#রৌদ্দুর_তোমার_নামে🍂
#কায়ানাত_আফরিন(মাইশা)
পর্ব:৪৬ (অন্তিম)
.
আয়াতের বিধ্ধস্ত চেহারা দেখেই তোলপাড় শুরু হয়ে গিয়েছে মাইশার মনে। দেয়ালে নিজের ভর দিয়ে শুকনো মুখে তাকিয়ে আছে সে মাইশার দিকে। পরনে শার্টেের উপরের বোতামদুটো খুলে রেখেছে।আয়াতের এরকম মুখ দেয়ে নিজেরই বেশ ভয় হচ্ছে মাইশার ।
ডাক্তার একপাশে বসে ব্যাগ থেকে কিছু মেডিক্যাল রিপোর্টস বের করলো।মাইশার আর আয়াতের রুমে সবাই উদগ্রীব হয়ে বসে আছে রিপোর্টস এ কি আছে তা জানার উদ্দেশ্যে।
.
সবার এরকম দৃষ্টি দেখে তার ভয় হচ্ছে। কোনো বড় রোগ হয়নিতো আবার।আয়াতের এমন অবস্থা দেখেতো আরও চিন্তার সাগরে ডুবে যাচ্ছে সে।
.
বিগত কয়েকদিন যাবৎ আগের মতই পুনরায় মাথা ব্যাথার সমস্যা শুরু হয়েছে মাইশার।কিন্ত এবার তার সাথে শরীরের দুর্বলতাটাও যেন বেশ চাড়া দিয়ে উঠেছে। না পারছে ঠিকমতো কিছু খেতে আর না পারছে তা হজম করতে। আর গতকাল তো মাথা ঘুরিয়ে বাগানে পড়েই গিয়েছিলো সে। প্রায় দুইঘন্টার মতো জ্ঞান ছিলো না মাইশার। আয়াত তখন অফিসে। মাইশার এ অবস্থা শোনামাত্রই সব কাজ কর্ম রেখেই ছুটে আসে বাড়ির দিকে।
.
ডাক্তার বাসায় এসে বললো হসপিটালে নিয়ে কিছু আল্ট্রাসনোগ্রাফির কিছু টেস্ট করতে হবে মাইশাকে। আর হসপিটাল থেকে আসার পর থেকেই আয়াত মাইশাকে খাট থেকে এককদমের জন্য উঠতে দেয়নি শুধু খাওয়া আর ওয়াশরুম যাওয়া ছাড়া।
.
–মি : আরহাম আয়াত?
ডাক্তারের আওয়াজ শুনে মাইশার ধ্যান ভাঙ্গে।আয়াত কিছুটা আশঙ্কা নিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ডাক্তারের দিকে।
.
–ইয়েস ডক্টর? এনি প্রবলেম ইন হার রিপোর্ট?
.
–ভাবছি বিষয়টা আপনাদেরকে কিভাবে বলবো আর আপনারই বা কেমন রিয়্যাক্ট করবেন?
.
একথাটা শুনা মাত্রই মাইশা ভয়ার্ত চোখে আয়াতের দিকে তাকায়। আয়াত করুন চোখে তাকিয়ে আছে ডাক্তারের দিকে।ডাক্তারের কথা শুনে যেন আয়াতের প্রাণপাখি উড়ে চলে গিয়েছে। খালামণি , খালুজান আর আরিয়াপুও এ নিয়ে শঙ্কায় আছে।আয়াত করুন গলায় বলে ওঠে…
.
–কেন ডক্টর? এমন কি হয়েছে ওর? ইজ এভরিথিং ফাইন?
.
আয়াতের এই কথাটা বলার সময় গলার স্বর কেমন যেন মিলিয়ে যাচ্ছিলো। বারবার জিভ দিয়ে নিজের ঠোঁটজোড়া ভিজিয়ে নিচ্ছে সে।
.
–কি হয়েছে আমার মামণিটার?
খালামণিও কিছুটা ভীতস্বরে প্রশ্ন করেছে।ডাক্তার সবার প্রশ্ন শুনে কিছুক্ষণ তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে থাকে আয়াতের দিকে। তারপর একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে আয়াতকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে…
.
— সী ইজ প্রেগনেন্ট !
.
আয়াত কিছুক্ষণ অদ্ভুদ দৃষ্টিতে হাত ভাঁজ করে তাকিয়ে থাকে ডাক্তারটির দিকে। অস্ফুটস্বরে বলে ওঠে…
.
— এ্যা ?
.
— এ্যা নয় বলো হ্যাঁ। ইউ উইল গোইং টু বি ফাদার।(ডাক্তার)
.
সবাই এই কথাটার অর্থ বুঝে খুশিতে উৎফুল্ল হয়ে উঠলেও আয়াতের মাথা এখনও হ্যাং করে আছে। বিষয়টা বুঝতে ওর পাক্কা ২ মিনিট লাগে। ডাক্তার দেবনাথ হাসতে হাসতে বলে ওঠে…
.
–এত শক পেলে চলবে ইয়াংম্যান? তোমার ওয়াইফের এ অবস্থা দেখে তো তোমার প্রাণপাখি উড়ে চলে গিয়েছিলো।এভাবে চললে কি হবে?
.
আয়াত এখন সম্পূর্ণ প্রতিক্রিয়াহীনভাবে দাঁড়িয়ে আছে। মুখে না আছে কোনো অনুভূতি না আচ্ছে কোনো কথা। ধীরে ধীরে ওর মলিন ঠোঁটজোড়ায় হাসি ফুটে ওঠে।মাইশাও অবাক নয়নে তাকিয়ে আছে আয়াতের দিকে। আনমনে নিজের ডনহাতটি তার পেটে নিয়ে যায়।এখানে একটি ফুটফুটে জীবন গড়ে উঠছে এটা ভাবতেই হাসি ফুটে ওঠে তার ঠোঁটজোড়ায়।
.
আয়াত এখন স্তব্ধ হয়ে বসে আছে একই স্থানে।ঠোঁটে এখনো রয়েছে একচিলতে হাসি যা বরাবরই মাইশার মনে তোলপাড় করে দেয়।
.
–কি ব্যাটা ! শেষমেষ বাবা হয়ে গেলি।
আরিয়াপু খুশিতে উৎফুল্ল হয়ে বলে ওঠে। পরিবারে নতুন কোনো সদস্য আসার আনন্দটাই অন্যরকম। সেখানে রয়েছে নতুন পরিচয়ে আবদ্ধ হবার এক অন্য সুযোগ ; পরিজন দেখা পায় নানা অদেখা অনুভূতির।যা সাধারনত ভাষায় প্রকাশ অসম্ভব।❤
*
*
সবাই চলে যাওয়ার পর আয়াত দুর্বল পায়ে এগিয়ে হাটুগেড়ে বসে মাইশার কাছে।মাইশা কিছুটা আশা নিয়ে তাকিয়ে আছে শুধুমাত্র আয়াতের প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য। আয়াত একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে সরু গলায় বলে ওঠে………
.
—মাইশু সত্যি ! জীবনে এতটা প্রতিক্রিয়াহীন কখনোই হইনি আজ যতটা হলাম।…………কেননা আমি কখনো এই পরিস্থিতির সম্মুখীনই হইনি। ডাক্তার যখন বললো যে তুমি প্রগনেন্ট ট্রাস্ট মি আমার মাথার উপর দিয়ে গিয়েছিলো কথাটা।আমি নিজের স্বাভাবিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলাম।
আমাকেও কেউ বাবা বলে ডাকবে ! তার ছোট ছোট হাত ধরে আমি ঘুরে বেড়াবো সবজায়গায়। বাবার মতোই তাকে বানাবো ভবঘুরে………সবচেয়ে বড় কথা……..আমি আর তুমি বাবা-মা হতে চলেছি মাইশু !
.
একথাটা বলেই মাইশার পেটের কাছ থেকে কামিজ সরিয়ে গভীরভাবে নিজের ঠোঁটস্পর্শ করে আয়াত।মাইশা খনিকটা অনুভূতির জালে হারিয়ে সেই স্পর্শগুলো অনুভব করে। জীবনে এতটা চাঞ্চল্যতা কখনো পায়নি সে।আবার আয়াতের তখনকার প্রতিক্রিয়ার কথা ভেবে উঠলেই আনমনে হেসে উঠে সে।
.
আয়াত মাইশার দুহালে হাত দিয়ে নিজের কপাল মাইশার কপালের সাথে নিজের কপাল মিশিয়ে দেয়।দুজনেরই উষ্ণ নিঃশ্বাস একে অপরের মুখে পড়ছে।মাইশাকে নিজের আরও কাছে নিয়ে আসে আয়াত।মাইশা এবার হারিয়ে যাচ্ছে আয়াতের এমন উদ্ভট কার্যকলাপে।আয়াত মিহি কন্ঠে বলে ওঠে………
.
–তোমায় অনেক বেশি ভালোবাসি মাইশু । তুমিহীনা সত্যিই আমি পাগল হয়ে যাবো। হ্যাঁ আমি রাগী, জেদি , তোমার লুচুবাঘ ; তুমি যা বলবে সব টাইটেল আমি মেনে নিবো কিন্ত আমার থেকে কখনোই হারিয়ে যাবে না মাইশু। বলো কখনোই যাবে না ?
.
আয়াতের এমন কথা শুনে অভিমান হয় মাইশার।ক্ষোভে সে বলে ওঠে.
–আমায় তুমি এমন মনে করো?
.
একটা দুর্বল হাসি দেয় আয়াত। সে জানে তার মাইশুও তাকে নিজের সর্বস্ব দিয়ে ভালোবাসে ; আদ্রফের জায়গাটা হয়তো সে নিতে পারেনি কিন্ত মাইশার মনে চিরস্থায়ী জায়গা করে ফেলেছে সে।এটা ভাবতেই প্রশান্তি ছেয়ে যায় দুজনের মনে।❤
*
*
*
কিছু মাস পর…….
.
ফজরের নামায পড়ে আয়াতের হাত ধরে আস্তে আস্তে ছাদে উঠছে মাইশা। ছাদের দরজাটা খুলতেই একরাশ স্নিগ্ন হাওয়া তার গায়ে ছেয়ে যায়।এটা দেখেই উৎফুল্ল ভর করে মাইশার মনে।
মাইশা এখন ৬ মাসে পা দিয়েছে।একটু গুলুমুলুও হয়েছে বটে। আর আয়াত তো বলেই দিয়েছে এই গুলুমুলু বউকেই ভালোলাগে তার। সে তো পারে না শুধু টুস করে কামড় দিয়ে খেয়ে ফেলতে। প্রেগনেন্সির পুরো সময়টা উত্তরায় পার করছে সে। মাইশার মূলত এটাই ইচ্ছা ছিলো। তাই আয়াত মাইশাকে কোনো বাঁধা দেয়নি।
.
ছাদের একপাশে বেঞ্চে বসে আনমনে আয়াতের কাধেঁ মাথা রেয়েছে মাইশা। কিন্ত তার দৃষ্টি পাশের ছাদটির দিকে যেদিকে আদ্রাফ থাকতো। এটা অবশ্য নতুন কিছু না। যতবারই মাইশা ছাদে আসে ঠিক ততবারই মাইশা আপনমনে সেপাশে তাকিয়ে থাকে। কিন্ত আজ এর প্রবণতাটা একটু বেশি যা আয়াত ধরতে পেরেছে।
কেননা আজ আয়াতের কাধেঁ মাথা রেখে কোনো কথাই বলছে না সে।
.
–মাইশু !
.
আয়াতের গলার স্বর পেয়ে অস্ফূটস্বরে সে বলে ওঠে………
.
–হুম !
.
–প্রথম ভালোবাসা অনেকটাই অদ্ভুদ তাই না?
.
মাইশা মাথা উচুঁ করে তাকায় আয়াতের দিকে। আয়াত পূব আকাশে চেয়ে আছে।মাইশা আয়াতের বাহু আগলে আবারো কাধেঁ মাথা দিয়ে বলে ওঠে…….
.
–হ্যাঁ। কিন্ত শেষ ভালোবাসা তার থেকেও বেশি অদ্ভুদ। কেননা সেখানে একটা মায়া কাজ করে যা প্রথম ভালোবাসায় শুধু অনুভূতি ছাড়া আর কিছুই না।
.
—আয়াত নিশ্চুপ।
.
–আয়াত ! আমাদের বেবিটা অনেক কিউট হবে তাই না?
.
ইদানীং মাইশার বাচ্চা বাচ্চা প্রশ্নে প্রচুর হাসি পায় আয়াতের।তবুও সেসব উপেক্ষা করে বলে উঠে……
.
–অবশ্যই !
.
–আমি আমার বেবিকে অনেক আদর করবো। একটুও বকবো না। সবসময় তাকে ভালোবাসবো।
.
–আর বেবির বাবাকে?
.
থমকে যায় মাইশা। তারপর আয়াতের নাকে টুস করে একটা চুমু দিয়ে বলে ওঠে……..
.
–বেবির বাবাকেও অনেক ভালোবাসি।
.
পূব আকাশে সূর্যোদয়ের মাধ্যমে ভোরের নতুন উদ্যমতার সূচনা হতে চলছে। ছোট ছোট দোতল বাড়িগুলো ভেদ করে মুখে আছড়ে পড়েছে রৌদ্দুর।আয়াতের কালচে বাদামী চোখে সেই রশ্মিটা পড়ে এক অন্য আবেদন তৈরি করেছে।মাইশা আনমনে মনে ওঠে….
.
–আয়াত?
.
–হুম?
.
–আজ আদ্রাফের মৃত্যুবার্ষিকি।৫ বছর হয়ে এলো আজ।
.
আয়াত এবার বুঝতে পারলো মাইশার এত নীরব থাকার কারন।মাইশার অশ্রুসিক্ত চোখ দেয়ে সে বলে ওঠে…….
.
–আদ্রাফকে খুব মনে পড়ে ;তাই না?
.
–তা তো পড়েই। কিন্ত আমি ওকে অতীতেই রেখেছি। আমার অতীত সে। যা কখনোই ফিরে আসবে না। আর তুমি ! আমার বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ ; যা আমি কখনোই আলাদা রাখতে পারবো না।
.
আকাশের বুক চিরে আসা রৌদ্দুরের প্রতিটা রশ্মিই এখন আয়াতের নামে করেছে মাইশা। কেননা তার আধাঁরময় জীবনে আয়াত এসেছিলো এক প্রকার রৌদ্দুর হয়ে। যে অনুভূতির কোনো লিখিত প্রকাশ নেই……..শুধু রয়েছে একরাশ স্নিগ্ধতা।আয়াতের বুকে মিশে যায় মাইশা। তা দেখে আয়াত তার ভুবনভোলানো হাসি দিয়ে মাইশাকে আবারো ঘোরে ফেলে দেয়।সত্যি ! কপাল করেই সে আয়াতের মতো জীবনসঙ্গী পেয়েছে সে। দুজনেরই দৃষ্টি পূব আকাশ থেকে আছড়ে পড়া রৌদ্দুরের দিকে। মাইশা আনমনে বলে ওঠে……..
.
~ভালোবাসার এ এক অলিখিত অনুভূতি
বন্দী স্মৃতির খামে
হৃদয়ের এক সুপ্ত কোণে
রৌদ্দুর তোমার নামে🍂~
.
.
.
~সমাপ্ত~