ভুল সত্য পর্ব-১৮

0
301

ভুল সত্য
১৮

কিরে, তুই আজকে কলেজে এলি যে?
তিথির কথা শুনে আমি বিরক্ত হয়ে তাকালাম
কেন? কলেজে আসব না কেন?
শুনলাম ভাইয়ের জ্বর, তা বরকে ফেলে চলে এলি?
জ্বর তো কি হয়েছে? তাকে দেখার লোকের কি অভাব?
খুব সেবা যত্ন করছিস শুনলাম
আমার আপাদমস্তক জ্বলে গেল। এরা দেখি সব খবরই রাখে, তা এত খবরই যখন রাখে তখন শাওনের খবরটা রাখতে পারল না? এক মিনিট! নিশ্চয়ই এরা শাওনের ব্যাপারে সব জানে। আমি একটু রাগত স্বরেই বললাম
সব খবরই রাখিস দেখছি।
রাখবো না কেন? আমার প্রিয় বান্ধবী আর আমার একমাত্র ভাই
তাহলে তো শাওনের খবরও জানিস নিশ্চয়ই
তিথি একটু অবাক হয়ে বলল।
কেন, তার আবার কি হলো?
যা ভেবেছিলাম তাই। তার মানে এরা সবাই শাওনকে চেনে।
তুই শাওন কে চিনিস?
ওমা, চিনবো না কেন?
কতটুকু চিনিস?
মাঝেমধ্যে আমাদের বাড়িতে এসেছে। আমার চেয়ে মায়ের সঙ্গে ভাব বেশি ।
এই কথা শুনে আমার রাগ আরো বেড়ে গেল । যাও ভেবেছিলাম তিথির সঙ্গে পুরো বিষয়টা শেয়ার করব সবকিছু নিয়ে একটা আলোচনা করব তারপর হোস্টেলে ওঠার ডিসিশন নেব। কিন্তু না, এখন ঠিক করে ফেলেছি, আর কোন অবস্থাতেই কারো সঙ্গে কোনো কথা বলবো না।

আমি ক্লাস আছে এই ছুতো করে ওর সামনে থেকে চলে গেলাম। ক্লাস আসলেই ছিল কিন্তু মন বসলো না। আমি পরের ক্লাসটা না করে রিকশা নিয়ে বেরিয়ে গেলাম। কাল দুটো হোস্টেলের সাথে কথা বলেছি। কথা বলে তো ভালোই মনে হয়েছে। লোকেশন ভালো। একটা আজিমপুরে অন্যটা রায়ের বাজারে। আজিমপুর হলেই আমার জন্য ভালো। কলেজ থেকে কাছাকাছি হবে তাছাড়া আমি রায়ের বাজারে থাকতেও চাই না। মুকুলদের বাসা শংকর, কাছাকাছি এলাকায় থাকলে দেখা যাবে দেখা-সাক্ষাৎ হয়ে যাবে।

আমি রিক্সা নিয়ে হোস্টেল দুটো থেকে ঘুরে এলাম। দুটোর একটাও পছন্দ হলো না। আজিমপুরেরটাতে শেয়ারের রুম, শেয়ারের বাথরুম। জঘন্য অবস্থা। আর রায়ের বাজারেরটা এমন চিপা গলির ভেতর যে রাত বিরাতে ওখানে যেতে গেলে ভয়ই আমি মরে যাব। লাভের লাভ কিছু তো হলোই না উল্টো ড্রেনের মধ্যে পা পিছলে পা কেটে ফেললাম খানিকটা। কাটা পা নিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে বাসায় ফিরে আমি হতবাক। আমার শাশুড়ি নাজুকে নিয়ে বাজার করতে চলে গেছে। অসুস্থ ছেলেকে একা ফেলে এই মহিলা বাজার করতে চলে গেল? আমি আসা পর্যন্ত একটু অপেক্ষা পর্যন্ত করতে পারল না। কি জানি কি খেয়ে আছে সকাল থেকে। আমি দৌড়ে সিড়ি দিয়ে উপরে উঠে গেলাম। ঠিক যতটা উদ্বেগ আর অস্থিরতা নিয়ে ঘরে ঢুকেছিলাম ততটাই রাগ আর হতাশা আমাকে ঘিরে ধরল। মুকুল পা ছড়িয়ে বিছানায় বসে কারো সঙ্গে ফোনে কথা বলছি আর উচ্চস্বরে হাসছে। আমি একটু থেমে ওর কথা শুনতে লাগলাম ও হাসতে হাসতে বলছে

তুমি যে কি বলো না তোমার কথা শুনে আমার কান গরম হয়ে যাচ্ছে।

ওই পাশের কথা শোনা যাচ্ছে না তবে মুকুলের হাসি আবারো শুনতে পেলাম।
রাগে আমার ব্রহ্মতালু জ্বলে গেল। আমি ঘরের ভেতর ঢুকে ব্যাগ একপাশে রাখলাম শব্দ করে। মুকুল আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল। তারপর ইশারায় জানতে চাইলো এত তাড়াতাড়ি কেমন করে এলাম। আমি দাঁতে দাঁত পি্ষে মনে মনে বললাম এসে মনে হয় বিপদে ফেলে দিয়েছি? মুকুল আবারো ফোনে মনোযোগী হয়ে বলল
আচ্ছা ঠিক আছে রাখছি এখন
আবার ওই দিককার কথা শোনা গেল না। মুকুল বোধহয় আমাকে শোনানোর জন্যই বলল
হ্যাঁ বউ চলে এসেছে এখন আর তোমাকে দরকার নেই।
কত বড় বেয়াদব। আমার সামনে এসব কথা বলা শুরু করেছে। সামান্যতম চক্ষু লজ্জা পর্যন্ত নেই। মুকুল হাত বাড়িয়ে আমাকে কাছে ডাকল আমি কাছে এসে বললাম কার সঙ্গে কথা বলছিলেন ?
আমার কলিগ
কোন কলিগ?
তুমি চিনবে না
শয়তান একটা। না চেনালে চিনব কি করে? আমি ইচ্ছে করেই বললাম
আমাদের বিয়েতে এসেছিল?
কে শাওন? না ও আসতে পারেনি। কি যেন একটা ঝামেলা ছিল ওর। বাদ দাও ওর কথা। তুমি এত তাড়াতাড়ি এলে কি করে?
কেন তাড়াতাড়ি এসে কি আপনাকে ঝামেলায় ফেলে দিলাম?
তোমার পরীক্ষা বলেছিলে, তাই জানতে চাইছি
আরে তাই তো! আমার তো পরীক্ষা ছিল লাস্ট পিরিয়ডের একদম ভুলে গেছি। কি যে সব হচ্ছে আমার সঙ্গে। কেন যেন রাগ অভিমান বাদ দিয়ে ভীষণ মন খারাপ লাগছে। আমি ওর পাশে বসে বললাম
শাওনকে কি আপনি অনেক দিন ধরে চেনেন ?
হ্যাঁ প্রায় তিন বছর
ও কি শুধুই আপনার কলিগ?
আমরা ভালো বন্ধু ও। তুমি হঠাৎ ওকে নিয়ে পড়লে কেন?
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম এমনি। দুপুরে খেয়েছেন কিছু?
না এখনো খাইনি। বাসায় কি কেউ নেই?
না সবাই বাজার করতে গেছে। টেবিলে নোট রেখে গেছে। আপনার খাবার কি এখানে নিয়ে আসবো?
না তুমি ফ্রেশ হয়ে আসো তারপর একসঙ্গে খাই
খাওয়া টেবিলেও আমি বিশেষ কথা বলতে পারলাম না। আমার কেন যেন অসম্ভব মন খারাপ লাগছে। চেষ্টা করেও একটু স্বাভাবিক আচরণ করতে পারছি না । যে আমি সারা জীবন অভিনয় করে এসেছি, নিজের বাবা-মা অতি পরিচিত মানুষজনের সঙ্গে অভিনয় করেছি সারাক্ষণ; সেই আমি এখন কিছুতেই নিজেকে লুকাতে পারছি না। মুকুল বোধ হয় সেটা লক্ষ্য করেই বলল
কি হয়েছে তুলি? মন খারাপ? পরীক্ষা খারাপ হয়েছে? আমার জন্য পড়তে পারেনি তাই না?
আমি একটু অপ্রস্তুত হয়ে বললাম
না না আজকে পরীক্ষা হয়নি।
তাহলে কি হয়েছে? কেউ কিছু বলেছে?
আমি ওর কথার জবাব না দিয়ে বললাম কালকে আপনি অফিসে যাবেন?
হ্যাঁ যাবো। সামনে ছুটি নিচ্ছি তো তাই এখন মিস করা যাবে না।
সামনে কিসের ছুটি ?
ও খাওয়া থামিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল।

আমার হঠাৎই মনে পড়ল, আরে তাইতো, আমাদের তো মালয়েশিয়া যাওয়ার কথা সামনের সপ্তাহে। মনটা আগের চাইতেও বেশি খারাপ হয়ে গেল।

আমি পুরো বিকেলটা ছাদেই থাকলাম। মুকুল সারা দুপুর বিকেল ঘুমিয়ে কাটাল। সন্ধ্যার দিকে উঠে ওষুধ খেয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ল। সত্যিই অনেক ধকল গেছে ওর উপর। কনফারেন্স এর আগেও দিনরাত পরিশ্রম করেছে, তারপর জার্নির ধকল। আমি অনেক রাত করে ছাদ থেকে নামলাম। ঠিক করে রেখেছিলাম একটুও কাঁদবো না কিন্তু কেন যেন ওর ঘুমন্ত মুখটা দেখে ভীষণ কান্না পেল।

ঘরে ঢুকে দেখি ওর ফোন বাজছে। ও একেবারে ঘুমে কাদা হয়ে আছে। আমি কাছে গিয়ে ফোন ধরার আগেই রিং বন্ধ হয়ে গেল। তারপর টুং করে একটা মেসেজ এল। সেই মেসেজের ভাষা দেখে আমার ইচ্ছা হল বার্তা প্রেরণকারী আর গ্রহীতাকে যদি একসাথে দাঁড় করিয়ে ঝাড়ু দিয়ে পিটাতে পারতাম তাহলে আমার মনে শান্তি আসতো। মেসেজ লিখেছে
হ্যভ আ সুইট নাইট বাবু। তার সাথে বেলুনের মতো উড়ে যাওয়া কতগুলো হার্ট সাইন।

চলবে………

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে