ক। এত যখন মেয়ে লাগে তাহলে কারো মন নিয়ে না খেলে পতিতালয়ে গিয়ে বসে থাকতি।”
আকাশ ভাইয়া এতক্ষণ রুদ্রকে বোঝানোর জন্য চেষ্টা করলেও, শেষের কথা গুলো শুনে চুপ হয়ে যায়। চোখ থেকে কয়েক ফোটা জল গড়িয়ে পরে।
লিনা আপু এগিয়ে এসে জেনি আপুকে কিছু বলতে চাইলে আপু রাগে লিনা আপুর গালে থাপ্পড় বসিয়ে দেয়।
জেনি আপু আকাশ ভাইয়ার সামনে গিয়ে বলে-
“তোর লিনাকে নিয়ে তোর যেখানে যাওয়ার যা। তবে আমার চোখের সামনে যদি আর একবার আসিস খোদার কসম আমি সুইসাইড করব।”
আকাশ ভাইয়া জেনি আপুর কথায় কেঁপে ওঠে। জেনি আপু আর কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে রুমে এসে দরজা আটকে দেয়।
আমরা তার পিছন পিছন রুমে সামনে এসে দরজা খুলতে বললে খুলে না। হঠাৎ ভিতর থেকে কিছু পরে যাওয়ার শব্দ শুনে সবাই আঁতকে ওঠি। আকাশ ভাইয়ার আর কিছু না ভেবে পিছন দিক থেকে জানালার ওপর ভড় দিয়ে রুমে ডুকে দেখে জেনি আপু ফ্যানের সাথে উরনা বেঁধে প্রায় ঝুলে পরেছে। আকাশ ভাইয়া জেনি আপুকে তাড়াতাড়ি সেখান থেকে নিচে নামাতেই আপু জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।
দরজা খুলে দিতেই সবাই রুমের ভিতর ডুকি। কিন্তু পাশ কেটে আকাশ ভাইয়া রুম থেকে বেরিয়ে যায়।
রাইমা আপু ছিল বলে জেনি আপুর আর ডাক্তারের প্রয়োজন পরেনি।
,
,
আকাশ রিসর্টের দূরে একটা পাথরের ওপর ভাবনাহীন হয়ে বসে আছে। রুদ্র আকাশকে দেখে সেখানে এগিয়ে যায়। পাথরের উপর বসতে বসতে বলে-
“জেনিকে খুব বেশি ভালোবাসিস?”
আকাশ রুদ্রের কথা এড়িয়ে গিয়ে বলল-
“বিশ্বাস কর, আমি লিনার কাছে ইচ্ছে করে যাইনি। আর না তো লিনার উপর কোন টান ও আছে।”
“হুমম আমি বুঝতে পারছি। তোর চোখ যে সে কথাই বলছে। আমার কথায় কষ্ট পাস না, তখন জেনিকে ওই রকম ভাবে কাঁদতে দেখে মাথা ঠিক রাখতে পারেনি।”
আকাশ মাথা নেড়ে হাসার চেষ্টা করে বলে-
“আমি বুজতে পারছি দোস্ত, তোর জায়গায় আমি থাকলে এমনটাই করতাম।”
“কিন্তু কি হইছে, জেনি এমন করল কেন? আর ওই মেয়েটার সাথেই বা তোর সম্পর্ক কী?”
আকাশ এবার একটু হেসে চোখের জল মুছে উপরের দিকে তাকিয়ে বলল-
“তুই তো আমার প্রথম ভালোবাসার কথা জানিস। আর সেই মেয়েটাই হচ্ছে লিনা। ওর সাথে প্রায় চার বছর পর এই দেখা। ওকে এক সময় ভালোবাসতাম কিন্তু তখন আবেগটা বেশি ছিল। ধোকা দিয়ে চলে যাওয়ার পর ফিরে আসে তবুও মেনে নেই। কিন্তু লিনা আবারও চলে যায়। কিন্তু এই বার জেনি ভাবছে আমি এখন আগের বারের মতো লিনার কাছে ফিরে যাব। তুই বল রুদ্র আমার কি এখন আবেগের বয়সটা আছে, আমি কি আবেগ আর ভালোবাসার পার্থক্য বুঝিনা? আমি তো জেনিহীন নিজেকে মানুষ ভাবতেও কল্পনা করতে পারি না।
লিনার ব্লাড ক্যান্সার ধরা পরেছে। ডাক্তার বলেছে ও বড় জোড় কয়েক মাস বাঁচবে। আর তাই নিজেকে হাসিখুশি রাখার জন্য এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। এটা শুনে আমি একটু আবেগ প্রবণ হয়ে পরেছিলাম। জেনিকে বলতে চেয়েও বলেনি এটা ভেবে জেনি প্রথম দেখাই লিনাকে সহ্য করতে পারেনি আর ও এটাও পারবে না।। তাই আমি সকাল সকাল লিনার সাথে দেখা করে চলে আসতে চেয়েছিলাম যাতে জেনি কষ্ট না পায়। লিনা যাই করুক আমার খালাতো বোন তো।
হ্যাঁ একটা সময় ছিলো যখন আমি মেয়েদের মাঝে, খারাপ নেশায় ডুবে ছিলাম। কিন্তু এই যে এতটা বছর জেনির সাথে আছি ও বলতে পারবে আমি ওকেও ছুয়েও দেখেছি আজ কিভাবে ভাবলো ও আমি ওকে রেখে অন্য মেয়ের সাথে থাকবো? ওর এই বিশ্বাস টা কী আমি আজও অর্জন করতে পারেনি?
জেনি কিভাবে পারলো আমাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা? আমার একটু দেরী হলে এতক্ষণে কি হতো ভাবতেই গাঁয়ে কাটা দেয়। সুইসাইড কিভাবে করে ওকে তো আমি বুঝাব আগে একটু ঠিক হতে দে।”
৪২.
কিছুক্ষণ আগে জেনি আপুর জ্ঞান ফিরে। আসে পাশে তাকিয়ে কাউকে খুজে তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলে-
“মেঘ রুদ্র কোথায়?”
আমি আপুর কথায় মুচকি হাসি দিলাম। অভিমানে আকাশ কোথায় বলতে পারছেনা তাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে রুদ্রের কথা জানতে চাইছে।
“এই তো বাহিরে গেছে।”
জেনি আপু একটু হেসে বলল-
“আমার জন্য তোমাদের সবার সমস্যা হলো? সবাই ঘুরতে এসে আমার জন্য ঝামেলা করতে হলো।”
“ওটা ব্যাপার না আপু,ঠিক আছে। কখনো আর এমন কথা ভাববেও না। তুমি ঠিক হলে অনেক ঘোরা যাবে।”
“আমি ঠিক আছি মেঘ। বিকেলে রুদ্রকে বলো ঘুরার প্লান করতে। কোথায় কোথায় যাওয়া যায়, আর একটা দিন বাকি আছে।”
আমাদের কথার মাঝে সেখানে গুটিগুটি পায়ে লিনা আপু এগিয়ে এলো। লিনা আপুকে দেখে জেনি আপু চোখ মুখ কুঁচকে কড়া গলায় বলল-
“মেঘ এই মেয়েটাকে আমার সামনে থেকে যেতে বলো।”
লিনা আপু জেনির আপুর কথাকে গুরুত্ব না দিয়ে আপুর পাশে বসে বলতে শুরু করলো-
” আপু আমাকে ক্ষমা করে দেও। নিজের খুশির জন্য তোমাদের মাঝে এত ঝামেলা হলো। আমি জানতাম না আকাশের বিয়ে তোমার সাথে ঠিক হইছে। আমি শুধু শুনেছি আকাশের বিয়ে ঠিক হইছে। যদি জানতাম তবে কখনোই আকাশের সামনে আসতাম না।
আপু আমি আমার পাপের সাজা পাচ্ছি। যার জন্য দু দুইবার আকাশকে ঠকালাম সে আমার এমন বিপদের সময় ছেড়ে চলে গেছে।”
এই টুকু বলতেই লিনা আপু কেঁদে ওঠল। এতক্ষণে জেনি আপু ক্ষিপ্ত বাঘিনীর মতো চোখ জোড়া শীতল হয়ে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকাল। এমন বিপদ বলতে কি বুঝেয়েছে লিনা, কিসের বিপদ?
চোখের পাশের জল মুছে একটু হেসে বলতে শুরু করলো- “আপু আমাকে ডাক্তার বলছে দুই থেকে তিন মাস বাঁচবো। ব্লাড ক্যান্সার ধরা পরেছে আমার। সে জন্য জীবনের শেষ দিন গুলো নিজেকে দেওয়ার জন্য এদিক সেদিক ছটফট করে ঘুরে বেড়াই। যার সাথে পালিয়ে বিয়ে করেছিলাম আজ ওর টাকা পয়সা সব আছে তবে আমাকে দেওয়ার মতো সময় হয় না। এই টাকা পয়সা সব দিচ্ছি তবে দুইটা দিন আমি ওর থেকে পাইনি। কিন্তু সেসব নিয়ে আফসোস নেই আমার কর্মফল আমাকেই তো ভোগ করতে হবে।
তোমাকে আকাশ অনেক ভালোবাসে। তোমরা একসাথে থাকলে ও খুব সুখী হবে। আমার জীবনের শেষ দিনগুলোই তোমাদের এই সুখী জিবন দেখতে পেরে সত্যিই খুব ভালো লাগছে। ক্ষমা করে দিও আমায়।”
জেনি আপু সব শুনে কান্না করে লিনাকে জড়িয়ে ধরেছি। যে মেয়েটা সকালে একটা মেয়ের জন্য সুইসাইড করতে চেয়েছিল। এখন সেই মেয়েটার জন্য কান্না করছে। কি অদ্ভুত আমাদের মন। আমি আর রাইমা আপু সুপ্ত চোখে তাদের দিকে তাকিয়ে আছি।
,
আমরা সবাই দুপুরে খেয়ে। বেলা দুই টায় দিকে স্বর্ন মন্দিরের উদ্দেশ্যে বের হলাম। সেখানে থেকেবের হয়ে শৈল প্রপাত ঝর্নার দেখতে চলে গেলাম।
আমাদের উদ্দেশ্য ছিলো ঝর্নায় গোসল করা কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখি পাথরের সাথে ঝর্না বেয়ে বেয়ে নিচে পরছে। যেখানে দাড়িয়ে পা ভিজানো গেলেও গোসল করা যাবে না। কিন্তু রাইমা আপু জেদ ধরেই একটু কুয়া টাইপ সেখানে বসে পরল। যার মানে সে গোসল করবেই।
কুয়ায় স্বচ্ছ পরিষ্কার ঠান্ডা শীতল পানি। ঝর্নার পানি পাথর চুপসে কুয়ায় পরছে। কিন্তু সেখানে একজনের বেশি দুজন গোসল করা যায় না। তবুও জেনি আপু আর রাইমা আপু দুজনে সেখানে ভিজছে। আকাশ ভাইয়া এর মাঝে বেশ কয়েকবার জেনি আপুকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে কথা বললেও আপু শুনেও না শুনার ভাব ধরে এড়িয়ে গেছে।
আমি রুদ্র, রাকিব ভাই, আকাশ ভাইয়া ঝর্নার চারপাশের সুন্দার্য দেখছি। পাথরের নিচে একটা বড় কুয়া যেখানে গোসল করা গেলেও রিক্স অনেক। পরে গেল জীবন শেষ। তবুও আমি যেতে চাইলে রুদ্র হাত ধরে রেখে দেয় নিচে যেতে দিবে না তাই।
হঠাৎ রাইমা আপু কুয়া থেকে ওঠে ছটফট করতে থাকে। বার বার জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিচ্ছে। আমাদের জোড়ে জোড়ে জেনি আপু ডাকছে।
রাইমা আপুর চোখ ওল্টে যাচ্ছে। আমরা সবাই ভয়ে সেদিকে দৌড়ে যাই। রাইমা আপু জ্ঞান হারিয়ে দাড়ানো থেকে পরতে নিলে রুদ্র ভাইয়া দৌড়ে ধরতে যায় কিন্তু তার আগেই রাকিব ভাইয়া ধরে নেয়। আমি রাইমা আপুর হঠাৎ কি হইছে ভাবছি। হাত পা শীতল হয়ে চুপসে যাওয়ার আমি আর জেনি আপু হাত পায়ের তালু হাত দিয়ে ঢলছি। আস্তে আস্তে রাইমা আপুর শ্বাস বন্ধ হয়ে যায়।
আমি মুখের ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। কি থেকে কি হয়ে গেল। সবার জীবনের সুখ যে বেশি দিন টিকে না।
#চলবে,,,,,,,