লবঙ্গ লতিকা পর্ব-২০(শেষ পর্ব)

0
1430

#লবঙ্গ লতিকা
#নুজহাত আদিবা
পর্ব ২০

নাগরদোলা থেকে নামা মাত্রই সাদের মাথা চরকার মতো ঘুরতে শুরু করলো। বহুকষ্টে দুলতে দুলতে বাড়ি এলো। ঘরে ঢুকেই ধপাস করে দরজা লাগিয়ে দিলো। তমাকে যদি একটা শিক্ষা না দিয়েছে তবে তাঁর নামও ইরফান রশিদ সাদ না!

তমা আর আঙুর বালা রাতে একসঙ্গে ঘুমোচ্ছে। তমার তখন সবেমাত্র চোখ লেগে এসেছে। কারো ফুঁপানোর শব্দ শুনে উঠে বসলো তমা। আঙুর বালা বালিশে হেলান দিয়ে চোখের পানি মুছছে। তমা মায়াভরা কন্ঠে আঙুর বালাকে বললো,” কী হয়েছে দাদু? তুমি কাঁদছো কেন?”

আঙুর বালা কাঁদো কাঁদো গলায় বললো,”আর কী হইবো? কিছু হয় নাই।”

তমা আঙুর বালার আঁচল ধরে বললো,”তাহলে শুধু শুধু কান্না করছো কেন?”

আঙুর বালা তমাকে ঝারি মেরে বললো,” আমার কান্দন আমি কান্দি। তোর কী?”

তমা এবার চুপ হয়ে গেল৷ আর কোনো কথা না বলে, আঙুর বালার পাশে বসে রইলো। আঙুর বালা চোখের পানি মুছতে মুছতে বললো, ” আজকা তোর দাদার কথা বার বার মনে পরতাসে। তুই আর ওয় যহন মেলায় গেলি আমার বুকটা খাঁ খাঁ কইরা উঠসে। আমি যহন বিয়া কইরা এই বাড়িতে আইলাম। তহন আমি তোর মতো। হ্যাং/লা, জুংলা একটা চিকনা পাতলা শরীর লইয়া হারাদিন টইটই করতাম। আমার শাশুড়ী আবার এডি পছন্দ করতো না। বাইরে গেলে কী গাইল(গাল) যে পারতো! একবার হুনলাম মাঠের ওইদিকে মেলা হইবো। তোর দাদারে কইলাম। হ্যায় আমারে বিকালে লইয়া গেল। কতকিছু কিনা দিলো। ঝালমুড়ি, বাদামবুট খাওয়াইলো। আহারো! মানুষটা নাই। হারাদিন খালি হ্যার কথা মনে পরে।আমারে কত ভালোবাসতো। চল হ্যানে ঘুরতে যাই। এইডা খাই ওইডা খাই। আমার আর ভাল্লাগে না রে! আল্লাহ এত মানুষের মর/ন দেয়। আমি মরি না ক্যা? আমার আর একলা একলা ভালা লাগে না। কারে লইয়া থাকুম আমি?”

আঙুর বালা চোখের জল ফেলতে ফেলতে কথাগুলো বললেন। তমার মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছে। চুপটি করে আঙুর বালাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পরলো তমা।

সকালে তমা পুকুর পাড়ে বসে বসে পা দোলাচ্ছে। এমন সময় সাদ সেখানে এসে উপস্থিত হলো। তমা সাদকে দেখে গান ধরলো,” ১৫ আর ১৬ নাগরদোলায় দোলো।”
সাদের মাথায় যেন দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠলো। এই মেয়েটা ভারী বেয়া/দব তো! সাদ তমার দিকে তেড়ে গিয়ে বললো,”তুমি কিন্তু বেশি বাড়াবাড়ি করছো তমা! তোমাকে আমি দেখে নেবো।”

তমা ফিক করে হেসে বললো,” কাল নাগর দোলার ঘুরনি খেয়ে মাথা আছে না গেছে? সাত-সকালে এত মাতলামি না করে ঘরে গিয়ে ঘুম দিন। যান!”

সাদ এবার রেগেমেগে আগুনের জমাট বাঁধা কুন্ডলীর ন্যায় তমাকে বললো, “তোমার হাল যদি বেহাল না করেছি তবে আমার নাম সাদ না।”

তমা দাঁত বের করে হাসতে হাসতে বললো,” আপনার নাম সাদ না পাদ! হাহা!”

সাদ এবার রেগে গিয়ে তমাকে ধাক্কা দিয়ে পুকুরে ফেলে দিলো। তমা পুকুরে পরে গিয়ে টুপ করে ডুবে গেল। পানির নিচে শ্বাস বন্ধ করে বসে করে নিচে বসে থাকলো। সাদ পানির দিকে তাকিয়ে রইলো। তমা গেল কোথায়?পাঁচ মিনিট আগে তমাকে পুকুরে ফেলে দিয়েছে। এখনও উঠলো না যে? তমা আবার মরে-টরে গেল না তো? সাদ ভয়ে ভয়ে এক পা এক পা করে পানিতে নামল। কিন্তু কীসের তমা কীসের কী!

পেছন থেকে শিস বাজানোর শব্দ শুনে সাদ পেছনে ফিরে তাকালো। ওমা সেকি! তমা তো পানির নিচে ছিল। তবে ওপরে উঠলো কী করে? তমা সাদকে অবাক করে দিয়ে বলে উঠলো,” ছোটবেলা থেকে গ্রামে বড় হয়েছি।সাঁতার জানি!”

এটুকু বলেই তমা পুকুর পাড় থেকে লাফাতে লাফাতে চলে এলো। সাদ মদন হয়ে পুকুরে বসে থাকলো। অন্যকে পানিতে ফেলতে গিয়ে নিজেই কিনা শেষমেশ পানিতে পরে গেল!

সাদ ঘরে ঢোকার সময় শুনতে পেল আঙুর বালা আর অনিতা গল্প করছে। অনিতা কথা প্রসঙ্গে আঙুর বালাকে বলতে লাগলো,” সাদ যখন পড়াশোনা শেষ করে চাকরি-বাকরি করবে। তখন, সাদ আর তমার বড় করে বৌভাতের অনুষ্ঠান করবো। তমার জন্য কত গহনা তুলে রেখেছি আমি। লাল টুকটুকে একটা শাড়ি পরিয়ে তমাকে ঘরে তুলবো আমরা। আমার ছেলের একটা মাত্র বউ।”
সাদ এটুকু শুনে মুচকি হাসলো। তাঁর মায়ের এত স্বপ্ন তমাকে নিয়ে। একবার যদি টের পেতো তমার পেটে পেটে এত শয়তা/নি আর কু/বুদ্ধি তাহলে আর ভুলেও তমার দিকে ফিরে তাকাতো না।

ইদের ছুটি শেষ, কাল থেকে স্কুল কলেজ সব শুরু। তমারও কাল থেকে স্কুল শুরু। সাদের ও কলেজ শুধু কাল থেকে। তাই আজ দুপুরে খাবার খেয়েই সবাই রওনা দেবে।

তমার আজ মন ভীষণ খারাপ। সাদ চলে গেলে কার সঙ্গে ঝগড়া করবে তমা? কেন সাদ এত অল্প সময়ের জন্য আসে? আর কতগুলো থেকে গেলে কী হতো? কলেজে কয়দিন না গেলে কী এমন ক্ষতি হতো? তমা দুপুরে রাগ করে কিছুই খেলো না। সাদ চলে যাওয়ার আগে একবার সাদের সঙ্গে দেখাও করলো না।রাগে দুঃখে গাছতলায় মাথা নিচু করে বসে রইলো।

সাদকে অনিতা তাড়া দিতে শুরু করলেন। এখন না বের হলে দেরি হয়ে যাবে পৌঁছাতে পৌঁছাতে। সাদ ঘুরে ফিরে শুধু তমাকে খুঁজছিল। তমাকে খুঁজে না পেয়ে পুকুর পাড়ে দৌড়ে গেল। তমা যে সেখানেও নেই। তবে গেল কোথায় তমা? তমাকে খুঁজতে খুঁজতে বাড়ির পেছনের গাছ তলায় এলো সাদ। তমা মাথা নিচু করে বসে আছে। সাদ তমার সামনে গিয়ে হাঁটু মুড়ে বসে তমাকে ডাক দিলো,”তমা!”

তমা প্রত্ত্যুতরে কোনো জবাব দিলো না। এই মানুষটার সঙ্গে কোনো কথা নেই তমার। সাদ তমার মাথাটা উঁচু করে ধরলো। কেঁদে কেটে মুখ লাল টকটকে বানিয়ে ফেলেছে। সাদ বিনয়ের স্বরে বললো,” আমি কী একেবারে চলে যাচ্ছি? আবার আসবো তো!”

তমা তবুও নিরুত্তর। সাদ তমাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে গভীর মমতায় বললো,”এই কিছুদিন পরপরই তো দেখা হয়। তবুও তুমি এমন কেন করো? ফোন ও তো আছে? ভিডিও কল দেবে আমাকে দেখতে পাবে।”

তমা সাদের হাত সরিয়ে দিয়ে বললো,” ওখানে শুধু দেখা যায়। ছোঁয়া তো যায় না!”

সাদ এবার কিছুটা চুপ হয়ে গেল। তমার কথার কোনো উত্তর খুঁজে পেল না। নিবিড় কন্ঠে তমাকে বললো,” এখন তো অল্প অল্প দেখা হচ্ছে। আমার যখন পড়াশোনা শেষ হবে তখন অনেক অনেক দিন একসাথে থাকতে পারবো আমরা। এখন যদি পড়াশোনা ঠিকমত না করি। ফাঁকি দেই তাহলে তো আম্মু তোমার সঙ্গে দেখাই করতে দেবে না।”

তমা চুপ করে বসে রইলো। সাদ স্নেহ মাখা কন্ঠে তমাকে বললো,” আমি যাই এবার? ”

তমা মাথা নাড়িয়ে বললো,” আবার আসবেন তো?”

সাদ হেসে বললো,” আবার যখন আসবো অনেক অনেক দিন থাকবো। খুব মজা করবো তখন।”

তমা হঠাৎ দৌড়ে এসে সাদকে জাপটে ধরলো। সাদ নিবিড় বন্ধনে আঁকড়ে ধরলো তমাকে। তবে, দূর থেকে অনিতার গলার স্বর শুনে আস্তে আস্তে বাঁধন হালকা করে সাদকে মুক্ত করে দিলো তমা।

“আসি তবে” সাদ এটুকু বলেই পেছন ফিরে হাঁটতে শুরু করলো। তমা পেছন থেকে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। সাদ কিছু দূর গিয়েই আবার পেছন ফিরে তাকালো। অবাক করা বিষয় সে আর ক্রদনরত তমাকে দেখতে পাচ্ছে না! দেখতে পাচ্ছে লাল শাড়ি ও অলংকার পরিহিত বিয়ের সাজে দাঁড়িয়ে থাকা তমাকে।
আচ্ছা! মা যে বলেছিল তমাকে লাল শাড়ি পরিয়ে বৌভাতের অনুষ্ঠান পালন করবে। তখন কী তমাকে দেখতে এরকমই লাগবে?
সমাপ্ত,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে