#লীলা_বোর্ডিং_১২১৫
খন্ডঃ০৮
বাবার বয়সী একটা পুরুষের সাথে রেস্টুরেন্টে পাশাপাশি বসে খাচ্ছি ব্যাপারটা দৃষ্টিকটু না?
খাইরুল সাহেব শায়লার এমন প্রশ্নের উত্তরে জুসের গ্লাসে বার দুয়েক চুমুক দিয়ে বললেন,না, মোটেও দৃষ্টিকটু না। মনে স্বচ্ছতা থাকলে সব সুন্দর।
আচ্ছা বাদ দিন, আপনি বুঝবেন না। তা আপনার মেয়ে কানাডায় পৌঁছে গেছে ভালোই ভালোই?
-হ্যাঁ, পৌঁছে গিয়ে বিশাল বড় একটা মেসেজ করেছে। মেসেজে লেখা ছিল, “Safely reached “। হা হা৷
হাসির কী আছে এখানে! এত লম্বা জার্নি করে গেল, তাই অল্পতেই জানিয়ে দিয়েছে৷
-তুমি আমার মেয়েকে চেনো না শায়লা। সে মাসে একদিনও আমার সাথে যোগাযোগ করবে না যতক্ষণ আমি না যোগাযোগ করি। বললে খারাপ শোনায়। তবুও বলি, আমার মেয়েটা কেমন যেন স্বার্থপর স্বভাবের । আমার জ্বর হলে, শরীর খারাপ হলে সে ফিরেও তাকাত না, সে ব্যস্ত সারাক্ষণ বন্ধুদের নিয়ে, এটাসেটা নিয়ে৷ মায়ের স্বভাব মেয়েটা পায়নি, পেলে আমার এত কষ্ট থাকত না। এইযে গেল,ও আর এই দেশে আসছে না। আমি মরেছি শুনলেও ও আসবে না।
আহ,এমনভাবে বলনে কেন! ছোটো মানুষ, তাই একটু বেখেয়ালি , ঠিক হয়ে যাবে।
-শায়লা, তুমি তোমার বাবাকে ভালোবাসতে না?
শায়লা বার্গারটা কামড় দিতেও গিয়েও দেয় না, প্লেটে নামিয়ে রেখে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, আব্বা ছিলেন মাটির মানুষ। মসজিদের ইমাম, গায়ে সারাক্ষণ আতরের গন্ধ লেগে থাকত। আমি আব্বাকে দেখলেই ছুটে যেয়ে আব্বার বুকে নাক ঘষতাম, দাড়ি ধরে টানতাম। আব্বা হাসতেন। আমার বয়স যখন ছয়,তখন আব্বা মারা গেলেন সাপের কামড়ে। ছয় বছর বয়সেই আব্বার ভালোবাসা হারালাম, আমাকে কত যে আদর করত আব্বা। আর আমি? আমি তো আব্বা বলতে পাগল ছিলাম, আমাকে রেখে আব্বা মসজিদেও যেতে পারতেন না। নানা অজুহাত দিয়ে বের হয়ে যেতেন।
– তোমার মা? উনি কোথায়?
উনি আমাকে ফেলে রেখে দুঃসম্পর্কের এক মামাকে বিয়ে করলেন। আমি কত কাঁদলাম তবুও আমাকে সঙ্গে নিলেন না। না নিয়েই ভালো করেছিল। এই! আপনি বার্গার খান, জুড়িয়ে যাচ্ছে তো।
খাইরুল সাহেব কিছুই মুখে দেন না। নরম স্বভাবের খাইরুল সাহেব অপরাধীর মতো বললেন, আমি সরি শায়লা। তোমাকে পুরনো কথা মনে করিয়ে কষ্ট দিয়ে ফেললাম।
আরে না, না। কষ্টের কী আছে! এগুলো ধ্রুব সত্য আমার জীবনে৷ সত্য যতই নির্মম হোক মেনে নিতে হয়ে, তার সাথে মানিয়ে নিতে হয়। আমি মেনে নিয়ে মানিয়ে নিয়েছি। মিথ্যা কেবল মেনে নেয়া যায় না, তার সাথে মানিয়ে নেয়াও যায় না। যেমনটা আমার এই বেশভূষার সাথে পারছি না৷
-এভাবে বলো কেন শায়লা! এভাবে আর বলবে না। আচ্ছা ওঠো আজ, ভালো লাগছে না এখানে। চলো দিয়াবড়ির দিকে যাই, খোলা রাস্তা ধরে হাঁটব। যাবে?
যাওয়া যেতে পারে, তবে সন্ধ্যার আগেই ফিরতে হবে কিন্তু।
লীলা বোর্ডিং এর গেস্টরুমে বিচার বসেছে। জান্নাত বিচার দিয়েছে কানিজের কাছে। জান্নাত বাথরুমে গেলে শ্রাবণী ইঁদুরের বাচ্চা ছেড়ে দিয়েছিল দরজার ফাঁক দিয়ে। কেবল ইঁদুরের বাচ্চা ছেড়েউ ক্ষান্ত হয়নি, সাথে বাতিও নিভিয়ে দিয়েছিল। শিরিন আপা কলেজে বলে কানিজের কাছে বিচার দিয়েছে জান্নাত। কানিজের সামনে মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে আছে শ্রাবণী, জান্নাত কপাল কুঁচকে শ্রাবণীর দিকে তাকিয়ে আছে।
কানিজ ভারী ভারী মুখ করে বলল, শ্রাবণী! তুই ইঁদুর ছেড়ে বাতিটা নিভিয়ে দিলি। জান্নাত যদি বাথরুমে পড়ে মাথাটা ফাটাত? তখন কী হতো?।
শ্রাবণী কোনো উত্তর দিতে পারে না। শ্রাবণীর চুপ করে থাকা দেখে রুবাইয়া বলল, তুই এটা কোনো কাজ করলি? তুই ইঁদুর ছেড়েছিস ভালো কথা, বাতি নিভালি কেন?
কানিজ রুবাইয়ার দিকে চোখ পাকিয়ে বলল, ইঁদুর ছাড়া ভালো কথা? মাইর তো তোকে দেয়া দরকার।
রুবাইয়া ফিক করে হেসে বলল, আরে আমি সেটা মিন করিনি আপু।
মোনা শ্রাবণীর দিকে তাকিয়ে বলল, কিরে শ্রাবণী! ইঁদুরের বাচ্চা পেলি কোথায়? কেউ ইঁদুরের বাচ্চা ছাড়ে? তেলাপোকা ছাড়লে একটা কথা ছিল।
জান্নাত দাঁত কটমট করে বলল, কানিজ আপু! তুমি কিছু বলবা না! এই বিচার তোমার?
কানিজ মোনাকে ইশারায় চুপ করতে বলে শ্রাবণীকে কড়া গলায় বলল, শ্রাবণী! তুই জান্নাতের জন্য দুটো হিজাব কিনে নিয়ে আসবি আর এক বাটি রসমালাই, আর সবার সামনে কথা দিবি এমন ফাজলামি আর করবি না? রাজি থাকলে এখনি কিনে নিয়ে আয়, আর না থাকলে বিচার শিরিন আপা এসে করবে।
শ্রাবণী একমুহূর্ত ভেবে দেখল শিরিন আপা বিচার করলে কঠিন বিচার হবে । তাই অগত্যা কানিজের বিচার মেনে নিয়ে মুখ কালো করে বলল, আচ্ছা যাচ্ছি আনতে।
জান্নাত মুচকি হেসে বলল, পেস্ট কালার আর পিত্তি রঙের হিজাব আনবি, ঐ দুই কালার পছন্দ আমার। আর কুমিল্লার রসমালাই আনবি।
শ্রাবণী হনহনিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যেতেই সবাই হো হো করে একসাথে হেসে উঠল।
বিকেল নাগাদ কলেজ থেকে ফিরলেন শিরিন আপা। রিক্সা থেকে বোর্ডিং এর গেটের সামনে নামতেই কালো রঙের একটা গাড়ি শিরিন আপার সামনে এসে থামল। গাড়ি থেকে সাজুকে নামতে দেখেই শিরিন আপা ধাক্কা খেলেন। সাজু শিরিন আপার সামনে দাঁড়িয়ে অনুরোধের সুরে বলল, একটা মিনিট আমাকে দাও শিরিনি, প্লিজ।
-ও! আমার বোর্ডিং ও চিনে গেছেন। তাইতো বলি সাকিবকে চাকরিটা কে দিল। এনিওয়ে, মানুষের মতো এই প্রথম কোনো কাজ করলেন। আপনার অনেক দয়া ভাই, আল্লাহ আপনাকে এর প্রতিদান দিবেন। রাস্তা ছাড়ুন এবার।
শিরিন, আমার দুটো কথা তো শোনো প্লিজ৷ এভাবে যেও না, আমি সেই সকাল থেকে বোর্ডিং এর সামনে অপেক্ষায় আছি।
-আপনাকে কেউ অপেক্ষা করতে বলেনি। রাস্তা ছাড়ুন, নাহলে দারোয়ান এসে আপনার গায়ে হাত তুললে আমার কিছু করার থাকবে না।
আমাদের সবকিছু এভাবে ভুলে যাচ্ছো কেন? আমার একটা ভুলের কারণে এতবড় শাস্তি কেন দিচ্ছো?
– ও! ওটা ভুল ছিল? শোনেন ভাই, আপনি আমার প্রাক্তন৷ প্রাক্তনেরা হয় বমির মতো, যাদের গিলতে নেই, তারাই বমিকে গিলে খায় যারা বুভুক্ষু কিংবা পিশাচ। আমি দুটোর কোনোটাই নই যে। ভালো থাকবেন৷ ও হ্যাঁ, আজ রাতে সাকিবের বিয়ে হবে, ওদের জন্য দোয়া রাখবেন।
সাজু বার কয়েক শিরিন শিরিন বলে ডাক দিলেও শিরিন আপা পিছনে ফিরে তাকান না। দ্রুত কদমে বোর্ডিং এর ভিতরে ঢুকে যান।
বোর্ডিং এ যেন আজ ঈদ নেমেছে। সবাই হাতে মেহেদী দিয়েছে, সবাই একই রঙের শাড়ি পরেছে। মিনু মস্ত হাঁড়িতে বিরিয়ানি রেঁধে চলেছে, শিরিন আপা খাসির রেজালা করে চলেছেন। সাকিব আর জুঁইয়ের আজ যে বিয়ে। গ্রাম থেকে দুই পরিবারের অভিভাবক এসেছে। সবাই আসলেও কেবল লীলা হালদার এখনো আসেননি। শিরিন আপা বারবার ফোন করলেও লীলা হালদার ফোন উঠায়নি।
সাকিবকে অফিস থেকে আ্যডভান্স দুই মাসের বেতন আর ফ্ল্যাট দেয়া হয়েছে। সেই ফ্ল্যাটেই উঠবে জুঁইকে নিয়ে। শিরিন আপার রুমে জুঁইকে সাজিয়ে দিচ্ছে শ্রাবণী, রুবাইয়া আর জান্নাত। শায়লা ব্যস্ত মেহমানদের আপ্যায়নে।
শিরিন আপা হাসান মামাকে পাঠিয়েছিলেন লীলা হালদারের বাসায়। বাসায় তালা মারা নাকি। লীলার জন্য বেশ অঅনেকক্ষণ অপেক্ষা করে বেশ রাত করেই সাকিব আর জুঁইয়ের বিয়ে পড়ানো হলো। জুঁই সাকিবের ফ্ল্যাটে যাবার আগে সবাইকে গলা জড়িয়ে কেঁদে গেল। জুঁইয়ের কাছে এ যেন নিজের বাড়ি। বোর্ডিং এর সবাইর চোখে জল। হাসান মামাও কাঁদছেন জুঁইয়ের চলে যাওয়া দেখে।
শিরিন আপা চোয়াল শক্ত করে জুঁইকে যাবার আগে বলে দিয়েছেন, সংসার একটা ধাঁধার নাম, ধাঁধা মিলে গেলেই পানসে লাগে তখন। নিজেকে সস্তা করবে না কখনো, স্কুলের চাকরি ছাড়বে না, টিউশন কমিয়ে দিও। আপোষ করতে করতে আত্নসম্মান গিলে খেও না, সমস্যা হলেই আমাকে জানাবে। জানাবে তো?
উত্তরে জুঁই সকল জড়তা ভেঙে, দূরত্বের দেয়াল ভেঙে শিরিন আপাকে জড়িয়ে ধরে গুঙিয়ে কেঁদে বলেছে, আপা! আপনি এত ভালো কেন?
চলবে….
লেখকঃ Borhan uddin