#রূপকথা
#লেখিকাঃজিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#পর্ব_০৩
[৪]
রাতের ভারী বর্ষণের পর প্রকৃতিতে দেখা দিয়েছে সতেজতা। কচি কিশলয়ে জমে থাকা দু-এক ফোঁটা পানি যেন সূর্যের কিরণ পেতেই ঝলমল করে উঠলো। উঠানের মাটি বালু যুক্ত হওয়ায় ঝপাৎ করেই বৃষ্টির পানি শুষে নিলো। কলপাড়ে যাওয়ার সময় রাস্তায় নজর পড়লো রূপকথার। মামুন ভাই তাদের বাড়ির সামনে দিয়েই যাচ্ছে। সামনে এগোচ্ছে ঠিকই কিন্তু চো’রের মতো উঁকিঝুঁকি দিয়ে তাদের বাড়ির ভেতর কিছু খুঁজে যাচ্ছে। রূপকথার চোখে চোখ পড়তেই কাঙ্খিত জিনিস পেয়ে যাওয়ার ভঙ্গিতে ভুবন ভোলানো হাসি দিলো। লজ্জা পেয়ে চট করেই সরে গেলো রূপকথা। সালমান মামুনের পিঠে চাপড় মেরে বলল,
-“এরম মাইনষের বাড়িত কি খোঁজো বন্ধু? এ বাড়ির সুন্দরী মাইয়া মনে ধরসে নাকি?”
-“ধূর ব্যাডা। সব কিছুতেই তোগো ইয়ার্কি করন লাগে। আমি তো গাছ দেখতাছি।”
সালমান বাহু দিয়ে মামুনের পিঠে মৃদু ধা’ক্কা মে’রে বলল,
-“বুঝি বুঝি। এইসব ইন্দুর, টিকটিকির লেজ বহু আগেই মা’ইরা আইছি।”
মামুন আর বাড়াবাড়ি করলোনা। আপনাআপনি সালমানের কথা বন্ধ হয়ে গেলো।
মায়ের কাজ এগিয়ে দিয়ে প্রতিদিনের মতো আজও স্কুলের উদ্দেশ্যে বের হলো দুই বোন। পথে গিয়েই উপমা থেমে গেলো। রূপকথা পিছু তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
-“কিরে, খাড়াই গেলি ক্যান?”
উপমার আতঙ্কিত চেহারায় ভালো করে নজর পড়তেই উতলা হয়ে উঠলো রূপকথা। চরম উৎকন্ঠা নিয়ে প্রশ্ন করলো,
-“কি হইছে?”
উপমা অসহায় চোখে তাকিয়ে বুবুর দিকে পেছন দিক দিয়ে দাঁড়ালো। ভাঙা গলায় বলল,
-“আমি স্কুলে যাইতে পারুমনা বুবু।”
রূপকথা তিরিক্ষি গলায় ঝট করেই বলে ফেললো,
-“তোর কি আক্কেল জ্ঞান নাই? না কইতেই তালগাছের মতোন লম্বা হইয়া গেলি? তারিখ মনে থাকে না?”
-“এত কিছু আমার মনে থাকেনা বুবু। কি দরকার এসব ঝামেলা হওনের? কত কিছুই তো দান করন যায়। এসব দান করন যায়না? তাইলে আমি কাউরে দান কইরা বি’পদ মুক্ত হইতাম।”
উপমার কথা শুনে ধমকে উঠলো রূপকথা। কড়া শাসনের সুরে বলল,
-“সাবধানে বাড়িত যাইবি। তিড়িংবিড়িং করবিনা। ওড়না দিয়া পেছনদিক ঢাইকা রাখ।”
উপমা পেছন দিকে ওড়না জড়িয়ে বাড়ির পথে পা বাড়ালো। হাঁটতে হাঁটতেই কোমরের অংশ থেকে নিচের দিকের সাদা পায়জামা রঙিন হয়ে গেলো। জমরদ বাড়ির সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় কতগুলো ছোকরা উপমার দিকে আঙ্গুল তাক করে হাসাহাসি করতে লাগলো। লজ্জায়, অপ’মানে, ভ’য়ে সিটিয়ে গেলো উপমা। এ বাড়ির ছেলেগুলো বড্ড বেয়া’দব। মেয়েদের দেখলে খারাপ কথা বলে। বাড়ির মেয়েলোকেরা সারাদিন রাস্তায় থাকে। ছোট ছোট বাচ্চারা মুখে মুখে গা’লি দেয়। অথচ এদের সঠিক শিক্ষা দেওয়া হয়না। এবাড়ির ছেলেগুলো একদিন একটা মেয়ের পেছন দিকে কোমরের নিচের অংশে লাঠি দিয়ে আ’ঘা’ত করে বসে। এদের ভাষা ব্যবহার খা’রা’প বলে কেউ বিচার নিয়ে আসেনা। রাস্তায় বুবুকে দেখলেও খা’রা’প কথা বলে। কালি বলে ব্যঙ্গ করে। উপমার খারাপ লাগে, খুব খারাপ লাগে। কই তার বুবু এতটা কালো? বুবুকে তার সবচেয়ে সুন্দরী মনে হয়। বড় বড় চোখদুটোতে যখন জলে চিকচিক করে তখন মনে হয় বিলের জলে ঢেউ খেলে যাচ্ছে। লোকে কেনো তার বুবুকে নি’ন্দা করে?
সব ভাবনার সুতো ছিঁড়ে যায় আশিকের হুট করে আগমনে।
জোর করে উপমার হাত ধরে একটুকরো কাগজ গুঁজে দিয়ে বলল,
-“তোর লাইগা টেহা দিয়া জলিলের হাতে চিডি লেহাইছি। কাইল আমার চিডির উত্তর দিবি।”
অতিরিক্ত ভ’য় আর জড়তার কারণে শব্দ করে কেঁদে ওঠে উপমা।
মামুনকে সবসময়ই পাড়ায় পাড়ায়, দোকানে দেখা যায়। রং চায়ে তৃষ্ণা মেটাতেই জমরদ বাড়ির সামনের দোকানে এসেছিলো মামুন। উপস্থিত ঘটনা দেখে ধমক দিলো আশিককে। উপমাকে বলল,
-“তাড়াতাড়ি বাড়িত যাও উপমা আপু। এইহানে খাড়াইয়া থাকন ঠিক না।”
উপমা একবার তটস্থ দৃষ্টিতে তাকালো আশিকের দিকে, আবার তাকালো মামুনের দিকে। মামুন আশ্বস্ত করতেই ভরসা পেয়ে এক ছুটে বাড়ি এসে থামলো উপমা। উপমাকে স্কুলে না গিয়ে বাড়ি ফিরতে দেখেই আলেয়া বেগম জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন। মেয়ের অবস্থা দেখে সব আন্দাজ করে ফেললেন। মেয়েটার উপর চরম রা’গ ও হলো। এত বড় দা’মড়ি হয়েছে এখনো এসব ব্যাপারে তার হেয়ালিপনা। ইচ্ছে করছে ধরে উ’ত্তম ম’ধ্যম দিতে। আপাতত ক্ষান্ত হলেন। আলেয়া বেগমের এই একটা বদ অভ্যেস। রা’গ হলেই ছেলেমেয়েদের পিঠের উপর রা’গ ঝাড়েন।
স্কুল থেকে তাহমিনার সঙ্গে বাড়ির রাস্তায় উঠলো রূপকথা। তাহমিনাকে বিদায় দিয়ে বাড়ি পৌঁছালো। টেবিলে ব্যাগ রেখে আগে উপমাকে দেখতে গেলো। একটা বালিশ জড়িয়ে এলোমেলো হয়ে ঘুমিয়ে আছে উপমা। আল্লাহ নিজ হাতে তার চার বোনকে রং ঢেলে দিয়েছেন। বোনদের সৌন্দর্য দেখে রূপকথা মুগ্ধ হয়। এই রূপের পেছনেই মানুষ হন্যে হয়ে ছুটে। রূপকথা মনে মনে আফসোস করে বলে,
-“রূপ থাকলে আমার ও নিজস্ব একটা মানুষ হইতো। যার উপর খালি আমারই হক থাকতো।”
গোসল করতে গিয়ে চাচাতো বোনের দেখা পেলো। দুজন মিলেই অনেকক্ষণ ধরে সাঁতার কাটলো। ঘরে এসে ভাতের প্লেট নিয়ে বসতেই আলেয়া বেগম বললেন,
-“আইরিনের বিয়া ঠিক হইছে। তোর ফুফু আইজ আইয়া অনেকবার কইরা কইয়া গেছে বিয়াত যাওনের লাগি। তোর আব্বা থাকলে কি ভাগ্নীর বিয়াত না যাইয়া থাকতো?”
ভাত মাখতে মাখতেই রূপকথা বলে উঠলো,
-“তুমি কি কও? যাইবা?”
-“টেহা পয়সা ও তো লাগবো। আগে দেহি তোর ভাই আসলে আলাপ কইরা দেখমু।”
আলেয়া বেগমের কথায় রূপকথা মিনমিন করে বলল,
-“যদি বিয়াতে যাও তাইলে আমি কি পায়ে দিমু? আমার তো ভালা জুতা নাই।”
দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন আলেয়া বেগম। মেয়েকে হ্যাঁ, না কিছুই না বলে উঠে পড়লেন। খাবার খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে উঠানে গিয়ে বসলো রূপকথা। ততক্ষণে উপমা ঘুম ছেড়ে উঠে পড়লো। কলপাড় থেকে চোখেমুখে পানির ঝাপটা দিয়ে এসে রূপকথার পাশে বসলো। উপমার চোখমুখ মাত্রাতিরিক্ত ফোলা দেখে রূপকথা ভ্রু কুঁচকে বলল,
-“তোর চোখমুখ এমন ফোলা ক্যান? দিনের বেলা ঘুমাইলে চোখমুখ ফুইলা যায়, তয় এতটা ফোলে না।”
বুবুর কাছে কিছুই লুকিয়ে রাখতে পারেনা উপমা। ফ্যালফ্যাল করে কেঁদে বুবুকে জড়িয়ে ধরলো। কেঁদে রূপকথার বুক ভাসিয়ে দিয়ে আজকের ঘটনা বর্ণনা করলো। বুকের ভেতর ছ্যাৎ করে উঠলো রূপকথার। একবার ছেলেগুলোর নজর পড়েছে মানে তার বোনের জন্য সামনে শনি অপেক্ষা করছে। উপমাকে আগলে নিয়ে আদুরে কন্ঠে বলল,
-“তুই এহন আর পাড়ায় পাড়ায় ঘুরবিনা। কোথাও যাইলে আমার লগে যাইবি।”
উপমা সায় জানিয়ে রূপকথাকে ঝাপটে ধরে বসে রইলো। আলেয়া বেগম তীক্ষ্ণ চোখে দুইবোনকে পরোখ করে বললেন,
-“কি হইছে দুইডার?”
রূপকথা কথা কাটিয়ে বলল,
-“উপমার পেট ব্যথা। এর লাইগাই কানতাছে।”
গরম পানি খাইতে ক ওরে। আর কিছু বললেন না আলেয়া বেগম। নিজের খুঁটিনাটি কাজে মন দিলেন।
[৫]
সূর্যের উত্তপ্ত দাপুটে মগজ গলে পড়ার উপক্রম। কড়া রোদে সকালের ঝুলিয়ে দেওয়া মরা মাছটি শুকিয়ে শুঁটকি হয়ে গেছে। চারপাশে মাছি ভনভন করছে। মাছ থেকে এক উটকো গন্ধ নাসাপথে প্রবেশ করতেই গা গুলিয়ে আসলো খোরশেদের। গলা শুকিয়ে কাঠ। এমন রোদের মধ্যে কাজ করছে অথচ গৃহস্থ একগ্লাস পানি এগিয়ে দিচ্ছে না। চুক্তি কাজে আবার খাবার কিসের? খোরশেদ আপাতত কাঠমিস্ত্রীর কাজ করছে। চালের উপর বসে টিন গাঁথছে। আজ হাঁটের তারিখ। কাজের টাকা হাতে আসবে। গত রাতে মাকে বলে দিয়েছে আইরিনের বিয়েতে যাওয়ার জন্য। কিছু না দিলেও অন্তত এক হাজার টাকা তো দিতে হবে। চাল গাঁথা শেষ করে নিচে নেমে আসলো। গামছায় ঘাম মুছে কলপাড়ে গিয়ে কল চেপে পানি পান করলো। দুইমিনিট না জিরোতেই আবার সবাই কাজে নেমে পড়লো। বসে থাকা লোকের ভাত নাই।
রাতে টাকা হাতে পেয়ে আর বাজার করলোনা খোরশেদ। মায়ের হাতে টাকা তুলে দিলো।
আলেয়া বেগমের হাতে কিছু ডিম বেচা টাকা ছিলো। এক হাজার টাকা বিয়েতে দিবেন বলে আলাদা করে ছেলেকে বাকিটাকা বাজার করার জন্য ফেরত দিলেন। নিজের কাছে যে টাকা ছিলো সেগুলো নিয়ে দুই মেয়েকে নিয়ে বিকেলেই বাজারে গেলেন। দুই মেয়েকে দুইজোড়া জুতা কিনে দেবেন। বোরকা পড়ে মায়ের সাথে জুতা দোকানে ঢুকলো দুইবোন। জুতা ও পছন্দ হলো। দুজনেই এক রকম জুতা পছন্দ করেছে। সাতশ চাইছে একজোড়া জুতার দাম। অনেক দরকষাকষি করে চারশো তে এসে থামলেন আলেয়া বেগম। দুইজোড়া জুতার দামই আটশ টাকা। দোকানি ছেলেটা কিছুতেই এই মূল্যে জুতা দেবেনা। সে বলছে,
-“আরোও কম দামি জুতা ও আছে আন্টি। আপনি সেগুলো নিতে পারেন।”
আলেয়া বেগম অনড় হয়ে বললেন,
-“দেখো বাবা, এই জুতাগুলার দাম এমনিতেই আমি বেশি কইয়া ফালাইছি। এহন প্যাকেটে ভইরা দেও।”
ছেলেটি বলল,
-“আন্টি আপনাকে জুতা ভালোটা দেখিয়েছি। মেয়ে সুন্দরটা বিয়ে দিতে টাকা লাগবেনা। তার চাহিদা এমনিতেই বেশি। কিন্তু কালোটাকে বিয়ে দিতে টাকা দেওয়া লাগবে। তাহলে আপনিই বুঝেন ভালো খারাপ।”
বোরকার আড়ালে ঢোক গিললো রূপকথা। খারাপ লাগছে তার। উপমা ছ্যাৎ করে উঠে বলল,
-“লাগবো না জুতা কিনন। আসো তো মা। এ্যাই বুবু চলো।”
রূপকথার হাত ধরে উপমা বেরিয়ে গেলো। আলেয়া বেগম বেরিয়ে যাওয়া ধরতেই ছেলেগুলো পেছন থেকে ডেকে জুতা প্যাকেট করে দিয়ে বলল,
-“টাকা দেন আন্টি। আপনি বলে কম রেখেছি। অন্য কাস্টমারদের কাছে কিন্তু এক হাজার টাকার কম রাখতামনা।”
আলেয়া বেগম টাকা দিয়ে বেরিয়ে আসলেন। উপমাকে সামনে পেয়ে ধমক দিলেন। কোথায় কেমন ব্যবহার করতে হয় জানা নেই মেয়েগুলোর। এমনিতেই একজনের জন্য অন্যজন আটকে আছে। ব্যবহার দেখলে সারাজীবন আইবুড়ী হয়ে থাকতে হবে।
বাড়িতে ফিরে বোরকা খুলেই একছুটে বকুল তলায় পা বাড়ালো রূপকথা। তার ভীষণ মন খারাপ। মন খারাপ হলেই সে বকুল তলায় ছুটে আসে। মানুষগুলো কেনো বারবার গায়ের রং নিয়ে তাকে বিব্রত করে, খোঁটা দেয়, নিন্দা করে?
এলাকায় বড় একটা বকুল ফুলের গাছ আছে। তার পাশেই একটা বিল রয়েছে। গাছের মোটা শক্ত শেকড়ে হাঁটু উবু করে হাঁটুতে মাথা ঠেকিয়ে বসে পড়লো রূপকথা। বাতাসের দমকলে পুষ্পবৃষ্টি হলো। ছুঁয়ে দিলো রূপকথার গতর। মাথা তুলে উপরে চোখ তুলে তাকালো রূপকথা। অধর কোনে কৃতজ্ঞতার হাসি টেনে বলল,
-“বকুল সঙ্গী। যহনই মন খারাপ থাকে তহনই তোর কাছে ছুইটা আসি। তুই তোর সুরভীত শরীরখানা ঝরাইয়া আমার মন খারাপ সারাই ফেলার অদ্ভুত একখান ক্ষমতার নিয়া থাকস। জানিস বকুল সই তোর মতো কইরা কেউ আমার মন ভালা করতে পারেনা।”
তাচ্ছিল্য মাখা চোয়ালে ঝরে যাওয়া কয়েকটা বকুল ফুল কুড়িয়ে নিয়ে বলল,
-“দুনিয়াইতে সুন্দর মাইনষের অভাব নাই, কিন্তু দেখার মতো এক জোড়া সুন্দর চোখের বড়ই অভাব। যদি সুন্দর চোখ থাকতো, তয় কালা-সাদার কোনো ভেদাভেদ থাকতো না। সুন্দর চোখ দিয়া সবকিছুই সুন্দর দেহা যাইতো।”
#চলবে……..