শত্রু শত্রু খেলা পর্ব-১০

0
443

#শত্রু_শত্রু_খেলা
#পর্ব_১০
#মেঘা_সুবাশ্রী (লেখিকা)

প্রকৃতিতে এখন বসন্তকাল হলেও সন্ধ্যোর পর থেকে দমকা হাওয়াসহ ভারী বৃষ্টিপাত হচ্ছে। ক্ষণে ক্ষণে বজ্রপাতসহ বিজলিও চমকাচ্ছে। চারদিকে বাতাসের শো শো শব্দের প্রতিধ্বনি হচ্ছে। বৃষ্টির পানির ছিঁটে পড়ার কারণে দরজা জানালা সব বন্ধ করে নিজ কাজে মনোযোগ দিয়ে বসে আছে সৌরভ। পড়ার স্তূপ পড়ে আছে তার সামনে। আজকাল তারও পড়তে ইচ্ছে করে না। কিন্তু না চাইলেও পড়তে হবে তাকে। এটাই তার একাডেমিক জীবনের শেষ পড়া। পূর্ণ মনোযোগের সাথে সে বইয়ের মধ্যে ডুবে আছে।

দৈবাৎ ভো ভো কম্পিত শব্দে তার মোবাইল কেঁপে উঠলো। সৌরভ চমকালো। এই অবেলায় থাকে কল দিলো কে। নাম্বার দেখে ভ্রু কুঁচকালো এই নাম্বার সে চিনে না। প্রথমবার অগ্রাহ্য করলেও শেষে রিসিভ করলো কোনো প্রয়োজনীয় কল ভেবে। কিন্তু মেয়েলী কন্ঠ ভেবে থমকালো। নিজেকে ধাতস্থ করে প্রশ্ন করলো,

কাকে চাই?

অপর পাশের কম্পিত কন্ঠস্বর। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল আমি কি আপনার সাথে একটু কথা বলতে পারি ভাইয়া।

প্রয়োজনীয় হলে বলতে পারেন। অপ্রয়োজনীয় হলে রেখে দিন। আমার অতো সময় নেই আপনার সাথে গল্প করার।

আপনি কাউকে পছন্দ করেন?

মেজাজ চটে গেলো সৌরভের। কোথায় থেকে আসে এই আকাইম্মাগুলা? আমি কাকে পছন্দ করবো আর কাকে করবো না সেটা কি এদেরকে বলতে হবে না’কি? তিরিক্ষি মেজাজে বললো,

হাও রিডিকিউলাস! আমি প্রথমেই বলেছি প্রয়োজনীয় হলে কথা বলুন নয়তো রেখে দেন। আপনার ঐ প্রশ্নের জবাব দেয়ার প্রয়োজন আছে বলে তো মনে হচ্ছে না। এটা একান্তই আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। এবার ফোন রাখতে পারেন। আর হ্যাঁ, দ্বিতীয়বার কল করবেন তো কথা বলার মতো অবস্থায় আপনি থাকবেন না। মনে থাকে যেনো। ‘ইডিয়ট’

অপর পাশের মেয়েটির অপেক্ষা করলো না। সে নিজেই কল কেটে ফোন বিছানায় ছুড়ে ফেললো। মেজাজ শান্ত করতে বারান্দায় ছুটে গেলো। বৃষ্টির মধ্যে যদি নিজের রাগ পানি হয়ে ধুয়ে যায়।

বারান্দায় বসে বৃষ্টির মধ্যে নিজেকে স্নিগ্ধ করছে। কিন্তু আনমনে এক অপ্রত্যাশিত জিনিস দেখে সে থমকালো।

প্রিয়া বারান্দায় বসে আপনমনে বৃষ্টি বিলাস করছে। তার এলোমেলো খোলা চুলগুলো বাতাসের সাথে উড়ে উড়ে জলকেলি খেলছে। বিজলি চমকানোর ক্ষীয়মান আলোতে মেয়েটার বিমূর্ত প্রতিচ্ছবি স্পষ্ট বিদ্যমান।

সৌরভের দৃষ্টি এখনো বিমূর্ত প্রিয়ার দিকে নিবদ্ধ। কতক্ষণ সময় পেরিয়েছে সৌরভ নিজেই জানে না। আচমকা তার হুঁশ এলো। সে এভাবে মেয়েটাকে দেখছে কেনো? তার মাথা গেছে নাকি?

কিন্তু প্রিয়ার কোনো হেলদোল নেই। সে বৃষ্টিকন্যা হয়ে বসে আছে চুপটি করে। এই বৃষ্টি দেখলে তার কেমন প্রেম প্রেম পায়। সে জানে না কেনো? কিসের জন্য? তবে অদ্ভুত সব অনূভুতি এসে জমা হয় তার মানসপটে। তাই ছুটে আসে নিজের অজ্ঞাত অনূভুতিকে বুঝার জন্য। নিজের অর্ধভেজা তনু লেপ্টে আছে বারান্দার দেয়ালের সাথে। তার দৃষ্টি নিবন্ধ পাশের বড় আমগাছের দিকে। সেখানে গাছের পাতা থেকে বৃষ্টি পড়ার টুপ টুপ শব্দ আসছে। সে না চাইতেও মনটা সেখানে আটকে আছে।

চৈতন্যহীন প্রিয়ার পাশে যে আরও একজন ব্যক্তি আছে সেই সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত সে। অথচ সেই ব্যক্তির সম্পূর্ণ দৃষ্টি জুড়ে ছিল তার প্রতি একরাশ মুগ্ধতা।

প্রিয়ার অর্ধভেজা শরীর দেখে সৌরভের হুঁশ এলো। সে কর্কশ গলায় চেঁচালো,

এই ভূত্নীই, খুব শখ হচ্ছে বুঝি এই রাতে ভিজে জ্বর বাঁধানোর।

প্রিয়া বিদ্যুৎ চমকানোর মতই চমকে উঠলো। সে সৌরভ থাকলে খুব একটা বারান্দায় আসেনা। তার উপর তার শরীরের অর্ধেক ভিজে লেপ্টে আছে। ছিঃ! কি বিচ্ছিরি লাগছে তাকে। নিজেকে নিজে শ’ খানেক গা*লি দিলো। এত জ্ঞানশূন্য কখন হলো সে। লজ্জায় আর জড়োতায় কাচুমাচু করছিলো। গায়ের ওড়না ঠিক করলো দ্রুতই। প্রতিত্তোরে কি বলবে কোনো কথাই খুঁজে পাচ্ছে না।

সৌরভ নিশব্দে হাসলো। প্রিয়ার এমন লজ্জামাখা মুখ দেখলে মেয়েটাকে কেমন আদুরে আদুরে লাগে তার কাছে। তাই তো মেয়েটাকে সে বার বার লজ্জা দেয়। বৃষ্টিময় তিমির রাতে সৌরভের হাসি-মাখা মুখ প্রিয়ার নজরে এলো না। প্রিয়ার দৃষ্টি নত হয়ে আছে তখন থেকেই। আজকাল যখন তখন সে এই ছেলের সামনে লজ্জায় পড়ে যাই।

সৌরভ এবার কোমল গলায় বললো,

বাসায় চলে যাও। নয়তো ঠান্ডা লেগে পরে জ্বর উঠবে। এভাবে অসময়ের বৃষ্টিতে ভিজা ঠিক না।

প্রিয়া চলে যাওয়ার জন্য উদ্ধত হলেই পিছন থেকে সৌরভ ডেকে উঠলো,

প্রিয়া শোনো,

জ্বী, কিছু বলবেন?

সৌরভ কি বলবে এখন। মেয়েটাকে কেনো ডেকেছে সে নিজেই জানে না। আমতা আমতা করতে লাগলো।

তুমি দ্রুত কাপড় চেইঞ্জ করে নাও। পড়াশোনা কি সব ছেড়ে দিয়েছো? যাও পড়তে বসো।

আচ্ছা, বলে মাথা নাড়ায় প্রিয়া। তারপর নৈশব্দে প্রস্থান করে দ্রুত।

সৌরভ দীর্ঘ এক শ্বাস ছাড়ে কি বলতে কি বলেছে সে নিজেই জানে না। তবে তার মনটা স্নিগ্ধ এক সজীবতায় ভরে গেছে। সেও বারান্দার দরজা লাগিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে। বিরক্তিকর মনটা এখন বেশ ফুরফুরে আছে।

রাতের গভীরতা ক্রমশ বাড়ছে। বাইরে এখন বৃষ্টি নেই বরং অন্তরীক্ষে শুভ্র এক ফালি চাঁদের কিরণে উজ্জ্বল হয়ে আছে। সৌরভ হেলান দিয়ে শুয়ে আছে। চোখের কোণে ঘুম আসি আসি করছে। আচানক তার বেহায়া মোবাইল সশব্দে ভো ভো করে কেঁপে উঠলো। সৌরভ প্রচন্ড বিরক্তবোধ করলো। কিন্তু নাম্বার দেখে পুরাই দস্তুর অবাক।

সে জানে না, কখনো দেখেনি এই নাম্বার? কিছু একটা চিন্তা করে কলটা রিসিভ করলো। কিন্তু অপর পাশের পুরুষালি ব্যক্তিটির কথা শুনেই কিংকর্তব্যবিমূঢ়। বুঝার চেষ্টা করছে ব্যক্তিটি চাইছে কি?

ভাই আমারে বাঁচান, আমার অনেক সমস্যা। বিশ্বাস করেন আমি বেশি যৌন সমস্যায় ভুগতেছি। আপনি যেখানে বলবেন আমি আসব? যত টাকা চান আমি দিবো তাও আমারে বাঁচান। যদি বলেন রাতে আপনার বাড়ি আসতে তাও আসবো শুধু আমার সমস্যাটা ভালো করে দেন,,,, বাকিটা বলার আগেই সৌরভ রামধমক দিলো।

মাথা গেছে নাকি আপনার? কোত্থেকে কল দিছেন? কি সব আবোল তাবোল বকতেছেন? আর কিসের সমস্যা দূর করবো আমি, রাখেন তো মিয়া।

সৌরভ ভেবে পাই না এত রাতে তার কাছে কিসের সমস্যার সমাধান চাই। লাইট নিভিয়ে শুয়ে পড়লো সে। যদি মাথাটা ঠান্ডা হয় তার।

________________

ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলো প্রিয়া প্রীতি। আচমকা প্রত্যুষ এলো তাদের কাছে। প্রিয়া অবাক না হলেও প্রীতি অবাক হলো প্রত্যুষকে দেখে।

প্রত্যুষ বোনের বিছানায় বসে আবদার করলো আপু আজকে আমি তোমাদের সাথে ঘুমায়। প্রিয়া বলার আগেই প্রীতিই বললো ঘুমা, কিসের সমস্যা ঘুমাইলে। তবে শর্ত একটাই হাত পা ছোড়াছুড়ি করতে পারবি না, সটান হয়ে ঘুমাবি, পারবি?

প্রত্যুষ ভাবলো কিছুক্ষণ। কি বলবে উত্তর গোচ্ছাছিলো। তারপর আচমকা বললো জানো আপু আজকে আমাদের স্কুলে কি হয়েছে?

প্রিয়া ভাইয়ের কান্ড দেখে মনে মনে হাসছে। কিন্তু চোখমুখ শক্ত করে বললো না বললে জানবো কি করে?

প্রত্যুষের ভয় কেটে গেছে। এবার হাসি মুখে বললো জানো আপু, আমাদের ক্লাশের তিয়াশ আছে না সে রাফিদের ব্যাগ থেকে টাকা চুরি করেছে। তিয়াশকে সবাই এখন চোর বলে ডাকে। তার সাথে কেউ কথা বলে না।

তুই দেখেছিস তিয়াশকে চুরি করতে।

না আপু, আমি তো দেখেনি কিন্তু আয়ানরা বলেছে তিয়াশ একটা চোর। সে সবার ব্যাগ থেকে টাকা চুরি করে। তার বাবাও একটা চোর। আরও অনেক কথা বলেছে তাকে।

শোন প্রত্যুষ, কখনো কারো কথা শুনে কোনো কিছু বিশ্বাস করবি না। যদি নিজের চোখে না দেখিস। তবে হ্যাঁ’ দেখার পরও ভালো করে যাচাই করবি তুই যা দেখেছিস তা সত্যিই কিনা?

আচ্ছা, আপু।

তুই তিয়াশকে চোর ডাকবি না। কালকে গিয়ে তিয়াশকে সরি বলবি। তারপর ওর থেকে আসল কথা জেনে নিবি। সবাই ওকে কেনো চোর ডাকে।

ঠিক আছে আপু।

এখন তুই উঠ আমাদের মাঝখানে ঘুমাবি। পারবি?

হ্যাঁ, পারবো তো। আপু আমাকে একটা ভূতের গল্প শোনাবে।

ডাইনী বুড়ির শোনালে হবে।

হুম হবে।

প্রিয়া ভাইয়ের মাথায় হাত রেখে আপনমনে গল্প শোনাতে লাগলো। গল্প শুনতে শুনতে প্রত্যুষ ঘুমিয়ে পড়েছে। প্রীতিও গভীর ঘুমে নিমগ্ন। কিন্তু তার চোখের ঘুম উধাও। অন্তরীক্ষে উদিত তারকারাজির দিকে তার অপলক দৃষ্টি। এক পশলা বৃষ্টির পর অন্তরীক্ষে চাঁদের এমন উজ্জ্বল দীপ্তি সত্যিই অসাধারণ!

___________

এদিকে ঘুম নেই সৌরভের দু’চোখে। কিছুক্ষণ পর পর তার মোবাইল কেঁপে উঠছে। শেষে বাধ্য হয়ে সে মোবাইল বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু সে ভেবে পায় না তার কাছে এরা কিসের সমস্যার সমাধান চাই।

দু’চোখ হাজার চেষ্টা করেও বন্ধ করতে পারলো না। বার বার একটা প্রশ্ন আসছে মনে এরা কারা ভাই? তার নাম্বার কোথায় পেলো?

চলবে,,,,,,,,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে