#মেঘের বাড়ি☁
#পর্ব-১২
#লেখনীতে_ফারহানা_আক্তার_ছবি
.
.
” কী করবে মেঘ?”
” যখন করবো তখন তো জানতেই পারবেন৷” বলে কল কেটে দিলো মেঘ৷ মেঘের কথা শেষ হতে তার মা
শেফালী বেগম এসে বলে,” মেঘ মা তোর জা মনি এসেছে তোর সাথে দেখা করতে৷”
“ভেতরে পাঠিয়ে দেও আম্মা৷” শেফালী বেগম বাইরে গিয়ে মনিকে ভেতরে পাঠিয়ে দেয়৷ মেঘ মনিকে দেখে বেশ অবাক হয়৷ বোরকা পড়া থাকলেও মনির চোখের কোন ফুলে কালচে হয়ে আছে সেটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে৷ মনি ভেতরে ঢুকে নেকাব খুলে টুলের উপর বসে মেঘকে বলে,” কেমন আছেন ভাবি?”
” বেঁচে আছি মনি আপু৷ কিন্তু তোমার চোখ মুখের এই অবস্থা কেন? কেউ নিশ্চয়ই তোমাকে আঘাত করেছে?”
মনি নিঃশব্দ হাসি হেসে বলে,” যে জানোয়ার গুলো তোমাকে আর তোমার অনাগত সন্তানকে মারতে চাইছিলো তারাই আমারে মারছে তোমারে সাহায্য করার অপরাধে৷”
মনির কথা শুনে রাগে মেঘের চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে৷ রাগে দাঁতে দাঁত চেপে মনিকে বলে,” ওদের আমি এমন অবস্থা করবো যে বউয়ের গায়ে হাত দেওয়ার সাধ সারা জীবনের জন্য মিটে যাবে৷”
” কী করবা ভাবি?”
” জেলের ভাত খাওয়াবো মনি আপু৷ কিন্তু তুমি তো ওই বাড়িতে তো নিরাপদ না মনি আপু৷”
” আমি ওবাড়ি নেই ভাবি৷ গতকালই আমি আমার সন্তানদের নিয়ে বাপের বাড়ি চইলা আইছি৷”
” ভালো করেছো৷ ওই জাহান্নামে না থাকাই ভালো৷ ” মনি তার ব্যাগ থেকে ছোট একটা বক্স বের করে মেঘকে দিয়ে বলে,”ভাবি তোমার জন্য পায়েশ রাইন্ধা নিয়া আসছি৷ তুমি কী খাবা?”
মেঘ মুচকি হেসে বক্সটা খুলে কয়েক চামচ পায়েশ খেয়ে বক্সটা পাশে রেখে দিয়ে বললো,” কিছুক্ষণ আগে নাস্তা করেছি তাই এখন পুরোটা খেতে পারবো না৷ পরে না হয় পুরো টা খাবো৷”
মনি মুচকি হেসে বললো,” সমস্যা নাই তুমি যে বিশ্বাস কইরা পায়েশ টা খাইছো এইডাই অনেক৷”
” মনি আপু আমি দুঃখিত ৷ আমার জন্য তোমাকে মার খেতে হলো৷”
” তোমার দুঃখিত হওয়ার কিছু নাই ভাবি৷ ওদের মা মেয়েরা অনেক বছর যাবত আমার উপর অত্যা*চার করছে৷ এখন তুমি আইসো তোমার উপর অত্যা*চার করতাছে৷”
” এর পরিনামও তারা ভুগবে৷”
ঘন্টাখানিক মেঘের সাথে গল্প করে মনি চলে যায়৷
২৪.
পুলিশ অফিসার মেঘের শশুড়বাড়ির সবার নামে ওয়ারেন্ট বের করে তাদের এরেস্ট করার জন্য বেরিয়ে পরে৷
পুলিশ এলাকায় ঢোকা মাত্র জায়েদা বেগমের কাছে খবর চলে যায়৷ পুলিশ আসছে তাদের খুঁজছে৷ জায়েদা বেশ ভয় পেয়ে যায়৷ দ্রুত মেয়ে জামাইকে ডেকে বাড়ি থেকে পালিয়ে অন্য কোথায়ও লুকিয়ে পড়ে৷
পুলিশ বাড়ি এসে কাউকে না পেয়ে আশে পাশে খোঁজ করলে কেউ কিছু বলতে পারে না৷ সোহেলের বড় চাচা মোহাম্মদ গাজী পুলিশকে দেখে এগিয়ে এসে বলে,” স্যার আপনারা এখানে?”
” আমরা আপনার ভাই তার স্ত্রী এবং মেয়ে জামাইকে খুঁজছি৷ তারা কোথায়?”
” ওনাদের কেন খুঁজতাছেন?”
” তাদের নামে নারী নি*র্যা*ত*ন এবং এটেম্ট টু মা*র্ডা*রের কেস হয়েছে৷ আমরা ওয়ারেন্ট নিয়ে এসেছি তাদের এরেস্ট করতে৷”
” কি কইতাছেন স্যার৷ ওগো নামে কেস করলো কেডা?”
” এই বাড়ির বড় বউ মেঘ৷”
” বউমা কেস করছে?”
” আমি যতদুর জানি আপনি এই গ্রামের মাতব্বর আর আপনি জানেন না আপনার ভাইয়ের পরিবারে কী হচ্ছে না হচ্ছে?”
মোহাম্মদ গাজী মাথা নিচু করে বলে,” স্যার আমরা তো জানি সব ঠিক হইয়া গেছে৷ মাইয়াডার উপর আর কোন অত্যা*চার করে না আমজাত আর তার বউ কিন্তু যা হুনতাছি৷”
” শুনুন ওনাদের গ্রামে দেখলে খবর দিবেন৷ ওনাদের এরেস্ট করা হবে৷ আর যদি আপনি ওদের কোন ভাবে সাহায্য করার চেষ্টা করেন তাহলে আপনাকেও আমি এরেস্ট করতে বাধ্য হবো৷”
” না না স্যার আমি ওদের সাহায্য করুম না ৷ আপনি নিশ্চিন্তে থাকেন৷”
অফিসার আর কিছু না বলে তার টিম নিয়ে চলে গেলো৷
সোহাগের বন্ধুরা তাদের লোক লাগিয়ে দিয়েছে সোহেলের বাবা মা বোন জামাই কে খোঁজার জন্য৷ এদিকে জায়েদা তার বোনের বাসায় এসে উঠেছে৷ এখানে বসে তার ভাসুরকে কল দিয়ে জানতে চায় পুলিশ কেন আসছে৷ তখন জায়েদা জানতে পারে মেঘ তাদের নামে কেস করেছে৷ সবটা জেনে জায়েদা রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে সোহেলকে কল করে৷ সোহেল সবে মাত্র কাজ থেকে ফিরে বাসায় ফিরেছে তখনি ফোনটা বেজে ওঠে৷ সোহেল বাড়ির নাম্বার দেখে দ্রুত কল রিসিভ করতে ফোনের ওপাশ থেকে জায়েদা কান্নারত গলায় সোহেল কে বলতে লাগলো,” বাপজান বাপজান তোমার বউ আমাগো জেলে পাঠাবার চায়৷ আমাগো নামে কেস করছে৷”
মায়ের কথা শুনে সোহেল অবাক হয়ে বলে,” কী বলতাছো আম্মা? মেঘ তোমাদের নামে কেস করছে?” জায়েদা কিছু বলার আগে তার বড় মেয়ে ফোন টা ছোঁ মেরে নিয়ে নিজে বলতে লাগলো,” ভাইজান আম্মা যা কইছে সব সত্যি কইছে৷ ভাবি এমন কেন করতাছে ভাইজান? আমরা তো এহন ঘর ছাড়া পুলিশ আইয়া আমাগো খুইজা গেছে৷ ” আখির কথা শুনে সোহেল রাগে হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে কল কেটে মেঘের নাম্বারে ডায়াল করে৷
মেঘ সবে মাত্র খাবারের পর ঔষধ খেয়ে চোখ বুঝে তন্দ্রায় পড়েছিলো কিন্তু হঠাৎ ফোনের রিংটন বেজে ওঠায় মেঘের তন্দ্রা কেটে যায়৷ ধীরে সুস্থে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে সোহেলের নাম্বার৷ মেঘ জানে হঠাৎ এই সময় সোহেল কল করে না আর যেহেতু করেছে তার মানে কেসের কথা তার কান পর্যন্ত পৌছে গেছে৷ মেঘ নিজের মন শক্ত করে কল রিসিভ করে কানে ধরতে ফোনের ওপাশ থেকে কর্কশ ভাষায় সোহেল বলে,” তুই আমার মা বাবা বোন জামাইয়ের নামে কেস করেছিস?”
” হ্যাঁ করেছি৷ ”
সোহেল রাগ কন্ট্রোল করার চেষ্টা করতে লাগলো কিন্তু পারলো না৷ অত্যান্ত বাজে ভাষায় মেঘকে বললো,” হা*রা*ম জা*দী তোর সাহস কী করে হয় আমার পরিবারের মানুষ উপর কেস করার?”
” ভাষা সংযত হয়ে কথা বলুন সোহেল৷ আর কী বললেন আমার সাহস কী করে হয় কেস করার? আরে আমার তো শুরুতেই উচিত ছিলো আপনার পরিবারের উপর কেস করার কিন্তু করেনি৷ এবার আর সেই ভুল করি নি৷ আমার নামে মিথ্যা চুরির কেস করতে যখন আপনার মা বোনের বাধে নি৷ আমাকে সহ আমার বাচ্চাকে খুন করতে চায় তাদের আমি ছেড়ে দিবো? হাহ! কখনো না৷ এবার আর এই মেঘ মাথা নত করবে না৷ আপনার পরিবারকে জেলের ভাত না খাওয়ানো পর্যন্ত আমার শান্তি নেই৷”
” মেঘ..” ফোনের ওপাশ থেকে সোহেল চিৎকার করে বললো৷ মেঘ সোহেলের চিৎকার করতে শুনে বলে,” আপনি জানেন সোহেল আপনি একজন কাপুরুষ৷ যে পুরুষ তার স্ত্রী সন্তান কে রক্ষা করতে পারে না সে কেমন স্বামী কেমন বাবা?”
” মেঘ ঠিক করে কথা বলো৷ আমার রাগ ওঠাইস না৷ ভালো ভাবে বলছি কেস তুলে নে৷ আমি দেশে আসছি খুব শীগ্রই তখন সমস্যার সমাধান করবো৷”
সোহেলের কথা শুনে মেঘ হাসতে হাসতে বলতে লাগলো,” যে পুরুষ সত্য মিথ্যা যাচাই না করে হুকুম জারী করে৷ আমি মেঘ সে পুরুষের কথা মানবো সেটা ভাবলে কী করে?”
” মেঘ কেস তুলবে কীনা?”
” তুলবো না৷ অন্যায়ের শাস্তি তো আমি দিবোই ৷ ”
” মেঘ আর একবার বলছি কেস তুলবে কীনা?”
” তুলবো না৷”
” তাহলে ডিভোর্সের জন্য তৈরি থেকো৷”
মেঘ থমকালো ডিভোর্সের কথা শুনে৷
” ডিভোর্স!”
” হ্যাঁ ডিভোর্স৷ তোমার কাছে দুইটা অপশন আছে৷ এক. কেস তুলে নিবে৷ আর দুই. ডিভোর্স নিবে৷”
মেঘ কয়েক সেকেন্ড চুপ থাকলো৷ মেঘকে চুপ থাকতে দেখে সোহেল বলতে লাগলো,” বউ মাথা গরম করো না৷ কেস টা তুলে নেও৷ আমি দেশে ফিরে না হয় এর সমাধান করবো৷ আমাদের বাচ্চাটার জন্যই না হয় ফিরে এসো৷ ”
” সমাধান করবে? যেখানে তোমাদের বংশের রক্তকে তোমার রক্তকেই যারা শেষ করে দিতে দু’বার ভাবলো না৷ সে বাচ্চার দোহাই দিয়ে তাদের ক্ষমা করতে বলছো? বাহ সোহেল বাহ! আমি পাগল ছিলাম৷ ভেবে ছিলাম শশুড় শাশুড়ি ননদ দেবর এদের মন মত চললে হয়তো সুন্দর একটা সংসার হবে৷ কিন্তু আমি ভুল ছিলাম৷ আমার শুরু থেকেই অন্যায়ের প্রতিবার করা উচিত ছিলো৷ তোমাদের কাছে দ্বিতীয় বার ফিরে আসাটা আমার উচিত ছিলো না৷ ভেবে ছিলাম এবার হয়তো মেঘের একটা সংসার হবে মেঘের বাড়ি হবে যেখানে থাকবে অনাবিল সুখ কিন্তু হলো না৷ সোহেল আমি তোমার দ্বিতীয় শর্ত মেনে নিলাম৷ আজ থেকে তুমি মুক্ত৷ গর্ভাবস্থায় তালাক হয় না তাই তোমাকে কয়েকমাস অপেক্ষা করতে হবে৷ আমি তালাক নামা সাইন করে পাঠিয়ে দিবো তোমাদের বাড়িতে বাড়ি ফিরে না হয় সাইন করে দিও৷” ঠান্ডা গলায় কথা গুলো বলে মেঘ কল ডিসকানেক্ট করে চোখ বন্ধ করে ফেললো৷ মেঘ নিজের মনকে নিজে নিজেকেই বোঝাতে লাগলো, মেঘ কাঁদলে চলবে না৷ নিজেকে শক্ত রাখতে হবে৷ এখনো যে কাঁটায় ভরা রাস্তায় তোকে একাই চলতে হবে৷ নিজের বাচ্চাকে পৃথিবীর আলো দেখাতে হবে৷ বাঁচতে হবে সন্তানের জন্য হলেও যে তোকে বাঁচতে হবে৷ ভেঙে পড়লে চলবে না৷”
মেঘের চোখের কোন বেয়ে কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো৷ কেবিনের বাইরে দাড়িয়ে সোহাগ সহ তার মা ভাই দাড়িয়ে মেঘের প্রত্যেকটা কথা শুনে ওখানে দাড়িয়ে রইল৷ তবে আজ শেফালী বেগমের চোখে পানি জমে নেই৷ তার মেয়েটা যে বেঁচে আছে শুধু এর জন্য আল্লাহর কাছে হাজার হাজার শুকরিয়া জানায়৷
” আম্মা কী ভাবছেন?”(মেজভাই)
” মেঘ যেটা চায় তোরা সেটাই কর৷ তালাকে ব্যবস্থা করবি৷ আর ওকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা কর৷ আমার মেয়ে লাখে একটা৷ যদি আবারও বিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে তাহলে বিয়ে দিবো৷ একটা ভালো সুস্থ পরিবারে বিয়ে দিবো৷ এমন জানোয়ার অশিক্ষিত ঘরে আমি আমার মেয়েকে আর পাঠাবো না আবদুল্লাহ৷”
” ঠিক আছে আম্মা৷ আমি ডাক্তারের সাথে কথা বলে আসছি৷”
২৫.
সোহেল মেঘের কথা গুলো কোন ভাবেই মেনে নিতে পারছে না৷ মেঘ তাকে ডিভোর্স দিবে ভাবতেই সোহেলের যেন দম বন্ধ হয়ে আসছে৷ কিন্তু বাবা মা বোন তাদের কথাও ভুলতে পারছে না সোহেল৷ সোহেল এবার তার মা’কে কল করে৷ দুবার রিং হওয়ার পর কল রিসিভ হয়৷
” আম্মা তুমি মেঘরে বিষ দিছো কেন?”
ছেলের মুখের কথা শুনে জায়েদার হুস উড়ে যাওয়ার মত অবস্থা৷ মেঘ যে সব বলে দিছে সেটা বুঝতে আর বাকি নেই৷ জায়েদা ন্যাকা কান্না জুড়ে দিয়ে বলতে লাগলো,” বাপজান তুমি তোমার আম্মারে এই চিনলা? আমি কেন বড় বউরে বিষ দিমু৷ হে তো মোর বংশে বাতি দিবো৷ আমি কেমনে আমার বংশধর গো ক্ষতি করি? এই কথা তুমি কেমনে কইলা বাপ?” মায়ের এমন অভিনয় দেখে আখি মিলা সাথী অবাকের চোখে তাকিয়ে আছে৷ এত নিঁখুত অভিনয় কেমনে করতে পারে একজন মানুষ?
সোহেল তার মায়ের কথা শুনে কী বলবে বুঝতে পারছে না৷ একদিকে মা তো অন্যদিকে বউ কার কথা বিশ্বাস করবে সে? ভেবেই নিজেকে পাগল পাগল লাগছে সোহেলের৷ তাই আর কিছু না বলে কল কেটে দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো৷ পেটের ক্ষিদের জ্বালা যেন নিমিষেই উধাও হয়ে গেল৷ সোহেল কী করবে না করবে ভেবে পাচ্ছে না৷
তিনদিন পর পুলিশ আখি আর মিলার জামাইকে একসাথে জুয়া খেলার সময় এরেস্ট করে৷ কথাটা বাড়িতে পৌছানো মাত্র আখি মিলা কান্নায় ভেঙে পড়ে৷ জায়েদা কী করবে না করবে ভেবে না পেয়ে থানায় যাবে বলে মনস্থির করে কিন্তু পরক্ষণে………..
.
.
.
#চলবে………..