শত্রু শত্রু খেলা পর্ব-০৯

0
636

#শত্রু_শত্রু_খেলা
#পর্ব_৯
#মেঘা_সুবাশ্রী (লেখিকা)

রাঢ়ী, নীল, শ্রাবণের কোনো ভাবাবেগ নেই। ওরা জেনো জানতোই এমন কিছু হবেই। তাই তাদের মুখে শুভ্র কোমল হাসি বিভাসিত হচ্ছে।

লুবনা অথৈজলে ডুবন্ত নাবিকের মত ছটপট করছে। বক্ষস্থলে র*ক্তক্ষরণ হচ্ছে, তার না হওয়া প্রেমিক তাকে এভাবে ছ্যাকা দিল। তার হাত-পা ছড়িয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। মনে মনে সে সৌরভকে নিয়ে গানও গাইতে শুরু করলো।

“ও পাষাণী কেনো ভালোবাসোনি?
মুছে দিয়ে যাও তুমি চোখের পানি।”
(আসিফ)

পিউর আর ফুচকা খাওয়া হলো না। সে সৌরভকে আর একটা সু্যোগ দিতে এসেছিল। আবার তাকে আপন করতে চেয়েছিল। কিন্তু সৌরভ তাকে সেই সুযোগটাই দিলো না। মনের কষ্ট চে*পে সে উঠে দাঁড়ালো। গটগট পায়ে সেই জায়গা দ্রুত ত্যাগ করলো।

রাঢ়ী মুখ টিপে হেসে যাচ্ছে। যাক তার পরিকল্পনা সফল হয়েছে।

___________________

কিছুদূর যেতেই আচমকা সৌরভ বাইকের ব্রেক কষলো।

প্রিয়ার কোনো হেলদোল নেই সে চুপচাপ বসে আছে। কিন্তু মনের মধ্যে রাগের পারদ থরথর করে বাড়ছে তবে এই জোকারের মতলবটা কি তার জানা দরকার। এভাবে সবার সামনে তাকে উডবি বলার কারণ তাকে বলতে হবে। তার আগে এর পিছু ছাড়ছে না সে।

আচম্বিত সৌরভ বলে উঠল কি ব্যাপার বলো তো? তোমার আজকে কোনো রাগটাগ লাগছে না। আমি তোমাকে বললাম তুমিও চলে আসলে।

প্রিয়া স্মিথ হাসলো। কোনো ভণিতা ছাড়াই বললো,

আমি আপনার উডবি হই না। আপনি বলবেন আর আমি আসবো না তা’কি হয়?

সৌরভ চমকে উঠলো। লাফ দিয়ে বাইক থেকে নামলো। তারপর ধীরে ধীরে প্রিয়ার একদম মুখের সামনে আসলো। চার-পাঁচ ইঞ্চি ব্যবধান শুধু তাদের মধ্যে।

সৌরভের এত কাছে আসা দেখে প্রিয়া আত*কিত হয়ে পড়লো। সৌরভের মতিগতি তার কাছে ভালো ঠেকছে না। এই সার্কাস তার সাথে কি করতে চাইছে?

সৌরভ প্রিয়ার দিকে পূর্ণদৃষ্টি রেখে নেশালো গলায় বলল,

‘মাশাআল্লাহ’

তোমার ঐ দুটি অধর এতো মোহনীয় কেনো প্রিয়ারানী? একদম রক্তজবার ঐ লালচে পাপঁড়ির মতো। ইচ্ছে করছে ঐ অধরে নিজেকে ভাসিয়ে দিতে। কিন্তু?

প্রিয়া তাজ্জব বনে গেছে সৌরভের এহেন বাক্যে। অস্থির হয়ে ঠোঁটের উপর হাত চে*পে রেখেছে। লজ্জায় আর অস্থিরতায় বার বার শুকনো ঢোক গিললো।

প্রিয়ার এমন অস্থিরতা দেখে সৌরভ শরীর ঝাঁকিয়ে হো হো করে অট্টহাসিতে ফে*টে পড়লো। পুনরায় সে আবার তার কাছে গিয়ে এক ভ্রু উঁচিয়ে বলল,

কি ভাবছিলে আমি এটাই বলবো? তারপর বাঁকা হাসি দিয়ে বললো নামো আমার বাইক থেকে। মনে আছে কি বলছিলে আমাকে, আমি পাবলিক টয়লেট তাই না! তোমার পিছনে তাকাও তো একবার প্রিয়ারানী।

প্রিয়া চকিতে মুখ ঘোরালো। বড় বড় অক্ষরে দেয়ালের মধ্যে খোদাই করে লিখা ‘পাবলিক টয়লেট’। প্রিয়া ভেবে পায়না নিছক মজার ছলে বলা কথার জন্য তাকে পাবলিক টয়লেটের সামনে এই জোকার নিয়ে এসেছে। ভাবতেই গা ঘিন ঘিন করছে তার।

সৌরভ বাঁকা হেসে আবার বলে উঠল,

আমাকে পাবলিক টয়লেট বলার শা*স্তি এইটা, বুঝলে! নামো এখন আমার বাইক থেকে। এবার থেকে নেক্সটাইম কিছু বলার আগে দুই হাজারবার ভাব্বে।

প্রিয়ার মেজাজ চটে গেল। এই সার্কাস আসলেই একটা জোকার। এত বড়ো অপমান করলো তাকে। ছিঃ! কিন্তু সেও হার মানার পাত্র নয়। কর্কশ গলায় চেঁচিয়ে বললো,

আমি নামব না। কি করবেন আপনি? বাইকে উঠানোর সময় মনে ছিলো না তখন।

সৌরভ কুঠিল হাসলো। ঠিক আছে তোমার মর্জি। তারপর প্রিয়ার কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,

আমার দু’হাত তোমার কোমরে রেখে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে তারপর ধীরে-সুস্থে বাইক থেকে তোমাকে নামাবো। তখন আমার বুকে তুমি একদম হরিণ ছানার মত গুটিশুটি মেরে লেপ্টে থাকবে। আমার তপ্ত নিশ্বাস তোমার ঘাড়ে গিয়ে বার বার আঁচড়ে পড়বে। তুমি লজ্জায় বাঁকানো লতার মত নুয়ে পড়বে। চলবে।

প্রিয়া আর কোনো বাক্য বিনিময় না করেই আমতা আমতা করে বললো,

থাক আপনাকে আর কষ্ট করতে হবে না। আমি নিজেই নেমে যাচ্ছি।

সৌরভ আর একমূহুর্তও দেরি করলো না। শুধু যাওয়ার আগে একবার তার দিকে তাকিয়ে বললো গুড গার্ল। সবসময় আমার কথা শুনবে। বাই প্রিয়ারানী।

প্রিয়ার রাগে পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে। জোকার এইভাবে তার ব*দলা নিলো। আশেপাশে চোখ বুলালো এখানে তেমন মানুষ নেই। কিছুটা শঙ্কিত সে কিন্তু তার চোখ আটকালো পাবলিক টয়লেটের গায়ে একটা লিখা দেখে,

যৌন সমস্যায় ভুগছেন, কোনো ব্যাপার না আমাদের কাছে আছে স্বপের ঔষধ। নিমিষেই আপনার সমস্যা উধাও হয়ে যাবে। চাইলে আপনারা আমার বাড়ি এসেও চিকিৎসা নিতে পারেন। আপনার পরিচয় সম্পূর্ণ গোপন রেখে কাজ করা হবে। নতুবা নিচের নাম্বারে যোগাযোগ করুন। ০১৮৭১**

প্রিয়া লিখাটা দেখে কুটিল হাসলো। তারপর ব্যাগ থেকে মার্কার বের করে খচ খচ করে সৌরভের নাম্বারটা বসিয়ে দিলো পাশে। আগের নাম্বারটা মুছে দিলো। দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ সৌরভের নাম্বারটার দিকে তাকিয়ে আনমনে মিটমিট করে হাসলো।

আহ্! বেচারা আজ থেকে শান্তির ঘুম দিতে পারবে না।
_____________

বাসায় প্রবেশ করতেই মারিয়ার মুখ কেমন হাস্যেজ্জ্বল দেখাচ্ছে। পাশেই আনোয়ারও খুব প্রানোবন্ত। প্রিয়া জিজ্ঞেস করবে ভেবেও জিজ্ঞেস করলো না। তাকে দেখে মারিয়াই বলে উঠল এত দেরি হলো যে আজকে?

প্রিয়া অতি সন্তপর্ণে জবাব দিলো দুপুরবেলায় রিকশা পাইনি তাই দেরি হয়ে গেছে। এজন্য অনেকটা হেটে আসছি আজকে। এখন তো আমার খিদে লাগছে প্রচুর।

যা ফ্রেশ হয়ে আয় আমি ভাত বাড়ছি। আমরাও তোর জন্য অপেক্ষা করছিলাম এতক্ষণ।

প্রিয়া দ্রুত কদম বাড়ায় নিজের রুমের দিকে। কিন্তু রুমে গিয়ে যা দেখে তাতে খুশির চোটে এক চিৎকার দেয়। মারিয়া আর আনোয়ার মিট মিট করে হাসে মেয়ের এমন কান্ডে।

আচমকা চিৎকার শুনে প্রীতি ভয় পেয়ে যায়।বুকে বার কয়েক থু থু দেয়। প্রিয়া দৌড় দিয়ে এসে ঝাপ্টে ধরে প্রীতিকে। দু’জন দুজনকে জড়িয়ে ধরে হু হা করে চিৎকার করতে লাগলো।

প্রীতি শেষে বললো বইন এবার ছাড় দেয় গরম লাগের। প্রিয়া ছাড়লো তবে প্রশ্ন করতে দেরি হলো না। কখন এলি তুই?

প্রীতিও জটপট জবাব দিলো দুপুরেই।

প্রিয়া তো হেব্বি খুশি নিজের সমবয়সী খালাতো বোনকে পেয়ে। প্রীতি প্রিয়াকে তাড়া দিলো জলদি ফ্রেশ হ। তোর জন্য অপেক্ষা করতে করতে পেটের ক্রিমি মরে গেলো সব।

প্রিয়া হাসতে হাসতে বাথরুমে গেলো।

খাবার খেয়ে সবাই সবার রুমে চলে গেছে। প্রীতি, প্রিয়াও নিজের রুমে বসে আছে। দু’জন অনেকদিন পর একসাথে হয়েছে তাই গল্পের ফোয়ারা শেষই হচ্ছে না।

ঘড়ির কাটায় তখন বিকেল ৫টায়। গল্পে মশগুল হয়ে কখন দুজন ঘুমিয়েছে টেরই পায়নি। মোবাইলের কর্কশ শব্দে প্রিয়ার ঘুম ভেঙে যায়। নিদ্রাঘোরে তখনও বুঝতে পারে না কে কল দিয়েছে? রিসিভ করে কানে দিতেই হুঁশ আসে তার।

ওপাশ থেকে ফ্যাচ ফ্যাচ করে কান্নার শব্দ আসছে। অস্পষ্ট বেদানার্ত সুরে বলে উঠল আমার সাথে দেখা করতে পারবি?

প্রিয়া আৎকে উঠে লুবনার কান্নাজড়িত কন্ঠস্বর শুনে। তড়িঘড়ি উঠে বসে ভালো করে শোনার জন্য। তারপর জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে লুবনা? কাঁদছিস কেনো?

লুবনা নিরুত্তর থাকে। মুখে বার কয়েক একটা কথায় আওড়ালো,

বাসার বাইরে একটু আসবি। আমি তোদের গ্রেটের সামনেই আছি।

প্রিয়া স্তব্ধ হয়ে গেলো লুবনার কথা শুনে। এই মেয়েটার হঠাৎ হয়েছে টা’ কি? দুপুরেও তো ভালো ছিলো। মুখের কোণে উজ্জ্বল হাসির আভা দেখা গিয়েছিল। কিন্তু কি এমন হয়েছে যার জন্য মেয়েটা তাকে তলব করছে। ধরফড়িয়ে বিছানা ছেড়ে নেমে পড়ে।

প্রিয়া ত্বরিতগতি নেমে আসে বাসার নিচে।

লুবনাকে উদ্বাস্তুর মত লাগছে। ভীষণ অবলা অসহায়ের মত তাদের বাসার সদর দরজায় দাঁড়িয়ে আছে সে। প্রিয়া হতবিহ্বল লুবনার এমন দৈন্যদশা দেখে। কি হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই মেয়েটা ঝর ঝর করে চোখের পানি ছেড়ে দেয়। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল লুবনা। কান্নাজড়িত কন্ঠে তার কথা অস্পষ্ট যা বোঝার সাধ্য নেই প্রিয়ার। তবুও অনেক কষ্টে বোঝার চেষ্টা করলো সে লুবনা কি বলতে চাই।

লুবনার বার কয়েক আওড়ানো বুলি শুনে থমকে যাই প্রিয়া।

তোর আর সৌরভের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে কখন? কিন্তু আমি যে সৌরভকে অনেক আগে থেকে পছন্দ করি প্রিয়া।

লুবনা এইটুকু বলে থেমে যায়। কান্নার ফোঁপানো আওয়াজ ছাড়া দ্বিতীয় আর কোনো কথা সে বলতে পারে না। প্রিয়া নিজেই নিস্তব্ধ হয়ে যায় লুবনার কথা শুনে। কি সান্ত্বনা দেবে তার জানা নাই। লুবনাকে শান্ত করতে বলল,

তুই যে সৌরভকে পছন্দ করিস, সেটা তিনি জানেন?

লুবনা না বলে মাথা দোলায়। তার মানে সৌরভ জানে না। প্রিয়া ভালই মসিবতে ফেসেছে। এই লুবনাকে কিভাবে বুঝাবে মাথায় আসছে না। তখন বললো তোর কাছে সৌরভের নাম্বার আছে।

লুবনা হ্যাঁ বলে মাথা দোলায়। প্রিয়া বলে যা তুই ফোন করে তার সাথে কথা বল। তোর মনের কথা জানা দেখনা কি হয়?

লুবনা ব্যথিত গলায় বলল সৌরভের সাথে তোর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে এখন কি সে আর আমার সাথে কথা বলবে?

প্রিয়া লুবনাকে জড়িয়ে ধরলো। কানের কাছে ফিস ফিস করে বললো ঐগুলো যাষ্ট মজা করে বলছে। আমার থেকে প্রতি*শোধ নিতে। আমি তাকে পাবলিক টয়লেট বলেছি তাই? আমার আর সৌরভের বিয়ে ঠিক হয়নি। আর না হবে?

প্রিয়ার কথা শুনে মূহুর্তে লুবনার মুখের আদল পরিবর্তন হয়ে গেল। তার চোখে-মুখে তৃপ্তির হাসি, আনন্দিত হয়ে বললো সত্যিই!

প্রিয়া হ্যাঁ বলে মাথা নাড়ালো।

লুবনা আত্মতুষ্টির একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। খুশিতে গদগদ হয়ে বললো ঠিক আছে আমি এখন বাসায় যাই কাল কলেজে দেখা হবে।

লুবনাকে বিদায় জানিয়ে মাত্রই সে বাসায় ঢুকতে যাবে তখন দেখে সৌরভও বাসায় ঢুকছে। প্রিয়াকে দেখে মিষ্টি একটা রহস্যময় হাসি উপহার দিলো।

প্রিয়া বিরসমুখে দাঁড়িয়ে আছে। এই জোকার আজকাল তাকে দেখে এমন করে হাসে কেনো?

চলবে,,,,,,,,,,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে