মেঘ বিয়োগের মৌসুম পর্ব-১৭

0
412

#মেঘ_বিয়োগের_মৌসুম
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্ব_১৭

তিনজন বাড়ি থেকে বেরিয়েছে বিয়ের শপিংয়ের উদ্দেশ্যে। গাড়ি থেকে নেমে তিনজন সোজা শপিংমলের ভেতরে চলে যায়। বেলা তখনো মাঝেমাঝে ওয়াহাজকে কল দিয়ে যাচ্ছে। অতঃপর কলটা রিসিভ হলো।

একটু দূরে চলে আসে বেলা। ফোনটা কানে নিয়েই বলে ওঠে,” তোমাকে কখন থেকে কল দিচ্ছি খেয়াল আছে তোমার?”
” কেন?”
” তোমাদের বিয়ের শপিং করতে এসেছি।”
” টাকা?”
” আমার কিছু বাসায় ছিল। আপাতত ওগুলো নিয়ে এসেছি।”
” এড্রেস বলো, আমি এখনই আসছি।”

বেলা এখানকার এড্রেস দিয়ে ভেতরে চলে আসে। মৌ শাড়ি দেখছিল। বেলাকে দেখেই বলে ওঠে,” দেখো তো শাড়িটা কেমন লাগছে?”
” তোমার পছন্দ হলে ঠিক আছে। বিয়ে তোমার, এই দিনে তোমার পছন্দের সবকিছু পরবে। যদি তোমার ভালো লাগে তাহলে নিয়ে নাও।”
” আমার ভালোই লাগছে এটা।”
” তাহলে নিয়ে নাও। ”

মৌ আরও কিছু শাড়ি দেখতে থাকে। বেলা মৌ-এর বাহু ধরে এগিয়ে এনে বলে,” তোমার হবু বর আসছে কিন্তু। আমি জায়গার ডিটেইলস বলে দিয়েছি। এতক্ষণে হয়তো চলেই এসেছে প্রায়। দোকানের নামটা টেক্সট করে বলে দিয়েছি। এখন এখান থেকে বের হওয়া যাবে না।”

মৌ অবাক হয়ে বেলার দিকে তাকিয়ে বলে,” উনি আসছেন?”
” হ্যাঁ, আসছেই তো। তোমার শপিং করে দেবে তার জন্য আসছে।”
” তাহলে আমি এখন কিছুই কিনব না। উনার পছন্দে কিনব।”
” সেটা তোমার ইচ্ছে।”

ওয়াহাজের জন্য কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে তারা। ফারাজ বসা থেকে উঠে বাহিরে থেকে কয়েকবার হেটেও এসেছে ওয়াহাজের জন্য।
পনেরো মিনিটের মধ্যে ওয়াহাজ নির্দিষ্ট জায়গায় এসে পৌঁছায়। ঘুরে ঘুরে কেনাকাটা করে নেয়। একদিনে সবকিছু কেনা শেষ হয় না বিধায় আগামীকাল আসার সিদ্ধান্ত নেয় তারা। মৌ আর ওয়াহাজ কথা বলছিল এমন সময় তাদের চোখের আড়ালে ফারাজ একটা শপিং ব্যাগ বেলার দিকে বাড়িয়ে দেয়। বেলা ভ্রু উঁচিয়ে জানতে চায়- এটা কী?

ফারাজ মৃদু হেসে বলে,” প্রেম তো গ্রহণ করলেন এই ছোটো ভালোবাসাটুকু গ্রহণ করুন। এটার বিনিময়ে ভালোবাসতে বলব না। বিয়ের দিনে এটা পরবেন, আপনাকে এই রঙের শাড়িতে হয়তো অনেক ভালো লাগবে।”

বেলা একবার মৌ আর ওয়াহাজের দিকে তাকিয়ে তাদের দেখে নেয়৷ ওয়াহাজ যেহেতু ফারাজের বিষয়টা জানে তাই তার সামনে কিছুতেই ফারাজের সাথে কথা বলা উচিৎ হবে না বলে মনে করে সে।

বেলা ফারাজকে উদ্দেশ্য করে বলে,” আমি এটা নিতে পারব না।”
” কেন?”
” আমি পাঁচ বছর সংসার করেছি, আমি জানি কোনটা করা উচিৎ আর কোনটা করা উচিৎ না৷ আপনি প্লিজ আমাকে অসস্তিতে ফেলবেন না। ”
” গিফটটা নিলে খুশি হব।”
” কাউকে খুশি করে চলার দায়ভার আমার নেই।”

ফারাজ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বেলার মুখের দিকে নীরবকণ্ঠে বলে ফেলে,” কী অদ্ভুদ বিষয় তাই না?
আমরা তাদেরই ভালোবেসে ফেলি যারা আমাদের ভাগ্যে থাকে না। যে ভালোবাসে সে মনেপ্রাণে চায় ভালোবাসার মানুষটার সাথে থাকতে কিন্তু সেটা ভালোবাসার মানুষটা চাইলেও সমাজ চায় না আবার সমাজ চাইলেও সেই মানুষটা চায় না।”
” এখানে আপনার ভালোবাসার মানুষ এবং সমাজ কেউই চাইছে না। সব ভালোবাসার সমাপ্তিটা সুন্দর হতে নেই। থাকুক না কিছু গল্পে হাহাকার,কষ্ট আর প্রিয় মানুষকে কাছে না পাওয়ার আক্ষেপ।”
_____

ওয়াহাজ নতুন একটা বাসা ঠিক করতেই সকালে বের হয়েছিল। বিয়ের কথাবার্তা ঠিক হতেই সে নতুন বাসার খোঁজ চালাচ্ছিল। সকাল সকাল নতুন একটা ফ্ল্যাটের খোঁজ পেতেই বেরিয়ে গিয়েছিল সেটার উদ্দেশ্যে। নতুন বাসাটা তার ভালো লেগেছে। তারা যে এলাকায় আছে সেটারই পাশের এলাকায়। বাসায় দুইটা বেডরুম, ছোটো একটা ড্রয়িং প্লাস ডাইনিংরুম, রান্নাঘর, দুইটা ওয়াশরুম,দুইটা রুমেই বেলকনি সব মিলিয়ে বাসাটা ওয়াহাজের পছন্দ হয়েছে। শপিং শেষ করে সেটা বেলা আর মৌকে দেখানোর জন্য সেখানে নিয়ে যায়। ফারাজের কাজ পরে যাওয়ায় আগেই শপিংমল থেকে চলে গিয়েছে। ওয়াহাজ বেলা আর মৌকে নিয়ে বাসা দেখে বাড়ি ফিরতে ফিরতে দুপুর আড়াইটা বেজে যায়। তারা ঠিক করে ওই বাসাতেই উঠবে এবং খুব তাড়াতাড়ি বাসায় আসবাবপত্র নেওয়া শুরু করবে। ওয়াহাজ জানায় বাড়িওয়ালার সাথে সে রাতেই কথা বলবে।

সাড়ে তিনটার দিকে খাওয়া দাওয়া শেষ করে বিছানায় শুয়ে শুয়ে একটা বই নিয়ে সময় কাটাচ্ছিল বেলা। হঠাৎ তার মনে পড়ে ফারাজের দেওয়া শাড়িটার কথা। তখন ফারাজের জোরাজুরিতে ব্যাগটা নিয়েছিল ঠিকই কিন্তু শাড়িটা দেখেইনি সে। বিছানা থেকে উঠে তার জন্য কেনা জিনিসপত্রের ব্যাগগুলো থেকে ফারাজের দেওয়া ব্যাগটা বের করে সে।

গাঢ় সবুজ রঙের একটা শাড়ি। সেটা নেড়েচেড়ে দেখে বেলা। শাড়িটার ভাজ খুলে কাধের ওপর ছড়িয়ে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। কী সুন্দর শাড়িটা। মনে মনে ফারাজের পছন্দের তারিফ করতে থাকে সে। পরক্ষণেই নিজেকে গুটিয়ে নেয়, শাড়িটা বিছানায় ছুড়ে ফেলে আয়নার সামনে দাঁড়ানো ভেতর থেকে ভেঙে গিয়েও ভাইয়ের ভালোবাসার শক্তির জোরে দাঁড়িয়ে থাকা নিজেকে দেখতে থাকে সে।
______

মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে শুয়ে মায়ের সাথে ছোটো বোনের বিয়ের ব্যাপারে কথা বলছে ফারাজ। মা ফাহমিদা বেগম বলে ওঠেন,” শোন বাবা, তোর বোনের বিয়ে হয়ে গেলে কিন্তু এবার আমি তোকে বিয়ে দেব। আর কত বাড়িটা এমন ফাঁকা থাকবে বল তো? এতদিন তবু মৌ ছিল সামনে সপ্তাহ থেকে তো সে আর এ বাসায় থাকবে না। এ বাড়িতে একা একা আমার দম বন্ধ হয়ে আসবে। ”

ফারাজ মৃদু হেসে বলে,” তোমার ছেলেকে কেউ বিয়ে করবে না, আম্মা। তোমার ছেলেকে ভালোবাসা যায় না।”

ফাহমিদা বেগম ছেলের মাথায় হাত বুলানো থামিয়ে বলেন,” আমার ছেলের মতো ছেলে কি আর একটাও আছে নাকি? পেশায় ভালো একটা ডাক্তার, এত সুন্দর একটা চেহারা তাকে কি না কেউ বিয়ে করবে না? একবার শুধু বিয়ে করবি বল, আমি আজ থেকেই পাত্রী দেখব।”
” সবাইকে কি আর বিয়ে করা যায় আম্মা? গেলেও কি ভালোবাসা যায়?”

ফাহমিদা বেগম সন্দিগ্ধ চোখে ছেলের দিকে তাকান। বড়ো উৎকন্ঠায় জানতে চান,” তোর কিছু হয়েছে, বাবা?”

ফারাজ মিথ্যে হাসি হেসে বলে,” কী হবে, আম্মা? কিচ্ছু হয়নি। ”
” আমি তোর মা হই। মাকে মিথ্যা বলবি?”

ফারাজ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,” মিথ্যা তো বলতে চাই না আম্মা।”
” সত্যিটা বল আমায়। আমি কয়েকদিন ধরে খেয়াল করছি তুই বাসায় সেরকম কোনো কথা বলছিস না। হাসপাতালে বেশি সময় থাকছিস আবার বাড়িতে থাকলেও নিজের ঘরেই সবসময় খিল এঁটে থাকছিস। কিছু হয়েছে, বাবা?
” হচ্ছে তো অনেককিছুই শুধু মাঝেমধ্যে সহ্য করতে পারছি না। কান্না আসছে কিন্তু ছেলে মানুষ বলে কথা, ছেলেদের তো কান্না করা একটা অপরা*ধের মতো।”

ছেলের কথায় আশ্চর্য হন ফাহমিদা বেগম। ছেলে এরকম একটা সময় পার করছে আর তিনি জানেন না, বুঝতেই পারেননি। ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করেন,” কাউকে পছন্দ করিস, বাবা? আমাকে বল তুই। আমি তোর বাবার সাথে কথা বলব।”
” সে-ই তো রাজি না, আম্মা। তোমরা কথা বলে আর কী করবে? ”
” কে সে? আমি কি চিনি? তুই আমাকে শুধু বল, আমি নিজে রাজি করাবো তাকে।”
” তার আগে একটা সংসার ছিল, আম্মা। তুমি কি পারবে তাকে মেনে নিতে আমার জন্য।”
” এসব কেমন কথা ফারাজ? তুই যেমন, তোর জন্য সেরকম মেয়েই প্রয়োজন। তুই কেন ওরকম কোনো মেয়েকে বিয়ে করতে চাইছিস?”
” আমি ভালোবাসি তাকে, আম্মা। তুমি তো জানোই তোমার ছেলেকে। প্রথম দেখাতেই ভালো লেগে গেলেও তার সাথে এ বিষয়ে জোর আমি করতে পারিনি কখনো। একবার জানিয়েছি কিন্তু সে ‘না’ করে দিয়েছে। এতগুলো দিন পর এসে বুঝতে পারছি আমার চাওয়াটাই ভুল।”
” হ্যাঁ। এসব মন থেকে দূর করে দাও। অসম্ভব কিছু মনে জায়গা দিও না।”
” আমার ভালো থাকাই এখন স্বপ্ন। দূরত্ব বেড়েই চলেছে, আমি আর ভালো থাকা যেন দুই মেরুর বাসিন্দা।”

ফাহমিদা বেগম কিছু একটা আন্দাজ করতে পেরেছেন হয়তো কিন্তু তিনি এ বিষয়ে কথা না এগিয়ে ছেলেকে একটা কথাই বললেন,” বোনের বিয়েতে মনোযোগ দাও, ফারাজ। বোনের বিয়েতে সমস্যা হতে পারে এরকম কিছু করার কথা মাথাতেও এনো না।”

ফারাজ উঠে বসে৷ মায়ের দুই হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলে,” আমি আর কী করব। দেখি ভাগ্যে কী আছে।” বলে মায়ের রুম থেকে বেরিয়ে নিজের রুম থেকে ওয়ালেট নিয়ে বেরিয়ে পড়ে বাহিরের উদ্দেশ্যে।
______

দুদিন হলো নতুন বাসা গোছগাছ শুরু করেছে বেলা আর ওয়াহাজ। এ বাসার প্রায় সব প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নতুন বাসায় নেওয়া হয়েছে। বেলা ওয়াহাজের সাথে গিয়ে একটু একটু করে সাজিয়ে রেখে এসেছে। তানিয়া মাহি। আজ কিছু জিনিসপত্র কিনতে হবে জন্য ওয়াহাজ বেলাকে তার সাথে বের হতে বলেছে। জিনিসগুলো মূলত মৌ কিনতে বলেছে। তার পছন্দের একটা ডেকোরেশন করা রুমের ছবি দিয়ে বলেছে তাদের রুমটা যেন সেভাবে সাজানো হয়। আপাতত কিছুটা এরকম হলেই হয়ে যাবে আর বাকিটা পরে সে সাজিয়ে নিবে। বেলাকে সবকিছু ডিটেইলস জানিয়ে দিয়েছে সে৷ ওয়াহাজকে কিছু বলার সাহস তার এখনো হয়ে ওঠেনি। ওয়াহাজ কয়েকবার জানতে চেয়েছে তার কোনো পছন্দ আছে কি না রুম ডেকোরেট করার জন্য, মৌ বারবার জানিয়েছে ওয়াহাজের পছন্দমতো ডেকোরেট করলেই হবে। ওয়াহাজের আড়ালে বেলাকে সে নিজের পছন্দের কথা জানিয়েছে। বেলাও নিজের হবু নতুন ভাবির কথামতো রুম সাজাতে জিনিসপত্র কিনতে বের হবে।

বাসা থেকে রেডি হয়ে বের হয় সে। ওয়াহাজ কিছুক্ষণ আগেই কল করে বের হয়ে রাস্তার সামনে দাঁড়াতে বলেছে।

বেলা বাসা থেকে বের হয়ে রাস্তার সামনে এসে দাঁড়ায়। রাস্তার দুই পাশেই তাকিয়ে বারবার দেখতে থাকে ওয়াহাজ আসছে কি না। আসছে না দেখে বেলা ওয়াহাজকে কল করে। রিং হতেই রিসিভ হয়ে যায় ওপাশ থেকে।

বেলা আবারও রাস্তার দিকে তাকিয়ে বলে,” কোথায় ভাইয়া?”
” এই তো প্রায় চলে এসেছি। জাস্ট দুই মিনিট অপেক্ষা করো। বের হয়েছ?”
” হ্যাঁ। আমি তো তাড়াতাড়ি করে বের হয়ে গেইটের বাহিরে দাঁড়িয়ে আছি। ”
” আচ্ছা থাকো, আমি আসছি। ”

বেলা কল কেটে আবার ফোনেই ডুবে যায়। সেখানেই দাঁড়িয়ে ফোন ঘাটাঘাটি করতে থাকে। মেসেঞ্জারে মেসেজ আসতেই সেখানে গিয়ে দেখে মৌ টেক্সট করেছে। দুটো শাড়ির ছবি দেখিয়ে জানতে চেয়েছে কোনটা বেশি সুন্দর।

বেলা ভালো করে ছবি দুইটা দেখে জানায় হালকা গোলাপি রঙের শাড়িটা সুন্দর। সাথে সাথে ওপাশ থেকে মেসেজ আসে,” তাহলে তোমার জন্য আমি এটা নিচ্ছি। ”

বেলা বুঝতে পারেনি শাড়িটা মৌ তার জন্যই কিনবে বলে পছন্দ করিয়েছে। সে তৎক্ষনাৎ রিপ্লাই করে,” আমার অনেক শাড়ি আছে আর সেদিন তো কেনা হলো। আমার আর শাড়ি লাগবে না।”

ওপাশ থেকে আর রেস্পন্স পেল না সে। ফোনটা হাতে রেখেই সামনের দিকে তাকাতেই বাইকে দুজনকে দেখে ছানাবড়া হয়ে যায়। একটা শিশি থেকে তরল জাতীয় কিছু তার দিকে ছুড়ে দেয় তারা। সাথে সাথে পিছন থেকে কেউ উলটো দিকে টেনে নেয় বেলাকে।

হাতে সেই তরলের কিছু অংশ ছিটে পড়তেই বেলা চিৎকার দিয়ে বলে ওঠে,” আহ্ আমার হাত জ্ব*লে গেল গো।”

#চলবে…..

গঠনমূলক মন্তব্য আশা করছি।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে