লীলা বোর্ডিং ১২১৫ পর্ব-১১ এবং শেষ পর্ব

1
1515

#লীলা_বোর্ডিং_১২১৫
শেষ খন্ড

প্রায় মাঝ রাত তখন, ঘড়িতে দুইটা উনচল্লিশ। লীলা হালদার বেশ কয়েকবার বোর্ডিং গেট ধাক্কানোর পর শিরিন আপা এসে গেট খুললেন হাসান মামা ঘুমে বিভোর হয়ে থাকায়। শিরিন আপা গেট খুলতেই লীলা অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল, ঘুমাস নি?

-না, ঘুম আসছিল না৷

ও। গেস্টরুমে আয় গেটে তালা মেরে৷ হাসান মামাকে ডেকে আয়।

লীলা হালদার শ্লথ পায়ে বোর্ডিং গেস্টরুমের দিকে পা বাড়ায়। শিরিন আপা গেটে তালা মেরে হাসান মামাকে বেশ কয়েকবার ডেকে ঘুম থেকে জাগিয়ে গেস্টরুমের দিকে চলে আসেন।

লীলার মুখখানা বড্ড শুকনো ঠেকছে, চোখ দুটো নির্ঘুম থাকার দায়ে লাল দেখাচ্ছে। সোফায় বসতে বসতে ঢক ঢক করে পুরো গ্লাসের পানি শেষ করে যুদ্ধাহত গলায় থেমে থেমে শিরিন আপাকে বলল, সব রাস্তা বন্ধ হয়ে গেল রে, কেবল মন্ত্রীর রাস্তাটাই খোলা।

শিরিন আপা ধপাস করে সোফায় বসে পড়েন, সমস্ত দুনিয়া যেন তার মাথার ওপর আছড়ে পড়েছে। ভালোমন্দ কোনো কথা বলার শক্তিটুকুও যে হারিয়ে ফেলেছেন। ছোট্ট করে কেবল বললেন, “ও”।

হাসান মামা চোখ কচলাতে কচলাতে গেস্টরুমের দরজার সামনে আসতেই লীলা হালদার বলল, মামা, আপনি সবাইকে ডেকে নিয়ে আসুন যান।

হাসান মামা বিস্ময় কাটাতে লীলার ফরমায়েশ নিশ্চিত হতে অবাক হয়েই বলল, এখন!

-হু, এখন। সবাইকে বলুন আমি এসেছি, ইমারজেন্সি।

হাসান মামার ঘুম এই এক আদেশেই যেন উধাও হয়ে যায়। হাসান মামা দোতলার দিকে পা বাড়ান মনে একগাদা প্রশ্ন নিয়েই।

সাড়ে তিনটা বেজে গেল সবাইর গেস্ট রুমে আসতে আসতে। কেউ হাই তুলছে, কেউ চোখ কচলাচ্ছে আবার কেউ অবাক হয়ে লীলার দিকে তাকিয়ে আছে। লীলা হালদার ইশারায় শিরিন আপাকে কিছু একটা বলার জন্য ফরমায়েশ দিল। শিরিন আপা বার দুয়েক চেষ্টার পর তৃতীয় বারের মাথায় ধরা গলায় বললেন, আমি এখন যা বলতে যাচ্ছি,সেটা আমার মুখ দিয়েই যে কখনো তোমাদের বলতে হবে সেটা কল্পনাও করিনি কখনো। আমি জানি এটা কঠিন সিদ্ধান্ত তবে লীলার জীবনের চাইতে কঠিন না, বরং আমরা আজ লীলার পাশে না দাঁড়ালে লীলার বেঁচে থাকাটাই কঠিন হবে। আমাদের সবাইকে কাল বোর্ডিং ছেড়ে দিতে হবে, বোর্ডিং বিক্রির কথা চলছে ।

শিরিন আপার কথার মাঝেই মেয়েরা নানা প্রশ্ন করতে শুরু করে দিল, বিক্ষিপ্ত প্রশ্নে কারো কথাই ঠিকঠাক বোঝা যাচ্ছে না। শিরিন আপা সবাইকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, তোমরা সকাল হলেই বাড়ি চলে যাও যারযার, আর ঢাকায় থাকার জায়গা থাকলে সেখানে চলে যাও, আমিও যাব কোথাও একটা, কোথায় যাব তা জানি না, তবে আমাকে এবং আমাদের সবাইকে যেতে হবে।

শিরিন আপার কথার মাঝেই লীলা চোখের পানি মুছতে মুছতে বলল, আমার ছেলেটাকে বাঁচাতে হবে, বোর্ডিং বিক্রি না করলে এত টাকার যোগাড় সম্ভব না, আমাকে মাফ করে দিও তোমরা। তোমাদের এভাবে সমস্যায় ফেলতে চাইনি আমি।

কানিজ, শ্রাবণী, জান্নাত, রুবাইয়া, শায়লার কারো মুখ থেকেই কোনো কথা বেরোচ্ছে না। দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা হাসান মামা বাঁ হাতের তালুতে বারবার চোখ মুছে যাচ্ছেন, তবে পানি আটকাতে পারছেন না।

শিরিন আপা উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আমি রুমে গেলাম, গোছগাছ করে নিতে হবে, লীলা তুই বাসায় যেয়ে ঘুমা গিয়ে, চিন্তা করিস না। শিরিন আপা যুদ্ধে পরাজিত সৈনিকের ন্যায় পালানোর মতোই তার রুমে পালিয়ে গেলেন। এতগুলো টলমলে চোখ, প্রিয় মুখের কালশিটে রঙ দেখার শক্তি কোথায় তার?

কানিজ চেয়ারের ওপর নির্বিকার বসে আছে, এক দৃষ্টিতে দেয়ালজুড়ে খেলা করা টিকটিকির দিকে তাকিয়ে আছে তো আছেই। শ্রাবণী শায়লার দিকে তাকাবার সাহস করছে না, যে মানুষটা তাকে বড়ো বোনের মতো, মায়ের মতো আগলে রেখেছিল তাকে ছেড়ে যাওয়া এত সহজ নাকি? চেনা মুখ দূরে ঠেলে বুকের ভেতর এক সমুদ্দুর সমান ভালোবাসা রেখে দূরে যাওয়ার মতো অসহ্য যন্ত্রণা পৃথিবীতে আর একটিও নেই যে। জান্নাত বোরকা পরতে ভুলে গেছে আজ, মস্ত বড় একটা ওড়না গায়ে পেঁচিয়ে কানিজদের রুমে ঢুকতেই কানিজের যেন ঘোর কাটল। জান্নাত শ্রাবণীর দিকে তাকিয়ে বলল, শ্রাবণী, আমি বাথরুমে গেলে তুই আর ইঁদুরে বাচ্চা ছাড়বি না, না? লাইট নিভানি না আর?

কানিজ আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না, হু হু করে কেঁদে ওঠে৷ শ্রাবণী বসা থেকে চিলের মতো তড়িৎ বেগে জান্নাতকে জড়িয়ে ধরেই গুঙিয়ে কেঁদে ওঠে৷ রুবাইয়া কানিজের কাঁধে হাত রেখে নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কেবল, ওর যেন কিছুই বলার নেই, শোনার নেই।

কান্না থামিয়ে জান্নাত শ্রাবণী আজ পাশাপাশি বসেছে, সারাদিন ঝগড়া করা দুটো মানুষ যেন আজ এক আত্না, কোনো বিবাদ নেই, কোনো অমিল নেই। কানিজ চোখ মুছতে মুছতে জান্নাতকে বলল, কোথায় যাবি রে তুই?

জান্নাত ধরা গলায় বলল, বাড়ি যায় তো আগে, পরে দেখা যাবে। তুমি তোমার আব্বার কাছে যাও আপু, যাবে না?

কানিজ উত্তরে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ায় কেবল।

রুবাইয়া শ্রাবণীর হাত ধরে বলল, তুই খালার বাড়ি উঠবি, তাই না?

শ্রাবণী মাথা ঝাঁকায় উত্তরে৷

কানিজ চেয়ার থেকে নেমে শায়লার দিকে তাকিয়ে বলল, আপা বাড়ি যাবেন, না?

শায়লা ফিক করে হেসে দিয়ে বলল, আমার বাড়ি তো দুর্জয় হোটেল ছিল, তারপর লীলা বোর্ডিং, আর এখন? কোনো বাড়ি নেই।

রুবাইয়া অবাক হয়েই বলল, দুর্জয় হোটেল! ঠিক বুঝলাম না আপু৷

শায়লা ঠোঁটের কোণে মেকি হাসি এনে বলল, তুমি বুঝেছ, তবে নিশ্চিত হতে পারছো না। আচ্ছা আমি আজ খোলসা করে দেই। বয়স যখন চৌদ্দ তখন মামারা জোর করেই এক লোকের সাথে বিয়ে দিলেন। ভেবেছিলাম যাক বাবা, মামীদের হাত থেকে বাঁচলাম, খাওয়ার খোটা শুনতে হবে না। বিয়ের পরদিন আমার স্বামী আমাকে নিয়ে গেলেন দুর্জয় হোটেলে, সেই যে রেখে আসলেন আর খোঁজ নিলেন না। নিজের শরীর বেচে বাঁচতে হয়েছিল আমাকে। তারপর একদিন খাইরুল সাহেব ওখানে গেলেন, আমার গল্প শুনে বিশ্বাস করে ওখান থেকে লাখ তিনেক টাকা দিয়ে ছাড়িয়ে আনলেন, ডে-কেয়ারে জব দিলেন। এই তো আমার বাড়ির গল্প৷

কানিজরা যেন হুট করেই কাঁদতে ভুলে গিয়েছে, এমন গূঢ় সত্য, এতো তিক্ততা যে শায়লা তাদের কাছ থেকে লুকিয়ে রেখেছিল এটা যেন মানতে কষ্ট হচ্ছে ওদের। শায়লার কষ্টের কাছে বোর্ডিং ছাড়া কষ্টটা যেন বড্ড দুর্বল হয়ে গেল ওদের জন্য। শ্রাবণী শায়লার হাত ধরে হাতটা বুকের কাছে টেনে নিয়ে বলল, এসব আগে বলোনি কেন?

-বললে কী হতো? অনেকেই আমাকে ঘৃণা করতে শুরু করত। একজীবনে এত ঘৃণা নিজের ওপর করেছি যে নতুন করে কারো কাছ থেকে ঘৃণা পেতে চাইনি।

কানিজ শায়লার কাঁধে হাত রেখে বলল, আপু! আপনি আমার সাথে যাবেন? আমার বাড়িতে?

শায়লা মৃদু হেসে বলল, নারে পাগল, তা হয় না। খাইরুল সাহেব বড্ড একা মানুষ। একা থাকার জ্বালা আমি বুঝি। তার ওখানেই যাব, আমার সঙ্গ তার খুব দরকার যে।

শহুরে বুড়ো কাকেরা কা কা করতে শুরু করেছে, ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। বোর্ডিং এর মেয়েরা আস্তে আস্তে বোর্ডিং ছাড়তে শুরু করেছে। মিনু জ্বর শরীর নিয়েই উঠে এসেছে, সবাইকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে বিদায় দিচ্ছে। রুবাইয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকবে। মোনাকে ফোনে জানানো হয়েছে সব, মোনা আজই ঢাকায় এসে তার মালপত্র নিয়ে যাবে বলে জানিয়েছে। শায়লা শ্রাবণীকে নিয়ে খাইরুল সাহেবের বাসার দিকে রওনা দিয়েছে, কদিন থেকে শ্রাবণী ওর খালার বাসায় চলে যাবে। বৃষ্টির বেগ বেড়েছে, কানিজের বাসা থেকে গাড়ি এসেছে, জান্নাত কানিজের সাথে বাস স্টেশন অবধি যাবে বলে গাড়িতে উঠে বসেছে।

ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে, শিরিন আপা ইচ্ছে করেই ছাতা বের করছেন না। হাসান মামা, মিনুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গেটের বাইরে আসতেই দেখলেন বৃষ্টিতে ভিজে দাঁড়িয়ে আছে সাজু। শিরিন আপা সাজুকে দেখেও না দেখার ভান করে একটা রিক্সা ডাকতেই সাজু শিরিন আপার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল, শিরিন! আমাকে মাফ করে দেয়া যায় না? তোমার দুটো হাতে ধরি আমাকে ক্ষমা করো, প্লিজ?

শিরিন আপা উত্তর দেন না, রিক্সায় তার ব্যাগপত্র উঠিয়ে চলেছেন নির্বিকার।

সাজু শিরিন আপার আরো কাছে ঘেঁষে বলল, তোমার বাবা মারা গেছেন আরো বছর তিনেক আগে, তোমার মায়ের সাথেই আলাদা ফ্ল্যাট নিয়ে থাকছি আমি, এটা কেউ জানে না। তোমার মা গতরাতেও হাসপাতালে ছিলেন, কেবল তোমাকে দেখতে চান।

শিরিন আপা যেন আকস্মিক ধাক্কা খান৷ বাবার মৃত্যু সংবাদটা যেন ভেতরটা চুরমার করে চলেছে, মায়ের অসুস্থ মুখটা চোখে ভাসতেও শিরিন আপা ব্যাকুল হয়ে বললেন, আমার মা কেমন আছেন এখন?

এখন একটু ভালো, মাকে দেখতে যাবে না? প্লিজ?

শিরিন আপা কোনো কথার উত্তর না দিয়ে সাজুর গাড়িতে যেয়ে বসেন। সাজুর এক আসমান সমান আনন্দ নিয়ে রিক্সা থেকে ব্যাগপত্র নামিয়ে গাড়িতে তুলে নেয়।

শিরিন আপার চোখে পানি, টপটপ করে চোখ থেকে পানি পড়ে চলেছে। ঠিক এমনি এক বৃষ্টির দিনে স্বামী, ঘর ছেড়ে লীলা বোর্ডিং এ উঠেছিলেন। আর আজ? আজ তো লীলা বোর্ডিং ছেড়ে সেদিনের মতো বৃষ্টির দিনে সেই মানুষদের কাছে ফিরছেন। মাঝে চলে গেল সাতটা বছর!

দিন তিনেক পেরিয়ে গেছে, লীলা বোর্ডিং এর গেটের সামনে টিনের প্লেটে সাদা অক্ষরে লেখা,
” বিক্রয় হইবে লীলা বোর্ডিং”
যোগাযোগঃ ০১৭১*******
তেজগাঁও, ঢাকা-১২১৫

সন্ধ্যে নাগাদ লীলা বোর্ডিং এর সামনে লাল রঙা গাড়ি এসে থেমেছে। কেয়া কেজি পাঁচেক মিষ্টি, ফলফলাদি সহ নানান গিফট নিয়ে এসেছে সবাই সারপ্রাইজ দিতে। কেয়া গাড়ি থেকে নামতেই হাসান মামা মলিন মুখ নিয়ে কেয়ার দিকে এগিয়ে এসে বলল, আপা, আছেন কেমন?

কেয়া, হাসান মামাকে দেখেই একগাল হেসে বলল, এই মামু! আছেন কেমন?

-আছি একরকম। আপনি এখন আইলেন যে? কিছু শোনেন নাই?

কী? কী শুনব?

হাসান মামা কেয়াকে আঙুলের ইশারায় গেটের সামনে ঝুলতে থাকা বিজ্ঞাপনের দিকে তাকাতে বলে ক্লান্ত পায়ে উদ্দেশ্যহীন হাঁটতে শুরু করল।

লেখকঃ Borhan উদ্দিন

সমাপ্ত!

1 মন্তব্য

  1. অসাধারণ,,,, এমন গল্পই মিস করছিলাম। গল্পটা আসলেই অন্যরকম সুন্দর এক গল্প।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে