“মেঘলা আকাশ”পর্ব ৩
দুপুর থেকে এক চিন্তা মায়াকে খুব ভাবাচ্ছে। যতই মেয়েটির ভাব-ভঙ্গির কথা মনে পড়ে, ততই সে বিচলিত হয়। আফরা নামের মেয়েটি হাবীব ভাইয়ের একমাত্র বোন। সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তা হলো, মেয়েটি এখানে কীভাবে এডজাস্ট করবে। যেখানে আড্ডা হয়, মেয়েটি সেখানে বেশিক্ষণ থাকতে চায় না কিংবা কোনোকিছুর ঘাটতি দেখা দিলে সে খুবই বিরক্ত হয়। অতিথিকে সুখী রাখতে না পারলে একপ্রকার অপরাধ বোধ কাজ করে। তার তা হলেও সন্ধ্যা না হতেই মেয়েটির প্রতি মায়ার ও তার বান্ধবীদের মনে ঘৃণা জন্মাতে লাগল, যদিও সে বয়সে প্রায় সাথী আপার সমান। কিন্তু মাঝে মাঝে মায়াদের উপর গজগজ করে কথা বলাটা তাদের মোটেও ভালো লাগেনি।
হাবীব ভাই স্বভাবতই ভাইয়াদের সাথে ব্যতীত তেমন কারও সাথে কথা বলেনি। মায়া একবার চোখাচোখি হওয়ায় কুশল বিনিময় করেছিল। সেসময় তাদের কথা বলতে দেখে আফরা আপা চলে আসে। হাবীব ভাইয়ের দিকে ভ্রূ কুঁচকিয়ে তাকিয়ে তাকে সতর্ক করে দিয়ে চলে গেল। মায়া বুঝল না কী হলো। কারণ বোনের ইশারা বুঝে ভাই আর কথা বলেনি। এর আগে হাবীব ভাই এখানে বেশ কয়েকবার এসেছে, অনেকবার একরাত মতো থেকেছে। কিন্তু কথা না বললেও কখনও সরাসরি ইগনোর করেনি। হয়তো এর আগে কখনও তার বোন সাথে না থাকায় মায়া কিছু বুঝে উঠতে পারেনি। তারা ভাই-বোন দু’জনই কিছুটা গম্ভীর স্বভাবের। একটি উদাহরণ দেওয়া যায়, বাসায় দুপুরে পোলাও, মুরগির মাংস ইত্যাদি সুস্বাদু খাবার করা হয়েছিল। খাবার পরিবেশন করার সময় ভাই-বোন পছন্দ-অপছন্দের কথা কিছুই বলেনি। কিন্তু যখন পোলাও আফরা আপার প্লেটে দেওয়া হলো তখন সে নাক সিটকে ভাইয়ের দিকে তাকাল। মায়াও হাবীব ভাইয়ের দিকে তাকাল। এই সময় মায়ার দৃষ্টি লক্ষ করে হাবীব বলল, “আসলে ওর পোলাও একদম পছন্দ নয়।” হুহ্! আগে বললেই পারত।
অবশেষে আফরাও বলল, “হ্যাঁ, গন্ধটা আমার একদম বাজে লাগে। দয়া করে এগুলো এখান থেকে নিয়ে যাবেন।” এমনভাবে বলল যেন এটা একটা পচা খাবার ছিল। মায়া হতভম্ব হয়ে সাথে সাথেই নিয়ে গেল, কারণ সে আগে কখনও এমন মানুষের মুখামুখি হয়নি যারা মুখের ওপর অপছন্দের কথা বলে অন্যকে বিভ্রান্ত করে। তবে একটা ব্যাপারে মায়ার ভালো লাগল, হাবীব বোনের কাণ্ড দেখে একটু বিরক্ত হয়েছে।
খাওয়া-দাওয়ার পর মা এসে মায়াকে বললেন, তার রুমে যেন আফরাকে থাকতে দেয় এবং তারা যেন বীথিদের রুমে এডজাস্ট করে থাকে।
মায়া বিরোধ করল, “আপাদের রুমে এমনিতেই ফ্লোরে শুতে হবে, তারচেয়ে বরং আমার রুমেই ফ্লোরে ঘুমালে সমস্যা কী? উনি তো খাটেই ঘুমাবেন।”
“আহ্, বুঝার চেষ্টা করিস না। ওদের জীবনযাপন আমাদের মতো নয়। হয়তো কারও নিচে থাকাটা তার পছন্দ হবে না।”
“কিন্তু হাবীব ভাই তো নির্বিঘ্নে ভাইয়ার সাথে একই বিছানায় ঠাসাঠাসি করে শুতে পারে।”
“ওহহো আর পারলাম না। আমি আর কোনো কথা শুনতে চাই না। ওকে তোর রুমটা বিয়ে অবধি দিবি ব্যাস!”
জেরিন মায়াকে সান্ত্বনা দিলো। তবু মায়া বলল, “আমার রুম… এটা কোনো কথা হলো?”
রাত অবধি মায়ার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে রইল। রাজিব এলে সে তাকে ধরে বসল। বলল, “হাবীব ভাই আসছিল তা ঠিক ছিল। তুমি গিরগিটিকে আই মিন ওর বোনকেও কেন আসতে বললে?”
“ও আমাদের মেহমান। ম্যানার শেখাতে হবে? আর কেন? কী হয়েছে? আমি বলিনি। হাবীবকে ফোন করেছিলাম, আফরা রিসিভ করেছিল। এরপর হাবীবকে যখন ইনভাইট করি, তখন সে তার সামনে থাকায় হাবীবের জবাবদিহি করতে হয়েছে। আমি সৌজন্যের খাতিরে ওর বোনকেও ইনভাইট করেছি। আমি জানতাম না, ও এক কথায় রাজি হয়ে যাবে। হাবীব বিরোধ করেছিল। কিন্তু আফরাই বলল, তাকে সাথে না নিলে তার বাবাকে বলে দেবে।”
“কী বলে দেবে?”
রাজিব আমতা আমতা করল, “হাবীবের বাবা আমাকে পছন্দ করে না। স্বভাবতই হাবীব এখানেই আসছে শুনলে খুশি হতেন না। আর হাবীবের আসার সম্বন্ধে আফরাই জানায় সে ব্ল্যাকমেইল করছিল।”
“আমি মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝছি না। ওদের বাবা কেন তোমায় পছন্দ করবে না? আগে তো বলোনি।”
রাজিব দীর্ঘশ্বাস ফেলল, “এই পৃথিবীতে মানুষের আর্থিক স্তরের অনেক দাম। যে যত উপরের স্তরের, তার মূল্য তত বেশি।” রাজিবের আর কিছু বুঝাতে হলো না।
এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি মাসে জিতে নিন নগদ টাকা এবং বই সামগ্রী উপহার।
শুধুমাত্র আপনার লেখা মানসম্মত গল্প/কবিতাগুলোই আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হবে। এবং সেই সাথে আপনাদের জন্য থাকছে আকর্ষণীয় পুরষ্কার।
গল্পপোকার এবারের আয়োজন
ধারাবাহিক গল্প প্রতিযোগিতা
◆লেখক ৬ জন পাবে ৫০০ টাকা করে মোট ৩০০০ টাকা
◆পাঠক ২ জন পাবে ৫০০ টাকা করে ১০০০ টাকা।
আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এই লিংকে ক্লিক করুন: https://www.facebook.com/groups/golpopoka/?ref=share
“তাহলে তুমি হাবীব ভাইয়ের সাথেই কেন বন্ধুত্ব করলে?”
“বন্ধুত্ব কি আর স্ট্যাটাস দেখে হয়? ওর সাথে যখন আমার হাই স্কুলে বন্ধুত্ব, তখন থেকে ওকে উদার মনের একটি ছেলে হিসেবে জানি। এমন ছেলের কে না বন্ধু হতে চায়, যখন বিশেষ করে ওই ছেলেই যোগাযোগ রাখে!”
“আর আফরা আপাই বা কেন তার এমন অপছন্দের জায়গায় আসতে চাইছিল?”
“ওর এই এক স্বভাব, নিজেকে সবসময় অপছন্দের সাথে জড়িয়ে নেওয়া।”
“তুমি কীভাবে জানো?”
“ও আমার ফ্রেন্ডের বোন হয়! অবাক হওয়ার কিছু নেই। একটু এডজাস্ট কর। কয়েকটা দিনই তো।”
কিন্তু সবকিছু বলার মতো সহজ নয়। বান্ধবীদের সাথে আপাদের রুমের ফ্লোরে ঘুমাতে অনেক অস্বস্তিকর লাগছে। বান্ধবীরা বেড়াতে এসে এমন অবস্থায় পড়েছে দেখে মায়ার ভেতরটা দাউ দাউ করে জ্বলছে, বিশেষ করে তখন, যখন তার রুম অপ্রীতিকর একটি মেয়ে দখল করে আছে। মায়া তার ভাইয়ার কথা মোতাবেক ভাবতে চেয়েও পারছে না। কোনোভাবেই ওই মেয়েটির জন্য মনে দয়া হচ্ছে না। হবেই বা কী করে! একটু আগে মশার ব্যাপার নিয়ে ঝামেলা হয়েছিল। মায়া বারবার বলেছে এখানে কোনো মশা নেই। আর আফরাও প্রতিউত্তরে বলছিল, এখানে বাইরে ঝোপঝাড় আছে দেখছি। অগত্যা রাজিব মশার কয়েল কিনে আনল। তখন থেকেই মায়া ফুঁসছে। বাকিদের কথার এতো অবজ্ঞা করার মানে কী? মনে হয়, ছোটবেলা থেকেই আফরা সবসময় সবার মাথার উপর বসে হুকুম দিয়ে এসেছে।
যখন বীথি আপারা ঘুমিয়ে যায় তখন মায়া আর আতিকা জেগে ছিল। আতিকারও মনে একই ধরনের আগুন জ্বলছে। বিছানায় শুতে না পারার জন্য নয়, বান্ধবীর রুমটা ওই আফরা দখল করে আছে দেখে। আতিকা আর মায়ার স্বভাব খাপে খাপে মিলে। আতিকার ভাব দেখে মনে হয়, মায়ার সমস্যাগুলো যেন তারই।
সে হঠাৎ ফিসফিস করে বলল, “চল, ওই আপার একটা ব্যবস্থা করি।”
মায়া জেগে আছে, তা আতিকা কীভাবে জানল, সে তা জানে না। তবে অবাক হলো না। বান্ধবীর মুখের দিকে ফিরে বলল, “মানে?”
“মানে এভাবে যে সবকিছু নিয়ে সবাইকে খাটাচ্ছে, তাকে একটা উচিত শিক্ষা দেওয়া উচিত। কী বলিস?”
“আইডিয়া মন্দ নয়। কিন্তু তিনি আমাদের গেস্ট।”
“তা হোক। তাকে ভাগিয়ে দেওয়ার মতো তো কিছু করতে বলছি না। এই ছোটখাটো একটা কিছু করি। আর সে গেস্ট হয়ে যেহেতু গেস্টের চেয়ে অতিরিক্ত আচরণ করছে, আমরা কিছু করলে খারাপ তো হবে না।”
মায়ার ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি ফুটে উঠল। তার মুখে যতই ভদ্রতা প্রকাশ পাক, ভেতরে সে আতিকার প্রস্তাব শুরুতেই কবুল করে নিয়েছে। কিছু করলে তারা ধরা পড়বে না। আফটার অল, এই বান্ধবীর জুটির সাথে কখনও কেউ চ্যালেঞ্জ করার সাহস পায়নি। রাতের এই অন্ধকারে স্কুলের একটা সময়ের কথা মনে পড়ে যায়, কীভাবে তারা তাদের অপছন্দের ক্লাসমেটকে উত্যক্ত করেছিল।
মেয়েটির নাম ছিল তানিশা। তাদের স্কুলে ক্লাস নাইনে ভর্তি হয়েছিল। মেয়েটি ছিল তাদের শত্রুর মতো। তারা কীভাবে সবসময় একজন অন্যজনকে কটু কথায় পরাজিত করতে পারবে তারই প্রতিযোগিতা চলত। একদা তানিশা সীমাই অতিক্রম করেছিল। আতিকা যে ছেলেটিকে পছন্দ করত, তার নাম ধরে পুরো ক্লাসের সামনে তানিশা আতিকাকে ডাকল। ছেলেটি তাদেরই ক্লাসমেট ছিল; সে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে আতিকার দিকে তাকাল। সেদিন আতিকা অনেক কান্না করেছে। এ নিয়ে মায়া প্রতিশোধ নেয়, তানিশার অজ্ঞাতসারে তার ব্যাগে কতগুলো তেলাপোকা ঢুকিয়ে দিয়ে, যা সে ফেলে দেওয়া বড় লাগেজ থেকে পেয়েছিল। সাথে দেয় আতিকাও। সে তানিশার একটি খাতার উপর লিখে দেয়, “আই লাভ গঞ্জু”। গঞ্জুদা ছিল ছাত্রদের দেওয়া স্কুলের বদমেজাজি দপ্তরির ডাকনাম; বেঁটেখাটো মানুষ, ময়লা করার দায়ে স্টুডেন্টের দিকে এভাবে তাকায় যেন তাদের সাথে হাজার বছরের শত্রুতা। ছাত্রছাত্রীরা কেউই তাকে পছন্দ করত না। পাছে তাকে নিয়ে মজা করত।
তানিশা ব্যাগে তেলাপোকার স্তূপে হাত দিয়ে চিৎকার করে উঠার পর যখন ব্যাগ উপুড় করে বই-খাতা সবকিছু ফেলে দেয়, তখন ওই খাতা অনেকেরই চোখে পড়েছে। ওই জায়গার বেঞ্চ কি ফ্লোর চারিদিকে তেলাপোকার ছড়াছড়ি হয়ে যায়, যার ফলে বেশ কয়েকজনের চিৎকারে দপ্তরি ক্লাসে আসতে বাধ্য হয়। ব্যস, মায়া আর আতিকা শয়তানি হাসি হাসল। গঞ্জুদা ক্লাস ফোর পর্যন্ত পড়েছে। কাজেই মরা কি জীবন্ত তেলাপোকা পরিষ্কার করার সময় গঞ্জুদা খাতাটি পেয়ে জিজ্ঞেস করে ওঠে এটি কার। তখন তানিশা আমার আমার বলে চিৎকার করে এসে খাতাটা দেখে মাটিতে গেঁড়ে যায়। সে কল্পনাও করেনি, ওই খাতাটাই গঞ্জুদার হাতে পড়েছে। ঠিক আতিকার মুখ যতটা নিচু হয়েছিল, সেদিন তারচেয়ে বেশি নিচু হয়েছিল তানিশার। সেই এক দিন স্কুলে এ নিয়ে মাতামাতি চলল। তবু তানিশার শিক্ষা হয়নি। সে মায়াদের সাথে আগের চেয়েও অতিরিক্ত শত্রুতা করতে শুরু করল। কিন্তু তারাই এসবের পেছনে ছিল, তা অনেকে জানলেও ধরা পড়েনি। কারণ তানিশাকে অনেকেই পছন্দ করত না। কাজেই তেলাপোকার কাণ্ড দেখে উলটো মজাই পেয়েছে।
বিয়ের আয়োজন শুরু হয়ে যাওয়ায় পরদিন কেউ খেয়াল করেনি মায়া আর আতিকা আফরার পিছু লেগেছে। তাকে চোখে চোখে রাখছে, যাতে তার সম্বন্ধে জানতে পারে। অবশেষে তারা একটা আইডিয়া পেয়ে গেল। আফরার অবসর সময় কাটানোর জন্য তারা যখন টিভি অন করে দেয়, তখন তারা পেয়ে যায় কীভাবে প্র্যাঙ্ক করবে। মায়া যখন একটি চ্যানেলে ভূতের সিনেমা দেখতে শুরু করে, তখন আফরা ধড়ফড় করে ওঠে পড়ে বলল, “চ্যানেলটা চেঞ্জ করে দাও। আমার বাবা রাতে ঘুম আসবে না।”
মায়া থ হয়ে বলল, “আপনি কি মনে করেন ভূতের অস্তিত্ব আছে?”
“অবশ্যই আছে। আমি.. আমি যতবারই কাজিনদের সাথে এই ধরনের মুভি দেখেছি, ততবারই আমি অস্বাভাবিক অনেককিছু দেখেছি। একদম বাস্তব। সবাই বলে ভূত নেই। কিন্তু আমি জানি ওরা আছে। কারণ আমি ওদের রাতের অন্ধকারে দেখেছি।” মায়াদের হা করে থাকতে দেখে সে বলল, “তোমরাও বিশ্বাস করছ না তাই না? ভাইয়াও কেউ দুষ্টুমি করছে বলে উড়িয়ে দেয়।”
আতিকা আর মায়া একসাথে বলে উঠল, “না, না, আমরা বিশ্বাস করি।” এও বিশ্বাস করে, তার কাজিনরাই হয়তো তাকে ভয় লাগিয়েছে। এমন সময় সিনেমায় কেউ একজন চিৎকার দেওয়ায় আফরাও চিৎকার করে ওঠে চলে গেল।
জেরিন আর রাইসা সন্দেহের দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকাল। মায়া আর আতিকা সাদাসিধে মানুষের মতো চুপটি করে সিনেমা দেখতে লাগল। জেরিনরা কলেজে তাদের বন্ধু হয়েছে। তাই তারা আতিকা আর মায়ার স্কুলে করা বাঁদরামির সম্বন্ধে বেশিকিছু জানে না। কলেজে ওঠার পর তাদের বাঁদরামি বিশেষ করে জেরিনের কাছে ধরা পড়তে দেয়নি। নইলে সে মায়ার মায়ের কাছে অভিযোগ করত বান্ধবীরা শোধরে যাওয়ার জন্য। তাদের দু’জনকে কিছুই বলা হলো না। পাছে যদি রাইসাও জেরিনের পক্ষ নিয়ে বসে! কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে তাদের উত্তেজনা একজনের কাছে ধরা পড়ে গেল।
মায়া আর আতিকা যখন বীথিদের রুমে একা কথাবার্তা বলছিল, তখন তারা খেয়ালই করেনি দরজাটা খোলা রয়ে গেছে। নয়ন রুমের কোণায় উঁকি দিলে দু’জনই ভ্যাবাচ্যাকা খেল।
সে ভ্রূ কুঁচকিয়ে বলল, “আমি বোধহয় শুনলাম, তোমরা আফরাকে ভয় লাগানোর কথা বলছ?”
“কই না তো।” মায়া ফটাফট উত্তর দিলো।
“আপনি ভুল শুনেছেন। আমরা কেন আবার ওই গির- আই মিন আফরা আপাকে ভয় দেখাতে যাব!” মায়া ভাবল, আতিকা একটু বেশিই বলে ফেলল।
নয়ন ভাই এবার সরাসরি ভেতরে ঢুকল, “রাজিব কিন্তু আমার কাছেও কিছু লুকায় না। তোমাদের কাণ্ডকাহিনি আমি অনেক শুনেছি। ফটাফট বলো, কী করতে যাচ্ছ।”
“যাস্ট ছোটখাটো একটা প্র্যাংক। আর কিছু না।” আতিকা জবাব দিলো।
“ও তোমাদের মেহমান। তোমার মাকে আমি বলে..”
“ও মেহমানের মতো আচরণ একটু বেশি করছে বিধায় আমরাও একটু বেশি মেহমানদারি করতে চাই।” মায়া তার সামনে গিয়ে আঙুল তোলে বলল, “অ্যানি প্রবলেম?”
তার কিছু ছেলেমানুষি নয়নকে বাকরুদ্ধ করে দেয়। এবার সে ইচ্ছাকৃতভাবে তাকে বাকরুদ্ধ করল। এবার দেখা যাক, সে মায়ার ওপর কীভাবে কথা বলে।
“আমি… এটা ঠিক হচ্ছে না।”
“কোনটা ঠিক হচ্ছে না আপনার তা বলতে হবে না। আপনি যদি আমাদের কথা সিক্রেট করে রাখেন, তবে.. তবে আপনাকে ঝাল-পাকুরা করে খাওয়াব। ওইদিন কি মজাদার করেই না বানিয়েছিলাম! মুখে এখনও স্বাদটা লেগে রয়েছে।”
“আচ্ছা আচ্ছা। ওকে ওকে।”
নয়ন ভাই চলে গেলে আতিকা বলল, “ফ্যান্টাস্টিক। উনার মুখে কোনো লোভ প্রকাশ না পেলেও আই অ্যাম শিওর, তার মুখে লালা এসেছিল। হা হা হা।”
“চুপ! এভাবে বলবি না। আমার ভাইয়াও ছোটবেলায় এমন ছিল। ওরা পেটুক না, কিন্তু সুস্বাদু খাবার ওদের পছন্দের। উনি সত্যিই গোপন করলে আমি তাকে পাকুরা করে খাওয়াব।”
“ইশ..!”
মায়া আতিকার বাহুতে একটা চাপড় মেরে হেসে চলে গেল। তার হাসি মুখে বেশিক্ষণ রইল না। ডাইনিং টেবিলে ওরা যখন রাতের খাবার খাচ্ছিল, তখন নয়নের দৃষ্টি দেখে তারা ইতস্তত করতে লাগল। কারণ নয়ন বারবার আফরা আর হাবীবের দিকে তাকাচ্ছে, যেন তাদের সতর্ক করে দিতে না পারায় সে অনেক দুঃখিত। মায়ার মনে একবার খেয়াল এলো, যদি ওদের বলে দেয়? হাবীব ভাই দেখতে চিকন আর ভদ্র একটি ছেলে। দেখে মনে হয় না, নয়ন ভাইয়ের কথা শোনে মায়াদের উপর রাগ করবে। কিন্তু উনি গম্ভীর। ভাবভঙ্গি বুঝা দায়, রাগ হতেও পারে। আর যদি গিরগিটিকে (মায়াদের দেওয়া আফরার ডাকনাম) বলে দেয়? না, তা হতে পারে না। গিরগিটির সাথে নয়ন ভাইকে কথা বলতে দেখা যায় না।
সব জল্পনা-কল্পনা বাদ দিয়ে সবাই ঘুমিয়ে পড়ার পর দুই বান্ধবী রুমের বাইরের লাইট বন্ধ করে অন্ধকারে বেরিয়ে পড়ল। মায়া তার রুমে ঢুকে দেখতে গেল আফরা ঘুমিয়েছে কিনা। পরিস্থিতি তাদের মনোমতো হলো। রুমের ডিম লাইট আফরা জ্বালিয়েছে, যেটা ব্যবহার না করার ফলে আলো কমে গিয়েছে, যা আলো-আঁধারের পারফেক্ট এক আবছা ভাব তৈরি করেছে। আর সে আশঙ্কায় ছিল, তারা ঢোকার সময় আফরা ওঠে যেতে পারে। তা হয়নি। সব যখন ঠিকঠাক, তখন মায়া বেরিয়ে এসে তার আর আপাদের রুমের মাঝখানে দাঁড়িয়ে পাহারা দিতে লাগল। প্ল্যান মোতাবেক আতিকা তার গায়ের উপর বেডশিট জড়িয়ে নিয়ে দরজার কাছ দাঁড়াল। মায়া খোলা দরজা দিয়ে কোণ থেকে চেয়ে রইল। মনে মনে আশা করছে, এই নকল ভূতকে দেখে যেন আফরা আতিকার ওপর কিছু ছুঁড়ে না ফেলে। অবশ্য সে আয়োজন করে রেখেছে। ছোঁড়বার মতো জিনিস সে আগেভাগে সরিয়ে ফেলেছে। মায়ার ধারণা যদি সঠিক হয়, তবে আফরা ভূতে বিশ্বাস করায় এতোই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে যে, সে বিছানা থেকে ওঠার সাহস পাবে না। তবু মনে কোথাও ফাঁকা রয়ে গেল, ওরা হয়তো সফল হবে না।
স্বাভাবিকই আতিকা ভেতর থেকে চোখে কিছু দেখবে না। তাই বেডশিটের একপ্রান্ত মায়া ধরে রইল। প্রস্তুত রইল, আতিকাকে ফিসফিসিয়ে সরে যেতে বলার জন্য। আতিকা গম্ভীরভাবে গুঙিয়ে উঠল একটা রক্তখেকো পিশাচের মতো করে। মায়া একটু শিউরে উঠল। আজ ও দৃশ্যটা অভিনয় বলে জানে বলেই ভয় লাগছে না। নইলে মধ্যরাতে যদি এমন অপ্রত্যাশিত কিছু শুনত, তবে সে কম ভয় পেত না। তাছাড়া আগে কখনও এমন উদ্ভট প্ল্যান করেইনি।
মায়া ফিসফিস করে বলল, “আরেকটু।”
আতিকা আবারও সেই গায়ে কাঁটা দেওয়া স্বরে গুঙিয়ে উঠল। তা কয়েক সেকেন্ড পর নিঃশব্দের এই জায়গায় আবছা আলোয় মিইয়ে গেল। মায়ার বুক উঠা-নামা করছে। যেকোনো সময়.. যেকোনো সময়..
মায়া আরেকবার ফিসফিস করে আতিকাকে আবার তা করতে বলতে যাবে, অমনিই বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে থাকা আফরা এপাশে ফিরল। ঠিক তখনই আফরা ভালো করে চোখ খোলে চিৎকার করতে যাবে, মায়া বেডশিটে মৃদু টান দিলো। ইশারা বুঝে আতিকা দীর্ঘকায় শরীর নিয়ে মৃদুপায়ে হেঁটে দরজার কাছ থেকে চলে এলো। যেই ওরা আফরার দৃষ্টির বাইরে এলো, ওরা তাড়াতাড়ি নিঃশব্দে দৌড়ে ওদের ঘুমানোর রুমে ঢুকে পড়ল। এসবকিছু যেন তিন-চার সেকেন্ডের মাঝেই হয়ে গেছে। কিন্তু আফরার চিৎকার এলো না। তারা দ্রুত এসে ফ্লোরে বাকি দু’জনের সাথে শুয়ে পড়ল, যেন কিছুই হয়নি। কিন্তু পরক্ষণে মায়ার ভয় কমল আফরাকে দেখে। সে কাঁপতে কাঁপতে তাদের রুমের দরজা খুলেছে। মায়ারা ঘুমানোর ভান করে রইল। তারপর অনুভব করল তার পাশে গুঁজে কে যেন শুয়ে পড়েছে আর ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলছে। মায়ার তাদের বিজয়ে হাসতে ইচ্ছে হলো, হয়তো আতিকারও একই অবস্থা। তারা এই ভেবেও হাসতে চাইছিল যে, মারাত্মক কিছু ঘটেনি। কিন্তু মায়ার ভেতরের খুশিতে ফাঁকা রয়ে গেল। সে আতিকাকে ইশারা করাতে মনোযোগ দেওয়ায় খেয়ালও করেনি, তার রুমের পাশের ভাইয়ার রুম থেকে কেউ বেরিয়েছিল কিনা। এই এক সমস্যা, দরজাগুলো খুললে আওয়াজ হয় না। কিন্তু..
আফরা ঘুমিয়ে পড়লে মায়া আতিকাকে ফিসফিস করে বলল, “আমি বাজি ধরতে পারি, ভাইয়ার রুমের বাইরে মূর্তির মতো করে কে যেন দাঁড়িয়ে ছিল। আমরা এখনও কেন ধরা পড়িনি?”
(চলবে…)
লেখা: ফারিয়া কাউছার
[এই এক মাস গল্প না লেখায় দুঃখিত। কিছু সময়ের জন্য বিরতি নিয়েছিলাম। তাছাড়া সময় খুব একটা পাই না।]