রৌদ্দুর তোমার নামে পর্ব-১৩+১৪+১৫

0
2911

#রৌদ্দুর_তোমার_নামে🍂
#কায়ানাত_আফরিন(মাইশা)
পর্ব:১৩
মাঝরাতে যখন কোনো ছেলে কোলে তুলে নিয়ে যাওয়ার ওয়ার্নিং দেয় তখন একটি মেয়ে ভয় পাবে এটাই স্বাভাবিক। আর মাইশাও তার ব্যাতিক্রম কিছু না। কম্বল মুড়িয়ে যে আরামের ঘুমটিতে সে বিচরণ করছিলো মোবাইলে আয়াতের কথা শুনে এখন তার বিন্দুমাত্র রেশ নেই। মাইশা কপাল কুচকে আবার বলে উঠে….
.
” শ্বশুড়বাড়ির আবদার পেয়েছো….আমাকে এত রাতে আসতে বলছো কেন…আমি যাবো না। দেখি, ৯ তলা থেকে তুমি কীভাবে আমায় নিয়ে যেতে পারো !.”
.
” ওহ্…তাহলে তুমি আসবা না…Is it your final decission?”
,
আয়াত দাঁতে দাঁত চেপে এ কথাগুলো বলছে। বুঝাই যাচ্ছে মাইশার কথায় ভয়ঙ্করভাবে রেগে আছে। মাইশাও এবার অটল।সবসময় সব জায়গায় তো নিজের জেদ দেখালে চলে না।এত রাতে কিছুতেই সে আয়াতের সাথে যাবে না। মাইশা একটু ঢোক গিলে বলে…….
” Yeah, It is my Final decission, আমি যাবো না মানে যাবো না।”
.
আয়াত হেসে উঠে। ফোনে স্পষ্ট তার দীর্ঘনিঃশ্বাস শুনতে পেয়েছে মাইশা।
.
” ওকে ফাইন…..মনে রেখো আমিও আরহাম আয়াত।আমার কথার বিন্দুমাত্র পরিবর্তন করিনা আমি…See you soon…”
বলেই আয়াত ফোন কেটে দেয়। মাইশা অবাকপানে মোবাইলের দিকে তাকিয়ে আছে। মাইশা ভেবেছিলো একথা শুনে আয়াত রেগে যাবে, চিল্লাচিল্লি করবে এমন তো কিছুই হলো না। তবে এখন সে ভাবছে যে আয়াত এত রাতে তাকে বাইরে আসতে বললো কেন?
.
রাত প্রায় আড়াইটা বাজে। মাইশা আবার ঘুম দেওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্ত আয়াতের কথা ভেবেই তার ঘুম আসছে না। পরে সে ভাবে আয়াতের কথা এতো ভাবছে কেনো সে। আয়াত শুধুমাত্র ওর খালাতো ভাই যে ওকে পছন্দ করে না। তবে মানতে হবে ওর মধ্যে কিছু একটা আছে যেটা বারবার মাইশাকে আকর্ষণ করছে। মাইশা হঠাৎ এসব চিন্তা ঝেড়ে ফেলে দেয়। কি সব আবোল-তাবোল ভাবছে সে…..এসব ভেবে কোনো লাভ নেই। উল্টো তার মনের কাছে এর জন্য জবাবদিহিতা করতে হবে।
.
ঘুমের দোরগোড়ায় একপা দিতেই মাইশার মনে হলো কেউ আচমকা তাকে ঘুমের রাজ্য থেকে টেনে-হিচড়ে নিয়ে আসলো। চোখটা পিটপিট করে খুলতে সে যেই না আয়াতকে দেখলো তার চোখ আপনাআপনি কুমিল্লার রসগোল্লার মতো হয়ে যায়। আয়াত তাকে কোলে তুলে ওর রুম থেকে বাইর হচ্ছে।
আধাঘুম থেকে সবেমাত্র চোখ খুলে কেউই এ পরিস্থিতি সামলে উঠতে পারেনা। আর মাইশাও আয়াতের গলায় ঝুলে যেন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। কয়েক সেকেণ্ড পর যখন ওর ধ্যান ফিরে শুরু হয়ে যায় নড়াচড়া। আয়াতের বুকে এলোপাথারি কিল-ঘুষি মারছে সে।আয়াত এবার কড়া গলায় বলে থাকে…..
.
” এভাবে আমার বুকে কিল-ঘুষি না দিয়ে….একটা চিৎকার দাও। আর খালুজান যদি এতরাতে তোমাদের বাসায় তোমাকে আমি কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি এটা দেখে ভাবতে পারছো কি হবে……ঠাস করে কবুল বলে ঠুস করে তোমায় নিয়ে বাসরঘরে যেতে হবে। Now choice is your……(কানের কাছে ফিসফিসিয়ে)আমার সাথে বাসর করতে চাও ? Than shout….”
.
একথা শুনে মাইশা শামুকের মতো আয়াতের শরীরের সাথে মিশে যায়। গলা দিয়ে একটা সাউন্ডও বের হচ্ছে না তার।আয়াত তারপর ফ্যাট থেকে বের হয়ে ওয়াচম্যানকে ফাকিঁ দিয়ে বাইরে বেরিয়ে যায়। মাইশা বুঝতে পারছে না এই ছেলটার মনে কি চলছে।
.
মাইশাকে গাড়িতে বসিয়ে আয়াত ড্রাইভিং সিটে বসে পড়ে। মাইশা এবার প্রশ্ন করে…
”এবার তো বলো কোথায় নিয়ে যাচ্ছো আমাকে?”
.
”চুপ করে বসো….আস্তে আস্তে জানতে পারবে…..”
.
.
ঢাকা-মাওয়া Highway দিয়ে গাড়িটা এগিয়ে যাচ্ছে। রাস্তাটা আসলেই চমৎকার। বাতাসের ঝাপ্টায় মাইশা বাইরেও ঠিকমতো তাকাতে পারছে না।হাইওয়েতে সে অনেকবার আসা-যাওয়া করেছে কিন্তু নিঝুম রাতে এমন কৃত্তিম সৌন্দর্য কখনোই উপভোগ করেনি সে। বেশ সময় পর মাইশা রাস্তায় সারি-সারি দোকান দেখতে পারছে। বেশিরভাগই খাবারের দোকান…..এই মাঝরাতেও দোকানগুলো মানুষের সমাহারে যেন গমগম করছে। নাকে ভেসে আসছে ভাজা ইলিশ মাছের ঘ্রাণ।
.
অনেকটা অস্বাভাবিকভাবেই মাইশা তাকিয়ে আছে সেপানে। এটাই তবে মাওয়াঘাট। ফেসবুকে বা ইউটিউবের অনেক ব্লগেই এই জায়গাটির নামে কম-বেশি শুনেছে কিন্ত কখনো আসা হয়নি। আর এখন বাজে প্রায় সাড়ে তিনটা। এ সময় যে এখানে ট্যুরিস্ট দিয়ে গমগম করবে তা মাইশার ভাবনার বাইরে ছিলো।
মাইশা এবার কৌতূহল নিয়ে আয়াতের দিকে তাকায়। আয়াত বরাবরের মতোই তার নিজের কাজে ব্যস্ত। মাইশা একটা স্বতস্ফূর্ত হাসি দিয়ে আয়াতকে প্রশ্ন করে….
” এখানে কেন এসেছি আমরা? ”
.
আয়াত একপাশে গাড়ি পার্ক করতে করতে বলে….
” মিডনাইটে তোমার মতো ভূতনির সাথে ঘুরবো তাই…..একা আসতে ইচ্ছে করছিলো না।”
.
আয়াত মাইশাকে ভূতনি বলায় একটু চোখ কুচকে ফেলে সে। কিন্ত এখন রাগারাগি করার মতো মনমেজাজ নেই ওর। আয়াতের কথাগুলো কিছুক্ষণের জন্য এককোণায় বন্দী করে এখানে ঘুরবে বলে স্থির করলো।
.
” পানসী রেস্তোরা ” এখানকার খুব জনপ্রিয় একটি রেস্তোরা। মানুষও এখানে অনেক গমগম করছে। আবার অনেক বিদেশি পর্যটকেরাও এখানকার ফুড রিভিউ দিচ্ছে। কিন্ত আয়াত এই রেস্টুরেন্টে ঢুকবে না। ভিড় আয়াতের কাছে বরাবরই অপছন্দের এক জিনিস। ৫ মিনিট হেটে ওরা হাইওয়ে থেকে অনেকটা দূরে একটা রেস্তোরা পায়। এখানে মানুষ একটু কম।
আর পরিবেশটাও অসাধারণ। রেস্তোরাটির পেছনে মাওয়াঘাটটি স্পষ্ট দেখা যায়। ক্ষণে ক্ষণে কানে ভেসে আসে ঢেউয়ের সুর। আয়াত মাইশার কানে মৃদু কণ্ঠে বলে…..
” ভালোলেগেছে.?”
.
”হুম্ অনেক ।”
জানুয়ারির প্রথম সময়ে শেষরাতে ঠান্ডার তীব্রতা একটু বেশিই থাকে। তাই এখন একটু একটু শীত করছে । মাইশা নিজের পরনে চাদরটি নিজের গায়ে ভালোমতো পেচিয়ে নেয় কিন্ত অদ্ভুদ ব্যাপার আয়াত শুধু একটা হাফ হাতা গ্রে টিশার্ট আর ব্ল্যাক ট্রাউজার ছাড়া কিছুই পড়ে নি।
.
” আয়াত…..! ”
.
” বলো…”
.
” তুমি জ্যাকেট আনো নি ? এই শীতের মধ্যে জ্যাকেট ছাড়া ঘুরে বেড়াও কিভাবে…..?”
.
” তুমি যা শুরু করেছিলা ! তাড়াহুড়োর মধ্যে জ্যাকেট আনতে ভুলে গিয়েছি…….বাই দ্য ওয়ে ! প্রবলেম নাই । (মাইশার কানের কাছে ফিসফিসিয়) আমার পাশে তুমি আছো না? পুরাই তো এটম বোম্ব। তোমার মেজাজে গরমে তো আমি ভষ্ম হয়ে যাবো।(দুষ্টু হেসে)
.
মাইশা বিনিময়ে কিছু বলে না। আয়াতের এমন কথা শুনলে তার কান কেমন যেন গরম হয়ে যায়। তখন তার হার্টবিটের সাউন্ডও স্পষ্ট শুনতে পায় সে। আয়াত তার এমন রিয়্যাক্ট দেখে যেনো আরও মজা পেয়ে যায়। মাইশাকে এভাবে জ্বালাতে তার অনেক ভালোলাগে।
.
শীতের রাতে নদীর পাড়ে ভাজা ইলিশ মাছের সাথে গরম গরম ভাত আর হরেক রকমের ভর্তার মধ্যে এক আলাদাই আমেজ আছে , অন্যরকম এক আনন্দ আছে যা ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব। ক্ষণে ক্ষণে উত্তুরে হাওয়া বইছে আর তারই সাথে তাল মিলিয়ে খেলা করছে নদীর ঢেউ। পদ্মার তাজা ইলিশ মাছের স্বাদে তা আরও সমৃদ্ধ লাগছে দুজনের কাছে।
.
অন্যান্য রেস্তোরাগুলো বেশ জনবহুল আর এটা একটু দূরে হওয়াতে এই নিশিসৌন্দর্য আরও নিরিড়ভাবে অনুভব করতে পারছে মাইশা। আয়াত তাকিয়ে আছে মাইশার দিকে । মাইশার মুখে এক অন্যরকম ঝলক। খাওয়া-দাওয়া শেষে দুজনেই সেখান থেকে বেরিয়ে সামনের দিকে এগোতে থাকে।
আয়াতের গন্তব্য মাইশার কাছে অজানা। মাইশার একহাত আগলে সে এগিয়ে যাচ্ছে।
.
” আয়াত , আমরা কোথায় যাচ্ছি ?”
.
আয়াত নিশ্চুপ।
.
”কি হলো….চুপ করে আছো যে?”
.
আয়াত আলতো হাসে। তারপর একরাশ আগ্রহ নিয়ে সে তাকায় মাইশার দিকে। মাইশা আয়াতের দৃষ্টি বুঝতে পারছে না।
.
” বাংলাদেশে আসার পর খুব ইচ্ছে ছিলো কাউকে সাথে নিয়ে ঘোরার। কিন্ত ভাবতে পারিনি ভাগ্য তোমাকে আমার কাছে পাঠিয়ে দেবে। যা-ই হোক আমার সাথে চলো…..গভীর রাতে তুমি আর আমি আজ যা দেখবো হয়তো সারাজীবন চাইলেও দেখতে পারবো না। তাই বলছি সময়টাকে অনুভব করো।”
.
আয়াতের প্রতিটি কথা মাইশার কাছে ধাঁধার মতো লাগছে। এটা সত্যি যে ছেলেটা অদ্ভুদ। অনেকটাই অদ্ভুদ। হয়তো খুজে হাজারেও এমন একটা আয়াতকে পাওয়া যাবে না যে মাইশার জন্য অনুভব করে ঠিকই ; কিন্ত হয়তো তা প্রকাশ করে না। এটাই হয়তো তার ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ।
.
.
#চলবে

#রৌদ্দুর_তোমার_নামে🍂
#কায়ানাত_আফরিন(মাইশা)
পর্ব:১৪+১৫
নিস্তব্ধ এই রাতে সরু রাস্তা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে দুজন যুবক-যুবতী।তাদের মাঝে যে কিসের সম্পর্ক হয়তো তার উত্তর তারা নিজেরাই জানেনা। ঠান্ডা উত্তুরে হাওয়া দুজনের গায়েই স্পর্শ দিয়ে চলে যাচ্ছে। মাইশার এতে ভালোলাগলেও আয়াত হাফহাতা টিশার্ট পড়ায় তা আরও নিবিড়ভাবে অনুভব করতে পারছে সে।আয়াত এবার মাইশার পরনে চাদরের মধ্যে ঢুকে যায়। পা এগোনো থামিয়ে দেয় মাইশা। আয়াতের ঠান্ডা শরীর মাইশার উষ্ণ গায়ের সাথে অনেকটাই মিশে আছে।
.
আয়াত তার দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে মাইশার হাতের তালুতে নিজের হাত আলতো করে স্পর্শ করে এগিয়ে যেতে ব্যাস্ত। দুজনেই এক চাদরে নিজেদের আবৃত করে গন্তব্যহীনভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। মাইশার কানে পানির ঢেউয়ের আওয়াজ প্রবেশ করতেই এক অন্যরকম উত্তেজনা কাজ করে মনে। উত্তজনার বশে আয়াতের হাত আঁকড়ে ধরে সে।
.
মুচকি হাসে আয়াত। মাইশা আনমনে বলতে থাকে……
” সামনে কিসের আওয়াজ শুনতে পারছি আয়াত?”
.
”আমি হয়তো আন্দাজ করতে পারছি কিন্ত সম্পূর্ণ নিশ্চিত না…..এগিয়েই নাহয় দেখি……”
.
কিছুদূর এগিয়ে দুজনেই পা থামিয়ে দেয়। কেননা এর পর আর কোনো পথ নেই। অবাক দৃষ্টিতে দুজনেই তাকিয়ে আছে সামনের দিকে। এটাই বাংলাদেশের বৃহত্তম নদীগুলোর একটি…..পদ্মা নদী। নিশিরাতে এখান দিয়ে কোনো যান চলাচল করে না বলে এটা এখন নীরব নদী…তা কিন্ত ঠিক নয় ! উত্তাল নদীর সুমধুর গর্জন , আছড়ে পড়া ঢেউগুলো খেলা করছে নদীর পাড়ে। অদূরেই কাজ চলছে বাংলাদেশের বৃহত্তম পদ্মা সেতুর। কুয়াশার আবরণে সেই কাজগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না।
.
আয়াত আর মাইশা এখন যেদিকে দাঁড়িয়ে আছে বোঝাই যাচ্ছে এখানে মানুষজন আসে না। আশেপাশে চলছে জোনাকির খেলা। শেষরাতের আবছা অন্ধকারে হলুদ জোনাকিগুলো সবুজের সাথে মিশে হলদেটে সবুজ রং ধারণ করেছে। মাইশা একটা লম্বা নিঃশ্বাস নেয়। তারপর আয়াতের দিকে তাকায়…..
.
আয়াত এখনো সেদিকে তাকিয়ে আছে জোনাকির আলো প্রতিফলন ঘটিয়ে তার কালচে বাদামী চোখে খেলা করছে রঙের খেলা। ঠোঁটে ফুটে আছে এক চিলতে হাসি…..যে হাসি হয়তো তার মুখে পাওয়া দুষ্কর। আয়াত মন থেকে আসলেই অনেক স্বচ্ছ কিন্ত সে তা প্রকাশ করতে চায় না। মাইশা আদৌ জানে না আয়াত এমন অস্পষ্ট কেন। অজানা এক কারনে এই অস্পষ্ট আয়াতের জন্য হয়তো কোনো অনুভূতি জন্মে গিয়েছে মাইশার।
মাইশা আবার পদ্মা নদীর সৌন্দর্যে নিজের দৃষ্টি দেয়। অস্পষ্ট কন্ঠে বলে ওঠে,
.
” আয়াত? ”
.
”বলো…..”
,
” এই জায়গাটি আসলেই অনেক সুন্দর……তুমি আমাকেই কেন নিয়ে এলে এখানে…….”
.
”তখন বললামই তো ! একা আসতে ভালোলাগছিলো না তাই তোমার মতো পেত্নিকে নিয়ে এলাম।”
.
বিরক্ত হয় মাইশা। প্রত্যেকবার আয়াতকে ভালো মুডে কোনো কিছু জিজ্ঞেস করলে আয়াত তখন সবকিছু বিগড়িয়ে দেয়। আর এই জিনসটাই মাইশার বরাবর অপছন্দ। আয়াতের হাত ছেড়ে মাইশা সামনে গিয়ে দাড়ায়। অনেকটা পাড়ের কাছে। আয়াতের কথা নিয়ে এখন বিরক্ত হতে চাচ্ছে না সে।
.
নদীর হাওয়াগুলো মাইশার গায়ে মিশে যাচ্ছে। চোখ বুঁজে তা অনুভব করছে সে। আচমকা আয়াত পেছন থেকে তার হাত টেনে নিজের কাছে নিয়ে আসে। মাইশার টলটলে কালো চোখযুগল আয়াতের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আয়াতের চোখেমুখে আছে অদ্ভুদ এক আকর্ষণ যাতে যেকোনো সময়ই মাইশা তলিয়ে যেতে বাধ্য। আয়াত তার ঠোঁট কিঞ্চিত প্রসারিত করে রাখলেও তার তীক্ষ্ন চোখজোড়া প্রমাণ করে দিয়ে যে ঠিক কতটা সে মাইশার জন্য অনুভব করে যার উত্তর হয়তো দুজনের কাছেই অজানা।
.
মাইশা গায়ে কোনো ওড়না না পড়ে শুধু চাদর পড়ে ছিলো ; আর বাতাসের তালে তা এখন গায়ের থেকে সরে নিচে পড়ে গিয়েছে। মাইশা তা বুঝতেও পারেনি। মাইশার কোমড় চেপে নিজের সাথে মিশিয়ে ফেলে আয়াত। মাইশা আয়াতের কাছে থেকে সরে আসতে নিলেই আরও জোরে মাইশাকে নিজের সাথে মিশিয়ে ফেলে…আয়াতের কাজকর্ম সবকিছুই মাইশার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। আয়াত এবার মাইশার কানে ফিসফিসিয়ে বলে…….
.
” আই এম সরি মাইশা…..”
.
মাইশা নিস্তব্ধ। আয়াতের অনেকগুলো কাজই মাইশার কাছে কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলো ; কিন্ত আয়াত যে ঠিক কোন কারনে সরি বলছে মাইশার কাছে তা অজানা।
.
” সেদিন তোমাকে হসপিটালে এভাবে থাপ্পড় মারা আমার উচিত হয়নি। কিন্ত থাপ্পড় না মেরেও আমি পারি নাই,….কারন আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম তোমাকে হারানোর। আর তোমার যে কোনো ট্রমা আছে তা তুমি কখনোই কাউকে জানাওনি এই ভেবেই রাগের বশে আমি…….”
থেমে যায় আয়াত। আয়াত বেশ স্বাভাবিকভাবেই একথাগুলো বলছে।
.
”এটা ভেবো না এর জন্য তোমায় আমি তুলে নিয়ে এসেছি…..রাগের বশে আমি ভুল করে ফেলেছিলাম & that’s why তোমায় সরি বলেছি…..”
.
মাইশা আনমনে হাসে…..সে ভেবেছিলো আয়াত তার সব ভুলের জন্য অনুতপ্ত ; কিন্ত না। আয়াতের বুকে হাত দিয়ে সরে আসতে নিলেই আয়াত নিজের বাঁধন আরও গাঢ় করে। মাইশা চোখ কুচকে তাকালেই আয়াত দুষ্টু হেসে বলে…..
” আমি কি একবারও বলেছি আমার কথা শেষ হয়েছে মাইশুপাখি ?”
.
আয়াতের দৃষ্টি নিচের দিকে। মাইশা সেই দৃষ্টি অনুসরন করে নিচে তাকাতেই তার চোখ ছানাবড়া। গলার নিচে সে লাল তিলটি রাতের আধারে স্পষ্ট না দেখা গেলেও অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। মাইশা এবার ছোটাছুটি করছে। কিন্ত আয়াতও কম না; ঠোঁট কামড়ে মাইশার দিকে তাকিয়ে হাসছে সে। এবার না পেরে আস্তে করে মাইশার চুলে মুখ ডুবিয়ে দেয়।
.
এতক্ষণ চাতক পাখির মতো ছটফট করা মাইশা নিমিষেই শান্ত হয়ে যায়। পাথর হয়ে গিয়েছে সে। আয়াতের উষ্ণ নিঃশ্বাস তার চুল ভেদ করে ঘাড়ে আছড়ে পড়ছে। আয়াত নেশাকাতুরের মতো করে বলছে….
.
”তোমার ওই লাল তিলটা দেখলে আমি কিছুতেই ঠিক থাকতে পারি না মাইশা ! ড্রাগের মতো ওই জিনিসটা আমায় টেনে তোমার কাছে নিয়ে যায়। মনটা তো চায় কোনো বড়সড় একটা ভুল করে ফেলি……কিন্ত এমন কিছু করলে আমাদের দুজনকেই যে পস্তাতে হবে ! তাই তো তোমার সাথে খারাপ বিহেব করে ফেলি। Trust me মাইশা ! তোমার ওই লাল তিলটা এখনো আমায় খুব করে টানছে।”
.
মাইশার ইতিমধ্যে কাপাকাপি শুরু হয়ে গিয়েছে। আয়াতের বিহেব তার অন্যরকম লাগছে।
.
” আমি….আমি জানি না মাইশা…..তুমি আমার কাছে কি? বাট আমি কিছুতেই তোমাকে হারাতে চাই না। আমি জানি না…এটা আমার ভালোবাসা নাকি অন্যকিছু কিন্তু তোমাকে আমি আমার কাছে রাখতে চাই। তোমার রৌদ্দুর হয়ে থাকতে চাই।”
.
আজ এই রাতটি হয়তো ওদের দুজনের কাছেই স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এই সৌন্দর্য যেমন ওরা স্মৃতি থেকে মুছতে পারবে না তেমনি এই প্রকাশ্য অনুভূতিগুলোও অগ্রাহ্য করতে পারবে না। গাড়ি দিয়ে পুনরায় ঢাকায় ফিরছে তারা। মাইশার চোখে এবার ঘুম ভর করেছে । কখন যে ঘুমের দেশে তলিয়ে গেলো তা সে বুঝতেই পারে নি।
.
🍂🍂🍂🍂🍂🍂🍂🍂🍂🍂
.
অতীত
আজ একসপ্তাহ ধরে আদ্রাফ ভাইয়ের সাথে দেখা হয় না। সেরাতে মিহির আপুর জন্মদিন করে যখন তার বাইকে করে বাড়িতে ফিরলাম তখনই ছিলো আমাদের শেষ দেখা। তাই আজ রাত লুকিয়ে আস্তে করে ছাদে গেলাম একনজর হলেও তাকে দেখার জন্য।
ছাদের দরজা খুলতেই গিটারের সুর বেজে উঠলো আমার কানে…..আমি একটা মুচকি হাসি দেই। কেননা আদ্রাফ ভাই ছাড়া এতরাতে ছাদে আর কেউ গিটার বাজাবে না। পাশের ছাদে উকি মেরে দেখি…..সে গিটারে একটু আধটু করে টুং টাং সুর তুলছে।
,
আদ্রাফকে দেখলেই আমার মনে কেমন যেন ঝড় শুরু হয়ে যায়। তার প্রতিটা কাজেই এক ভালোলাগা কাজ করে। আজ এতদিন পর তাকে দেখাতে বেশ ভালোলাগছে আমার। আমি আস্তে করে তাদের ছাদে চলে যাই। সে হয়তো আমার উপস্থিতি বুঝতে পারেনি তাই এখনো রেলিয়ে বসে ব্যাস্ত শহরের সৌন্দর্য উপভোগ করে গিটারে সুর তুলছে।
.
আমি বুকে একরাশ সাহস আর আশা নিয়ে তাকে ডাকি.
” আদ্রাফ ভাই…..!”
.
সাথে সাথে পেছনে ঘুরে আদ্রাফ। তার চোখে-মুখে কেমন যেন উদ্বিগ্নতা। যেন এতক্ষণ মলিন সুর তুলে আমার অপেক্ষারই জানান দিচ্ছিলো সে।সে রেলিং থেকে নেমে সাথে সাথে আমার সামনে এসে দাঁড়ায়। আমি কৌতুহল নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছি। সে তার শুকনো ঠোঁটযুগল একটু ভিজিয়ে আমার চোখে চোখ রেখে বলে ওঠে…..
.
” আমি খুবই সাধারন একটা ছেলে। সাধারন মানুষদের মতোই আমার ভাবনা। তাই হয়তো অন্যভাবে নিজের প্রিয়জনকে মনের ভাব ব্যক্ত করতে পারবো না। তাই সাধারনভাবেই বলছি….. আমি তোমাকে ভালোবাসি মাইশা ! তোমার কালো চোখ আমার মন কেড়ে নিয়েছে…..তোমার ঠোঁট কামড়ে হাসি তোলপাড় করেছে আমার হৃদয়। আমি চাই সারাজীবন তোমাকে আগলে রাখতে….হবে আমার সঙ্গী? ”
.
আমি এবার পাথর হয়ে গিয়েছি। ঠোঁটে আপনা-আপনি এক মুচকি হাসি চলে আসে আমার। জানিনা কেন।হয়তো আদ্রাফের মুখে ভালোবাসি কথাটি শুনে। তার জন্য আমারও এক অনুভূতি ছিলো। আমি এবার তাকে জরিয়ে ধরি….তার বুকে মুখ গুঁজে বলতে থাকি….
.
” আমিও আপনাকে অনেক ভালোবাসি আদ্রাফ ভাই। অনেক ভালোবাসি….আপনার প্রতিটা কাজের প্রেমে পড়েছি…..আপনার টোলপড়া হাসিতে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছি…..কখনো আপনাকে আমি হারাতে পারবো না আদ্রাফ ভাই ! ”
.
আদ্রাফের মুখে প্রশান্তির হাসি দেখছি আমি। হয়তো আজ থেকেই শুরু হবে আমাদের প্রেমের পথচলা !”
.
🍂🍂🍂🍂🍂🍂🍂🍂🍂
.
বর্তমান
,
সকালে মুখে মিষ্টি রোদের প্রতিফলন পড়তেই পিটপিট করে চোখ খুলে মাইশা। তার ঘরের লালচে কমলা পর্দাগুলো হাওয়ার ধাক্কায় উড়ে বেড়াচ্ছে। আবারও আদ্রাফকে স্বপ্নে দেখেছে সে। অতীতের সেই কথাগুলো ভাবতেই মুখে যেমন এক চিলতে হাসি ফুটে উঠে তেমনি বের হয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস।
কিন্ত এখন সে ভাবছে এখানে এলো কি করে? সে তো আয়াতের সাথে গাড়িতে ছিলো। তবে কি ওটাও স্বপ্ন ছিলো?
.
আশেপাশে তাকাতেই সে একটা সাদা চিরকুট খুজে পায়। চোখ ছোট ছোট করে ফেলে মাইশা। চিরকুটটা খুলে সে পড়তে থাকে….
.
” Good Morning মাইশুপাখি !
ভেবোনা গতরাতে যা দেখেছিলে তা স্বপ্ন ছিলো বরং মনে করবে জীবনের
একটা সুন্দর সময় পার করেছিলে। তুমি যে এতো ঘুমকাতুরে গতকাল না
দেখলে জানতেই পারতাম না। এতবার করে ডাকলাম কিন্ত না ; তুমি তো
আমার বডিকে নিজের বেড বানায় ফেলেছিলে। যাই হোক , আমিই
তোমায় কোলে করে তোমার রুমে এনেছি। ভয়ের কারন নেই… খালু-
খালামণি দেখেনি। আর ওজন কমাইও। আমার হাতগুলো এখনো ব্যাথা
করছে।
আজ আমি সারাদিন ঘুমাবো ; তাই একা বাইরে গেলেও সাবধানে যাবা।
উল্টাপাল্টা কিছু শুনলে ঠ্যাং ভেঙে দিবো। তখন নাহয় আমার কোলে
করেই ঘুরো….তার আগে প্লিজ ওজন কমিয়ে নিয়ো। Have a good day!
.
ইতি
তোমার handsome cousin আরহাম আয়াত😎”
.
.
#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে