#মেঘ_বিয়োগের_মৌসুম
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্ব_১৮
ফোনটা হাতে রেখেই সামনের দিকে তাকাতেই বাইকে দুজনকে দেখে ছানাবড়া হয়ে যায়। একটা শিশি থেকে তরল জাতীয় কিছু তার দিকে ছুড়ে দেয় তারা। সাথে সাথে পিছন থেকে কেউ উলটো দিকে টেনে নেয় বেলাকে।
হাতে সেই তরলের কিছু অংশ ছিটে পড়তেই বেলা চিৎকার দিয়ে বলে ওঠে,” আহ্ আমার হাত জ্ব*লে গেল গো।”
রফিক চাচা তাড়াহুড়ো করে বেলাকে ধরে নেয়। আম্মা আম্মা করে চিৎকার করতে থাকে। বেলার এই অবস্থা দেখে রফিক চাচা কান্না করা শুরু করে দিয়েছে। ততক্ষণে গাড়ি এসে তাদের সামনে থামে। দুজনকে এভাবে দেখে ওয়াহাজ তাড়াতাড়ি করে গাড়ি থেকে নেমে আসে।
” কী হয়েছে রফিক চাচা?”
” দেখেন না, ওয়াজিহা আম্মারে দুইটা ছেলে এ*সি*ড মে*রে পালাইছে।”
ওয়াহাজ বেলার দিকে তাকিয়ে দেখে বেলা চোখ বন্ধ করে কষ্ট সহ্য করার চেষ্টা করছে। ওয়াহাজ পকেট থেকে টাকা বের করে রফিক চাচার হাতে দিয়ে বলে,” বড়ো দেখে দুইটা পানির বোতল নিয়ে এসে গাড়িতে বসবেন। আমি ওয়াজিহাকে পিছনের সিটে বসিয়ে দিচ্ছি। অনবরত পানি ঢালবেন। জলদি যান
”
রফিক চাচা সেখানে আর দেরি না করে দোকানের দিকে দৌঁড়ে চলে যায়। ওয়াহাজ তাড়াতাড়ি করে বেলাকে গাড়িতে উঠিয়ে বসিয়ে দেয়। মাথায় হাত বুলিয়ে বুকের সাথে নিয়ে বলে,” কিচ্ছু হবে না বোন। আর একটু সহ্য করো সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।”
রফিক চাচা পানি নিয়ে চলে আসলে বেলার পাশে বসে হাতে পানি ঢালতে বলে নিজে ড্রাইভিং সিটে চলে যায়। এক হাত দিয়ে ড্রাইভ করা শুরু করে অন্যহাত দিয়ে ফোনটা বের করে ফারাজকে কল দেয়। ফারাজের অফটাইম থাকায় তাড়াতাড়ি কল রিসিভ করতে সক্ষম হয়।
ওয়াহাজ জলদি বলে ওঠে,” ফারাজ, ওয়াজিহাকে কেউ বা কারা যেন এ*সিড নিক্ষেপ করেছে। মুখ তো বেঁচে গিয়েছে তবে ছিঁটেফোঁটা হাতে লেগেছে। তুমি ব্যস্ত থাকলেও একটু তাড়াতাড়ি শেষ করে ওয়াজিহার জন্য ফ্রি হয়ে যাও প্লিজ। পাঁচ মিনিটের মধ্যে চলে আসছি আমরা।”
___
বেলাকে হাসপাতালে নিয়ে আসার সাথে সাথে পর্যাপ্ত চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। হাসপাতাল থেকে জানানো হয়েছে একটা দিন অন্তত এখানে রাখতে হবে সম্পূর্ণ চিকিৎসার জন্য। আগামীকাল সকালে চলে যেতে পারবে।
নার্স বেরিয়ে গেলে ওয়াহাজ এসে বেলার বেডের পাশে চেয়ার টেনে বসে। বেলা জানালার বাহিরে তাকিয়ে বৃষ্টি দেখছিল। ওয়াহাজের উপস্থিতিতে তার দিকে তাকায়।
ওয়াহাজ বেলার উদ্দেশ্যে বলে,” কারা ছিল? কাদের এতো বড়ো সাহস হলো তোমার সাথে এরকম করার?”
” নুসরাতের কেসের ওই তিনটা ছেলের মধ্যে দুজন। আমি তোমার জন্য অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। তখনই দুজন বাইকে করে যেতে যেতে এরকম করেছে। রফিক চাচা উলটো দিকে টেনে না নিলে এসি*ড এসে আমার মুখে পড়তো।”
” ওরা কি জানে না, তোমার একটা ভাই আছে? খুব ভুল করেছে। এর জন্য জীবন না দিতে হয় ওদের।”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেলা। এসব নিয়ে তার আর কোনো কথা বলতে ইচ্ছে করছে না৷ সম্ভব হলে নিজেই ওই জানো*য়ারগুলোকে খু**ন করে গাছের সাথে ঝুলিয়ে রাখতো।
কেবিন থেকে বেরিয়ে যায় ওয়াহাজ। বেলা আবার জানালার বাহিরে তাকায়। নার্স এসে দরজায় নক করে। বেলা বাহিরে তাকিয়েই নার্সকে ভেতরে আসতে বলে।
নার্স হাতটা ভালো করে দেখে বলে,” হাতের জন্য কি খুব কষ্ট হচ্ছে?”
বেলা আনমনে বলে ওঠে,” ” পৃথিবীতে সবচেয়ে কষ্টের জিনিস কী জানেন? কেউ সত্যিকারের ভালোবাসে জেনেও তার ভালোবাসা গ্রহণ করতে না পারা।”
” জি?”
বাহিরে থেকে ফারাজ নার্সকে উদ্দেশ্য করে বলে,” আপনি যান আমি দেখছি।”
ফারাজের গলা শুনে বেলা বেশ চমকে যায়। আনমনে বলা কথাটা ভাবতেই কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে করে তার। তবুও কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে চুপচাপ শুয়ে থাকে।
নার্স চলে গেলে ফারাজ কেবিনে এসে চেয়ারটায় বসে হাত দেখতে দেখতে বলে,” এতো কষ্ট পাচ্ছেন তবুও কেন গ্রহণ করছেন না আমায়? একটু ভালোবাসলে কী এমন ক্ষতি হবে আপনার? থেকে যান না আমার সাথে সারাজীবনের জন্য।”
ফারাজের কথায় তার দিকে তাকায় বেলা। ভ্রু কুচকে বলে,” কিছু বললেন?”
” না।”
” হুম। ভাইয়া কোথায়, জানেন কিছু?”
” না তো। আচ্ছা শোনেন, মৌ এসেছিল৷ তখন তো কেবিনে কাউকে আসতে দেওয়া হচ্ছিল না তাই ফিরে গেছে। রান্না করে নিয়ে আসবে একেবারে। কী খাবেন বলুন। আমি মৌকে বলে দেব।”
” কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না।”
” হাত কি এখনো জ্বা*লাপো*ড়া করছে?”
” হ্যাঁ করছে তো। সহ্য করে নিচ্ছি।”
” আমাকে সহ্য করে নেওয়া যায় না?”
বেলা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,” আপনি বারবার এভাবে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করবেন না।”
” কেন? অনুভব করলে সেটা প্রকাশ করলে দোষের কী? আপনারও জানা উচিৎ আপনাকে কেউ ভালোবাসে।”
” জানা উচিৎ নয়। আমি যে জীবন পার করেছি সেটার পর তো একদমই নয়। যে ভালোবাসা সময়ের সাথে বিলীন হয়ে যায় সেই ভালোবাসা আমার প্রয়োজন নেই৷ আমার জীবনে আমার ভাই ছাড়া আর কোনো পুরুষ আসতে পারবে না। সব পুরুষ আমার জন্য নিষিদ্ধ। আশা করছি আপনি পরবর্তীতে এসব আমাকে বলবেন না। আমাদের দুই পরিবারের মধ্যে একটা ভালো সম্পর্ক আছে এবং নতুন একটা সম্পর্ক তৈরি হতে যাচ্ছে সেদিকে আপনার খেয়াল রাখা উচিৎ। ”
ফারাজ আর কিছু না বলে কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়৷ যেখানে ফলাফল শূন্য সেখানে রচনা লিখে জানালেও কোনো লাভ হয় না৷
________
হাসপাতালে একটা দিন কেটে গিয়েছে। ওয়াহাজ সারাদিন বোনের আশেপাশে থেকেছে আজ। গতরাত একটার দিকে সে হাসপাতালে বেলার কেবিনে এসেছে। হাসপাতালের গেইট দশটার দিকে বন্ধ হয়ে যায় বিধায় সে ফারাজের সাথে দারোয়ানের কথা বলিয়ে ভেতরে ঢুকেছে। রাতে বোনের কাছেই ছিল সে। সকালে মৌ রফিক চাচার কাছে খাবার পাঠিয়ে দিয়েছিল৷
জিনিসপত্র গুছিয়ে বেলাকে রেডি করা হয়েছে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য৷ হাসপাতালের সবকাজ শেষ করা হয়েছে। চলে যাওয়ার আগে ফারাজ রুমে আসে। ওষুধপত্র সব ঠিক আছে কি না দেখে নেয়।
ওয়াহাজ ওষুধগুলো হাতে নিতে নিতে বলে,” আর কোনো সমস্যা হবে না তো?”
ফারাজ বেলার হাতটা আরেকবার দেখে বলে,” কোনো সমস্যা হওয়ার কথা না। হাতে যতটুকু লেগেছিল তার কার্যকারিতা কমে গেছে। এখন ওটা একটু সাবধানে রাখলেই হবে। দেখা যাবে আগামীকালই একদম ঠিক হয়ে যাবে কিন্তু দাগটা যাবে না। দাগ উঠাতে চাইলে অনেক পরে চিকিৎসা নিতে হবে।”
” না না দাগ উঠানো লাগবে না। এমনি ঠিক হয়ে গেলেই হবে।”
” ঠিক হয়ে যাবে ইন শা আল্লাহ। এখন তো আমাদের ওখানেই যাবেন তাই তো?”
” হ্যাঁ। পরশু নতুন বাসায় আসব। আচ্ছা, এখানে আর দেরি না করি। সাবধানে থেকো। আমরা আসছি।”
ওয়াহাজ বেলাকে মৌ-এর কাছে রেখেই বাহিরে বেরিয়েছে। সারাবেলা মৌ বেলাকে দেখে রেখেছে। বেলা নিজহাতে কিছু খেতে পারছে না মৌ নিজেই বেলাকে খাইয়ে দিয়েছে। মৌয়ের মাও বেলার খুব যত্ন করছেন।
বিকেল থেকে বেলাকে রেখে ওয়াহাজ বাহিরে গেছে। রাতের খাবারের সময় হয়ে যাওয়ায়ও সে এসে পৌঁছায়নি।
রাতের খাবারের সময় হয়ে গেলে মৌ খাবারের প্লেট রুমে নিয়ে চলে আসে। বেলা শুয়ে শুয়ে বই পড়ছিল। মৌ এসে ডেকে তুলে বসিয়ে দেয়।
” অনেক রাত হয়ে গেছে। জলদি খেয়ে নাও।”
” আমাকে চামচ দিতে আপু। বাম হাতে চামচ দিয়ে খেতাম।”
” কেন? আমি খাইয়ে দিচ্ছি মজা লাগছে না?”
” না, সেটা না। তুমি সেই বিকেল থেকে কষ্ট করছ আমার জন্য।
” কোনো কষ্টই না। আর কতদিনই বা তোমাকে এভাবে ভালোবাসতে পারব বলো তো? আমার বিয়ের পরেই তো তুমি চলে যাচ্ছ আমাদের সবাইকে ছেড়ে।”
মৌ বেলাকে খাইয়ে দিতে থাকে। খাওয়ানো যখন শেষের দিকে তখন বেলাকে নিম্নস্বরে বলে ওঠে,” ফারাজ ভাইয়া কাউকে পছন্দ করে। সে নাকি ডিভোর্সি। ভাইয়া কি তোমাকে পছন্দ করে? তোমাকে বলেছে কিছু?”
#চলবে……