#লীলা_বোর্ডিং_১২১৫
খন্ডঃ০৯
সারা রাত একচিমটি ঘুম হয়নি শিরিন আপার। গত সাতটা বছর ধরে কল্পজগতে যে পুরুষের মুখে সকাল-সন্ধ্যে থুতু ছিটিয়েছিলেন গতকাল রাতে সেই মুখটাকে বারবার মনে পড়ছিল, ঘৃণা নয়, মায়ার টানে। শিরিন আপার বারবার মনে পড়ছিল তাদের বিয়ের দিনের কথা।
মায়া,ভালোবাসা অনেকটা ফসলের বীজের মতো। ঘৃণায় তা মাটি চাপা দিলেও তা থেকে একটা সময় পর গাছ বেরোয়, সেই গাছ ধীরেধীরে বড় হয়, বুকের ভেতর বেড়ে ওঠা সেই গাছের দেখা ঘৃণা করা মানুষটা কখনো দেখতে পায় আবার কখনো পায় না। সাজু হয়তো সেই গাছের দেখা পেয়েই বারবার ছুটে আসে শিরিন আপার কাছে।
গতকাল রাতের বেচে যাওয়া খাবার কিচেনে গরম করে চলেছে মিনু। রাত জাগার কারণে কেউ এখনো ওঠেনি, শিরিন আপা ঝটপট গোসল সেরে কলেজের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন। বাইরে থেকে কেউ দরজায় মৃদুভাবে টোকা দেয়, শিরিন আপা ব্লাউজের বোতাম লাগাতে লাগাতে উঁচু গলায় বললেন, কে?
আপা, আমি। শায়লা।
ওহ আচ্ছা, শায়লা ভেতরে আসো।
শিরিন আপা পাকা হাতে দেয়ালে বাঁধানো ছোট্ট আয়নাটা দেখে চোখে কাজল দিতে দিতে বললেন, এত সকালে যে? রাতে ঘুম হয়নি?
শায়লা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,আমার ঘুম মরা বাড়িতেও আসে আপা।
শিরিন আপা বাঁ চোখে কাজল দিতে গিয়েও থেমে যান, শায়লার মুখের দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় বললেন, তুমি আমার চেয়েও অনেক শক্ত স্বভাবের, আমি জানি। আচ্ছা কিছু বলবে হয়তো তুমি।
জ্বি। শ্রাবণীর জন্মদিন আজ। মেয়েটাকে চমকে দিতে চাই, হাজার পাঁচেক টাকা লাগবে আমার, বেতন পেলেই দিয়ে দেব৷
শিরিন আপা আয়না দেখে গোলাপি রঙা লিপিস্টিক হালকা করে ঠোঁটে ঘষে নিয়ে খানিকটা অবাক হয়েই বললেন, পাঁচ হাজার টাকা! খরচটা বেশিই করে ফেলছো না তো?
আমার নিজের জন্য হলে পাঁচশো টাকাও বেশি মনে হতো। কাছের মানুষদের জন্য টাকা কেবল কাগজে কয়েকটা সংখ্যার খেলা মাত্র।
শিরিন আপা যেন প্রস্তুতই ছিলেন শায়লাকে টাকা দেবার জন্য৷ আলমারি খুলে এক হাজার টাকার পাঁচটা নোট বের করে শায়লার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, পুরো টাকা একবারে দেবার দরকার নেই, তিনমাসে দিও।
শায়লা টাকাগুলো হাতে নিয়ে মুচকি হেসে কেবল দুবার মাথা ঝাঁকাল৷
কলেজে গেটে নেমে রিক্সাওয়ালার ভাড়া দিয়ে কলেজে ঢুকতে যাচ্ছিল শিরিন আপা, এমন সময় সাজু এসে হাজির। সাজু দুই হাত জড়ো করে করুণ সুরে বলল, স্রেফ দুইটা মিনিট দাও আজ, শুধু দুইটা মিনিট। প্লিজ?
শিরিন আপা আজ আর মেজাজ দেখালেন না। একমুহূর্ত কী যেন ভেবে রসকষহীন গলায় বললেন, আচ্ছা, ছুটির পর। এটুকু বলেই দ্রুত কদমে কলেজের ভেতর ঢুকে গেলেন।
কলেজের বাইরে অধীর আগ্রহ, উত্তেজনা নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল সাজু। আর ক্লাসে যেন আজ মন বসছে না শিরিন আপার। একই কথা তিনি দু তিনবার বলছেন৷ শিরিন আপার হুট করে কেন যেন মনে হলো সাজু ফিরে যায়নি, ছুটি পর্যন্ত গেটের বাইরে আজও দাঁড়িয়ে থাকবে৷ শিরিন আপা ক্লাসের জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই দেখলেন সাজু তার গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে, বারবার কলেজের গেটের দিকে তাকাচ্ছে সাজু। শিরিন আপা আজ নিজেকে দেখে অবাক হচ্ছেন, এমনটা তো তিনি ছিলেন না। হুট করেই কোন টানে আজ এত অস্থির লাগছে ঘৃণা করা মানুষটার প্রতি?
শিরিন আপা ক্লাস নেন না, নিতে পারেন না। প্রিন্সিপালের কাছে ছুটি চাওয়া মাত্রই প্রিন্সিপাল ছুটি দিয়ে দিলেন। দেবেই না কেন? শিরিন আপার মতো কাজের প্রতি নিষ্ঠাবান একটা শিক্ষকও নেই গোটা কলেজে। শিরিন আপাকে কলেজ থেকে বেরোতে দেখামাত্রই সাজু এগিয়ে এসে বলল, ছুটি নিয়েছ?
শিরিন আপা উত্তর না দিয়ে হাঁটা শুরু করেন। সাজুও পেছন পেছন হাঁটতে থাকে। কলেজ থেকে খানিকটা দূরে আসতেই শিরিন আপা দাঁড়িয়ে পড়লেন৷ চোয়াল শক্ত করে বললেন, কী বলতে চান বলুন।
সাজু দম নিয়ে বলল, আমার প্রতি রাগ এখনো কমেনি?
-আপনার ভুল হচ্ছে। ওটা রাগ নয়, ঘৃণা। তীব্র ঘৃণা।
সাজু খানিকক্ষণ শিরিন আপার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, আমি তোমাকে আমাদের অভাবের দিনে বাবার বাড়িতে গিয়ে থাকতে বলেছিলাম বলেই ঘৃণা? আমার চাকরি হয়ে গেলে তোমাকে নিয়ে আসব, এটা বলিনি আমি?
-কোনো ব্যাখায় যাব না, জবাবদিহিতার প্রয়োজন মনে করছি না।
আমি করছি। শিরিন, তুমি যেদিন থেকে বাবা-মা ছাড়া, ঘর ছাড়া সেদিন থেকেও আমিও তাই। একটা দিনের জন্যও নিজের ঘরে যাইনি, বাড়িতে নিয়মিত টাকা পাঠিয়েছি, যোগাযোগ রেখেছি, কিন্তু বাবা-মায়ের কাছে যাইনি। ঠিক করেছিলাম, ঘরে তোমাকে নিয়েই ফিরব। ব্যাপারটা তো এমন না যে বাবা-মায়ের আদর থেকে তোমাকে বঞ্চিত করে আমি বাবা-মায়ের আদরে দিন কাটিয়েছি।
শিরিন আপা সাজুর মুখের দিকে একপলক তাকিয়ে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বললেন, আপনি কী করেছেন সেগুলার হিসেব আমি চেয়েছি?
না, তুমি চাওনি। তবে বাচ্চাদের মতো মিছে অভিমান করে আছো। শিরিন, সংসার মানে ছেলেবেলার মতো ছোট্ট হাঁড়িতে মাটি দিয়ে মিথ্যেমিথ্যি খেলা করা না। এখানে দায়িত্ব, অর্থের যোগান সব লাগে। পুরুষের বুক পকেটে টাকার গরম না থাকলে দুনিয়া অন্ধকার লাগে, পানসে লাগে। ঐ টাকার গরমে স্বচ্ছলতা আসে। সুখ আপেক্ষিক আমি মানি, তবে ভালোবাসার মানুষটার ওমন আধপেটা দিন, চোখের কালি সহ্য করতে পারিনি বলেই তোমাকে বলেছিলাম বাবার কাছে ফিরে যেতে। আচ্ছা শিরিন, এইযে সাকিব এত ভালোবাসে জুঁইকে, একটা চাকরির অভাবে তো ছেলেটা বিয়ে করতে পারছিল না, চাকরিটা হতেই বিয়ে করে নিল। সাকিবের মতো বাকি নয়টা ছেলেই স্বচ্ছলতার আগে বিয়ে করার দুঃসাহস দেখাবে না, যেটা সংসারের নিয়ম। আর দশটার ভেতর বাকি একটা ছেলে আমার মতো দুঃসাহ দেখাবে। তারপর বুঝতে পারে সংসারটা জীবনানন্দের কবিতার মতো এত সুন্দর না৷
-আহ! ইনাফ, এত লেকচার কে শুনতে চেয়েছে? আর সাকিবকে চাকরি দিয়ে খোটা দিচ্ছেন? দয়ালু সাজতে এসেছেন? আমি তো বলিনি আমাকে দয়া দেখাতে।
শিরিন! এমন করে কথা বলছো কেন? আমি তো দয়ার কথা বলিনি। আমি স্রেফ কিছু তেতো সত্য বললাম।
-আপনার তেতো সত্য আপনি আপনার পকেটে রাখুন। ঘর ছাড়া মেয়ের ঘরে ফেরার যন্ত্রণা, অপমান নব্য ধনী মানব টের পাবে না এটাই স্বাভাবিক। দুই মিনিটের বেশিই দিয়েছি। আপনার মুখটা আর কখনো দেখাবেন না আমাকে। আসি, আর হ্যাঁ পিছু নেবেন না।
সাজু পিছু নেয় না, সাহস করে না, দমে গিয়েছে। এতদিনের অপেক্ষা, যার জন্য নিজেও ঘর ছাড়ল সে-ই এমন করে চলে গেল সাজুর যন্ত্রণাটা টের না পেয়ে!
শ্রাবণীকে নিয়ে নুহাশপল্লী এসেছে শায়লা। ছোট্ট কদবেল গাছটা একশো বেলুনে সাজিয়েছে দুজন মিলে। দাঁড়ালেই হাত দিয়ে বেলুন ধরা যাচ্ছে। মৃদু বাতসে বাহারি রঙের বেলুনগুলো নেচে চলেছে। ঘাসের গালিচায় দুজন বসে একসঙ্গে কেক কাটে। কেক কাটা হতেই পুকুরের মাঝে বানানো ছোট্ট দ্বীপটায় বসে দুজন দুপুরের খাবার সেরে নিয়ে গোটা নুহাশপল্লী ঘুরে বেড়ায় দুজন।শেষ বিকেলে
আসা আচমকা বৃষ্টিতে দুজন গাছের ওপর বানানো ছোট্ট ঘরটায় আশ্রয় নেয়। শ্রাবণী শায়লার হাত ধরে আদুরে গলায় বলল, এত সুন্দর একটা দিন আমি আগে কখনো পাইনি আপু। শায়লা ব্যাগ থেকে একটা লাল রঙা পুতুল শ্রাবণীর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, এটা পুরোটাই পুঁথি দিয়ে গড়া। দিনের আলোর সাথে সাতে এই পুতুলের রঙ বদলে যায়। পুতুলটার দিকে তাকিয়ে দেখো, কী হাসিখুশি! কত সুখে আছে, তুমিও আমার কাছে এই পুতুলের মতো। নিজের সুখ, হাসি এগুলো অন্যর জিম্মায় দিয়ে দিও না, দিলেই তুমি একা হয়ে পড়বে। হাসতে ভুলে যাবে। নিজেকে এই পুতুলটার মতো রেখো, যখন যেমন দরকার পড়বে তেমন করে খালি বদলে নেবে পুতুলটার মতো। নেবে তো?
শ্রাবণীর চোখে জল, কতদিন পর সে কাদঁল আজ! শ্রাবণী আনন্দে দুবার মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, নেব আপু, নেব।
লীলা বোর্ডিং এ আজ গতকালের মতো সবাই আজও বেশ উৎফুল্ল। রুবাইয়াকে পার্টি থেকে হল সভাপতি বানানো হয়েছে, এই খুশিতে সে রসগোল্লা নিয়ে এসেছে সবাইকে খাওয়াবে বলে। আর কানিজ নিজ হাতে কেক বানিয়েছে শ্রাবণীর জন্মদিন উপলক্ষে। শিরিন আপার উপস্থিতিতে কেক কাটা হলো, মিষ্টি খাওয়া হলো। রাতের খাবার খেতে যাচ্ছিল সবাই এমন সময় লীলা হালদার বোর্ডিং এ ঢুকল। লীলার চোখ দুটো লাল হয়ে আছে, চুলগুলো কেমন ফ্যাকাশে হয়ে আছে, আর সমস্ত মুখজুড়ে বিষাদের ছাপ। শিরিন আপা উৎকন্ঠিত হয়ে বারবার জিজ্ঞেস করল, লীলা কী হয়েছে তোর? ফোন অফ কেন? কাল আসলি না কেন? এমন দেখাচ্ছে কেন?
লীলা হাউমাউ করে কেঁদে উঠল শিরিন আপার প্রশ্নের উত্তরে। কান্না যেন থামবেই না আজ আর।
চলবে….
লেখকঃ Borhan uddin