#মনের অন্তরালে
#পর্ব_৭(অন্তিম পর্ব)
#লেখিকা সাদিয়া জান্নাত সর্মি
আমার গান শুনে পিছন থেকে কে যেন বললো,কার আলতো পরশ চাইছিলি তুই? আমি পিছন ঘুরে তাকালাম, দেখি আয়াশ ভাই এসে দাঁড়িয়েছে। আমি বললাম, না কারো না, আমি এমনিই গাইছিলাম গান টা।
আমার কথা শুনে আয়াশ ভাই ঠিক বিশ্বাস করলেন না। সন্দেহের গলায় জিজ্ঞেস করলেন, আমার তো মনে হচ্ছে না।
আপনার মনে না হলে আমার কী? আমি কার আলতো পরশ চাইবো না চাইবো তাতে আপনার কি হ্যা?আপনি আপনাকে নিয়ে ভাবুন আর আপনার ওই প্রেমিকা কে নিয়ে ভাবুন আমার কথা আপনাকে ভাবতে হবে না।
আমার কথা শুনে আয়াশ ভাই আগুন চোখে আমার দিকে তাকালো।
কি বললি তুই? আমি তোকে নিয়ে ভাববো না, তাহলে তোকে নিয়ে কে ভাববে হ্যা? ওই জোচ্চর রিহান ভাববে তোকে নিয়ে?
এখানে রিহান কে কেন টানছেন আয়াশ ভাই?আপনি তো নিজেই আমাকে বলেছিলেন যে আপনি আমাকে বউ হিসেবে মানেন না তাহলে আমাকে নিয়ে ভেবে আপনার কি কাজ? আমি তো আর আপনার কেউ না।
আমার কথা গুলো শুনে আয়াশ ভাই আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালো না। আমার দিকে রাগি চোখে তাকিয়ে হনহন করে চলে গেলো। আমি চুপচাপ আমার ছোট্ট বাগানের পাশের বেঞ্চে বসে রইলাম। সবসময় মন খারাপ করতে ভালো লাগে না আমার। উনি তো যখনি আমার সাথে কথা বলেন তখনি তেড়া কথা বলেন তাই আজ আমি ও বলেছি। আমি তো ঠিকি বলেছি ওনাকে, উনি আমাকে নিয়ে ভেবে কি করবেন। আমি এখানে একটু গান গাইছিলাম আর উনি সেটার অন্য মানে করে নিলেন। ওনার তো প্রেমিকা ই আছে তাহলে আমি কি চাইছি না চাইছি সেটা জেনে উনি কি করবেন?যত্তোসব।
আয়াশ ওদিকে বাড়ির ভেতরে গিয়ে ওর মাকে বললো, মা এখনি আমাদের যেতে হবে,আমার অফিসে এমার্জেন্সি আছে। আয়াশের এমন কথা শুনে মা বললেন, তোমরা তো মাত্রই এলে আর এখনি চলে যাবে?
মামী বললাম না আমার অফিসে এমার্জেন্সি আছে,অন্যদিন এসে অনেকক্ষন থাকবো ওকে।আজ আসছি। তুমি তোমার মেয়ে কে গাড়িতে গিয়ে বসতে বলো, তোমার মেয়ে শশুর বাড়ী যাওয়ার জন্য আগে থেকেই বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।
মা বাইরে বেরিয়ে এসে আমার কাছে এলো। আমাকে গিয়ে আয়াশ ভাইয়ের গাড়িতে বসতে বললো। আমি অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকালাম।
মা এখনি কেন যাবো?ফুপি রা তো একটু আগেই এলো।
মা বললো,আয়াশের অফিসে নাকি এমার্জেন্সি আছে তাই এখনি চলে যাবে, তুই গিয়ে আয়াশের গাড়িতে বস।আর শোন,মন খারাপ করে থাকিস না যেন, তোকে আবার দুই দিন পরেই আমরা গিয়ে নিয়ে আসবো। তুই তো তোর ফুপির বাসাতেই যাচ্ছিস।
আমি কিছু না বলে আয়াশ ভাইয়ের গাড়িতে গিয়ে বসলাম। দুটো গাড়ি এসেছে,একটা আয়াশ ভাইয়ের গাড়ি আরেকটা ওদের বাসার সবার। ওটাতে করে ফুপি আর অর্থি আপু এসেছে। আমি গাড়িতে বসার কিছুক্ষণ পর আয়াশ ভাই এলো।মাকে বিদায় জানিয়ে গাড়িতে এসে বসলো। আমার দিকে তাকিয়ে বলল,সিটবেল্ট বেঁধে নে। আমি সিটবেল্ট বেঁধে নিলাম। উনি গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ড্রাইভ করতে লাগলেন। কিছুক্ষণ যাওয়ার পর আমি রাস্তা টা ঠিক চিনতে পারলাম না।আয়াশ ভাই কে জিজ্ঞেস করলাম,
এটা তো আপনাদের বাসায় যাওয়ার রাস্তা না। কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে আপনি?
আয়াশ ভাই উত্তর দিলো,
তোকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য নিয়ে যাচ্ছি। চুপচাপ বসে থাক।
আমি আর কোন কথা বললাম না। ঘন্টা খানেক পর একটা হাসপাতালের সামনে গাড়ি থামালো আয়াশ ভাই। আমাকে গাড়ি থেকে নামতে বললো। আমি নেমে এলাম।আয়াশ ভাই আমাকে হাসপাতালের ভেতরে নিয়ে একটা রুমের সামনে এসে দাড় করালো। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এটা কোথায় নিয়ে এসেছেন আমাকে আপনি? কেমন সারপ্রাইজ দিবেন আমাকে আপনি?
উনি কোন কথা না বলে আমাকে রুমের ভেতর নিয়ে গেলেন। আমি ভিতরে গিয়ে চমকে উঠলাম। পাশাপাশি দুটি বেড, একটাতে শুয়ে আছে আশিক ভাই আর আরেকটা তে রিহান তাওহীদ। ওদের দুজনেরই অবস্থা খুব খারাপ। মাথায়, হাতে পায়ে ব্যান্ডেজ করা,স্যালাইন চলছে দুই হাতে। আমি আয়াশ ভাই কে জিজ্ঞেস করলাম,
এরা এখানে কেন?আর এদের দুই জন কে এইভাবে কে মেরেছে নাকি এক্সিডেন্ট হয়েছে ওদের?
আয়াশ ভাই আমার দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলো,
এই দুজন তোকে কাঁদিয়েছে। একজন ধোঁকা দিয়ে আর আরেকজন তোর সাথে মিস বিহেভ করে। তাই এদের মেরেছি,আমি মেরেছি ওদের।যারা তোকে কাঁদাবে তাদের কে আমি কখনো ছাড়বো না। আমার প্রিয় মানুষটাকে যে কাঁদাবে তাকে আমি ছাড়বো না। তাই মেরেছি, মনের সমস্ত রাগ এদের উপর ফেলেছি। তুই এদের এই অবস্থায় দেখে খুশি হস নি?
আমি আয়াশ ভাইয়ের কথা শুনে ভ্যাবাচেকা খেয়ে ডেব ডেব করে তাকিয়ে আছি। কি বলছে এসব আয়াশ ভাই?
আমার এভাবে তাকিয়ে থাকা দেখে আয়াশ ভাই আমাকে আবার জিজ্ঞেস করল,
কি হলো,বল আমাকে তুই কি খুশি হস নি?
আমি থতমত খেয়ে বললাম, আপনি ওদের মেরেছেন বুঝলাম, কিন্তু আমার জন্য মেরেছেন একথা বিশ্বাস হচ্ছে না আমার। আপনার প্রিয় মানুষটা তো অন্য কেউ, আমাকে কেউ কাদালে আপনি তাকে ছাড়বেন না এই কথা টা ঠিক মাথায় ঢুকছে না।
আয়াশ ভাই আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,
আমার প্রিয় মানুষটা তো আমার সামনেই দাঁড়িয়ে।যাকে ভালোবাসি তাকে যদি কেউ কাঁদায় তাহলে সেটা সহ্য করবো কেন?
এ্যা?আপনি আমাকে ভালোবাসেন?
তা নয়তো কি?
তাহলে এই দুই দিন আমার সাথে এতো বাজে ব্যবহার করলেন সেটা কেন? আবার আমাদের বিয়ের রাতে ডির্ভোস পেপার দিয়েছিলেন কেন?
সেটা তোকে একটু কষ্ট দেওয়ার জন্য। আমাকে দেখিয়ে দেখিয়ে রিহানের সাথে প্রেম করতে যেতি তুই তার শাস্তি দিয়েছি এই দুই দিন।
তার পর আমার দিকে রাগি চোখে তাকিয়ে বলল,
গবেটের বাচ্চা,এক রাতে কি ডির্ভোস পেপার তৈরি হয়? তোর মতো গাধাকে আমি ভালোবাসি এটা ভাবতেই আমার লজ্জা করছে।
আমি জিভে কামড় দিলাম। সত্যিই তো,আমার সে কথা মাথাতেই আসে নি। লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে আবার জিজ্ঞেস করলাম, গভীর রাতে ফোন গুলো তাহলে আপনিই করতেন?
হুম।
তাহলে অর্থি আপু আমাকে কেন বলেছিল যে আপনি অন্য কাউকে ভালো বাসেন?
আমি বলতে বলেছিলাম তাই বলেছে। তোর জন্য আমি এতো দিন যে পরিমাণ কষ্ট পেয়েছি তার সবটুকু তোকে সুদে আসলে ফেরত দিতে চেয়েছিলাম কিন্তু পারলাম না। তোর মন খারাপ দেখলেই আমার বুকের বাম পাশে ব্যাথা করে।
বাহ্ এতো প্রেম আমার জন্য? আমার তো ভাবতেই লজ্জা করছে বলেই আমি ওখান থেকে দৌড়ে বের হয়ে গেলাম।আয়াশ ভাই ও পিছু পিছু চলে এলেন। আমি গাড়ির কাছে এসে দাঁড়ালাম। নিজের উপর রাগ হচ্ছে আবার লজ্জা ও লাগছে।এক রাতে ডির্ভোস পেপার তৈরি হয় না এটা আগে মাথায় আসে নি এটা ভেবে রাগ হচ্ছে আবার আয়াশ ভাই আমাকে ভালোবাসে এটা ভেবে লজ্জা লাগছে। দুটোই একসাথে কাজ করছে, কোন টা আগে প্রকাশ করবো সেটার জন্য কনফিউজড হয়ে গেছি আমি। এমন সময় পিছন থেকে কে যেন জড়িয়ে ধরলো আমাকে। আমি বুঝতে পারলাম এটা আয়াশ ভাই ছাড়া আর কেউ না।আশে পাশে রাস্তায় কেউ নেই। তার পরও বললাম,
কি করছেন আপনি? ছাড়ুন আমাকে, মানুষ দেখলে কি ভাববে আমাকে?
কি ভাবে ভাবুক আমার তাতে কোনো যায় আসেনা। আমি আমার বউকে জড়িয়ে ধরেছি, আর কাওকে না। রোশান ভাইয়ের কাছে শুনলাম তুই নাকি গবেটের দাদিমা। কিচ্ছু বুঝিস না এখনো।তাই আজ বাসায় চল, সবটুকু বুঝিয়ে দেবো।পরে আর পেনিসিলিন নিয়ে আপুর পিছনে দৌড়াবি না।
কি লজ্জার কথা।আয়াশ ভাই এসব কি বলছে? আমি লজ্জা পেলাম, খুব লজ্জা পেলাম।
________________________________________________
ছাদে আয়াশ ভাইয়ের বুকে মাথা রেখে বসে আছি।আজ পু্র্নিমা।তাই উনি আমাকে ছাদে নিয়ে এসেছেন। আমাকে বললেন, গান শুনবি মেহুল।
আমি বললাম, হুম,শোনান।
উনি গান গাইতে লাগলেন,,,
দেখেছি স্বপ্নকে
খুঁজেছি তোকে স্মৃতির আড়ালে
স্বপ্নকে সেই স্বপ্নেতে ভেসেছে বারে #মনের_অন্তরালে
……..সমাপ্ত।