#মনের অন্তরালে
#পর্ব_২
#লেখিকা সাদিয়া জান্নাত সর্মি
আমি মেঝেতে বসে পড়লাম। কান্না আসছে খুব, শেষে এই ছিল আমার জীবনে। আমি তো নিজে থেকে আয়াশ ভাইকে বিয়ে করতে চাই নি।বাবাই তো বাধ্য করেছে আমাকে ওনাকে বিয়ে করতে। উনি তো আমার কোন কথা শুনতে চাইলেন না। আমার উপর দোষ চাপিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। কান্না করতে লাগলাম আমি। আয়াশ ভাইয়ার বড় বোন অর্থি আপু আমার কান্নার শব্দ শুনে তাড়াতাড়ি রুমে এলেন।
কি হয়েছে মেহুল? তুমি কাঁদছ কেন, আয়াশ কি তোমাকে কিছু বলেছে?
আমি কোন উত্তর না দিয়ে কেঁদেই চলেছি। অনেকক্ষণ পর কান্না থামিয়ে বললাম, আয়াশ ভাই আমাকে বউ হিসেবে মানেন না। আমি নাকি ওনার জীবন টা নষ্ট করে দিয়েছি।
দেখো মেহুল আয়াশের এমন টা বলা স্বাভাবিক।ও অন্য একজন কে ভালোবাসে। শুধু মাত্র মায়ের জেদের কারণে ও তোমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে। তুমি মন খারাপ করোনা। আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে।যাও, তুমি শুয়ে পড়, আয়াশ আজ রাতে আর রুমে আসবে না।
কিন্তু ফুপি তো বলেছিল আয়াশ ভাই আমাকে পছন্দ করে। তাহলে ওটা কি মিথ্যা ছিল?
হ্যা বলে আপু চলে গেল। আমি বিছানায় শুয়ে পড়লাম। কাঁদতে কাঁদতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম বুঝতেই পারিনি। সকাল ৯টায় আমার ঘুম ভাঙল। অতিরিক্ত কান্না করার জন্য শরীর দুর্বল হয়ে গেছে তাই দেরীতে ঘুম ভাঙল। ঘুম থেকে উঠে দেখি আয়াশ ভাই সোফায় বসে আছে। হাতে কিসের যেন একটা ফাইল। আমাকে ঘুম থেকে উঠতে দেখে বললেন,
এই হচ্ছে আমাদের ডিভোর্স পেপার। এইখানে সই কর, আগামী ছয় মাসের মধ্যে আমাদের ডিভোর্স হয়ে যাবে।ফারদার,যদি তুই ডিভোর্স হয়ে যাওয়ার আগে কাওকে এ কথা বলেছিস তাহলে খুব খারাপ হয়ে যাবে। আমাদের ঘরের কথা ঘরেই থাকবে বাইরে যেন না যায়।
ঘুম থেকে উঠেই এমন একটা কথা শুনতে হবে এটা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি।প্রায় অবাক হয়েই বললাম,
আপনি আমাকে ডির্ভোস কেন দিবেন আয়াশ ভাই? আমি কি করেছি?
সব কিছু তো তুই করেছিস। আমার জীবনটা নষ্ট করে এখন বলছিস তুই কি করেছিস? তোকে ডির্ভোস দেব কারন তোকে আমি ভালোবাসি না আর কখনো ভালোবাসতেও পারবো না।নে এখন তাড়াতাড়ি সাইন কর।
আমি বিছানা থেকে নেমে বললাম,
আমি সাইন করবো না। বিয়ে টা কি পুতুল খেলা নাকি যে আগের দিন বিয়ে করবো পরের দিন ডির্ভোস পেপারে সাইন করবো। আপনাকে বিয়ে যখন করেছি তখন আপনার সাথেই সারাজীবন কাটাতে চাই।
ঠাস করে আমার গালে একটা থাপ্পড় মেরে আয়াশ ভাই বললেন,
তোর লজ্জা করে না একথা বলতে?বলেছি তো আমি তোকে কখনো বউ হিসেবে মানিনা।
আপনি আমাকে বউ হিসেবে মানেন বা না মানেন আমি আপনাকে আমার স্বামী হিসেবে মেনে নিয়েছি।
তোর মানাতে কিছু যায় আসেনা,সাইন কর বলছি।
আমি ওনার হাত থেকে ডির্ভোস পেপার টা টান দিয়ে নিয়ে ছিঁড়ে ফেলে বললাম,
যদি ডির্ভোস পেপারই না থাকে তাহলে সাইন কোথায় নিবেন আমার।
আয়াশ ভাই আমার দিকে প্রায় তেড়ে এসে বললেন,
এটা কি করলি তুই?ছিড়লি কেন এটা? তুই কি ভাবছিস এটা ছিঁড়েছিস বলে আমি আর তৈরি করতে পারবো না?
তৈরি করতে পারবেন কিনা জানিনা তবে আপনাকে আমার স্বামী হয়েই থাকতে হবে।অন্য কাউকে ভালো বাসলেও তাকে ভুলে যান।
একথা শুনে আমার দিকে আগুন চোখে একবার তাকিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন।
আমি বিছানায় বসে পরলাম। এটা ছাড়া আর কিছু করার নেই আমার।রিহান কে তো জীবনে পেলাম না,যাকে পেয়েছি তাকে কেন হারাবো।আয়াশ ভাই অন্য একজন কে ভালোবাসে বলে আমাকে বউ হিসেবে না মানতেই পারে তাই বলে যে আমি ও ওনার কথামতো ডির্ভোস দিয়ে দেব এমনটা তো না। ওরকম মেয়ে আমি না যে একজন কে বিয়ে করলাম সে আমাকে ডির্ভোস দিয়ে দিল আবার আমি অন্য কাউকে বিয়ে করলাম।হ্যা আমি রিহানকে ভালোবাসতাম কিন্তু এখন আমি আর ওকে ভালবাসি না। ওকে ভালোবেসে লাভ নেই আমার।যে কখনো আমার হবে না তাকে ভালোবেসে লাভ কি?আয়াশ ভাইয়ের মনে আস্তে আস্তে আমার জায়গা করে নিতে হবে কারণ উনি এখন আমার স্বামী যদিও উনি তা মানতেছেন না। একদিন না একদিন ঠিক মানবেন আমাকে।
রুম থেকে বাইরে বেরিয়ে নিচে এলাম আমি।আমাকে নিচে নামতে দেখে ফুপি বললেন,
ঘুম ভেঙ্গে গেছে তোর? একবার ডাকতে গিয়েছিলাম তোকে, গিয়ে দেখি তুই ঘুমাচ্ছিস তাই আর ডাকিনি।আয় টেবিলে বস। খেয়ে নে,পড়ে আর খাওয়ার সময় পাবিনা। একটু পরেই বউভাতের অনুষ্ঠান শুরু হবে। বসে পড়।
ফুপির কথা শুনে আমি খাবার টেবিলের চেয়ারে বসতে যাবো তখন সামনে তাকিয়ে দেখি আয়াশ ভাই আমার দিকে কটমট করে তাকিয়ে আছে। ওনার খাওয়ার সময় আমিও খেতে বসছি এটা মনে হয় ওনার ঠিক পছন্দ হচ্ছেনা। ওনার পাশের চেয়ার টা ফাঁকা দেখে সামনে না বসে ওনার পাশে গিয়ে বসলাম। আমার কান্ড দেখে অর্থি আপু হেসে ফেললো সাথে বাকি যারা বসেছিল তারা সবাই হাসতে লাগল।
ওদের হাসতে দেখে আয়াশ ভাই বললেন,
কি হয়েছে আপু? তোরা হাসছিস কেন?
দুলাভাই বললেন,
কিছু না শালা বাবু। তুমি এবার বউকে নিজের হাতে খাইয়ে দাও।
একথা শুনে আয়াশ ভাই আমার দিকে তাকিয়ে বলল,যাকে তাকে খাইয়ে দেওয়ার অভ্যাস নেই আমার।
আমি ওনার কানের কাছে এসে বললাম, আমাকে এখন যদি আপনি না খাইয়ে দেন তাহলে আমি কিন্তু সবাই কে বলে দিবো যে, আপনি একটু আগে আমাকে ডির্ভোস পেপারে সাইন করার জন্য থাপ্পর মেরে ছিলেন। ভাবুন, তখন ফুপি আর ফুপা আপনার কি অবস্থা করবে?
উনি আমার দিকে রাগি চোখে তাকালেন। আমি ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বসে রইলাম। মনে মনে বললাম, আমার গালে থাপ্পড় মেরে ছিলেন তাই না, এখন সবার সামনে আমাকে খাইয়ে দিন এটাই আপনার শাস্তি। আপু জিজ্ঞেস করল,
কিরে ভাইয়া খাইয়ে দিচ্ছিস না কেন?
উনি আমাকে আর কিছু না বলে বিরক্ত হয়ে চুপচাপ খাইয়ে দিলেন। আমি খেতে খেতে ওনার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপলাম। উনি রাগে ফুঁসছেন কিন্তু সবার সামনে কিছু বলতে পারছেন না। আমাকে খাইয়ে দিয়ে উনি উঠে হনহন করে চলে গেলেন। দুলাভাই হাসতে হাসতে বলল, শালা বাবু লজ্জা পেয়েছে খুব তাই চলে গেছে এভাবে। কিন্তু আমি তো জানি উনি কেন চলে গেছেন। খাওয়ার পর আমি ফুপার কাছে গিয়ে বসলাম।ফুপা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, এখন থেকে এটা নিজের বাড়ি বলে মনে করবি।আর আমাকে ফুপা নয় বাবা বলে ডাকবি। আমি মুচকি হেসে মাথা নাড়লাম শুধু। কিছুক্ষণ পর অর্থি আপু ও আরো কয়েকজন মেয়ে এসে আমাকে সাজাতে নিয়ে গেল। নীল বেনারসী শাড়ি পড়ালো আমাকে। হাতে নীল চুড়ি। মুখে মেকআপ করাতে চেয়েছিল অর্থি আপু কিন্তু আমি করাতে দেইনি।শ্যাম বর্ণের মেয়ে আমি মেকআপ করে ময়দা সুন্দরী হতে চাই না।
অনুষ্ঠানে আমাদের বাসা থেকে অনেকজনেই এসেছে আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আমি তাদের সাথেই বসে আছি।এ সময় আপু আমাকে এক পাশে টেনে নিয়ে গিয়ে বললো,
মেহুল তুই কি বিয়ে টা মন থেকে মেনে নিয়েছিস?
হ্যা আপু। কেন মানবো না?
তুই তো রিহানকে ভালোবাসতি তাহলে এটা মেনে নিলি কি করে?
আপু যে আমার হবে না তাকে ভালোবেসে লাভ কি আমার? তার চেয়ে বরং যাকে পেয়েছি তাকে নিয়েই ভালো থাকার চেষ্টা করি।
আর আয়াশ কি মেনে নিয়েছে তোকে? আমার যতটা মনে হয় আয়াশ তোকে মেনে নেয়নি।
ঠিকি বলেছো আপু। উনি আমাকে মেনে নেননি কিন্তু তাতে কি? একদিন না একদিন ঠিক মেনে নিবেন আমাকে।
আমার কথা শুনে আপু হাসল।বললো,
সেদিনের অপেক্ষায় রইলাম।যেদিন দেখবো আমার বোন টা তার স্বামীর সাথে সুখে আছে।
আমি হাসলাম শুধু।সে দিন কবে আসবে তার অপেক্ষায় আমিও আছি।
(চলবে) কী……