#লবঙ্গ লতিকা
#নুজহাত আদিবা
পর্ব ১৯
“আপনি এত কি/প্টা কেন?” তমা একথাটা বলেই সাদের দিকে তাকালো।
সাদ সোফায় বসে ফোন নিয়ে ব্যস্ত ছিল। তমা সাদের সামনাসামনি বসেই সাদকে হঠাৎ কি/প্টা বলে সম্মোধন করলো। সাদ হাত থেকে ফোনটা সরিয়ে একবার তমার দিকে তাকালো। সোফা হতে উঠে বসে বললো,” আমাকে কোন দিক দিয়ে কি/প্টা মনে হয় তোমার? তুমি কি/প্টা তাই সবাইকেই নিজের মতো মনে হয় তোমার।”
তমা সোফায় পা উঠিয়ে বসতে বসতে বললো,” আজকে একটা ইদের দিন। ভেবেছিলাম আজ আপনার পিছু লাগবো না। কিন্তু, শেষ অবধি আর পারলাম না। আপনি না বলেন আপনি আমার বড়? তো বড় হয়ে আমাকে এখনও সালামী দিলেন না কেন এখনও?”
সাদ তমার কথা শুমে এবার একটু নড়েচড়ে বসলো। আজ সাদের পকেট ফাঁকা হবে এটা তো নিশ্চিত! পেছন থেকে অনিতা হঠাৎ বললো,” আসলেই তো সাদ! তুই না কি ওর বড়। তো বড় হলে যে ইদের সালামী দিতে হয় তুই জানিস না?”
সাদ বেচারা মহা বিপদে পরলো। বুদ্ধি করে তমাকে বললো,” সালামী যেহেতু চেয়েছো৷ পাবে কিন্তু সালাম তো করলে না। পা ধরে সালাম করো তারপরই সালামী দেবো।”
তমা তৎক্ষনাৎ সাদের দু”পা ধরে সালাম করলো। সাদ ভ্রু উঁচু করে বললো,” হয়নি হয়নি! এটাকে সালাম বলে না কি? তোমার সালামী বাদ! সালাম-ই করতে পারো না ঠিকঠাক ভাবে। আবার আমি সালামী কী দেবো?”
তমা অগ্নিদৃষ্টিতে সাদের দিকে তাকালো। কিন্তু সাদ নিজের মতো বসেই আছে। তমার দিকে কোনো পাত্তা নেই। তমা রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে নিজের কাজে চলে গেল। সাদকে এর শাস্তি যদি সে না দিয়েছে তাহলে তাঁর নাম তাবাসসুম তমা না! তমা তো তমা-ই! সে এর প্রতিশোধ নেবেই নেবে!
দুপুরে খাওয়া দাওয়া শেষ করে তমা অনিতার সামনে গিয়ে অনেকটা সময় ঘ্যান ঘ্যান করতে শুরু করলো। ইদের মতো একটা এত ভালো দিনে মা আর ভাইকে না দেখলে তমার ভালো লাগবে না মোটেও। অনিতা শেষমেশ অনুমতি দিয়ে দিলো। তবে, সন্ধ্যার পরে বাইরে থাকা চলবে না। তমা নতুন জুতো পায়ে দিয়ে নিজের বাড়ি চলে গেল। সাদ অবশ্য নিজের বাড়িতেই আছে। নিজের মতো হাত পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিছানায় পরে আছে।
ইদের পরদিনও গ্রামে বেশ উৎসব উৎসব ভাব রয়েছে। তমা অনিতার কাছে গিয়ে বায়না করে বললো,” আজকে বড় মাঠে মেলা হবে। আমাকে যেতে দাও না আম্মু।”
অনিতা তমার কথা শুনেই শুরুতেই না করে দিলো। এত বড় মেয়েকে একা একা বাইরে যেতে দেবেন না উনি। তমা মুখ ভার করে বসে রইলো। ভালো লাগে না আর! একটু যেতে দিলে কী হতো?
আঙুর বালা তমার মন খারাপ দেখে অনিতাকে বললেন,” ওয় একলা যাইবো ক্যা? তোমার পোলা সাদরে দিয়া পাঠায়া দাও। ছে/ড়িডা যখন এত শখ করতাসে। যাক একটু! ঘুইরা বেড়ানোর সময় তো এহনই। এহন না ঘুরলে আর কহন ঘুরবো? আমগো মতো বুইড়া হইয়া দাঁত ভাঙলে?”
অনিতা শাশুড়ির কথা শুনে আর কোনো যুক্তি খুঁজে পেলেন না। অগত্যা সাদকে বললেন তমাকে মেলায় ঘুরতে নিয়ে যেতে।
সাদ বিছানায় হাত পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে শুয়ে ছিল। অনিতা গিয়ে সেই মুহূর্তে সাদকে বললো,” বাবা, কোথায় না কি মেলা হচ্ছে? তমা যেতে চাচ্ছে। এত বড় মেয়েকে আমি একা একা ছাড়তে পারবো না। তুমি একটু নিয়ে যাও তো তমাকে।”
সাদ তমার কথা শুনে ঢোক গিললো। এই মেয়ে অনেক ভয়ংকর! কখন কী ঘটিয়ে ফেলে কে জানে!যতবার তমার সাথে বাইরে গিয়েছে তমা একটা না একটা বিপদে সাদকে ফেলেছেই! সাদ তমার সাথে কোথাও যেতে মোটেও ইচ্ছুক না। তাই নিজের মাকে বললো,” আম্মু, আমি আন্দাজে ওকে কোথায় নিয়ে যাবো? আমি তো এখানকার পথ-ঘাট চিনি না কিছু।”
অনিতাকে বিনয়ের স্বরে সাদকে বললো,”এতে কোনো সমস্যা হবে না বাবা। তমা তো এখানেই থাকে। ও তোমাকে পথ চিনিয়ে নিয়ে যেতে পারবে। এটা নিয়ে ভেবো না তুমি।এখন তাড়াতাড়ি তমাকে নিয়ে যাও। একটু পরে আবার সন্ধ্যা হয়ে যাবে। এটা তো শহর না যে সন্ধ্যা হলেও সমস্যা নেই। এটা গ্রাম, তাই তুমি বের হয়ে যাও। সাবধানে যেও, নাদিয়াও ছোট মানুষ। ওকেও সঙ্গে করে নিয়ে যেও।”
সাদ বিরক্তি মাখা মুখ করে তমাকে নিয়ে বের হলো। একটু সাবধানে সাবধানে থাকতে হবে আজ। এই মেয়ে অনেক চালাক। কখন কোন কথা বলে বিপদে ফেলে কে জানে!
তমা সাদকে পথ চিনিয়ে নিয়ে গেল। সাথে রয়েছে ছোট্ট নাদিয়া। তমা নাদিয়ার হাত ধরে তাঁকে সামলে রেখেছে। ছোট মানুষ পরে-টরে আঘাত পেলে?
গ্রামের মেলা বেশ বড়সড় ভাবেই হচ্ছে। পাশের গ্রাম থেকেও লোকজন মেলায় ঘুরতে এসেছে। তমা সাদের কাছে বায়না ধরলো তাঁকে ঝালমুড়ি কিনে দিতে। গোল গোল আলু দেওয়া ঝালমুড়ি। অনেক মজার! সাদ তিনটা ঝালমুড়ি নিলো ঝালমুড়ি ওয়ালার কাছ থেকে।
ছোট ছোট ঠোঙ্গায় রাখা ঝালমুড়ি খেতে খেতে সাদ এদিক ওদিক ঘুরে সবাইকে দেখছে। নাদিয়া ইতিমধ্যে একবার বায়না ধরেছে তাকে গোলাপি গোলাপি হাওয়াই মিঠাই কিনে দিতে হবে। সাদ অবশ্য দু’টো হাওয়াই মিঠাই কিনে দিয়েছে। একটা নাদিয়ার;আরেকটা তমার।
মেলায় এত জনসমাগমে বেশ হইচইপূর্ণ পরিবেশ। সাদের অবশ্য ভালোই লাগছে। শহরে এসব কখনো দেখেনি সাদ। প্রতিবছর ১-২ বার গ্রামে আসলেও সেটুকু সময় ঘরে বসেই কাটানো হয় সাদের। প্রয়োজন ছাড়া বাইরে খুব একটা বের হয় না সে। ভালোই হয়েছে তমার জন্য অন্তত নতুন একটা জিনিসের সাথে পরিচিত হতে পারলো সাদ।
তমার হাতে মালাই কুলফি। বাদাম আর দুধের সর দিয়ে বানানো। সাদ কিনে দিয়েছে একটু আগে। তমা দূর থেকে ছেলে-মেয়েদের চিৎকার শুনে দৌড়ে গেল। সবাই নাগর দোলায় উঠে আনন্দে চিৎকার করছে। তমা এবার সাদের কাছে নাগর দোলায় চড়ার জন্য বায়না করলো। সাদ দাম জিজ্ঞেস করতেই জানতে পেল জনপ্রতি পাঁচ টাকা দাম।
তমা আর নাদিয়া কুলফি হাতে নাগর দোলায় চড়েছে। নাদিয়া হঠাৎ সাদকে বলে উঠলো,” ভাইয়া তুমি উঠবে না?” সাদ কিছু বলার আগেই তমা বলে উঠলো,” তোমার ভাইয়া ভীতুর ডিম। এসব নাগর দোলা-টোলাকে ভয় পায়।”
সাদ তমার সঙ্গে জেদ দেখিয়ে নিজেও নাগর দোলায় চড়ে বসলো। প্রথমবার যখন নাগর দোলায় একটা হালকা ঘুরানি দিলো তখন সাদের ভালোই লাগছিল। কিন্তু হঠাৎ করে জোরে জোরে নাগর দোলা ঘুরতে শুরু করলো। সাদ ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললো। কলিজাটা ছিঁড়ে যাচ্ছে মনে হচ্ছে। সাদ হঠাৎ নিচের দিকে তাকালো ভয়ে ভয়ে। এত জোরে নাগর দোলা দুলছে দেখে সাদ জোরে চিৎকার করে বলতে লাগলো,” থামান! থামান! আমি নামবো! আমি নামবো! আল্লাহ বাঁচাও! আল্লাহ আমার কলিজা ছিঁড়ে যাচ্ছে! আম্মু! আমি নামবো! আমি নামবো!”
কিন্তু ছেলে-মেয়েদের চিৎকারে কেউই সাদের কথা কিছুই শুনতে পেল না। সাদ শেষে তমাকে বললো,” তমা এটাকে থামতে বলো! অনেক ঝাকি লাগছে! আমি নামবো!”
তমা তো সাদের অবস্থা দেখে হেসেই চলেছে! বিরবির করে সাদকে বললো,” কালকে পায়ে সালাম করা সত্ত্বেও কোনো সালামী পাইনি। এটার শোধ কী আমি তুলবো না ভেবেছেন?”
তমা সাদের বুক পকেট থেকে পনেরো টাজা নিচে ছুঁড়ে দিয়ে বললো,” এই যে মামা! আমরা আরো একবার চড়বো। তিনজন, টাকা রাখেন।”
এবার নাগর-দোলা আবারও জোরে জোরে ঘুরতে শুরু করলো। সাদ নাগরদোলা ঘুরতে দেখে বললো,” আল্লাহ গো! আমাকে বাঁচাও! আমি শেষ! আমাকে নামাও কেউ! আমাকে দয়া করে নামিয়ে দাও! আমি নামবো!”
কিন্তু সবাই তো নিজের মতো চিৎকার করতেই ব্যস্ত। সাদের কথা শোনার সময় কারো আছে? সাদ আরো জোরে জোরে আল্লাহ গো! আল্লাহ গো!বলে চিৎকার করতে শুরু করলো। তমা পাশ থেকে হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে। বাছাধন! তুমি ঘুঘু দেখেছো কিন্তু ফাঁদ দেখোনি! কত ধানে কত চাল বোঝো এবার।
চলবে…