Sunday, October 5, 2025







বাড়ি"ধারাবাহিক গল্প"শক্তিময়ীশক্তিময়ী পর্ব-৩১ এবং শেষ পর্ব

শক্তিময়ী পর্ব-৩১ এবং শেষ পর্ব

#শক্তিময়ী
৩১ তম পর্ব (শেষ পর্ব)
বড় গল্প
নাহিদ ফারজানা সোমা

“মা, একমাত্র তুমিই আমার সদ্য জন্ম নেওয়া শরীরটাকে ভালোবেসেছিলে এই বিরাট পৃথিবীতে, তাই না? ”

“হ্যাঁ, মা।”

” ভাইয়া বা পরীকে প্রথম কোলে নিয়ে তোমার যে অনুভূতি হয়েছিলো,আমার বেলায় কি তা হয়েছিলো,মা?”

” সত্যিটাই বলি। না মা,অতোটা না। ”

“তারপর?”

“তারপর থেকে ধীরে ধীরে তুমি আমার প্রিয়তম সন্তান হয়ে গেলে। এখনো তাই।”

“বাকিরা সবাই ভালোবেসেছে আমাকে ব্যবহার আর কাজের জন্য, ঠিক না? ”

“ঠিক। একসাথে থাকতে থাকতে মায়াও পড়ে গিয়েছিল। তবে ব্যবহার, কাজকর্ম আর সুন্দর মানসিকতার জন্য সবাই তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছে। তুমি তোমার আব্বুরও প্রিয়তম সন্তান। সে যে একসময় কি পরিমাণ অনুতপ্ত হয়েছিলো, তোমার আব্বু যে তোমাকে কি অসম্ভব রকম ভালোবাসতো,তুমি তা কল্পনাও করতে পারবে না। তুমি তোমার দাদা-দাদুরও সবচেয়ে প্রিয় নাতনি। সমুদ্র -পরীর চেয়ে অনেক বেশি ভালোবাসা তোমার জন্য তাঁদের ছিলো।”

” তারমানে একমাত্র তুমিই আমাকে এমনি এমনি ভালোবেসেছিলে, তাও ধীরে ধীরে, বাকি সবার ভালোবাসা আমাকে অর্জন করতে হয়েছে।তাই না,মা? ”

” ভালোবাসা পাওয়ার জন্য কান্নাকাটি, হা-হুতাশ না করে আচরণ আর কাজের মাধ্যমে ছোট থেকে বড় সবার ভালোবাসা , শ্রদ্ধা অর্জন করাইতো তোমার জীবনের একটা বিরাট সাফল্য, মা। তুমি ভালোবাসা জয় করেছো। আরেকজন তোমাকে জন্মের দিন থেকে নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবেসেছিলেন। মাজেদা বু।”

“মাজেদা খালা অসাধারণ মানুষ ছিলেন, উনাকে ভালোবাসার মহাসাগর বলা যায়। পৃথিবীতে ছয় মহাসাগর, প্রশান্ত, আটলান্টিক, ভারত,উত্তর মহাসাগর, দক্ষিণ মহাসাগর আর মাজেদা খালার ভালোবাসার মহাসাগর। ”

“ভালো বলেছো। আল্লাহ উনাকে খুব, খুউব শান্তিতে রাখুন। ”

“যাই মা, ফুপিকে কিছু খাইয়ে আসি।”

ফুপি মানে আমি। ব্রেস্ট ক্যান্সারের রোগী। একটা ব্রেস্ট ফেলে দেওয়া হয়েছে আড়াই বছর হলো। কেমোথেরাপিতে চুল,ভুরু,চোখের পাপড়ি পর্যন্ত সাময়িক ভাবে হারিয়েছিলাম। পরে ওগুলো গজালো বটে,তবে আগের মতো আর হলো না। আমার অতি প্রেমময় স্বামী আমার থেকে ক্রমাগত দূরে সরে যাচ্ছিলো। ব্রেষ্ট সার্জারীর এক বছর হতে না হতেই সে আমাকে ডিভোর্স দিলো। আর তার চার মাসের মাথায় এক উদ্ভিন্নযৌবনাকে বিয়ে করলো।

আমার পরিবার ইচ্ছা করলেই মাহমুদকে কঠিন গ্যাঁড়াকলে ফেলতে পারতো। আমি নিষেধ করলাম। জোর করে ভালোবাসা পাওয়া যায় না,জোর করে সংসারও করা যায় না। আমি কখনো সুন্দর চেহারা দেখে কারো প্রতি আকৃষ্ট হই নি। মানুষের দৃঢ় ব্যক্তিত্ব, উদার মন মানসিকতা, মানবিক গুণাবলি, বাচন ভঙ্গি, রুচি এগুলো আমাকে টানতো। মাহমুদের সবকিছু ছিলো আপাতদৃষ্টিতে, সেই সাথে দারুণ হ্যান্ডসাম, স্মার্ট। কিন্তু আমার একটা ব্রেষ্ট না থাকায়, আমার মাথা ন্যাড়া হয়ে যাওয়ায়,আমার চেহারার সব সৌন্দর্য উবে যাওয়ায় আমি ওর যে রূপ দেখলাম,তাতে ওর প্রতি আমারই বিতৃষ্ণা এসে গেলো। মাহমুদ আসলে সহানুভূতিশূন্য, মমতাশূন্য, শরীর সর্বস্ব এক নির্লজ্জ মানুষ। এমন মানুষের প্রতি আমার অন্ততঃ এতোটুকু শ্রদ্ধা, ভালোবাসা কাজ করে না। কাজেই ও আমাকে ডিভোর্স দেওয়াতে খুব খুশি হয়েছি। আমার দুই মেয়ে মাহিন আর মেহেক আমার কাছেই থাকে। বাবা তাদের চায় নি। নতুন স্ত্রী ঝামেলা চায় না।

বাবার বাড়িতে চলে আসলাম। যদিও বাবা-মা কেউ নেই। মা চলে গেছেন আট আর বাবা পাঁচ বছর আগে। ভাই বোন ভাবীরা আদরের কমতি রাখে না, তাও মনটা ফাঁকা ফাঁকা লাগতো। মনে হতো, একটা বিশেষ জায়গায় গেলে শান্তি পাবো।

আল্লাহ আমার মনোবাঞ্ছা পূরণ করলেন। তিথি ভাবী আর অদিতি এসে আমাকে আর মাহিন -মেহেককে নিয়ে গেলেন তাঁদের বাড়িতে। আমাদের বাসা থেকে কেউ আপত্তি করলো না, কারণ তারা বুঝতে পেরেছিল কোথায় আমি শান্তি পাবো। তাছাড়া বিশাল বাড়িতে বাস করা তিথি ভাবী আর অদিতির শূন্যতা কিছুটা কাটবে আমাদের পেলে।

এই বাসায় ভীষণ ভালো আছি। এই বাসায় যে আসে,সে ই ভালো থাকে। তবে প্রায়ই চোখ ঝাপসা হয় আসে। হ্যালুসিনেশন হয়। শুনতে পাই,ফুপু বলছেন ,”এতো শুকিয়ে গেছিস কেন রে বুড়ি? ” ” কোথায় যাচ্ছিস?ভাত না খেয়ে যাওয়া যাবে না। আয়,আমি মুখে তুলে খাইয়ে দিই।” মনে হয়, ফুপা গলা খাঁকারি দিতে দিতে ডাইনিং রুমের দিকে আসছেন। এইতো ফুপা মসজিদে যাচ্ছেন নামাজ পড়তে। আমাকে বলছেন,”তোর আব্বা-আম্মা আজ ছয়দিন হলো,এই বাড়িতে আসেন নি। বিষয় কি রে, মা? দেখি,আমিই আজ সন্ধ্যায় যাবো। তোর মা’কে বলিস ইলিশ পোলাও করতে। ” মাঝে মধ্যে মনে হয়, পাশের ঘরে আনন্দ ভাইয়া কথা বলছেন। তন্দ্রার মধ্যে অনেক আগে হারিয়ে যাওয়া দিনগুলো ফিরে আসে। বাবা-মা-তিন ফুপু-চার ফুপা, তিন চাচা,দুই চাচী,আনন্দ ভাইয়া, লাবণী আপা, পরী,মাজেদা বু সবাই খুব ঘন ঘন আসেন আমার তন্দ্রায়, স্বপ্নে। ঘুম ভাঙার পরে বাস্তবে ফিরে আসতে অনেক সময় লাগে। ধীরেধীরে মাথায় ঢোকে, কেউ নেই, ওরা কেউ নেই।

সবার আগে চলে গেলেন ফুপু। বারো বছর আগে।, দিব্যি ভালো মানুষ, ওইদিন অদিতির “পরীর রাজ্যের ” শুভ উদ্বোধন হয়েছে। অদিতির ইচ্ছে অনুযায়ী তার দাদা-দাদি ভবনটি উদ্বোধন করেছেন। এর সাত দিন আগে সমাজ সেবায় বিশেষ অবদানের জন্য ফুপু “অনন্যা” পুরষ্কার পেয়েছেন। “পরীর রাজ্য” উদ্বোধন করে ফুপু অনেক সময় বাচ্চাদের সাথে কাটালেন। তাদের কোলে নিলেন, আদর করলেন, একটু বড় যারা, তাদের রূপকথার গল্প শুনালেন। ওদের সাথে দুপুরের খাবার খেলেন। একটু বিশ্রাম নিয়ে গেলেন আবদুর রহমান সাহেবের বৃদ্ধাশ্রমে। ওখান থেকে আমার বড় চাচার বাসায়। চাচী অসুস্থ, তাঁকে দেখতে। চাচী ফুপুর রান্না খুব ভালোবাসতেন, তাই ফুপু নিজের হাতে পাঁচ মিশালি ডালের সব্জি খিচুড়ি করেছিলেন। ভাবী গরুর মাংস আর অদিতি কাস্টার্ড করে দিয়েছিল। সবগুলোই আমার বড় চাচীর প্রিয় আইটেম। সেখান থেকে বাসায় ফিরে নামাজ পড়ে অনেক আড্ডা মেরেছিলেন ফুপা-ফুপু -ভাবীর আব্বা-ভাবী -অদিতি। আড্ডার বিষয়বস্তু ছিলো কি করলে দেশে একজন পথশিশু ও থাকবে না, একজন অসহায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধা থাকবেন না। ফুপু উত্তর দিয়েছিলেন, “তিথি আর অদিতির মতো এক লক্ষ মানুষ যদি দেশে থাকে,তাহলেই সম্ভব। ” আড্ডা শেষে শোয়া। দাদা-দাদির ঘুমানোর আগে অদিতি দুজনের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। সেদিন ও দিয়েছিল অনেক সময় ধরে। সকালে ফুপু আর ঘুম থেকে উঠলেন না।

ছয়মাস যেতে না যেতে ফুপা। মাগরিবের নামাজ আদায় করার সময় সিজদায় গিয়েছিলেন, সেই সিজদারত অবস্থায় সব শেষ।

ভাবীর আব্বা ছেলের কাছে চলে গিয়েছিলেন আমেরিকায়। একই স্টেটে স্নিগ্ধা আপাও বাস করেন। আমেরিকা যাওয়ার আট মাস পরেই খালু খুব অসুস্থ হয়ে যান। ভাবী রওনা হবেন, ভিসা পাওয়ার আগেই খালু চলে গেলেন।

লাবণী আপা রোড অ্যাক্সিডেন্টে।

মাজেদা বু খুন হয়েছিলেন আপন ভাই আর তার ছেলেদের হাতে। মাজেদা খালা চিরকুমারী ছিলেন, তাঁর সব বেতন ভাই আর ভাইপোদের পিছনেই খরচ করেছিলেন। ভাইরা পাকা বাড়ি বানালো, ভাইপোরা শিক্ষিত হলো। ফুপা-ফুপু -আনন্দ ভাই -ভাবী ওদের দিকে খুব খেয়াল রাখতেন। কয়েকবার ছেলেগুলোকে তাঁরা গাঁজা, ফেনসিডিল থেকে রক্ষা করেছিলেন। বাসায় নিয়ে এসে বুঝিয়েছিলেন,কয়েক দফা ডাক্তার দেখিয়েছিলেন। সেই দুর্বৃত্তগুলো যখন দেখলো, বাসায় এখন শুধু মেয়েমানুষরা বাস করে, তিথি ভাবী-অদিতি-মাজেদা খালা,রেশমা,শিলা আপা, তখন তারা মাজেদা বু’কে হাত করার চেষ্টা করে। বেচারি গ্রামে বেড়াতে গিয়েছিলেন চারদিনের জন্য। ভাই ভাবী,ভাইয়ের ছেলেরা বুঝালো,এই সুযোগ। ওরা মুখোশ পরে বাড়ির ভেতরে ঢুকবে গভীর রাতে, বাড়িতে থাকা প্রচুর নগদ টাকা,গয়নাগাটি, দামী জিনিসপত্র নিয়ে নির্বিঘ্নে চলে আসবে গ্রামে, মালসামাল লুকিয়ে রাখবে অন্য এক নিরাপদ জায়গায় যাতে পুলিশ যদি আসেও,কিছু যেন খুঁজে না পায়।

এই অমানুষগুলো গ্রেফতার হওয়ার পরে স্টেটমেন্ট দিয়েছিল, তাদের প্রস্তাব শুনে মাজেদা বু’ ভয়ংকর রেগে যান। মাজেদা বু’র এতো ভয়ংকর রূপ তারা কখনো দেখেনি। মাজেদা বু তাদের বলেন তাঁর ভাগের সব জমি জমা তিনি নিয়ে নিবেন। আর কখনো গ্রামে আসবেন না। টাকা পাঠানো দূরের কথা। এতো কৃতঘ্ন তাঁর ভাই,ভাইপোরা, এটা তিনি দুঃস্বপ্নেও কল্পনা করতে পারছিলেন না। ব্যাগপত্র গুছিয়ে তখনই ঢাকায় রওনা হওয়ার সময় ভাই,ভাবী,ভাইপোরা মিলে তাঁকে ঘরের ফ্যানের সাথে ঝুলিয়ে দেয় আর মাজেদা বু আত্মহত্যা করেছেন প্রচার করে মহাকান্না জুড়ে দেয়। এই গল্প কেউ বিশ্বাস করে নি। তিথি ভাবী মামলা করেন। সব তথ্য বের হয়ে আসে। তিথি ভাবী আর অদিতির বক্তব্য হলো,অমানুষগুলোর সর্বোচ্চ শাস্তি না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা মরবেন না। মাজেদা বু’কে তিথি ভাবীর উদ্যোগে ও সবার সম্মতিতে আমাদের পারিবারিক গোরস্থানে দাফন করা হয়েছে। উনাকে আমরা পরিবারের সদস্য ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারি না।

সমুদ্র পলিনকে ডিভোর্স দিয়েছে তিন বছর হলো। কারণ কিছুই না। পলিন পানশে। গত আট বছর ধরে সমুদ্র ওখানকার এক বাঙালি মেয়ের সাথে লিভ টুগেদার করছে। কর্মস্হলে তার দারুণ দক্ষতা। কোম্পানি তাকে মাথায় তুলে রাখে। চাকরি আর প্রেমিকাকে নিয়ে সে সুখেই আছে।

সমুদ্রের ছেলের বয়স বিশ বছর। আনন্দ ভাইয়ার সাথে অস্বাভাবিক মিল চেহারায়,স্বভাবে। ভীষণ বুদ্ধিমান, কর্মঠ, বিবেচক। প্রতি বছর মার্থা,পলিন আর আমাদের নয়নমনিটা দেশে আসে। কি সুন্দর করে আদর করে আমাদের সবাইকে। সবাইকে একসাথে নিয়ে পিকনিক করে। পলিন আর মার্থার তুলনা নেই। ছেলে এখানে অ্যাডজাস্ট করতে পারবে না হয়তো, ওর পড়াটা শেষ হলে,কোনো এক মায়াবতীর হাতে ওর দায়িত্ব দিয়ে মার্থা আর পলিন বাংলাদেশে চলে আসতে চান।

তিথি ভাবী ছেলের সাথে কোনো যোগাযোগ রাখেন নি, কিন্তু নাতি আর প্রাক্তন বৌ, বেয়ানের সাথে তাঁর দারুণ সখ্যতা।

তিথি ভাবী আর অদিতি এখনো আমাদের পরিবারকে এক সূতোয় গেঁথে রেখেছেন। মাহিন আর মেহেককে নিয়ে আমি নিশ্চিন্ত। ওদের আছে তিথি মামী আর বড় আপ্পি মানে অদিতি। এখানে ওরা খুব ভালো থাকবে জানি। অপারেশন, কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপির পরেও আমি সুস্থ হইনি। আমার শরীরে হরমোন থেরাপি আর ইমিউনোথেরাপি কোনো কাজ করবে না,করলে ভালো হতো। তাছাড়া ক্যান্সারটা ধরাই পড়েছে অনেক দেরি করে।

আনন্দ নিকেতনে এখন পঞ্চাশ জন ছেলে শিশু, পরীর রাজ্যে সত্তর জন মেয়ে। তাদের খাওয়া,পরা,শিক্ষা, চিকিৎসা , বিনোদন সব চলছে খুব সুন্দর করে। মার্থাও অবাক হয়ে যান। তাঁর মতে, আমেরিকাতেও এতো সুন্দর করে অসহায় শিশুদের প্রতিপালন করা হয় না।

তিথি ‘জ ফুড শপের এখন চৌদ্দটা আউটলেট, আনন্দ বেকারির দুইটা, সবকিছু খুব দারুণ চলছে।

অদিতি দেশের খুব পরিচিত ও প্রিয় একটা মুখ। তাকে নিয়ে কতো পত্রিকায় কতো প্রতিবেদন ! কতো চ্যানেলে কতো সাক্ষাৎকার! তার চিন্তা, কর্ম, জীবনাদর্শ নিয়ে হাজারো আলোচনা। রাজনৈতিক দলগুলোও তাকে টানার বহু চেষ্টা করেছে। টিভির সাক্ষাৎকারে অদিতি বলেছে,” রাজনীতি একটা বিদ্যা।রাজনীতি ছাড়া একটা দেশ চলতে পারবে না। কিন্তু পলিটিশিয়ানরা পলিটিক্সকে এতো পচিয়ে ফেলেছেন যে এই নোংরার মধ্যে পা রাখতে চাইনা। আপনি বলছেন, সৎ,সাহসী,মেধাবী, দেশপ্রেমিকদের রাজনীতিতে আসা খুব দরকার।আমি সহমত। কিন্তু যেখানে নিরানব্বই ভাগ রাজনীতিবিদ চরম দূর্নীতিগ্রস্ত, ক্ষমতালোভী, মিথ্যাবাদী, ধূর্ত, সেখানে এক ভাগ টিকবে কেমন করে? হয়তো তার মধ্যে থেকেও কেউ পারবে,কিন্তু আমি পারবো না। আমার লক্ষ্য ছোটবেলা থেকে একটাই। আমি সেই লক্ষ্যের ধারেকাছে যেন পৌঁছাতে পারি, আপনারা সেই দোয়া করবেন। ”

অদিতি পৌঁছাতে পেরেছে তার অভীষ্ট লক্ষ্যে। আনন্দ আশ্রম, পরীর রাজ্য, আনন্দ নিকেতন, বৃদ্ধাশ্রম, মনোবিজ্ঞানী পরিচালিত কাউন্সেলিং সেন্টার, দুঃস্হ মহিলাদের বিভিন্ন কাজে যোগ্য হওয়ার জন্য প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, মাদক নিরাময় কেন্দ্র … কি না করেছে এই মেয়ে? এবং খুব বেশি সফল ভাবে। নিজের উপার্জনে, দাদা-বাবা-ফুপুর দেওয়া সম্পত্তি বিক্রি করে।
ফুপা-ফুপু বেঁচে থাকতেই অদিতি সবার অনুমতি নিয়ে নিজের গর্ভধারিণী ও তাঁর সন্তানদের নিয়ে এসেছিলো ঢাকায়। নানা-নানিকেও। নানা-নানিকে বৃদ্ধাশ্রমে জায়গা দেওয়া হয়েছিলো। প্রথম কিছুদিন তাঁরা নানা অপকর্ম করেছিলেন, কিন্তু নিয়মিত কাউন্সেলিং, সবার নম্র ভদ্র
ব্যবহার, পেট ভরে ভালো খাওয়ার নিশ্চয়তা, পরিস্কার জামাকাপড়, পরিচ্ছন্ন পরিবেশ, অন্য বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের সাহচর্য, নিয়মিত বাধ্যতামূলক প্রার্থনা, প্রতি সন্ধ্যায় এক ঘন্টা সৎ শিক্ষামূলক আলোচনায় উপস্থিত থাকা তাঁদের জীবন দর্শন পাল্টে দিয়েছিলো অনেকটা। আশ্রমের প্রায় সব বৃদ্ধ-বৃদ্ধার আক্ষেপ ছিলো কেমন করে মতো মিথ্যায়,অসাধুতায়,স্বার্থপরতায় তাঁরা আস্ত একটা জীবন পার করে দিলেন। এতো সুন্দর অনুভূতি নিয়ে বাঁচার সাধ আগে পেলেন না কেন? অদিতির বায়োলজিক্যাল নানা-নানিরও শুভ বোধ একসময় জাগ্রত হয়েছিল, অদিতির নানা-নানু সম্বোধনে, তার নম্রতা আর উদারতায়, অদিতির মমতা আর ভালোবাসায় আবেগে আনন্দে আপ্লুত হওয়ার পাশাপাশি তাঁরা অনুতাপের আগুনেও পুড়ছিলেন। অদিতির গর্ভধারিণী তিথি ভাবী ও অদিতিকে দেবীজ্ঞান করা শুরু করেছিলেন। স্বেচ্ছায় তিনি বৃদ্ধাশ্রম ও শিশুদের অনেক দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। কাজ করতেন আর নিজের পাপীতাপী জীবনের কথা মনে করে শুধু কাঁদতেন। অদিতিকে বুকে জড়িয়ে ধরার সাহস পেতে তাঁর অনেক সময় লেগেছে। সারাক্ষণ আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতেন। তিথি ভাবীকে বলতেন,”প্রতিটা অঞ্চলে তোমার আর আমার অদিতির মতো মেয়ে যদি থাকতো, তোমার স্বামী শ্বশুরবাড়ির মতো লোকজন থাকতো, তাহলে কোনো মানুষ খারাপ হতো না। ভালো ভাবে বেঁচে থাকার যে কি শান্তি, আগে বুঝি নাই গো। দু’বেলা নুন ভাত খেয়েও এমন জীবন হাজার বছর ধরে কাটানো যায়। কিন্তু আমাদের যে কেউ শেখায় না। জন্মানোর পর থেকে খিস্তি খাউড়, ঝগড়াঝাটি, টাকার লোভ, চুরি, ডাকাতি,লোক ঠকানো এগুলোই স্বাভাবিক বলে মনে হয়। কেন তোমাদের মতো মানুষরা বেশি করে জন্মায় না?”

অদিতির নানা-নানি -মা প্রচন্ড অনুতপ্ত হয়েছিলেন। অদিতিকে ভালোবেসেছিলেন গভীর ভাবে। তিথি ভাবী আর আমাদেরকেও। অদিতির নানা-নানি কয়েক বছর আগে মারা গিয়েছেন, অদিতির গর্ভধারিণী বছর দুই আগে।

মাহমুদের শরীরের নেশা কেটে গেছে বোধহয়। নতুন বৌ আর নতুন শ্বশুরবাড়ির সাথে অ্যাডজাস্ট হচ্ছে না মোটেও। নতুন বৌ নাকি টাকার কাঙাল। এটা লাগবে, ওটা লাগবে, এই মডেলের মোবাইল কিনে দাও, হীরের নেকলেস লাগবে, পশ এরিয়ায় আমার নামে ফ্ল্যাট কিনে দাও, গাড়ির মডেল চেঞ্জ করো – এসবই চলছে নাকি বিয়ের পর থেকে। মাহমুদের বাপ মা আত্মীয় স্বজনকে একদম সহ্য করতে পারে না মেয়েটা। মাহমুদের বাবা-মা-ভাই-বোনেরা আমাকে দেখতে আসেন, আফসোস করেন, কান্নাকাটি করেন। মাহমুদ তার ভুল বুঝতে পেরেছে। আমাকে হারিয়ে সে বুঝতে পেরেছে যে আমাকে সে কি প্রচন্ড ভালোবাসে। মাহিন-মেহেকের জন্য তার জান ছটফট করে। তিথি ভাবীকে কয়েকদফা ফোন করে হা হুতাশ করেছে।

সত্যি বলতে কি, আমাদের পরিবারের জামাই বা বৌদের যেমন আদর করা হয়,সম্মান দেওয়া হয়, তাদের মতামতকে যে পরিমাণ গুরুত্ব দেওয়া হয়,তাদের পরিবারকে যে ভাবে আপন করে নেওয়া হয়, তা খুব কম পরিবারেই হয়। সুতরাং, এই পরিবার থেকে ছিটকে পড়লে যে কারোর নিঃস্ব,স্বজনহারা বোধ করা স্বাভাবিক। কিন্তু আমি মাহমুদের মুখটাও দেখতে চাইনা। আমার চরম নিস্পৃহতা এসেছে ওর ব্যাপারে। ওর কান্নাকাটি, হা হুতাশে কিছু যায় আসে না আমার। মাহিন -মেহেককে যেন তিথি ভাবী আর অদিতি নিজেদের কাছে রাখেন, এই অনুরোধ করি বারবার।ওরা আমাকে জড়িয়ে ধরে আদর করে, দৃঢ়তার সাথে আশ্বাস দেয়।

সমুদ্রের হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল। স্ট্রোক ও করেছে একবার। প্রেমিকারা পালিয়ে গেছে অনেক আগেই। চাকরির সেই রমরমা অবস্থা আর নেই। সমুদ্রের ছেলে খুবই মেধাবী। সে গবেষণা করছে চিকিৎসা সংক্রান্ত বিষয়ে, তরুণ সফল গবেষক হিসাবে তার নাম ডাক ছড়িয়ে পড়েছে ইতিমধ্যে। তিথি ভাবী,অদিতি আর আমরা সবাই মহাখুশি, ল্যানসেট এবং আরও কিছু বিখ্যাত পত্রিকায় তার নাম ধাম প্রকাশিত হয়েছে, তার কয়েকটা জার্নাল বিশ্বব্যাপী আলোড়ন তুলেছে বলে নয়, সে বিশ্ব মানবতার কল্যাণে কাজ করছে এই আনন্দেই তিথি ভাবী আর অদিতি অস্হির। পলিন স্বেচ্ছায় সমুদ্রের পাশে যেয়ে দাঁড়িয়েছে, মার্থা মারা গেছেন কয়েক মাস হলো। মার্থার মৃত্যুতে ভীষণ কষ্ট পেয়েছিলাম আমরা।

আমার শরীর বড্ড খারাপ লাগছে আজ। অদিতি, রঞ্জু ভাই, মুকুল ভাই আরও কারা যেনো আমাকে নিয়ে হাসপাতালে রওনা হয়েছেন। অদিতি আমার গালের সাথে ওর গাল চেপে রেখেছে। গতকাল খবর পেয়েছি , দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠ দশজন সমাজসেবীর মধ্যে অদিতির নাম এসেছে। তার স্বপ্ন আরও ডানা মেলেছে। আর স্বপ্নপূরণের আকাঙ্ক্ষায় তার উদ্যম বেড়ে গেছে বহুগুণ। পুরো দেশটাকে সে পাল্টে দিতে চায় সবাইকে সাথে নিয়ে, “এখানে মিথ্যে কথা কেউ বলে না,এখানে অসৎ পথে কেউ চলে না। ” এখানে সব শিশুরা খুব যত্নে প্রতিপালিত হয়, বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা ভালোবাসা আর যত্নের এতোটুকু অভাব বোধ করেন না, এই দেশে কেউ মাদকাসক্ত হয় না, এই দেশে সবাই সুশিক্ষিত, সবাই পরিশ্রমী। এই দেশে সবাই সবাইকে ভালোবাসে,সবাই সবার উন্নতি চায়।

হবে,নিশ্চয় আমার অদিতির স্বপ্ন পূরণ হবে। আমার মাহিন,মেহেক তাদের অদিতি আপুর মতো হবে। অদিতি তো অদ্বিতীয়াই। আর অদ্বিতীয়ারা পারে না,এমন কিছু নেই। বিশেষ করে সাথে যদি থাকে তিথি ভাবীর মতো মায়েরা। ভাবী,তোমার স্বপ্ন পূরণ হোক। অদিতি মা, তোর সব স্বপ্ন সত্য হোক। শক্তিময়ীদের স্বপ্ন কখনো মিথ্যা হয় না।

সমাপ্ত।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ
পরবর্তী নিবন্ধ
গল্প পোকা
গল্প পোকাhttps://golpopoka.com
গল্পপোকা ডট কম -এ আপনাকে স্বাগতম......
RELATED ARTICLES

1 মন্তব্য

  1. এমন গল্প সত্যিই অসাধারণ প্রতিটা মানুষের জীবনে এরকম চেষ্টা থাকা উচিত

Leave a Reply to Minu akter উত্তর বাতিল

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments

Md masrur Hasan mahi على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
আমিনুল ইসলাম على প্রয়োজন পর্ব: ৩০ ( অন্তিম)
সাজিবুল ইসলাম على ধর্ষিতাবউ২ ৯ তথা শেষ পর্ব
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
Nita Sarkar على স্বপ্নীল ৬৮
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على রহস্য শেষ_পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على অলক্ষ্যে তুমি পর্ব-০৬ এবং শেষ পর্ব
Nazmun Nahar Akhi على Psycho_is_back? part_7
Nazmun Nahar Akhi على Dangerous_Villian_Lover part 2
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على জানালার ওপারে পর্ব-১৭ এবং শেষ পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على লীলা বোর্ডিং ১২১৫ পর্ব-১১ এবং শেষ পর্ব
মিজানুর রহমান রাহুল على সেই তুমি পর্ব-০১
@feelings على প্রহেলিকা
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Nusrat jahan على coffee & vanilla Part-10
Pallabi Roy على স্বপ্নীল ৬৮
M.D Mahabub على The_Villain_Lover Part_2
Labani sarkar على Dangerous_Villain_Lover part 23
MD Akas Apc على বিবেক
Tanisha Ahmed على Devil love part-18 
Aius Barmon shorob على নারীর দেহকে নয়
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Priya Banerjee على devil love married life last part
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Riya Biswas على তুমি রবে ৫২
Mohammad Adib على তুমি রবে ৬০
Avni Ayesha على তুমি রবে ২৮
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
সুমিত على তুমি রবে ২৮
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
Samiah Begum على তুমি রবে ৫১
biddut das rocky على নর নারী
গল্প পোকা على নষ্ট গলি শেষ পর্ব
Md Jobayer Hossain Shohag على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على দুই অলসের সংসার
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤৪২.
A.J.S Rakib على মন ফড়িং ❤৪২.
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
Samiya noor على গল্পঃ ভয়
Sadikul على গল্পঃ ভয়
Samia Islam على গল্পঃ ভয়
শূন্য মায়া على মন ফড়িং ❤ ৪০.
Sutapa biswas على মন ফড়িং ❤৩৯.
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৮.
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৭
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
Siyam على বিবেক
Sudipto Guchhait على My_Mafia_Boss পর্ব-৯
saptami karmakar على devil love married life last part
saptami karmakar على devil love married life last part
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ২৬.
Shreyashi Dutta على  বিয়ে part 1
Sandipan Biswas على  বিয়ে part 1
Paramita Bhattacharyya على অনুরাগ শেষ পর্ব
জামিয়া পারভীন তানি على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
মায়া على মন ফড়িং  ২২
সুরিয়া মিম على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على মন ফড়িং ২১
গল্প পোকা على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
Sahin ssb على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৮. 
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৭.
Jannatul Ferdous على খেলাঘর পর্ব-৩৫
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ফাল্গুনের_ফুল last_part_8
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ছাত্রী যখন বউ পাঠঃ ১
গল্প পোকা على বাজির প্রেম পাঠঃ ১
Foujia Khanom Parsha على মা… ?
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৮
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
Ibna Al Wadud Shovon على স্বার্থ