ভুল সত্য পর্ব-১৭

0
71

ভুল সত্য

১৭

আমি কি করবো সব ঠিক করে ফেলেছি। মুকুলের সঙ্গে আর থাকবো না। বাবা-মায়ের সঙ্গেও না। বিয়ের আগেই বাবা-মা আমার কথা শোনেনি আর এখন আলাদা হতে চাইলে এসব নিয়ে নানান কথা হবে। সাক্ষ্য প্রমাণ নিয়ে বসা হবে, লোকজনের সামনে জবাবদিহিতা করতে হবে দুজনকেই। কথায় কথা বাড়বে। আমার এসব ভালো লাগে না। আমার খুব ইচ্ছা করছে কাউকে কিছু না জানিয়ে চুপ করে কোথাও চলে যেতে। অনেকটা যেন অদৃশ্য হয়ে যেতে। কিন্তু সেটা তো আর সম্ভব না। মুকুল ফিরে আসবে ওর মুখোমুখি হতে হবে।

আগামীকাল রাতে ওর ফ্লাইট। খুব সম্ভব রাত দশটার ফ্লাইট। সকালের আগেই বাড়িতে পৌঁছে যাবার কথা। নিশ্চয়ই পরশুদিন সকালবেলা এখানে এসে হাজির হবে। যত কিছুই হোক বউকে ম্যানেজ তো করতে হবে। যাক, তবু ভালো দুটো দিন শান্তিতে থাকা যাবে। আমি মাথাব্যথার ট্যাবলেট আনতে রান্নাঘরে গিয়ে দেখি মা বিশাল রান্নার আয়োজন করেছে। বুটের ডাল আর গরুর মাংস সিদ্ধ করা হয়ে গেছে। ফুড প্রসেসর এ বাটার আয়োজন চলছে। নিশ্চয়ই শামি কাবাব হবে। অন্যদিকে চিকেনের লেগ পিস ম্যারিনেট করা হচ্ছে রোস্টের জন্য। ডজন খানেক ডিম সেদ্ধ করা হয়েছে। আমার মা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তার খোসা ছাড়াচ্ছে। অন্য সময় হলে এসব আয়োজন দেখে আমার ভালো লাগতো। বলতে দ্বিধা নিয়ে হয়তো নিজেও হাত লাগাতাম। আজ অসহ্য লাগছে।

আমি মাকে পাশ কাটিয়ে মাইক্রোওয়েভে চা যাওয়ার জন্য পানি চাপালাম। মা একবার আড় চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল
বুঝলি তুলি, একটু কাজ এগিয়ে রাখি।
কাজ এগিয়ে রাখা মানে তো তিন দিন আগে রান্না করা না, মা
না, তিন দিন কেন হতে যাবে?
মা হঠাৎ করে কেমন যেন চুপ করে গেল তারপর আমতা আমতা করে বলল কালকে তো আমার স্কুল। বুঝিস না
আমি আর কিছু বললাম না। শুধু শুধু মায়ের সাথে ঝামেলা করে লাভ নেই। টুকটুকি কে নিয়ে বারান্দার দোলনাতে বসে দোল খেতে লাগলাম। আচ্ছা, আমি চলে গেলে টুকটুকির কি হবে? হোস্টেলে নিশ্চয়ই আমি ওকে সঙ্গে রাখতে পারব না। এই মুহূর্তে বাড়ি ভাড়া করে থাকা তো আমার পক্ষে সম্ভব না। এভাবে হুট করে, এত শর্ট নোটিশে ঢাকা শহরে একটা একা মেয়েকে কেউ বাড়ি ভাড়া দেবে না। টুকটুকির কি হবে তাহলে? বাবা বিড়াল দুচোখে দেখতে পারে । তিথিদের ওখানে অবশ্য রাখা যায় কিন্তু কেন জানিনা আমার ওদের উপর ভীষণ রাগ হচ্ছে। রেহানা আন্টি আর তিথি এরা নিশ্চয়ই শাওনের ব্যাপারটা জানত। না জানার তো কোনো কারণ নেই, তারপরও ওরা কি করে আমার সঙ্গে এই বিয়েটা হতে দিল। একবার চলে গেলে আমি কারো সঙ্গে কোন যোগাযোগ রাখব না।

ও বাড়ি থেকে আসার সময় আমি আমার সমস্ত গয়না নিয়ে এসেছি। বিয়েতে দুপক্ষ মিলিয়ে প্রায় ৩০ ভরির মতন গয়না দিয়েছিলা আমাকে । ওদের দেয়া গয়না গুলো আমি সঙ্গে নেব না। সেগুলো বাদ দিলেও যা থাকে তার বর্তমান বাজার দর অনেক; এছাড়া আমার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট্টেও ভালই টাকা আছে। কাল চেক করেছি। কলেজে ভর্তি হবার সময়ে ব্যাংক একাউন্ট করেছিলাম। প্রতি মাসে পকেট মানি পেতাম এছাড়াও বিভিন্ন আত্মীয়-স্বজনেরা পালা পর্বনে আমার হাতে টাকা দিত। আমার তিন মামা, দুই চাচা প্রায়ই টাকা দিত। বিদেশে থাকা আমার দুই ফুপু মাঝে মাঝে ডলার পাঠায়, সেসব আমি আমার একাউন্টে তুলে রাখতাম। কাল চেক করে দেখেছি প্রায় ৭৫ হাজার টাকা আছে। আপাতত ওতেই আমার চলে যাবে। পাশ করে না হয় একটা চাকরি নিয়ে নেব।
আগে হলে এসব আমার কাছে বেশ রোমাঞ্চকর মনে হতো কিন্তু এখন কেন যেন মন খারাপ লাগছে। প্রতিদিন সন্ধ্যা বেলা আমি আর মুকুল ছাদে বসে চা খাই, ছুটির দিনে রিক্সা করে ঘুরতে যাই। ও আমার একটা হাত ধরে রাখে সবসময়। অস্ট্রেলিয়ায় গেলে কি কি করব তার কত পরিকল্পনা যে করি। এখন মনে হয় সেগুলো সব আসলেই স্বপ্ন ছিল। ও মিথ্যেই আমাকে স্বপ্ন দেখিয়েছে। হয়তো শেষ মুহূর্তে আমাকে না নিয়েই চলে যেত।

আমি রাতের খাবারও খেলাম না, আবারও একটা ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। সকাল বেলা আবারো একই কাহিনী, মনে হচ্ছে কেউ দরজা ভেঙে ফেলছে। আমি দরজা খুলে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলাম। মুকুল আমাকে পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল
তুমি তো আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে। কি হয়েছে বলোতো?
আমি কোনমতে বললাম
আপনার না কাল আসার কথা
হ্যাঁ কথা ছিল কিন্তু আমার ভালো লাগছিল না, তাই একদিন আগেই চলে এসেছি কেন তুমি খুশি হওনি?
আমি জবাব দিলাম না। জামা কাপড় নিয়ে চলে গেলাম। ইচ্ছে করেই দীর্ঘ সময় ধরে গোসল করলাম। বেরিয়ে দেখি মা আর মুকুল বসে চা খাচ্ছে আর গল্প করছে। আমি কাছে এসে বললাম
তুমি আজ স্কুলে যাওনি মা?
নারে, আজ ছুটি নিয়েছি
বুঝলাম মা এসব আগে থেকেই জানতো। শুধু আমার কাছেই লুকিয়েছে।

দুপুরের খাবার পর মুকুল বলল
তুলি চল বাড়ি যাবে
প্রথমে ভেবেছিলাম যাব না, পরে মনে হয়েছে চলে যাওয়াটাই ভালো। ওই বাড়ি থেকে বরং হোস্টেলে ওঠাটা সহজ হবে। এখানে মা নানান ঝামেলা করবে। আমি সব গুছিয়ে ওর সঙ্গে বাড়ি ফিরে গেলাম।

বাড়ি ফিরতেই আমার শাশুড়ি তার অভিযোগের ঝুলি নিয়ে বসে গেল। এই কদিন তার খোঁজ নিইনি, বাপের বাড়ি গেলে আর কিছু মনে থাকে না, আমার মা পোলাও কোরমা খাইয়ে তার ছেলেকে কব্জা করার চেষ্টা করছে ইত্যাদি ইত্যাদি। চাইলে কথাগুলোর জবাব দিতে পারতাম কিন্তু ইচ্ছা করলো না। মুকুলকে দেখলাম বিরক্ত হয়ে উপরে চলে গেল। আমি আরো কিছুক্ষণ তার ভ্যজর ভ্যজর শুনলাম নিঃশব্দে। এক পর্যায়ে উনি বিরক্ত হয়ে বললেন
কি কইতাছি কিছু হু্নছো? নাকি কানের মাথা খাইয়া বইয়া আছো?
আমি কান থেকে হেডফোন খুলে বললাম
জ্বী না কানের মাথা খাইনি। আপনাকে কি চা দেব?
দেও
মিল্ক টি না গ্রিন টি?
গ্রিন টি, মাচা
আমার বিষম খাবার যোগাড়। এই ভদ্রমহিলা বিউটি কনটেস্টে অংশ নেবার তাল করছে নাকি। যাইহোক, তাকে মাচা গ্রিন টি দিয়ে ঘরে ফিরে দেখি মুকুল ঘুমিয়ে পড়েছে। সন্ধ্যা কেবল সাড়ে সাতটা বাজে, এত সকাল সকাল তো কখনো ঘুমায় না। আমি কাছে গিয়ে দেখলাম কেমন এলোমেলো হয়ে শুয়ে আছে। কপালে হাত রেখে বুঝলাম জ্বর বাধিয়েছে। যা বাবা! সব তো ওলটপালট হয়ে গেল; তার মানে কালকে অফিসে যাবে না। আমি ভেবেছিলাম কাল কলেজে যাবার নাম করে বাড়ি থেকে চলে যাব।

আমি ওর মাথার কাছে বসে বললাম
ওষুধ খাবেন?
মুকুল আমার একটা হাত ধরে বলল
আমার কি জ্বর এসেছে তুলি?

তাই তো মনে হচ্ছে , হঠাৎ করে জ্বর বাধালেন কি করে?
সেদিন পানিতে নামাটা উচিত হয়নি।
আচ্ছা উঠে ওষুধ খেয়ে নিন।
মুকুল বাধ্য ছেলের মতন উঠে ওষুধ খেয়ে নিল। তারপর বলল
আমার কাছে একটু বসবে তুলি
ভেবেছিলাম ও ঘুমিয়ে পড়লে ছাদে চলে যাব সেটা আর হলো না; অন্তত আমার কৃতজ্ঞতাবোধ সেটা করতে দিল না। আমার অসুস্থতার সময় ও অনেক করেছে। আমি ওর মাথার কাছে বসে বললাম
ঘুমিয়ে পড়ুন। ঘুমালে ভালো লাগবে

মুকুল আমার একটা হাত ধরে রেখেছে কিছুতেই যেতে পারছি না। ওর ভারি নিঃশ্বাসের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। খুব সম্ভব ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি ওর কপালে হাত রেখে দেখলাম জ্বর নামেনি। ও কেমন গোঙ্গানির মতন একটা শব্দ করছে। আমি আস্তে করে জিজ্ঞেস করলাম
কষ্ট হচ্ছে?
ও অস্ফুটে কি যেন বলল ঠিক বুঝতে পারলাম না। আমি একটু ঝুঁকে জিজ্ঞেস করলাম
কি হয়েছে?
আমাদের নতুন বাড়িতে তুমি গাছ লাগাবে তুলি?
আমি কেমন হোঁচট খেলাম। হঠাৎ করে এই কথা কেন? বোধহয় জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকছে। আমি বললাম
হ্যাঁ লাগাবো
একটা কামিনী গাছ লাগিয়ো কেমন?
কামিনী গাছ কেন?
মায়ের খুব প্রিয় ছিল

আমার মনটাই খারাপ হয়ে গেল। আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললাম আচ্ছা
টুকটুকিকে নিয়ে যাবে না?
নিয়ে যাবে। আপনি আর কাউকে নিতে চান?
আর কাকে?
শাওনকে নিবেন না
মুকুল জবাব দিল না। বদমাইশের হাড্ডি একটা। সময়মতো ঠিক ঘুমিয়ে পড়েছে।

চলবে………

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে