“মেঘলা আকাশ”পর্ব ৫.
মায়ারা মুরগি কাটছে। বান্ধবী তিনটা সামনের ঘরে সোফায় বসে গল্প করছে, আর সে কিনা এখানে নাক কুঁচকে এসব কাজ করছে। খাবার তৈরি করতে কত কিছুই না করতে হয়, আর খেতে তা দুই মিনিটও লাগে না। কী দরকার এমন খাবারের! বিরক্তির মাথায় সে হয়তোবা ভুলেই গেছে তার শরীরের গঠনে খাবারেরই অবদান বেশি।
হঠাৎ মায়ার দোয়া কবুল হওয়ায় মা বললেন, “মায়া, আফরাকে এই নাস্তাগুলো দিয়ে আয়।”
“এই পাকুরায় তেল দেখা যাচ্ছে। উনি খাবেন না।”
“তেল দিয়ে বানিয়েছি, তেল একটু থাকবেই। সবগুলোই কি পাকুরা থেকে বের করে নিতে পারব? নিয়ে যা। না খেলে একটু পর যে পায়েস করব, তা দিব। আর হ্যাঁ, ও বোধ হয় বিরক্তি বোধ করছে। টিভিটা অন করে দিস।”
মায়া একরাশ বিরক্তিকর মুখোমুখি হওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে গেল। কিন্তু তাকে অবাক করিয়ে দিয়ে আফরা আপা নাস্তা খেতে লাগল। নাস্তার নিচে মায়া যে টিস্যুগুলো দিয়েছে তাতে তেল মুছে খাচ্ছে। বলল, “মায়া, তুমিও বসো। খাও।”
মায়া টিভি অন করে দিয়ে বসলো। কিন্তু আফরা আপার পছন্দের মতো কিছুই দিচ্ছে না। মায়া বলল, “টিভিতে তো ভালো কিছু দিচ্ছে না। আমাদের দিঘীর পাড়ে যাবেন? ওখানে অনেক ভালো লাগবে।”
“না, ইচ্ছে হচ্ছে না। তোমরা সবাই সমবয়সী। আমি গিয়ে ওখানে কী করব?”
কথা বলবেন, মায়া বলতে চাইল। কিন্তু শেষে নিজেই কাজ থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য বান্ধবীদের নিয়ে ওখানে যাওয়ার কথা ভাবলো। আর এদিকে আফরা দোনোমনা করছে।
বাসা থেকে বেরুতেই মায়া বলল, “যাক, উনার শিক্ষা হয়েছে। খাবার নিয়ে কমেন্ট করেননি।”
“মনে হচ্ছে এখানে থাকতে থাকতে সেন্স হয়েছে।”
“ধুর। এসবই ওই প্র্যাংকের কারণে।”
ওহহো, মায়া জিহ্বায় কামড় খেল। সে জেরিনের কথার উত্তর দিতে গিয়ে খেয়ালই করেনি, ওরা ওই প্ল্যানে ছিল না। অগত্যা সে বলল, কীভাবে সে আপার সাথে মজা করেছে।
“ওহ্ এই কথা।” জেরিন বলল, “আমিই তো বলি নয়ন ভাই হঠাৎ এরকম অড কেন বেহেভ করছেন। উনি দেখে ফেলেছেন, অথচ আমাদের কিছু বলেননি।”
এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি মাসে জিতে নিন নগদ টাকা এবং বই সামগ্রী উপহার।
শুধুমাত্র আপনার লেখা মানসম্মত গল্প/কবিতাগুলোই আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হবে। এবং সেই সাথে আপনাদের জন্য থাকছে আকর্ষণীয় পুরষ্কার।
গল্পপোকার এবারের আয়োজন
ধারাবাহিক গল্প প্রতিযোগিতা
◆লেখক ৬ জন পাবে ৫০০ টাকা করে মোট ৩০০০ টাকা
◆পাঠক ২ জন পাবে ৫০০ টাকা করে ১০০০ টাকা।
আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এই লিংকে ক্লিক করুন: https://www.facebook.com/groups/golpopoka/?ref=share
“হু, নয়ন ভাই এরকম আমি তা জানতাম না।” রাইসা বলল, “আসলে আমরা বোধ হয়, উনার আসল ব্যক্তিত্বকেই দেখিনি আগে।”
তারা কথা বলতে বলতে দিঘীর পাড়ে চলে গেল। ঘাটে বসে গল্প শুরু করল। কিন্তু এখন ওদের আলোচনার মূখ্য অংশ হলো হাবীব ভাই। মায়া বলল, লোকটা খুব সুন্দর। আমি এটা আগে কখনও খেয়াল করিনি।
“আগেরজনকেও খেয়াল করিসনি শুরুতে। ওসব প্রেমে পড়ার ইফেক্ট। হা হা হা।”
সন্ধ্যা হতেই কাজ যেসব করেনি, সেসবও মায়াকে পুষিয়ে নিতে হয়েছে। বাইরে যে চাচারা বৈঠক বসবে, তাদের সবার জন্য নাস্তা, চা তৈরি করতে হয়েছে। কিন্তু এবার এ কাজে তার বান্ধবীরাও ছিল। আফরা আপাও আসতে চেয়েছিল, কিন্তু মায়াকে দেখে বিরক্তি নিয়ে চলে গেল।
মায়ার সে কি ব্যস্ততা! ভুলেই গিয়েছিল, চাচার এই পুরো বাড়িতেও আধিপত্য কতটা। স্বাভাবিকভাবেই লোকের সংখ্যা তার অনুমানের বাইরে। তার অতিরিক্ত ব্যস্ততার আরেকটা কারণ আছে। চাচা বারবার ওকে লোকগুলোর সামনে যেতে বলছে, যাতে ওরা বিয়ের যোগ্য মায়াকে দেখে রাখতে পারে। এই রাগে সে কাজ একটু বেশিই করছে। ফলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল এগারোটায়। বিয়ে না কাজের একটা বড় গোডাউন। কোনো ছেলের বিয়েতে বোন থাকলে যা হয় আরকি। কিন্তু সে সবই আগামী রাতে পুষিয়ে নেবে। গায়ে হলুদে জমে মজা করবে।
কিন্তু ছাদটা পরিষ্কার করার কথা ছিল। কাল সারাদিনও কাজের ব্যস্ততায় সে পারবে না। এখনই করার কথা ছিল, কিন্তু সবাই ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়েছে। সেও আলসেমি করে শুতে যাবে হঠাৎ নিস্তব্ধ এই পরিবেশে উপরে কারও হাঁটার আওয়াজ পেল। ছাদে কেউ আস্তে হাঁটলে এভাবে আওয়াজ হয়। কে উপরে?
মায়া ছাদে উঠল। এই অহেতুক কষ্ট না করতে সে ঝাড়ুও এনেছে। এসেছে যখন, পরিষ্কারও করে যাবে। কিন্তু উঁকি দিয়ে সে কাউকেই দেখতে পেল না। অদ্ভুত!
কিন্তু ও ছাদে পা রাখতেই কে যেন ওকে ঘুরিয়ে দেয়ালের সাথে লাগিয়ে ফেলে। আচমকা এই কাণ্ডের পর মায়া চিৎকার করে উঠার আগে খেয়াল করল কারো নিঃশ্বাসের গরম বাতাস। তারপর নজরে পড়ে সেই চোখগুলো, যেগুলো বিগত দুইদিন সে তার মনের মেঘাচ্ছন্ন আকাশে দেখেছে। তার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে এলো।
“কী? অনেক কাজ তাই না?” হাবীব ভাইয়ের এই লাইনটা আবারও তার কাছে কোনো প্রতিযোগিতায় জেতা বিশেষ এক পুরষ্কার মনে হয়েছে।
“হ্যাঁ। অনেক কাজ।”
“এতই কাজ যে, এটুকু সময় পাওয়া যায় না বসার?”
“হুম।” মায়া আচ্ছন্নের মতো জবাব দিলো।
তিনি মুচকি হেসে বললেন, “জানো, তোমাকে সকাল থেকে একটুও দেখতে পাইনি?”
“না জানি না। যদি জানতাম, তবে কাজই করতাম না।”
“না না, কাজ কেন করবে না? কাজ তুমি না করলে তো জমে থাকবে।”
“তাহলে আমি কাজ করি আপনি চেয়ে থাকুন।”
অতঃপর দরজার কাছে বেতের চেয়ারে বসে হাবীব ভাই তার ঝাড়ু দেওয়া চেয়ে রইল। আর মায়ার মনে হচ্ছে সে আকাশের গহ্বরে ঢোকে গেছে। এই রাত তাকে আপন করে নিয়েছে এবং খুলে রেখেছে তার সব রহস্যের জট। তার খুব করে ইচ্ছে হচ্ছে, হাবীব ভাইয়ের সাথে কথা বলতে। কিন্তু তার পা’গুলো তার মনের কথা শুনছে না। যার কারণে পরিষ্কারের কাজ শেষ হলে সে চলে যেতে উদ্যত হয়। অমনিই তার পথ রোধ করলো হাবীব ভাই। এবার হাবীব ভাই নিজেই দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে চোখে চোখে তাকায়।
“পালাবে না।”
“যদি পালাই?”
“তবে শাস্তি হবে।”
“কিসের শাস্তি? পালাবার আবার শাস্তি হয় নাকি?”
“পালাবার শাস্তি না পেলেও আমার বোনকে ভয় দেখানোর শাস্তিটা পাবে।”
মায়ার চোখ বড় বড় হয়ে গেল, “সেরাতে আপনিই আমাদের দেখেছিলেন?”
হাবীব ভাই ভ্রূ কুঁচকে তাকালেন।
“তুমি জানতে তোমাদের দেখে ফেলেছি। তবু তোমার অপরাধ বোধ কাজ করেনি?”
মায়া লজ্জায় মাথা নিচু করলো।
“আমি মনে করেছি নয়ন ভাই আমাদের দেখেছে। এজন্য তিনি রাগ করেও থেকেছেন।”
“আমি নয়নের সম্বন্ধে শুনতে চাই না। ও বলে, মানুষের উপর থেকে স্বচ্ছ থাকা উচিত। আর আমি মনে করি না, নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করিয়ে মানুষকে সুযোগ দিয়ে বেড়ানো উচিত। ওর প্রসঙ্গ আমার সামনে আনবে না। আশা করি, তুমি ওর রাগ ভাঙাতে যাওনি?”
মায়া তাড়াতাড়ি এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়ল।
“গুড।”
তাদের মাঝে বেশ কিছুক্ষণ নীরবতা কাজ করলো। কে যেন সিঁড়ি ভেঙে আসছে। মায়া হাবীব ভাই কিছু বলার আগেই পালায়। আতিকা উঠছে।
“আরে ছাদে ছিলি? আমরা তো সবাই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। তাই তোকে ডাকিনি।”
“ভালো করেছিস।”
“কী করছিলি?” নামতে নামতে সে বলল।
“ঝাড়ু দিচ্ছিলাম।”
“তাই নাকি? আমিই তো বলি ছাদে কারও হাঁটার আওয়াজ কেন হয়েছে।”
“আমিই হাঁটছিলাম।”
তারা ঘুমোতে চলে গেল। সবাই ঘুমিয়ে তলিয়ে গেছে ক্লান্তির কারণে। কিন্তু এতো ক্লান্তির পরও মায়ার ঘুম আসছে না। সে এপাশ-ওপাশ করে কল্পনায় কাটাচ্ছে ছাদে কাটিয়ে আসা মুহূর্তগুলো। আর মিটিমিটি হাসছে। আতিকা এ হাসির মানে বুঝছে না। হয়তোবা আলো-আঁধারির ফলে সে ভুলভাল দেখছে। পাশ ফিরে সে ঘুমিয়ে পড়ল।
কি সুন্দর সকাল! এমনটা আগে কখনও মায়ার মনে হয়নি। সামাজিক কর্মকাণ্ডের আয়োজক শাহেদ ভাইকেও তার ভালো লাগত। কিন্তু সেসময় সকালটা এমন সুন্দর লাগেনি। ওই লোকটার সাথে নামেই যেন সম্পর্কে যাওয়া। বর্তমানে সবার এই এক রোগ। একা থাকা যায় না, সম্পর্কে জড়াতে হয়। যে সম্পর্কে জড়ায়নি, তাকেও কেউ সাধু ভাবে না। আরও বিশ্বাস না করে বলে, অ্যাহ্, লাইন মারে না! তারচেয়ে বরং কারও সাথে থেকে নিজের মনকে রঙিন রাখা ভালো। নিজের চিন্তাধারাকে বাহবা দিয়ে সে উঠে পড়ল।
কিন্তু পরক্ষণে গিরগিটি দেখে তার সকালটা বড় অসুন্দর হয়ে গেল। একরাজ্য বিরক্তি নিয়ে গিরগিটি.. মানে আফরা আপা তার দিকে তাকিয়েছে এবং বলেছে ওরা কালকেই চলে যাবে। মায়ার মুখটা ভার হয়ে একটুখানি হয়ে গেছে। তার মানে কেবল আজকের দিন ওরা থাকবে। আর ওই সাহেবের কোনো দেখাই যে নেই। নাকি নিজেই ব্যস্ততার কারণে তার দেখা পাচ্ছে না তা বুঝতে পারছে না।
সন্ধ্যায় বান্ধবীদের সাথে বড় আনন্দ করে সে ছাদের চারিদিকটা সাজালো। মাকে না জানিয়ে তারা ফুল অর্ডার করেছে। তাতে সাহায্য করেছে বীথি আপারাও। দেখে চারিদিকটা প্রাণ ভরে যাওয়ায় অতিথিরাও সমবেত হলো। চাচা এসব একদমই পছন্দ করলো না। কিন্তু এসব সে গায়ে মাখল না। এরকম জমজমাট হবে তাও ভাবেনি। সে এতোই আনন্দিত ছিল যে, হাবীব ভাইয়ের কথা মাথায় তেমন আসেনি। কিন্তু এক সময় রাত গভীর হয়। ভাইয়াকে মেহেদি পরানো শেষ হয়েছে। কিন্তু হাবীব ভাইয়ের দেখা নেই!!
বাকি ক’জনও নিচে চলে গেছে। মায়া ছাদেই রয়ে গেছে। মন খুব খারাপ। অল্প কিছুক্ষণ পর সে সিঁড়িঘরে পা রাখতেই কে যেন তার হাত খপ করে ধরে তার মুখ চেপে ধরলো।
“চিৎকার না।”
“হুঁ।”
“শাস্তিটা কেমন হয়েছে?”
“কিসের শাস্তি?”
“ওই যে পালানোর আর আমার বোনকে উত্যক্ত করার শাস্তি।”
“আচ্ছা, এজন্যই দেখা দেননি? আপনারও শাস্তি হওয়ার দরকার।”
“শাস্তি-টাস্তি দিঘীর পাড়ে দিবে। চলো ওখানে।”
“এই রাতে? দিঘীর পাড়ে? কেউ আমাদের খুঁজে পাবে না।”
“এজন্যই তো।”
হাবীব ভাই তার হাত ধরে হেঁচকা টান দেয়। অতঃপর তারা আরও ঘন আঁধারে মিলিয়ে গেল।
(চলবে…)
লেখা: ফারিয়া কাউছার